যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে, ঘড়ির ভিতর লুকাইছে
১ম অংশ
২য় অংশ
তয় অংশ
************************************************************
৮.
রুমে ঢুকতে ঢুকতে সাদী চিৎকার করে বলতে থাকে, "হাসনাইন সাহেব, শুধু অনুমানের ভিত্তিতে আপনি আমাকে ফাঁসাতে পারেননা। আপনার হাতে কনক্রিট কোন প্রমাণ নেই। আমি আপনার নামে, আমি মামলা করে ছাড়বো বললাম!"
"বেশী চিন্তিত হবেননা স্যার, প্রমাণ আসছে। " বলতে বলতে হাসনাইন কালামকে দিয়ে ক্লাব ম্যানেজার বিপুলকে ডেকে পাঠায়।
প্রায় উর্ধ্বশ্বাসে ছুটে আসে বিপুল।
একপাশে নজরবন্দী সাদী ভাই, তার মহামূল্যবান ক্লায়েন্ট; অন্যপাশে সাক্ষাৎ আইনের লোক, ডিটেকটিভ হাসনাইন। বিপুল বুঝতে পারেনা এই মুহূর্তে তার কিরকম আচরণ করা উচিত। কিছুটা থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
হাসনাইনই এগিয়ে যায় বিপুলের দিকে, হ্যান্ডশেকের জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে, "স্যরি, বিপুল সাহেব,আপনাকে অনেক রাত পর্যন্ত আটকে রাখলাম। "
"আরে না না, কি বলেন!"ইতস্তত সহকারে বলে বিপুল, "স্যার, শুধু খেয়াল রাখবেন ক্লাবের যাতে বদনাম না হয়।
তবে আমার মনে হয় ..."
বিপুলকে আর বলতে দেয় না হাসনাইন, থামিয়ে দিয়ে বলে,"উঁহু, সেটা বোঝার দায়িত্ব আমার। তবে এরকম সিরিয়াস মার্ডার হয়ে গেলে তো স্পটের বদনাম খানিকটা হবেই। সেটা কতটুকু বাঁচানো যায় তা পুরোপুরি নির্ভর করবে কতটুকু সহায়তা আপনারা ক্লাব কর্তৃপক্ষ আমাদের করছেন, তার ওপর, তাইনা?"
বিপুল চোখ কুঁচকে তাকায়, শেষমেষ এমন নামকরা ডিটেকটিভ হাসনাইনও ঘুষ টুস চেয়ে বসে নাকি?
বিপুলের চোখে বিস্ময় দেখেই হাসনাইন টের পায় সে কি ভাবছে, জিভে কামড় বসিয়ে বলে, "নারে ব্রাদার, উপরি টুপরি চাইছিনা। বলছিলাম, আমরা যা যা জানতে চাইব সেগুলো একদম পরিস্কারভাবে জানাবেন, তথ্য নিয়ে কোন গোপনীয়তা করবেন না, তাহলেই হবে। "
"সেটা তো অবশ্যই, সেটা তো অবশ্যই।
আমাদের একটা সোশ্যাল রেসপন্সিবিলিটি আছেনা?" গদগদ হয়ে বলতে বলতে চোখের পলকে বিপুল সাদীর মুখোভাবও পরীক্ষা করে নেয়। তবে সেখানে যে পরিমাণ বিরক্তি সে আবিস্কার করে, তাতে সে এটুকু নিশ্চিত হয়ে পড়ে যে এই ঝামেলা থেকে মুক্তি পেলে সাদী ভাই একটা কাফফারা আদায় করে ছাড়বেই।
হাসনাইন প্রসঙ্গ পাল্টায়, "আচ্ছা বিপুল সাহেব, আপনাদের ক্লাবভবনের মূল ফটকটা তো অটোমেটিক দরজা, তাইনা?"
"জ্বি, স্যার। "
"কথায় কথায় স্যার বলতে হবেনা। " বিপুলকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করে হাসনাইন, জিজ্ঞেস করে,"আচ্ছা, এখন ওটা কি পাসওয়ার্ড দিয়ে খুলতে হয়?"
"জ্বি, স্যার" বলেই জিভে কামড় দেয় বিপুল, হাসনাইন মুচকি হাসে।
"নিয়মটা একটু বিস্তারিত বলুন তো!"
"সাধারণত কাউন্টারে একজন রিসিপশনিস্ট থাকেন, সন্ধ্যা আটটা পর্যন্ত, কেউ সে চার অংকের পাসওয়ার্ড দিয়ে দরজা খুলে দেয়। রিসিপশনিস্টের কাউন্টারেই মনিটর আছে, মনিটরে সে দেখতে পায় কে কে এসেছে, কে কে যাচ্ছে, বুঝলেন। আর পাসওয়ার্ড ইনপুট করার কী প্যাডও আছে কাউন্টারে। "
"আজ উনি ছিলেননা?" হাসনাইন জিজ্ঞেস করে।
"আজ শনিবার তো, আজ রিসেপশনিস্টের ছুটি।
আমি ছিলাম পাঁচটা পর্যন্ত, মিশুদের সাথে আমিও বের হয়ে গেছি। "
"তার মানে খুন হওয়া আলমগীর খানও পাসওয়ার্ড জানতেন?"
"হ্যাঁ, উনি এক্সক্লুসিভ মেম্বার। "
"ও তাইতো! সাদী সাহেবও তো এক্সক্লুসিভ মেম্বার, আর রায়হান সাধারন মেম্বার, তাইনা?"
"জ্বি, তাই। "
"আচ্ছা, বের হবার সময়েও কি পাসওয়ার্ড দিয়ে দরজা খুলতে হয়?"
"না, বের হবার সময় সামনে এসে দাঁড়ালে উপরের সেন্সরের মাধ্যমে দরজা অটোমেটিক খুলে যায়। "
"আচ্ছা, আচ্ছা।
ধন্যবাদ, আরেকটা প্রশ্ন। এখন যে সবাই ইচ্ছেমতো ঢুকছে, বেরুচ্ছে, সেটা কিভাবে সম্ভব?"
"ওহ, এখন দরজার লক আন-এবল করে রাখা আছে। "
"সেটা কে করেছেন?"
"যে সফটওয়্যার কোম্পানী এটার মেইনটিন্যান্সে আছেন, তারা। "
এটুকু কথা হবার পর হঠাৎ করেই বিপুলকে ইশারা করে বাইরে নিয়ে যায় হাসনাইন, ফিসফিস করে কি কি যেন জিজ্ঞেস করে। তারপর চকিতেই দরজা খুলে ঘরের ভেতরে মুখ দিয়ে সাদীর উদ্দেশ্যে বলে, "সাদী সাহেব, কিছু কাগজপত্র আসছে, একটু অপেক্ষা করুণ।
আপনার প্রমাণ আমি মিলিয়ে দেবো। "
মুখে নিষ্ঠুর হাসি ঝুলিয়েই দরজা বন্ধ করে চলে যায় সে। এতক্ষণ বেশ উত্তেজিত ছিল, এত সামান্য একটা কেইস যে হঠাৎ এমন মোড় নেবে কে জানত! "কিছুক্ষণ রেস্ট নেয়া দরকার" ভাবতে ভাবতে করিডোরে পাতা একটা চেয়ারে প্রায় শুয়ে পড়ে হাসনাইন।
৯.
মিনিট দশেক পরের কথা।
কালাম, রাজু, আর লিয়াকে নিয়ে হাসনাইন ক্লাবভবনের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।
রাজু এতক্ষণে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে যে রায়হান খুনী হতে পারেনা। লিয়া তো রীতিমত উত্তেজিত, হাসনাইনের দিকে সে এমনভাবে তাকিয়ে তাকিয়ে সব ব্যাখ্যা শুনছে যেন মহাপুরুষের অমোঘ বাণী গিলছে। লিয়ার বাবা বয়স্ক মানুষ, তার ওপর নিজের অমন নিরীহ গো-বেচারা ছেলেটার উপর দিয়ে যাওয়া এমন ঝড়। অসম্ভব ক্লান্ত আহমেদ সাহেব তাই গাড়ীতে বসে ঝিমুচ্ছেন, একটু আগে লিয়া তাঁকে বুঝিয়ে এসেছে, গোয়েন্দা হাসনাইন যখন বলেছে, তখন নিশ্চয়ই রায়হান বেঁচে যাবে।
কফি খেতে খেতে হাসনাইন পুরো ব্যাপারটা আবারও ব্যাখ্যা করল সবাইকে।
সাতটা পঁচিশে রায়হান এসএমএস করেছে, পাঁচ মিনিট পর তার ক্লাবে পৌঁছার কথা; অর্থাৎ, ক্লাব থেকে তিন-চারশো মিটার দূরে ছিলো সে। অথচ সাতটা উনত্রিশে ফোন গেছে গুলশান থানায়।
এর অর্থ দাঁড়ায় মাত্র চার মিনিটে রায়হান তিন-চারশো মিটার পথ হেঁটে ক্লাবে গিয়ে, কথা কাটাকাটি করে, খুন করে, থানায় ফোন করেছে, যা কোনভাবেই সম্ভব বলে ভাবা যায়না। এটুকুই ছিল হাসনাইনের লাইন অভ থটের শুরু।
তারপর ঘাঁটাঘাঁটি করে খুব নোশ্চিত প্রমাণ পাওয়া গেলো, দেখা গেলো যে ফোনটি থেকে গুলশান থানায় ফোন করা হয়েছে তার রিসিভারে শধু রায়হান না বরং কারুরই কোন আঙুলের ছাপ নেই।
রায়হান প্রায় সারা ঘরেই রক্তমাখা আঙুলের ছাপ রেখে এসেছে, আঙুলের ছাপ যে মোছার ব্যাপার এটাই হয়ত তার মাথায় আসেনি। সম্ভাব্য সব জায়গাতেই আঙুলের ছাপ ফেলে আসা রায়হান ফোন করে পুলিশের কাছে খুনের ব্যাপারটা স্বীকার করার পরও শুধু শুধু কেন ফোনের রিসিভারে থাকা সব আঙুলের ছাপ মুছতে যাবে? এর চেয়ে বরং অন্য কোন ব্যক্তি, যে কিনা সম্ভাব্য খুনী, তারই ফোন করার পর আঙুলের ছাপ মুছে ফেলার কথা -- এই যুক্তিতে রায়হানকে পুরোপুরি নির্দোষ ধরে নিয়েছে হাসনাইন।
এরপর আবারও আরেকটি প্রমাণ মিললো, দেখা গেলো, যে কী-প্যাড থেকে পাসওয়ার্ড দিয়ে রায়হানকে দরজা খুলে দেয়া হয়েছে তাতেও কারো হাতের ছাপ নেই! তার অর্থ, নিহত আলমগীর খান নয়, বরং অন্য কেউ, যে কিনা সম্ভাব্য খুনী, সেই রায়হানকে পাসওয়ার্ড দিয়ে দরজা খুলে দিয়েছে।
হাসনাইন তার অনুমানকে দাঁড় করায় এভাবে -- আলমগীরকে খুন করার পর খুনী রায়হানের এসএমএস দেখতে পায়। তখন সে রায়হানের নাম ধরে থানায় ফোন করে, রায়হানকে ক্লাব ঘরে ঢোকার জন্য পাসওয়ার্ড দিয়ে নিজে করিডোরের ওপাশে গিয়ে লুকায়।
তারপর সুযোগ বুঝে ক্লাব থেকে বের হয়ে পড়ে।
তারপর যখন দেখা গেলো যে ঘটনাস্থলের মিটিংরূমটিতে সেদিন যারা যারা এসেছিলো তাদের সবারই আঙুলের ছাপ আছে, কিন্তু অভিনেতা সাদী মোস্তাফিজের আঙুলের ছাপ নেই, তখন থেকেই সাদীকে সন্দেহ শুরু করে হাসনাইন।
সবকিছু শুনে ভীষন খুশী লিয়া। আনন্দে তার নাচতে ইচ্ছে করছে। তিন ডিটেকটিভকে বারবার ধন্যবাদ জানিয়ে ছুটে যায় সে তার বাবার গাড়ীর দিকে।
গাড়ীতে ঢুকেই মোবাইল ফোনটা অন করল, আহমেদ সাহেব মেয়ের হাসিমুখ দেখেই বুঝলেন বোকা ছেলেটা এ যাত্রা পার পেয়ে গেছে। তাঁকে আর তাঁর ভায়রা ভাইয়ের ছোট ভাই মন্ত্রী আসলাম মাহমুদের কাছে ফোন করতে হলোনা, বিরাট এক বাঁচোয়া।
এদিকে কিছুক্ষণ পরেই একগাদা কাগজ হাতে নিয়ে ছুটতে ছুটতে হাসনাইনদের দিকেই আসতে দেখা যায় ম্যানেজার বিপুলকে।
"এত কাগজপত্র কিসের?" প্রশ্ন করে রাজু।
"এক্ষুণই দেখতে পাবা, আসো আমার সাথে।
" রহস্য করতে করতে হাসনাইন প্রায় টেনে নিয়ে যায় তার সহযোগীদের, সোজা সাদীকে যে ঘরে আটকে রাখা হয়েছে সেখানে।
কোনরকম ভূমিকা ছাড়াই বলে, "সাদী সাহেব, বিপুল সাহেবের হাতের কাগজগুলো কি, অনুমান করতে পারেন?"
না-সূচক মাথা নাড়ে সাদী। পাত্তা দিতে চায়না।
"এগুলোকে বলে লগ-রেকর্ড। " বলে হাসতে হাসতে হাসনাইন জিজ্ঞেস করে বিপুলকে, "আচ্ছা, একটু আগে তো আমাদেরকে পাসওয়ার্ডের কথা বললেন।
এখন আমাকে বলেন, এই যে পাসওয়ার্ড ঢুকানো হয়, সেটা তো নিশ্চয়ই কোন কম্পিউটারে ঢোকে, এবং সেখানে পাসওয়ার্ড ম্যাচ করে গেট খোলা হয়, ঠিক?"
"জ্বী, আমাদের সার্ভারের মাধ্যমে কন্ট্রোল করা হয়। "
"তার মানে পাসওয়ার্ড কখন ঢোকানো হলো, কোন রুমের কীপ্যাড থেকে ঢোকানো হলো, এসব রেকর্ড তারা সার্ভারে জমা থাকে, রাইট?"
"অবশ্যই স্যার, সেই জমা থাকা তথ্যই এই কাগজগুলোতে প্রিন্ট করে এনেছি" বলে হাতের কাগজগুলোর দিকে ইশারা করে বিপুল।
বিপুলের মুখের কথা শুনে বুকের ধুকপুকানি বেড়ে যেতে থাকে সাদীর।
১০.
পুরো প্রিন্টআউট বোঝার জন্য হাসনাইনদের সামনে লগরেকর্ডের কাগজগুলো মেলে ধরে বিপুল, সেসব নিয়ে হিসেব মেলাতে বসে হাসনাইন আর রাজু।
হাসনাইন একটু উচ্চকন্ঠেই জানায়, সন্ধ্যা ছয়টা বাইশ মিনিট দশ সেকেন্ড, ছয়টা উনত্রিশ মিনিট এক সেকেন্ড, আর সাতটা উনত্রিশ মিনিট চল্লিশ সেকেন্ডের সময় তিনবার পাসওয়ার্ড দিয়ে দরজা খোলা হয়েছে।
এরমাঝে প্রথম পাসওয়ার্ড ইনপুট করা হয়েছে দরজার বাইরের কীপ্যাড থেকে, দ্বিতীয়টি রিসেপশনের কীপ্যাড থেকে, আর শেষটি মিটিংরুম, মানে যেখানে আলমগীর খুন হয়েছেন সেখান থেকে। যার অর্থ এই যে সাতটা উনত্রিশ মিনিট চল্লিশ সেকেন্ডের সময় মিটিংরুম থেকে পাসওয়ার্ড দিয়ে যেবার দরজা খোলা হলো সেবার রায়হান ক্লাবঘরে ঢুকেছ।
ওদিকে গুলশান থানায় ফোন গেছে সাতটা উনত্রিশ মিনিটে, সকেন্ড যোল সেকেন্ড স্থায়ী একটি ফোনকল। সূতরাং গুলশান থানায় ফোন যাবার পরে রায়হান ক্লাবে ঢুকেছে, যার অর্থ হলো খুনের ঘটনা ঘটার সময় রায়হান ক্লাবঘরের বাইরে ছিলো।
"হুমম, লগরেকর্ড থেকে রায়হানকে পুরো নির্দোষ বলে ঘোষনা দেয়া যাচ্ছে।
কালাম, ইন্সপেক্টর রাব্বীকে কানেক্ট করো, ছেলেটিকে ছেড়ে দিতে বলি। " বলতে বলতে হাসনাইন আবারো ডুবে যায় লগ রেকর্ডে।
এদিকে বিপুল আরেকটি কাগজ এগিয়ে দিয়ে বলে, "এমনকি পাসওয়ার্ড ছাড়াও দরজা কখন খুলে আর কখন বন্ধ হয়, সেই লগরেকর্ডও আছে। এই দেখেন। "
হাসনাইন কাগজটি হাতে নেয়, চোখ বুলায় আর সাথে সাথেই বিড়বিড় করে বলে, "সাদী মোস্তাফিজ, কোথায় যাবা বাপধন? কোন লাভ নাই!" যদিও সাদী সেটা শুনতে পায়না।
হাসনাইন সাদীকে জিজ্ঞেস করে, "আবারও জানতে চাচ্ছি, আপনি ঠিক কয়টার সময় ক্লাবঘর থেকে বের হয়েছেন, মনে করার চেষ্টা করুন। "
সাদী বলে "মনে নেই। আর শুনুন আপনার কোন কথার উত্তর দিতে আমি আগ্রহী না। আই টোল্ড ইউ, আই উইল কল মাই লইয়ার, ওকে?"
"কিন্তু এখন এমন সব প্রমাণ দেব যে আপনাকে কথা বলতেই হবে, না চাইলেও দেখবেন এমনি এমনিই কথা বের হয়ে যাচ্ছে মুখ দিয়ে। " হাসনাইনের সারা মুখজুড়ে পিত্তিজ্বালানো ক্রুর হাসি।
পাসওয়ার্ড ইনপুটের লগরেকর্ডটি সাদীর দিকে বাড়িয়ে দেয় সে, বলে, "এই দেখুন, এখানে বাইরের অটোডোরটি ঠিক কয়টার সময় খুলেছে সব রেকর্ড আছে। এই রেকর্ড নিশ্চিত করে বলছে আপনি মিথ্যে বলেছেন। "
"কি সব আজেবাজে কথা বলছেন!" সাদী উত্তেজিত।
হাসনাইন যথাসম্ভব ঠান্ডা রাখে মেজাজ, লগ রেকর্ডের তথ্যগুলো তুলে ধরে বোঝানোর ভঙ্গীতে বলতে থাকে, "দেখুন মশাই, সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার পর গুলশান থানায় ফোন যাবার আগ পর্যন্ত, মানে সাতটা উনত্রিশ মিনিট চল্লিশ সেকেন্ড পর্যন্ত ক্লাবঘরের দরজাটি একবারো ওপেন হয়নি। কারণ, আপনি আর আলমগীর ছাড়া আর কেউ তখন এখানে আসেনি।
ওদিকে গুলশান থানায় ফোন করা হয়েছে সাতটা উনত্রিশে। এখন বলুন, আপনি ছাড়া আর কে গুলশান থানায় ফোন করবে?"
"গুলশান থানার ঘড়ি হয়ত দুমিনিট স্লো। " সাদী বলে।
"হা হা হা, সাদী সাহেব, এসব বাজে বকে কোন লাভ নেই। এখান থেকে কখন গুলশান থানায় ফোন করা হয়েছে সেটা থানার ঘড়ি না, বরং এখানকার সার্ভার রেকর্ড থেকে বলা হচ্ছে।
গুণে গুণে সাতটা আটাশ মিনিট ছাপ্পান্নো সেকেন্ডে ফোন করা হয়েছে, সাতটা ঊনত্রিশ মিনিট তেরো সেকেন্ডে শেষ হয়েছে। এই দেখুন!" জোরের সাথে বলতে বলতে হাসনাইন কাগজটি মেলে ধরে সাদীর সামনে।
হঠাৎ করেই সাদী ছোবল মারার চেষ্টা করে কাগজে, চকিতে সরে গিয়ে হাসনাইন আরো বেশী গা-জ্বালানো হাসি হেসে বলে, "যুগ পাল্টে গেছে মশাই, ডিজিটাল ডেটা ছেঁড়া যায়না!"
সাদী বুঝতে পারেনা কি করা উচিত। সে বুঝতে পারে পার পাবার সুযোগ এখন খুবই কম, কারণ এইসব সার্ভার-টার্ভারের কথা সে ভুলেও চিন্তা করেনি। কিভাবে করবে, সে ভালোমতো জানেইনা এগুলো কিভাবে কাজ করে! "দুনিয়াটা যা জটিল হয়ে গেছে!" ভাবতে বাধ্য হয় সে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই টেবিল থেকে আরেকটি লগরেকর্ড হাতে তুলে নিয়ে হাসতে হাসতে হাসনাইন খুলে ধরে সাদীর সামনে, বলে, "সাদী সাহেব, বুঝলেন, দুনিয়া আসলেই অনেক এগিয়ে গেছে। ডিজিটাল পৃথিবীতে এখন সবকিছুরই একটা না একটা ট্রেস থাকেই। আপনি ট্রেস মুছে গেলেন, মানে, নিজেকে ফাঁসিয়েই গেলেন। " একটু দম নিয়ে লগরেকর্ডের প্রিন্টআউটের দিকে ইশারা করে আবারও বলতে থাকে, "শুধু পাসওয়ার্ড দিয়ে না, এমনকি কখন কখন দরজা ওপেন হয়েছিল সেই রেকর্ডও তোলা আছে সার্ভারে, এই যে দেখুন এখানে। "
বলতে বলতে সাদীর খুব কাছে নিয়ে যায় কাগজটি, মেলে ধরে বলে, "দেখুন, এই লগরেকর্ডটি দেখাচ্ছে যে সাতটা উনত্রিশ মিনিট চল্লিশ সেকেন্ড আর সাতটা ত্রিশ মিনিট পয়ঁত্রিশ সেকেন্ডের সময় দু'বার মূল দরজাটি খোলা হয়েছিল।
এই দু'বার ছাড়া কাছাকাছি সময়ে আর দরজা খুলেনি। "
সাদী কিছু বলেনা, তবে তার পরোয়া না করে হাসনাইন বাকী সবার উদ্দেশ্যেই বলে যায়, "সাতটা উনত্রিশ মিনিট চল্লিশ সেকেন্ডে যদি রায়হান ক্লাবভবনে ঢুকে, তাহলে, সাদী সাহেব, বাকী যে সাতটা ত্রিশ মিনিট পয়ঁত্রিশ সেকেন্ড, তখনই আপনি বের হয়েছেন। কারণ এছাড়া সাড়ে ছয়টার পর আর একবারও দরজা খোলেনি। আর আপনি বলছেন আপনি সাতটা পনেরোর দিকে বের হয়ে গেছেন?"
সাদীর চোখ দেখেই বোঝা যায় যে হাসনাইনের অকাট্য যুক্তি মেনে নেয়া ছাড়া তার উপায় নেই, তাও হাসনাইন বলে যায়, "তার মানে হলো, রায়হান ঢোকার পর আপনার বের হবার কথা। তাহলে অবশ্যই করিডোরে আপনাদের দেখা হবার কথা।
কিন্তু আপনি সেটাও অস্বীকার করছেন। "
"উল্টোও তো হতে পারে" সাদী বলার চেষ্টা করে, "হয়ত আমি বের হবার পরপরই রায়হান আসছে। "
"তাহলে তো ক্লাবের বাইরেই আপনাদের দেখা হবার কথা। আপনিতো এমনকি সেরকম কিছুও অস্বীকার করেছেন। মজার ব্যাপার হলো, রায়হানও বলেছে সে আপনাকে দেখেনি।
" হাসনাইন হাসে।
"ওহহো, আমার মনে পড়েছে, আমি বের হয়ে খুব দ্রুত দৌড়ে গিয়ে গাড়ীতে উঠেছিলাম, কি একটা তাড়া ছিল জানি। " সাদী তার শেষ চেষ্টাটুকু করে।
"সাদী সাহেব", হাসনাইনের মুখে সেই পিত্তিজ্বালানো হাসি, সে আরেকটি লগরেকর্ড যেখানে পাসওয়ার্ড ইনপুটের রেকর্ড আছে সেটা দেখিয়ে বলল, "কি বলতে চান পরিস্কার করে বলুন?"
"মানে বলছি, হয়তো সাতটা ঊনত্রিশ মিনিট চল্লিশ সেকেন্ডে আমি বের হয়েছি, আর সাতটা ত্রিশ মিনিট পঁয়ত্রিশ সেকেন্ডে রায়হান ঢুকেছে। "
"তাই? বের হবার সময় কি পাসওয়ার্ড লাগে?" হাসনাইন জিজ্ঞেস করে।
"না"।
"ঢোকার সময়?"।
"হ্যাঁ.
"আপনি কি জানেন, পাসওয়ার্ড একসেপ্টের মাত্র পয়েন্ট টু সেকেন্ডের মধ্যে ক্লাবঘরের দরজাটি ওপেন হয়?"
"সেরকমই হবে হয়তো"।
"এই দেখুন, এখানে, পাসওয়ার্ড ইনপুট হয়েছে সাতটা উনত্রিশ মিনিট চল্লিশ সেকেন্ডে। সূতরাং সেসময় আপনি বের হননি, বরং রায়হান ঢুকেছে।
"
আবারও বলা শুরু করে হাসনাইন, "যার অর্থ দাঁড়ায়, আপনি বের হয়েছেন সাতটা ত্রিশ মিনিট পঁয়ত্রিশ সেকেন্ডে। মানে, আপনি যে রায়হানের ঢোকার পরে এখান থেকে বের হয়েছেন এটাও প্রমাণিত। "
সাদী নিথর হয়ে পড়ে। হাসনাইন সেটা উপেক্ষা করে বলতে থাকে, "এর মানে হচ্ছে, রায়হান ঢোকার পর এই ক্লাবঘরে শুধু আপনিই ছিলেন। তাই, গুলশান থানায় ফোন এবং রায়হানকে পাসওয়ার্ড দিয়ে ঢোকানো, দুটো কাজই আপনি ছাড়া আর কারো পক্ষে করা সম্ভব না।
পিরিয়ড!"
"কিন্তু রায়হান কি নিজেও বলেনি যে সে আমাকে দেখেনি?" শেষ চেষ্টায় সাদীকে প্রাণপণ শোনায়।
হাসনাইন মিটিমিটি হাসে, বলে, "দরজার ওপাশেই ওয়াশরুমের দরজা, ওটা সবার চোখেই পড়ে। "
সাদী নিরুপায় হাসি হাসে। উঠে দাঁড়ায়, দু'হাত সামনে বাড়িয়ে দিয়ে বলে, "চলুন, আর সময় নষ্ট না করি। হাজতে ভালো করে ঘুম দেয়া যাবে তো?"
মুখের হাসিকে যত বেশী সম্ভব নিষ্ঠুর করে তুলে হাসনাইন বলে, "সেটার নিশ্চয়তা তো স্যার, আমি দিতে পারবোনা।
থানার অফিসারকে জিজ্ঙেস করাই ভালো। "
১১.
তবে দু'জনের সংঘাত এখানেই থেমে যায়নি।
করিডোরে হাঁটতে হাঁটতে সাদী আর হাসনাইন যখন এগিয়ে যায়, তখন হঠাৎ করেই সাদী হাসনাইনকে লক্ষ্য করে বলে, "হাসনাইন মিয়া, এই যে সি আইডি'র চাকুরী করেন, কত বেতন পান? "
"কেন? সেটা জেনে আপনার কি দরকার?"
"আমি তো বুঝিই আপনি সৎ অফিসার। বেতন পান আর কত? সব মিলিয়ে দশ হাজার? নাকি আরো কম?"
হাসনাইন অপমানিত বোধ করে। ইচ্ছে করে লোকটার মুখ প্রচন্ড এক ঘুষি মেরে বুঝিয়ে দিতে বেতন কম-বেশীর জোর কত।
তবে একইসাথে খানিকটা হতাশও বোধ করে সে।
আসলেই তো! এই যে এত মাথা খাটিয়ে সে খুনী খুঁজে বের করে, দেশের মানুষের নিরাপত্তার জন্য খেটে যায়, তার নিজের নিরাপত্তার কি অবস্থা! তার বেতন সাকূল্যে বারো হাজার চারশ। প্লাস বাইকের তেলের খরচ। এ বেতনে তার হাতখরচ চলে যায় কোনভাবে, বড় ভাইয়ের বাসায় থাকে, রাতের খাওয়াটাতো ওখানেই হয়। এটা কোন জীবন!
এবার সাদী কিছুটা নিচু গলাতেই হাসনাইনকে বলে, "আমার ফার্মে কাজ করবেন? আপনার মতো ব্রিলিয়ান্ট লোকই আমার চাই।
কনসালট্যান্টের কাজ, মাসে মাসে দুলাখ, বনানীতে ফ্ল্যাট আর চব্বিশ ঘন্টা গাড়ী। যান দুটো গাড়ী দেয়া হবে, রাজী?"
হাসনাইন ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকায়, তারপরই তার মনে হয় খারাপ কি। এমন জীবন তাকে সিআইডির কোন পদে গেলে দেবে? কোনো পদেই না। কি বলবে ভেবে পায়না গোয়েন্দা হাসনাইন, দু'হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে ওঠে, কাঁধ কুঁকড়ে আসে তার, অসহ্য বোধ করে। বলতে ইচ্ছে করে, "অবশ্যই রাজী।
" কিন্তু ঠিক তখনই সেই ছোটবেলা থেকে লালিত স্বপ্নটা এসে আবারও তাকে শীতের রাতের লেপের মতো চারপাশ থেকে জড়িয়ে ধরে। মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্ত বোধ করতে থাকা হাসনাইন নীরস হাসি হেসে বলতে থাকে, "তাহলে আপনি যখন আবার খুন করবেন তখন আরেক বেচারাকে কে বাঁচাবে, হা হা হা। "
ভয়ংকর কিছু ঘটতে যাচ্ছে জীবনে, এটুকু বোঝার পরও হাসনাইনের উত্তরে হাসতে শুরু করে সাদী। সবকিছু ডুবে গেলে হয়তো সাথে সাথে মানুষের যাবতীয় আশংকা, ভয়ভীতিও ডুবে যায়।
সাদীকে যখন পুলিশ থানায় নিয়ে যায় তখন বাজে ঠিক রাত বারোটা।
রায়হানকে ছেড়ে দেয়া হয়, সে তার বড়চাচা আর মাকে নিয়ে আসে ক্লাবঘরে। হাসনাইনের হাত ধরে কৃতজ্ঞতা জানাতে চায় সে, কিন্তু আবেগে পুরোপুরি বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে, নড়তে পারেনা, শুধু হা করে থেকে চোখের পানি ফেলে অবিরাম। অন্য কোন সময় হলে এটা যথেষ্ট বিরক্তিকর দৃশ্য মনে হতো হাসনাইনের কাছে, কিন্তু এই মুহূর্তে এরকম রায়হানকে দেখতে তার মোটেও খারাপ লাগেনা; বরং মনে হয়, "ধন্য, আমার বারো হাজার টাকার চাকরীই ধন্য। "
লিয়ার মুখ জুড়ে স্বস্তির হাসি, সামনে দাঁড়ানো গোয়েন্দা হাসনাইনকে দেখে এই মুহূর্তে তার মনে হচ্ছে ছোটবেলায় দেখা কার্টুন ছবি সুপারম্যান বা স্পাইডারম্যান টাইপের কোন চরিত্র, যাদের কাজই হলো নিরীহ মানুষকে বিপদ থেকে বাঁচানো।
হঠাৎ লিয়াকে দেখা যায় মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে কার সাথে যেন খুব আহ্লাদের সাথে কথা বলতে বলতে একটু দূরে সরে যেতে।
এর কিছুক্ষণ পরেই "হাসনাইন ভাইয়া", "হাসনাইন ভাইয়া" বলতে বলতে দৌড়ে আসতে থাকে সে, তার মুখে হাসনাইনের নামের উচ্চারণটা এতটাই সহজাত ঠেকে যে মনে হয় তারা অনেকদিন ধরেই একে অন্যকে চেনে। সেই কন্ঠে যে খানিকটা হৃদকম্পন হাসনাইন বোধ করে সেটা বলাই বাহুল্য।
তবে সে কম্পনটুকু পুরোপুরি বুঝে ওঠার আগেই সে দেখতে পায় লিয়া ফোনটা তার দিকে বাড়িয়ে দিচ্ছে, বলছে, "নিন, কথা বলুন। "
কিছু না বুঝেই ফোনে কান পাতে হাসনাইন, ওপাশ থেকে চমৎকার ভারী এক পুরুষকন্ঠ, যে বলছে, "নাইস টু মীট য়্যু, হাসনাইন ভাই। থ্যাংক্যু, থ্যাংক্যু সোও মাচ্।
আপনি কিন্তু অবশ্যই আমাদের বিয়েতে আসবেন, অবশ্যই। "
"জ্বি জ্বি, অবশ্যই" বলে হাসনাইন জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে লিয়ার হাতে ফোন ফেরত দেয়।
লিয়া লাজুকমুখে বলে, "ভাইয়া, ও আমার ফিয়ান্সে, থাকে ফ্রান্সে; দুমাস পরে আমাদের বিয়ে, আপনারা কিন্তু অবশ্যই আসবেন। "
এত জটিল একটা কেইস সমাধানের পরও হঠাৎই যেন অকারণে খুব অবসন্ন আর হতভম্ব বোধ করে হাসনাইন। লিয়ার আবদারে মাথা ঝাঁকানো ছাড়া আর কিছুই করার থাকেনা তার।
*************************************************************
## গল্পটি একটি বিদেশী গল্পের ছায়া অবলম্বনে লেখা
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।