আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ডিটেকটিভ গল্প: সেলিব্রিটি প্রবলেমস ৫

যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে, ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

আগের পর্বগুলো: ১.প্রথমপর্ব ২.দ্বিতীয়পর্ব ৩.তৃতীয়পর্ব ৪.চতুর্থপর্ব ****************************************** অনুষ্ঠান শুরু হবার সাথেসাথেই কাঁচের দেয়ালের ওপাশের রূমে, অর্থাৎ, স্টুডিওতে যেন প্রজাপতি নেচে উঠল। প্রথমে দেখে যে লুৎফাকে সাধারন গম্ভীর ধরনের মেয়ে মনে হচ্ছিল, তাকে দেখা গেল অসম্ভবরকম চঞ্চল হয়ে উঠতে। কি সুন্দর করে চুলের বেনী ঝাঁকিয়ে মাইক্রোফোনের সামনে মুখ রেখে কথা বলছে! আর প্রতি মুহূর্তেই প্রচন্ড সুন্দর এক ভুবনজয়ী হাসি দেখিয়ে যেন পরিবেশটাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। তার পাশেই সারাক্ষণ গম্ভীরমুখে বসে থাকা আখতার এখন রেশমাকে তার রোল কিছু কিছু করে বুঝিয়ে দিচ্ছে, হাসনাইন স্পষ্ট দেখতে পায় যে রেশমা কিছুক্ষণ পরপরই হাসিতে ঢলে পড়ছে। তার ধারনা হয় যে আখতার নিশ্চয়ই খুব মজার কোন ক্যারেক্টার হবে! সময় পেলে আখতারের সাথে অবশ্যই কথা বলতে হবে।

দর্শকদের উদ্দেশ্যে কথা বলা শেষ হলে মাইক্রোফোনে ইউ.এস. টপচার্টের নম্বর ৪ গানটা ছেড়ে দিয়ে নিজের চেয়ার একটু সরিয়ে এনে আখতার আর রেশমার সাথে যোগ দেয় লুৎফা। কি কথা হচ্ছে কিছুই শোনা যাচ্ছেনা, তবে হঠাৎ হঠাৎই তিনজনকে হাসিতে ফেটে পড়তে দেখা যাচ্ছে। রেডিওতে বাজতে থাকা গানটা ঠিক এই মুহূর্তে হাসনাইনরা বসে থাকা রূমে, অর্থাৎ তারুণ্যের অফিস রূমে বি.জি.এম হিসেবে বাজছে। গানের তালে তালে যেন অফিসের সবার, সবার বলতে যদিও এই মুহূর্তে হাসনাইন নিজে, লাবু ভাই, টেকনিকাল হ্যান্ড একজন যার নাম টুটুল আর হামিদ সাহেব আছেন, এদের সবার মাঝেই একটু করে ড্যান্স সংক্রমণ হয়েছে। পাঁচ ছয় মিনিট যেতে না যেতেই হঠাৎ ফোন বেজে ওঠে স্টুডিওতে, লুৎফা চটপট ফোন ধরে।

এটা তারুণ্যের অনুষ্থানে রেশমার কাছে আসা শ্রোতাদের প্রথম ফোন, লুৎফা আর আখতারের গালভরা হাসি। সাধারণত এরকম লাইভ অনুষ্ঠানে যদি কেউ ফোন না করে তাহলে শিল্পী ভীষন ইনসাল্টেড ফিল করেন, যেজন্য রেডিও স্টেশন নিজেরাই কয়েকজনকে ঠিক করে রাখেন ফোন করার জন্য, অনুষ্ঠান শুরু হবার পর প্রথম ১৫ মিনিটে যদি কেউ ফোন না করে তাহলে সেসব ভাড়াকরা শ্রোতারা ফোন করেন। সেকারণে, ১৫ মিনিটের আগে ফোন এলে লুৎফা আর আখতার দুজনেই খুব খুশী হয়, কারণ তাদের অনুষ্ঠান ভাল চলছে এটা তার প্রমাণ। অবশ্য আজকের গেস্টকে নিয়ে দুজনের কারুরই তেমন টেনশন ছিলনা, বরং ভক্তদের ফোনের যন্ত্রণায় অনুষ্ঠান চালাতে পারবে কিনা, রেশমার সাথে যথাযথ পরিমাণ কথা বলতে পারবে কিনা সেটা নিয়েই দুজন বেশী চিন্তিত ছিল। ফোন বেজে ওঠার সাথেসাথেই লুৎফা আর আখতারের মুখ যতটা আলোকিত হলো, ততটাই অন্ধকারাচ্ছন্ন হলো রেশমার মুখ; সেই অন্ধকার দেখেই হাসনাইন ধরতে পারে যে রেশমা ভয় করছে এই ফোনটা সেই লোকটার কিনা এই ভেবে।

প্রচন্ড ভয় নিয়ে খানিকটা আশ্বাসের আশাতেই হয়ত ওপার থেকে হাসনাইনের দিকে চাইল রেশমা, যেন এক বুক ভরা আকুতি, 'আমার পাশে থেকো, আমাকে রক্ষা কোরো। ' হাসনাইনের শরীরে বিদ্যুত খেলে যায়, কিন্তু পরমুহূর্তেই সে খানিকটা শক্ত হয়ে বসে। তবে হাসনাইন বুঝতে পারে তার এই হঠাৎ শক্ত হয়ে যাওয়া দেখেই রেশমা বেশী আশ্বস্ত হয়েছে, অজান্তেই মৃদু হেসে ওঠে সে। রেশমাও হাসে, সেন অদ্ভুত এক যোগাযোগ দুজনের মাঝে। হাসনাইন একধরনের দ্বিধবোধ করে এই মুহূর্তে; তার আজন্ম সাধ ছিল রহস্য সমাধান করা, সেজন্যই সে এত ভাল ভাল চাকরী বাদ দিয়ে ডি.বিতে ঢুকেছে, আজ তার প্রথম কেইস, আর এখন তার ভেতরের আরেকটা মন নেচে উঠেছে? যার কিনা ঘটনার রহস্যের চেয়ে নারীর রহস্যের ব্যাপারেই বেশী আগ্রহ! হাসনাইন কিছুটা হতাশ বোধ করে নিজের ব্যাপারে, কিন্তু একদৃষ্টে রেশমার দিকে তাকিয়ে থাকাটার সাথে সে কোনভাবেই কম্প্রোমাইজ করতে পারেনা।

প্রোগ্রাম শুরু হয়েছে সন্ধ্যা ৭ টা ১৫ তে আর শেষ হবে ১০ টায়, এর মাঝে ৮টা ৩০ থেকে ৮ টা ৪৫ পর্যন্ত ব্রেক, সেসময় রেডিওতে খবর চলবে, অফিসে সবাই মিলে তেহারী খাবে। তাও আবার ফখরুদ্দিনের তেহারী, তারুণ্যের দিনকাল ভাল যাচ্ছে বলতেই হয়। লাবু ভাই নিজে এই প্রোগ্রামটার ডিরেক্টর হলেও তার বিশেষ কোন কাজ নেই, তাই তিনি এসব টুকটাক নিয়েই ব্যাস্ত। আজ টেকনিকাল হ্যান্ড আরেকজন আসেনি, তার নাম ফিরোজ। লাবু ভাই তাই বাজেটের সেই অংশটা হাসনাইনের নামে চালিয়ে দেবেন বলে ভাবছেন।

হামিদ সাহেবকে দেখতে যুবক, খোলামেলা মনের মনে হলেও লাবু ভাইয়ের ধারনা লোকটা হাড়কিপ্টে। হামিদ সাহেব প্রতিটি খরচ মেপে মেপে করেন, একদিন এর মধ্যে জিজ্ঞেস করেছেন লুৎফাকে, পিৎজা হাটের পিৎজা রাতে ঠান্ডা হয়ে গেলে হাফপ্রাইসে দেয় কিনা, হামিদ সাহেব যখন ইতালী ঘুরতে গিয়েছিলেন তখন নাকি হোটেলের পাশে এমন ব্যবস্থা ছিল, রাত এগারোটার পর পুরোনো পিৎজা গরম করে অর্ধেক দামে বিক্রী করা হতো। এই লোকের কাছে হাসনাইন আর তার দুই ঈগলস আইয়ের জন্য রাতের খাবারের আলাদা টাকা বরাদ্দ চেয়ে দুকথা শুনতে তার ভাল লাগছেনা। লাবু ভাইয়ের নিজের পকেটের অবস্থাও শোচনীয়, রেডিও স্টেশনের বেতন বেশীনা। তিনি বুঝতে পারছেননা, শুধু হাসনাইনের জন্য তেহারী আনাবেন নাকি ঈগলস আই দুটোসহ তিনজনের জন্যই! ব্যাপারটা কিভাবে ট্যাকল করবেন ভাবতেই ঘেমে যাচ্ছেন তিনি।

বারবার হাসনাইনের দিকে আড়চোখে ডেখে ভাবছেন কিভাবে কথা পাড়া যায়। হাসনাইন মোটামুটি নিশ্চিত একদম অচেনা কোন লোক কাজটা করছেনা। আর একজন না বরং কয়েকজন মিলেই করছে হয়ত, যদিও সেব্যাপারে নিশ্চিত কিছু বলা যায়না এখনও। তবে হাসনাইন বুঝতে পারেনা এই অফিসের কাউকে সন্দেহ করা ঠিক হবে কিনা! কারণ, এদের কারুর সাথেই রেশমার তেমন কোন মেলামেশা নেই, এককথায় এরা স্ট্রেঞ্জার্সই। কিন্তু তাও কথা বলে জেনে রাখা দরকার, অন্তত লাবু ভাই আর হামিদ সাহেবের সাথে।

কিন্তু কি জিজ্ঞেস করবে সেটা নিয়েও সে একটু দ্বিধান্বিত, একটা হতে পারে রেশমা সম্পর্কে তারা কতটুকু জানে সেটা জিজ্ঞেস করা। কোন ক্লু বের হয়ে আসতে পারে। হাসনাইন লাবু ভাইয়ের সাথে কথা জমাবার চেষ্টা করে, 'প্রতি শুক্রবার এত লম্বা একটা প্রোগ্রাম লাইভ চালু করেন! আপনার সাহস আছে, লাবু সাহেব। ' 'তা কিছুটা তো আছেই। তবে আমি এ লাইনে প্রফেশনাল তো! এর আগে বাংলাদেশ বেতারে কাজ করতাম, পেমেন্ট ভাল ছিলনা।

এখনও যে খুব ভাল তা না, তবে চলে যায় আরকি। বউ-ছেলে-মেয়ে নিয়ে। ' লাবু একনাগাড়ে বলে যায়, 'হামিদ সাহেবকে আমি কত বলি যে এ্যাডের সংখ্যা বাড়ান, আমাদের রেডিও স্টেশন এখন ভীষন জনপ্রিয়, কাজেই এ্যাডের রেটও বাড়াতে পারেন। বস্ তো আমার কথা শুনেইনা!! ওদিকে কমবেতনের ঝক্কিটা তো আমাদের উপর দিয়ে। ' 'হুমম' হাসনাইন কিবলবে ভাবতে থাকে, একটু থেমে থেমে বলে যায়, 'আপনাদের কাজটা ইন্টারেস্টিং আর ক্রিয়েটিভ।

আপনি তো আপনার প্রোগ্রামের সিডি বের করতে পারেন। তাহলে কিছুটা চলবে, আপনারও আয় হবে। ' 'কপিরাইট!!' দীর্ঘশ্বাসের সাথেসাথে লাবু ভাই বলে যান,'কপিরাইটই তো মেরে দিল। তারুণ্যের সবপ্রোগ্রামের কপিরাইট কোম্পানীর। ' 'তাই নাকি?' খানিকটা মেকি আশ্চর্যবোধ প্রদর্শন করে হাসনাইন।

কপিরাইট আইন সম্পর্কে সে বিশেষ জানেনা, জানতে হবে। টুক করে পকেট ডায়রীটা খুলে নিয়ে 'টু বি লার্নড' লিস্টের পেজে 'কপিরাইট ল'জ' শব্দটা লিখে নেয়। তারপর লাবু ভাইকে বলে,' আচ্ছা আমি দেখব আপনার জন্য কিছু করা যায় কিনা, আই মিন ইফ আই গেট এনি আইডিয়া। ' লাবু ভাই সতম্ভিত চোখে তাকায়, মনে মনে ভাবে, 'বলে কি এই পাগল! পুলিশরা এরকম জায়গায় জায়গায় পরোপকার করে বেড়ায় নাকি!!' হাসনাইন কথা চালিয়ে যায়, 'রেশমার প্রোগ্রাম যেহেতু আজ নিশ্চয়ই অনেক বেশী শ্রোতা শুনবে?' 'হ্যাঁ, সেটা সন্দেহের ঊর্ধে। দেখছেননা? কিভাবে ফোন আসছে! আজ আখতারও বিরক্ত কাজের চাপে।

রেশমা আসলেই ভাল পারফর্মার। ' লাবু ভাইয়ের সুখী সুখী গলা। আজ শ্রোতার পার্সেন্টেজ ৩০% অতিক্রম করবেই, এটা তার বিশাল আনন্দের বইষয়। কারণ, ৩০% ক্রস করা বিকেলের অনুষ্ঠান তারুণ্যের রেডিওতে এবারই প্রথম হতে যাচ্ছে। 'হুমম, উনার গানের গলা আসলেই ভাল।

' হাসনাইন কথা চালিয়ে যায়, 'আপনার অফিস থেকে তো রেশমা গলা সাধলে শোনার কথা, রাস্তার ওপাশেই নাকি তার এ্যাপর্টমেন্ট?' 'কি??' লাবু ভাই উত্তেজিতভাবে বলেন, 'কবে থেকে?? আমি তো জানতাম রেশমা থাকে বারিধারা! বনানীতে শিফটই বা করল কবে?' হাসনাইন কাঁচুমাচু চেহারায় মৃদু হেসে বলল, 'তাই নাকি? তাহলে আমার ভুল হয়েছে, একটু আগে উনাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম কোথায় থাকেন, উনি রাস্তার দিকে হাত দেখিয়ে বললেন 'ঐ তো ওখানে', আমি ভাবলাম রাস্তার ঐপাড়ের এ্যাপার্টমেন্টটাই কিনা। ' 'আরে! মেয়েরা অমনেই বলে। ' লাবু ভাই এখন লেকচার মোডে চলে গেলেন, 'আপনে সচ্চরিত্র ডি.বি হোন আর আমি লুইচ্চা মাতাল লাবু হই, মেয়েদের কাছে আমরা সবাই পুরুষ। আপনারে নিজের ঠিকানা ফোন নাম্বার দেওয়ার আগে গাঁইগুঁই করবই। ' লাবু ভাই একটু থেমে এবার চোরা হাসি হেসে হাসনাইন কে জিজ্ঞেস করলেন, 'লাগব নাকি, স্যার? গায়িকা-নায়িকাগো ফোন নাম্বার? লাগলে বইলেন' 'আরে নাহ্' হাসনাইন কথা কাটাবার চেষ্টা করে।

অনুষ্ঠান চলতে থাকে, লাবু ভাই সিগারেট ধরিয়ে জানালার কাছে চলে যান, লাবু ভাই সম্পর্কে হাসনাইন তার ধারনা সাম-আপ করতে থাকে। এককথায়ই লাবু ভাইকে সন্দেহ তালিকা থেকে বাদ দেয়া যায়, নাইলে এমন চমকাতনা রেশমার ভুল ঠিকানা শোনার পর। হাসনাইন ইচ্ছে করেই রেশমার ভুল ঠিকনা বলে দেখতে চেয়েছে লাবু ভাইর রিয়্যাকশন কি? লাবু ভাইর সৎ রিয়্যাকশনের জেনারেল অর্থ হলো, সে কিছু ঢাকার চেষ্টা করছেনা; তবে এমনও হতে পারে লাবু ভাই খুব ঠান্ডা মাথায় ব্যাপারটা ট্যাকল দিচ্ছে। আফটার অল তার হাতে অনেক নায়িকা আর গায়িকার নাম্বার আছে, তিনি এরকমটা করতেই পারেন। কাউকে দিয়ে করাতেও পারেন।

কিন্তু যেই করে থাকুক, সে কেন করছে? এই প্রশ্নটাই হাসনাইনকে কুরে কুরে খাচ্ছে। কেন ডিস্টার্ব করছে? ক্রেজী ভক্ত হলে একটা কথা ছিল, কিন্তু হাসনাইন কোনভাবেই মানতে পারছেনা এই ঘটনাগুলো কোন ক্রেজী ভক্তের। যদিও এখন পর্যন্ত সে এই ঘটনার ব্যাপারে তেমন কোন ক্লু পাচ্ছেনা, তবুও তার ধারনা এটা পরিকল্পিত ব্যাপার। আর তার এই ধারনা ঠিক হলে এরসাথে জড়িত অন্তত একজনকে সে মার্ক করতে পেরেছে। ************************************** সুপ্রিয় পাঠক, আপনি কি পেরেছেন?


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.