যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে, ঘড়ির ভিতর লুকাইছে
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময়টা দেখে নেয় হাসনাইন, আর মাত্র ২০ মিনিটের মতো আছে, প্রশ্নগুলো খুব দ্রুত সেরে ফেলতে হবে।
নোটবুকটা হাতে নিয়ে কয়েক সেকেন্ড চোখ বুলায় হাসনাইন, তারপর মুখ তুলে রেশমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
'এবার আমি কিছু প্রশ্ন করতে চাই, আপনার যদি আপত্তি না থাকে। '
'নো প্রবলেম এ্যাট অল, গো এ্যাহেড। ' রেশমা সাহস দেয়ার ভঙ্গিতে বলে।
হাসনাইন তার প্রশ্ন শুরু করে, 'লোকটার ফোনকলে কি কখনই কোন নাম্বার ডিসপ্লে হয়নি? বিটিটিবি বা মোবাইল, যেকোন কিছুর'
'নাহ্ ,একবারও না।
মানুষ তো মাঝেমাঝে ভুল করে, কিন্তু লোকটার ফোনকলে সবসময়েই 'আননোওন' আসে', হড়বড় করে রেশমা বলে যায়।
'সবসময়েই কি তার গলার স্বর একই রকম শোনায়? নাকি কখনও পরিষ্কার, কখনও অস্পষ্ট শোনায়? আই মিন, আপনি জানেন, ল্যান্ডফোন আর মোবাইল থেকে ফোন করলে একই রকম শোনাবেনা। '
'হুমম', রেশমা খানিকটা চিন্তিত মুখেই বলে, 'আমি ব্যাপারটা নিয়ে ভাবিনি। তবে এখন হোয়েন আই লূক ব্যাক, সিমস ইট ওয়াজ মোর অর লেস দ্য সেইম অলথ্রুআউট। '
'তাই?' কিছুটা হতাশ গলায় বলে হাসনাইন।
ছোটবেলা থেকে পড়া ডিটেকটিভ গল্পগুলোতে সাধারণত অপরাধীরা মুখে রুমাল রেখে স্বর নকল করে নানান জায়গা থেকে ফোন করত, কিন্তু এখানে তো কোনটাই খাটছেনা।
হাসনাইন কিছুটা যারপরনাই হয়েই জিজ্ঞেস করে, 'গলার স্বরও কি সবসময় একই মনে হয়েছে?'
রেশমা কিছুটা থিতু হয়, তারপর বলে, 'দেখুন অনেকেই তো স্প্যামকল করে, আমি তো সবার স্বর মনেও রাখিনা। অনেক ভক্তও ফোন করেন। কিন্তু যখন থেকে লোকটাকে আমি মার্ক করা শুরু করেছি তখন থেকেই সে একই ভেয়েসে কথা বলছে। '
'কবে থেকে মার্ক করা শুরু করেছেন?' হাসনাইনের তরিৎ প্রশ্ন।
'ঐ যে, যেদিন প্রথম চিঠিটা এলো। ফোন করার আটদিন পর গুনে গুনে' রেশমাও চটপট জবাব দেয়।
'কেন? আপনারা কি ভক্তদের চিঠি পাননা? নাকি মোবাইল ফোন এসে চিঠির প্যাড বিক্রেতাদের ব্যাবসা বন্ধ করে দিয়েছে' হাসনাইন এখন অনুসন্ধিৎসু।
'হুমম, নাহ ভক্তরা চিঠি দেয়ইনা বলতে গেলে। আমি যে মডেল হাউসটায় জড়িত ছিলাম সেখানে আগে কয়েকটা চিঠি এসেছিল, কিন্তু সাধারণ দর্শকরা তো আমার ঠিকানা জানেননা।
' রেশমা বলতে থাকে, 'এজন্যই চিঠিটা পেয়ে একটু আশ্চর্য হয়েছিলাম। আর চিঠিটাও ছিল একটু উইয়্যার্ড! আপনি ভাবুন, কারও লেখা প্রথম চিঠির প্রথম লাইনটাই যদি হয় 'তোমাকে আমি চিনি আজ সাত দিন এগারো ঘন্টা ১৯ মিনিট। ' তাহলে কেমন লাগবে? গা ছমছম করবেনা?'
হাসনাইন সুর মেলায় রেশমার সাথে, 'সেজন্যই কি চিঠিটা রেখে দিয়েছিলেন?'
'অনেকটা তাই, ভেবেছিলাম যদি ঝামেলা করেই তাহলে পরে পুলিশকে দেয়া যাবে। ' রেশমা ভ্রূ কুঁচকে জবাব দেয়।
'দু'মাস লাগল আপনার আমাদের কাছে অভিযোগ করতে? আরও আগে করতেন, এত ঝামেলা হতোনা!' হাসনাইনের গলার স্বর যেনো গলে গলে পড়ে, 'আপনারা সেলিব্রিটিরা অনেক বিজি থাকেন, না? আমার ধারনা ছিল আপনারা অন্যগ্রহের মানুষ, আপনাদের লাইফে শুধু সুখ আর আনন্দ! কিন্তু এখন বুঝছি, আপনারা আমাদের মতোই, কাজর জালায় আর কোনদিকে তাকানোর সময় হয়না।
'
'সেটা ছাড়াও আরও কারণ আছে' রেশমা বলে যায় গম্ভীরমুখে, 'এমনও হতে পারত যে কোন মিউজিক বা নাটক ডিরেক্টর বা সিনে সাংবাদিক আমার সাথে ফাজলামো করছেন, যাস্ট ইউ নোও, হোয়াইট অফেন্স। ' বলে রেশমা মুচকি হাসে।
'আরেকটু ডিটেইলস বলবেন? আমি আপনার কথাটা পুরো ধরতে পারছিনা। ' হাসনাইন কৌতুহলী হয়ে উঠে।
'আর বইলেননা' রেশমার গলার স্বর সাধারণ গল্পবাজ নারীদেরর মতো শোনায়,'আজকালকার এসব দ্বায়িত্বশীল লোকদের পার্সোনালিটির অনেক অভাব, আমাদের অনেক ডিপ্লোম্যাটিকালি চলতে হয়।
যেমন ধরুন, আমি ধরতে পেরেছি সাপ্তাহিক আনন্দম্যাগ এর সাংবাদিক ঝির আমাকে উড়ো এস.এম.এস পাঠায়, বা মিউজিকম্যানিয়ার প্রোডাকশন ম্যানেজার রফিক ভাই আমাকে হিডেন নাম্বার থেকে মিসকল দেন। তো আমি প্রথমে ভেবেছি সেরকম কেউ, যাস্ট একটু বেশী সিরিয়াস হয়ে গেছে, হি হি হি। '
'হোয়াটএভার, এরকম রিস্ক নেয়া তো ঠিকনা। যতই দ্বায়িত্বশীল কাজই করুননা কেন, তারা তো এভাবে মেয়েদের উত্তক্ত করতে পারেননা। আপনার শুরুতেই জানানো উচিত ছিল।
' হাসনাইন কিছুটা জোরের সাথেই বলে।
'মোটেওনা!' রেশমার গলা বেশ চড়ে যায়, 'আপনি জানেননা। এসব নিয়ে বেশী মাতামাতি করলে কি হয়। দেখা যাবে পুরো প্রোডাকশন হাউসই আমার বিরুদ্ধে চলে গেছে। এসব উত্তক্ত করাকে তারা "সামান্য" মনে করে।
সেজন্যই শুরুতে ঘাঁটাইনি। '
'ও.কে । আপনি প্রথমে কার চিঠি বলে ভেবেছিলেন?' হাসনাইন প্রশ্ন করে যায়।
রেশমা মুচকি হেসে মাথা নিচু করে।
হাসনাইন কিছু বুঝে উঠতে পারেনা, বিহবল হয়ে বলে, 'দেখুন আপনি আমাদের যত বেশী তথ্য দেবেন আমাদের ততবেশী সুবিধা হবে সমস্যা সমাধানে।
'
রেশমা লাজুক স্বরে মাথানিচু ভঙ্গিতে বলে যায়, 'প্রথমে যার কথা ভেবেছিলাম তিনি না, এটা আমি নিশ্চিত। তাই এব্যাপারে কিছু বলতে চাইছিনা। '
'তাও বলুন', হাসনাইন নিজের মধ্যে একটা অপ্রতিরোধ্য কৌতুহল বোধ করে।
'তানিমের বন্ধু রিকি। ' রেশমা যেন অনিচ্ছাসত্তেও বলে যাচ্ছে, 'রিকির সাথে দেখা হয়েছিল তানিমের বার্থডে পার্টিতে।
প্রথমে ভেবেছিলাম ও হয়ত শয়তানি করেছে, পরে বুঝলাম না রিকি না। কারণ ওর সাথে এরপরেও দু'বার লাঞ্চ করলাম, ও বাইরে চলে যাবার আগেরদিন বাসায় এসেছিল। ও পুরো স্বাভাবিক ছেলে। '
'রিকি কি এখন আপনাকে ফোন করে?' প্রশ্নটা করেই হাসনাইন নিজেও চমকালো প্রশ্নটা সে কেন করেছে এই ভেবে।
'সেটা কি এই সমস্যার সাথে খুব রিলেইটেড? আপনাকে তো আমি বললামই হি'জ টোট্যালি আউট অফ এ্যানি ডাউট!' রেশমার গলা বেশ চড়ে যায়, 'আমার রেকর্ডিং শুরু হবে, সময় হয়ে গেছে।
আমি উঠি!'
হাসনাইন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। এই মুহূর্তে তার নিজের মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে। কি সুন্দর একটা কনভারসেশন হচ্ছিল, রেশমা কি চমৎকার হিউমার শো করছিল, হাসনাইন মনে মনে ভাবছিল কাল অফিসে গিয়ে সবাইকে এই কনভারসেশনের কথা শোনাবে। অথচ, এখন যদি এমন হয় রেশমা শাহাদাৎ স্যারকে ফোন করে বলে, 'আপনার কি একটা বেকুব টাইপের লোককে দায়িত্ব দিয়েছেন!', তাহলে? তাহলে তো হাসনাইনের প্রেস্টিজ পুরাই যাবে।
সি.ই.ও'র রুম থেকে বেরোতেই দেখে দরজার মুখোমুখি চেয়ারে এক যুবক বয়েসি ছোকরা তীর্থের কাকের মতো বসে আছে।
পোশাকে আশাকে বেশ ফিটফাট হলেও ছোকরার চাহনি দেখে মনে হচ্ছে রেশমাকে একনজর দেখার জন্য সে চেয়ারের সাথে নিজেকে সেঁটে দিয়েছে। হাসনাইনকে আরও আশ্চর্য করে দিয়ে রেশমা প্রায় নেচে উঠে ছেলেটার দিকে গিয়ে আহলাদে গদগদ কন্ঠে বলল,
'আরে! হামিদ ভাই! আপনি আগে বলবেননা আপনি আজ আসবেন, আমাকে তো লূৎফা বলল আপনি আসবেননা। '
'আর বোলনা!' হামিদভাই হতাশভাবে মাথা নাড়েন, 'খুব ব্যাস্ত ছিলাম, তো হঠাৎ করেই আজ সন্ধ্যার চ্যানেল এবিসিডি'র সাথের মিটিংটা ক্যান্সেল হয়ে গেল; আমিও লাকি ফীল করলাম, আফটার অল দ্য গ্রেইট রেশমার সাথে দেখা হবে। ' হামিদ মুখভর্তি এখন গদগদে হাসি।
'তাই!!' রেশমা যেন আহলাদে ভেঙে পড়ে, 'আমি তো অনার্ড ফীল করছি।
'
সি.ই.ও হামিদ সাহেবকে দেখে হাসনাইন আরেকদফা ভ্যাবাচ্যাকা খেল। 'এই সেই রুচিবান লোক!' হাসনাইনের মাথায় ছিল লোকটা কমসেকম ৫০ বছরের এক প্রৌঢ় যুবক হবে যে কিনা রংচঙা শার্ট পরে ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করে। অথছ এই ছেলেটাকে দেখলে ৩০ ও মনে হবেনা! আর হামিদ ভাইয়ের প্রতি রেশমার গদগদে ভাব দেখে কিছুটা শকও যে খায়নি সেটা বলাও ঠিক হবেনা।
এই মুহূর্তে তার মনে হলো তার এখান থেকে চলে যাওয়াই ভাল। খুব সংক্ষেপে হামিদ সাহেবের সাথে পরিচয় পর্ব সারল, তার অফিসে ডি.বি'র লোক এসেছে অথচ লোকটা বেশ নির্বিকারভাবেই হাসনাইনের সাথে পরিচয় পর্ব সেরেই যেন আবার রেশমাতে ডুবে গেল।
মেজাজ আরো খারাপ হবার আগেই হাসনাইন রুমের সবাইকে উদ্দেশ্য করেই যেন বলল, 'আমি একটু সিগারেট খাবার জন্য বাইরে যাচ্ছি'।
বেরোতে বেরোতে হাসনাইন শুনল হামিদ সাহেব রেশমাকে বলছে, 'রেশমা, তোমার সময় থাকলে আসো আমার রুমে, একসাথে কফি খেয়ে গল্প করি। '
হাসনাইন মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বের হয়ে গেল।
(চলবে)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।