যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে, ঘড়ির ভিতর লুকাইছে
তারুণ্যের অফিস থেকে বের হয়েই হাসনাইন খেয়াল করল বামে একটা দরজার উপর সাইনবোর্ড, তাতে দুই লাইনে লেখা 'গেস্ট রুম, তারুণ্য'।
একটু অবাক হয় হাসনাইন, এদের তাহলে আলাদা আরও রুম আছে!
ভাবতে ভাবতে দরজা খোলার চেষ্টা করে হাসনাইন, কিন্তু তখনই তার চোখে পড়ে যায় দরজার উপর ছোট করে লেখা 'অনলি ফর সেলিব্রিটিজ'।
একটু আহত হয় সে, ডানে এগিয়ে গিয়ে করিডোরের মাথায় বাঁয়ে টার্ণ করলেই যে লিফট, সেখানে চলে যায়, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আশপাশটা দেখে। লিফটের দিকে মুখ করে ডানে কিছুদূর গেলে একটা সিঁড়ি। এই সিঁড়ি বেয়ে নিচে নমে গেলে একতলার লবিটা।
লিফটের অপজিটে একটা ওয়েইটিং রুম টাইপের জায়গা আছে, যেটা ভুঁইয়া টাওয়ারের মাঝখানের অংশটা দখল করে আছে। ওয়েইটিং রুমে বেশ কয়েকটা ওয়ান সিটেড লেদার সোফা পাতা, একপাশে টিভিবোর্ডের উপর টিভি চলছেই। একজন লোক, সম্ভবত এই ফ্লোরের মেইনটেনান্সের কাজে নিয়োজিত , বসে বসে ঝিমুচ্ছে আর টি.ভি দেখছে। ওয়েইটিং রুমের অন্যপাশে যে অফিসগুলো আছে সেগুলোও আজ বন্ধ।
এরকম পরিবেশে হাসনাইনের ইনস্টিংক্ট কাজ করতে শুরু করে সাধারণত, তার মনে পড়ল এমন জনশূন্য, নিরিবিলি পরিবেশ একজন ক্রিমিনালের জন্য আদর্শ যদি সে আক্রমণ করতে চায়।
জনমানবপূর্ণ জায়গা পছন্দ হলো চোর-পকেটমারদের।
লিফটের সামনে রাখা এ্যাশট্রেতে ছাই ফেলতে ফেলতে হাসনাইন ফোন করে কালামকে। কালাম তার দুই ঈগলস আই'র একজন। কালামকে ছয় তলায় 'তারুণ্যে'র অফিসে চলে আসতে বলে, আরেক ঈগলস আই রাজুকে যেন কালাম মেইন এন্ট্রির অপজিটে রাস্তার অন্যপাশে দাঁড়াতে বলে, সেকথা জানিয়ে দিল হাসনাইন।
সিগারেট শেষ হতে না হতেই কালাম উপস্থিত।
কালাম আসার পরপরই হাসনাইন তাকে নিয়ে গেল লিফট থেকে বেরিয়ে ডানে দু-তিন মিটার গেলেই যে বারান্দাটা পড়ে সেখানে। বারান্দাটার কাঁচের দরজা দিয়ে লিফটের সামনের করিডোরটা দেখা যায় বলেই কালামকে এখানে আসতে বলেছে হাসনাইন। আর বারান্দাটা থেকে নিচে ভুঁইয়া টাওয়ারের সামনের অংশটা দেখা যায়, কাজেই টাওয়ারের সামনে কেউ থাকলে তাকেও দেখতে পারবে কালাম। আর নিচে তো রাজু আছেই!
হাসনাইন কিছুটা রিলাক্সড বোধ করল, তার মনের খুব বিশাল একটা অংশই বলছে আজ কিছু হবেনা, তবুও শাহাদাত স্যারের কেইস বলে কথা। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সর্বোচ্চ সতর্কতা।
'অঘটন হঠাৎ ঘটেনা, সবসময়েই ঘটার সুযোগ থাকে, তবে অসতর্ক সময়েই ঘটার সুযোগ পায়' শাহাদাত স্যার এই কথা বলতে বলতে কান ঝালাপালা করে ফেলেন। তাঁর ডিউটিতে এসে সেই জায়গায় সমস্যা রাখা চলবেনা।
মনে মনে হাসনাইন নিজের কর্মপরিকল্পনা ঠিক করে নেয়, বাকীটা সময় সে স্টুডিওর বাইরের ঘরটাতে বসে কাটাবে। নজর রাখবে রেডিওর বাকী সবার উপর, কারো আচার আচরণে কোন সন্দেহ করা যায় কিনা সেটা সে যতটুকু সম্ভব কাউকে বুঝতে না দিয়ে বাজিয়ে দেখবে। আর কালাম-রাজুর সাথে এস.এম.এস তো আছেই!
তারুণ্যের অফিসে ঢুকে তো হাসনাইনের চক্ষু চড়কগাছ! বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় মডেল রওনক এসেছে, সাথে আরেক মডেল টাইপের ছেলে।
হাসনাইনকে দেখে লাবু ভাই পরিচয় করিয়ে দেয় দুজনকে, একজনকে তো হাসনাইন আগের থেকেই চেনে, রওনককে চেনেনা এমন শুধু মেয়েনা ছেলেও বাংলাদেশে নেই এখন। রওনকের সাথে আসা আরেকজনই হলো তানিম। হাসনাইন আপাদমস্তক চেক করে নেয় তানিমকে। লম্বায় পাঁচ ফিট এগারো তো হবেই, বেশ ভাল স্বাস্থ্য। ঘন কোঁকড়ানো চুল আর তীক্ষ্ণ চোয়ালে ছেলেটিকে ঠিক ভুমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের বলে মনে হয়।
সত্যি বলতে এই ছেলেটি রওনকের চেয়ে অনেক হ্যান্ডসাম। হয়ত কয়েক বছরের মধ্যেই অনেক উপরে উঠে যাবে।
হাসনাইন ছেলেটিকে কিছু জিজ্ঞেস করবে ভাবতেই আবার মনে করল, 'ডিবি'র লোক কিছু জিজ্ঞেস করলে যদি জেরা ভেবে বসে!'। আর কিছু জিজ্ঞেস করা হলোনা।
বরং লাবু ভাইকে জিজ্ঞেস করল, 'মিঃ লাবু, আপনাদের সি.ই.ওকে খানিক আগে দেখেছিলাম, উনি কি আছেন?'
'হ্যাঁ, স্যার আছেনতো।
উনার রুমেই। আর হাসনাইন সাহেব, আপনি আমাকে মিঃ সাখাওয়াত বলতে পারেন। মিঃ লাবুটা কেমন যেন ইয়ে শোনায়। ' লাবু ভাই হড়হড় করে বলতেই সারা ঘরে 'হা হা হা' করে হাসির রোল পড়ল।
দুই মডেল অনেকটা কার্টুনের চরিত্রের মতো উপর নিচে মাথা ঝাঁকিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসতে লাগল।
হাসনাইনের কিছুটা অপ্রস্তুত চেহারা দেখে তানিম বলল, 'তারচেয়ে লাবু ভাই বলেই ডাকা শুরু করুননা। হা হা হা'
'হুমম, আমি তাতেও খুশী' লাবু ভাইও হাশিতে যোগ দিলেন।
নিরূপায় হাসনাইনও মুখে শুকনো হাসি ঝুলিয়ে রাখে।
এরমধ্যেই অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যাবে যাবে ভাব। আজকের অনুষ্ঠানে ইউ.এস আর ইউ.কে তে কি ধরনের গানের ট্রেন্ড চলছে তার ওপর আলোচনা হবে এবং তারসাথে সেখানে রিসেন্টলি পপুলার হওয়া ৮-১০টি গান শোনানো হবে।
সাথে সাথে চলবে রেশমার কনভারসেশন, দর্শকদের ফোনের জবাব, রেশমার ৩ থেকে ৫টা গান আর সবশেষে স্টুডিওতে রেশমার 'উইদাউট ইন্সট্রুমেন্ট পারফর্ম্যান্স', যেটা এ অনুষ্ঠানের মূল আকর্ষণ।
হাসনাইন দেখল পিয়া দ্রুত বের হয়ে আসছে, তার গায়ে রেশমার অফহোয়াইট পাতলা কার্ডিগানটা চাপানো। একটু আগে যে রশমা সুন্দরভাবে পিয়ার গায়ে কার্ডিগানটা পরিয়ে দিয়েছিল সেটাও হাসনাইনের চোখ এড়ায়নি।
পিয়া বর হয়ে আসতে আসতে তানিমকে বলল, 'আপুটা যে কিনা! বলে এ.সি.তে বসে থাকতে থাকতে নাকি আমার ঠান্ডা লেগে যাবে। চলো, আমি তোমাদের নামিয়ে দিয়েই আবার চলে আসব।
'
'কেন, তুমি থাকবেনা পার্টিতে? তাহলে কেমনে হবে?' এই প্রথম কথা বলল রওনক। খুব বেশী অপ্রতিভ স্বর।
'নাহ, আপুকে নিতে আসতে হবে। তুমি তো জানই রিসেন্ট ঝামেলাগুলো, এর মধ্যে পার্টিতে গেলে আমার যা হয়! তখন আমাদের গাড়ীটা কি আপনি চালাবেন?' একটু রংঢং মেখে পিয়া বলল।
'আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি যাস্ট চিয়ার্স টা করেই চলে এসো' তানিম মিটমাট করার সুরে বলল।
হাসনাইন এই প্রজন্মের সাথে একদম অপরিচিত। তাদের কথাবার্তার ফ্রিকোয়েন্সির সাথে তার কিছুতেই কুলিয়ে ওঠা হচ্ছিলনা। কি থেকে কি করবে হাসনাইন বুঝতে পারেনা। তার মাথায় কেবল রেশমার সেই মায়াভরা কার্ডিগান জড়িয়ে দেয়া দৃশ্যটা ভেসে উঠছে, তার মনে হচ্ছে রেশমা মেয়েটা অনেক আলাদা!
ঠিক সেসময়েই হাসনাইনের মনে খচ্ করে দেখা দিল চিন্তাটা। খানিক আগে থেকেই প্রশ্নটা তার মাথায় খচখচ করছিল, বিশেষ করে সিগারেট খাচ্ছিল যখন লিফটের কাছে।
কিন্তু নিজের কাছেই নিজে এড়িয়ে গেছে। কিন্তু এখন থিতু হয়ে বসতে গিয়েও যখন তার মাথায় চিন্তাটা আসল, তখন সে আর এড়াতে পারলনা প্রশ্নটাকে।
তার মাথায় শুধু একটাই চিন্তা, আসলে ক্রেজী ভক্ত বলে কেউ কি নেই!
সবকিছু কারও ওয়েল প্ল্যানড কাজ? কিন্তু কেন?
ধুস্, সেলিব্রিটিদের কেইস হ্যান্ডেল করাও ঝামেলা!!
ভাবতে ভাবতে হাসনাইন একটু আগে দিয়ে যাওয়া চায়ের কাপে চুমুক দেয়।
কাঁচের দরজার ওপারে রেশমা আর দুই ডি.জে মেতে ওঠে অনুষ্ঠান নিয়ে।
হাসনাইন দেখতে পায় কখন যেন সি.ই.ও হামিদ সাহেব বের হয়ে এসেছেন, একটা চেয়ারে হাত ভর করে রেখে রেখে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছেন রেশমার দিকে।
(চলবে)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।