যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে, ঘড়ির ভিতর লুকাইছে
ভুঁইয়া টাওয়ারের নীচ তলার লাউঞ্জটার পেছনের ছোট্ট গেটটা দিয়ে বের হয়ে খুব দ্রুত সিগারেট ধরায় হাসনাইন। হাতে সময় আছে আর মাত্র ছ'মিনিট, এর মধ্যেই পার্টি চলে আসবে। চার মিনিটে সিগারেট টেনে শেষ করবে, আর বাকী দুই মিনিটে তারুণ্য'র অফিসে যাবে -- এই মুহূর্তে এটুকুই তার পরিকল্পনা। এফ এম রেডিও স্টেশন তারুণ্য'র অফিসটা এই ভুঁইয়া টাওয়ারেঐ ছয়তলায়।
সিগারেট ফুঁকতে গিয়ে তাড়াহুড়ো করায় মাঝপথেই আগুনের সবটুকুসহ সিগারেটের সামনের অংশটা নিচে পড়ে যায়।
একটু মেজাজ বিগড়ে উঠে হাসনাইনের, জড়বস্তুর উপর ওর রাগটা এমনিতেও বেশী। যদিও ভীষন যুক্তিবাদী আর কাঠখোট্টা ধরনের মানুষ সে, তারপরও ওর ধারনা জড়বস্তুর প্রাণ না থাকলেও অসময়ে ঝামেলা বাঁধানোর একটা সূক্ষ্ম ক্ষমতা এদের ঠিকই আছে। জীবের বিবর্তনের সাথে সাথে জড়ের মধ্যেও যে বিবর্তনের মতো কিছু একটা ব্যাপার ঘটেছে সে ব্যাপারে সে প্রায় নিশ্চিত, শুধু বিজ্ঞানীদের টের পাওয়াটা বাকী আছে বলে তার ধারনা।
তাড়াহুড়ো করে আরেকটি সিগারেট বেশ কয়েকটা টান দিয়েও হাসনাইন দেখতে পেলো যে এখনও চার মিনিট যায়নি। তারপরও ফেলে দেয় সিগারেট, হেলেদুলে লাউঞ্জের পশ্চিম দিকের লিফট কর্নারে এসে দাঁড়ায়, উপরে ওঠার বোতামে চাপ দেয়।
হাতে সময় আছে, তাই "সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেলে তাড়াতাড়ি হবে কিনা" টাইপের বাড়তি টেনশন তার হয়না। তবে একটু অন্যরকম একটি টেনশন আজ তার আছে, কারণ আজই সে প্রথম প্রধান তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে কেইস হ্যান্ডেল করতে যাচ্ছে, এবং কাকতালীয়ভাবে সে কেইসের ক্লায়েন্টও হলেন একজন বিশিষ্ট ব্যাক্তি।
আসলে কেইসটা নেয়ার কথা ছিল দুঁদে ডিটেকটিভ শাহাদাত সাহেবের, কিন্তু আজ সকালেই উনার মামার মৃত্যুর খবর পেয়ে চিটাগাংয়ে ছুটে যেতে হয় শাহাদাত সাহেবকে। তড়িঘড়ি করে হাসনাইনের বস খালেক সাহেব আসেন তার কাছ। সিনিয়র কেউই ডিউটিতে নেই অথচ শাহাদাত সাহেবেরটা কেইসটা হলো ভি.আই.পি'র সাথে এপয়েন্টমেন্ট।
খালেক সাহেব পারলে হাত-পা ধরে অনুরোধ করেন হাসনাইনকে। "শুধু দেখে আসলেই হবে সমস্যা কি", "বৃত্তান্ত শুনে আসা ছাড়া আর কোন কাজ নেই" বিভিন্নভাবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একই কথা বলে হাসনাইনকে রাজী করান তিনি । হাসনাইন অবশ্য খালেক সাহেবের মতো কড়া সি.আই.ডি-বিগবসের এমন নমনীয় চেহারা দেখে এমনিতেই গলে গিয়েছইলো। তাছাড়া, জুনিয়ার অফিসার হয়েও একটি কেইসের মূল দায়িত্ব পাবার সৌভাগ্য তো আর সব সময়ে আসেনা। তারওপর, ক্লায়েন্ট যদি হয় রেশমা'র মতো বিখ্যাত গায়িকা, যাকে কিনা বলা হয় হালের হার্টথ্রব সুন্দরী মাল্টিডাইমেনশনাল সেলিব্রিটি, তাহলে তো কোন কথাই থাকেনা।
হঠাৎ করেই উদ্ধত হাই-হীলের 'কাট কাট কাট' আওয়াজে ভুইয়া টাওয়ারের লবীর নীরবতা ভেঙে খানখান হয়ে যায় যেন। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই হাসনাইণ দেখতে পায়, ত্রস্তব্যাস্ত ভঙ্গিতে লিফটের দিকে এগিয়ে আসছেন তার ক্লায়েন্ট রেশমা, সাথে আরো তিনজন আছে, দু'জন পুরুষ আর একজন তরুনী -- রেশমার সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটছেন সবাই। হাসনাইনের ভালমতো খুঁটিয়ে দেখতেও ইচ্ছে করেনা, কিন্তু এটুকু বোঝে যে এরা সবাই 'ম্যাডামে'র যাতে কোনরকম সামান্যতম অসুবিধাও না হয় তা নিয়েই চব্বিশ ঘন্টা ব্যাস্ত থাকে। তাও চাকরীর নিয়মের খাতিরেই হাসনাইন একবার চোখ বুলায় গ্রুপের সবার উপর।
রেশমাকে এই প্রথম সামনাসামনি দেখল হাসনাইন।
আসলেই ভীষন সুন্দরী, জিন্সের প্যান্টের সাথে কালচে রঙের হাফস্লীভড টি শার্ট, উপরে অফহোয়াইট কালারের পাতলা একটা কার্ডিগান। কার্ডিগানের কলারটাও খুব সুন্দর, বর্ডারের দিকটা নীলচে রঙের কাজে ভরা। সানগ্লাস এখনও খোলেননি তিশমা, লম্বা আর স্ট্রেইট সিল্কি চুল নেমে গেছে কাঁধের অন্ততঃ ছয় ইঞ্চি নীচ পর্যন্ত। পোষাকের সাথে মিলিয়েই কিনা, স্বভাবের দিক দিয়েও ম্যাডাম রেশমাকে খুবই গম্ভীর মনে হয়। এমনিতে রেশমা খুব ভাল গান করেন, নাচতে পারেনও চমৎকার; ৩৫ এর মতো বয়েসেও ফিগার, কমপ্লেক্শন সবই অসাধারণ -- অনায়াসেই ২৫ বলে চালিয়ে দেয়া যায়।
রেশমাকে খেয়াল করতে করতে অন্যদের খুঁটিয়ে দেখার সময় হয়না হাসনাইনের, লিফট নেমে আসে। হাসনাইন রেশমার দলটিকে আগে আগে ঢুকতে দেয় লিফটে, সবাই ঢুকে গেলে যেই হাসনাইন নিজে ঢুকতে যাবে তখনই দলের একজন গম্ভীর ধরনের কন্ঠে বলে উঠেন, 'ছয়তলার আগে যদি নেমে পড়েন, তাহলে একটু ওয়েইট করুন। উই আর রিয়্যালী শর্ট-অভ-টাইম। '
'ওহ, আমি হাসনাইন, আপনাদের দলেরই একজন। ' হাসনাইনের সপ্রতিভ উত্তর।
হাসনাইনের নাম শোনার সাথে সাথেই দলের মেয়েটি প্রায় চিৎকার করে বলে উঠে,
'ওহ মাই গড। আপনিই ডিটেকটিভ অফিসার হাসনাইন সাহেব!!'
এরই মধ্যে হাসনাইন লিফটে ঢুকে পড়ে, দরজা বন্ধ হয়ে লিফট চলা শুরু করে।
'আপু, তোমাকে বলেছি না, আজ শাহাদাত সাহেব আসতে পারবেননা, তাঁর বদলে ইনি এসেছেন, মিঃ হাসনাইন। ' মেয়েটি উচ্ছলভাবে বলতে থাকে।
রেশমা ভদ্রতার হাসি হেসে হাসনাইনের দিকে তাকান, হাসনাইন ধন্য বোধ করে, আবার একটু নার্ভাসও হয়ে যায়।
মাথা নড করে বলে, 'নাইস টু মীট য়্যু, স্য...ম্যাডাম'
লিফটের সবার মুখে হালকা রসাত্মক হাসি ফুটে উঠে। তাদের সবাইই সম্ভবতঃ এই প্রথম একজন নার্ভাস পুলিশ অফিসারকে দেখেছে।
ধীরে ধীরে সবার সাথে পরিচয় হয় হাসনাইনের। তরুণী মেয়েটির নাম পিয়া, রেশমার সেক্রেটারী। বয়েস ২৫ এর বেশী হবেনা, অসম্ভব মিষ্টি চেহারা, হালকা কোঁকড়ানো চুলকে সুন্দরভাবে সামলে পনিটেইল করে বেঁধে রেখেছে।
সেও একটা নীলচে রঙের পাতলা হাফস্লীভড টিশার্ট, আর থ্রি-কোয়ার্টার লং-স্কার্ট পরেছে। কথাবার্তায় বেশ সপ্রতিভ, রেশমার মতো সেলিব্রিটিদের জন্য যাকে বলে একেবারে পারফেক্ট এসিসট্যান্ট। সাথের দুজন লোকের কেউই কিন্তু রেশমার সাথে কাজ করেনা, যে লোকটি হাসনাইনকে লিফটে উঠতে মানা করেছিল সে হলো তারুণ্যর রেডিওর অনুষ্ঠান পরিচালক, সবাই ডাকে লাবু ভাই। লাবু ভাই দেখতে ৩৫ থেকে ৪০ এর কাছাকাছি, ডেনিম জিন্সের সাথে টি-শার্ট পরে আছেন। মাথার চুল বেশ হালকা হয়ে গেছে, এত বেশী চুলের মধ্যে হাত বোলান যে বারবার চুলে হাত দেয়াটা যে তার ভয়ঙ্কর এক অভ্যেস এটা মিনিট দুয়ের মধ্যেই বোঝা যায়।
আর একটু বেশী অনুমান ক্ষমতাসম্পন্ন কেউ এই কাজটিকেই তার হালকা চুলের পেছনের কারণ বলে মনে করে ফেলতে পারেন। বাকী যে লোকটি চুপচাপ কোন কথাই বলেনি, এমনকি পারলে চোখ তুলে তাকায়ওনা, সে হলো এফ.এম. রেডিও উপস্থাপক আখতার, যে কিনা প্রতিদিন কয়েকঘন্টার জন্য হাজার হাজার শ্রোতার কান ও মন মাতিয়ে রাখে। টিনএজাররা সম্ভবত একে খুব ভাল চিনে থাকবে, যদিও হাসনাইন লোকটার নাম শুনেছে কি শুনেনি তা নিয়ে একটু দিধ্বান্বিত। লোকটার মধ্যে, 'আমি সেলিব্রিটি হয়ে গেছি' এমন একটা ভাব আছে, এব্যাপারটাও হাসনাইনের চোখ এড়ায়না। আখতার পরে আছে একটা হালকা মেরুন রঙের ফতুয়া, আর একটা ঢলঢলে জিন্সের মতো প্যান্ট।
তারও চোখে সানগ্লাস ছিল, তবে লিফটে উঠেই সেটা হাতে নিয়ে নিয়েছে। প্রোগ্রামের সময় তো এরা অনেক কথা বলেই কিনা কে জানে, অন্য সময়ে লোকটি অসম্ভব চুপচাপ। হাসনাইনের সাথে শুধু একটা 'হাই' বলেছে, হাতও মেলায়নি, ভালমতো হাসনাইনের দিকে তাকায়ওনি।
লিফট ছয়তলায় পৌঁছে গেলে তারুণ্য'র অফিসটা দেখে ছোটখাট একটা শক খায় হাসনাইন। এত জনপ্রিয় এরা, প্রতি শুক্রবার সকাল দশটায় 'বিলবোর্ড' নামের এসপ্তার টপ-টুয়েন্টি গানের অনুষ্ঠানটা মনে হয় ঢাকার সব টিনেজাররা শোনে, গত বছর ঢাকায় হঠাৎ রেডিও'র বিক্রী অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে দেয় তারুণ্য।
আর তাদের অফিসটা মাত্র দুই রুমের!
বাইরের রুমে মোট ছয়টা ডেস্ক, রুমের শেষ মাথায় প্লাইউড দিয়ে ছোট্ট একটা কক্ষ তৈরী করা, কক্ষের দরজায় বড় বড় করে লেখা,
"হামিদুল হক
সি.ই.ও, তারুণ্য গ্রুপ"
বড় সাহেবের অফিসে পাশেই একটা দরজা, মধ্যভাগ থেকে উপরের অংশ কাঁচের তৈরী। দরজার ওপাশে স্টুডিও -- এপাশ থেকে অনুষ্ঠান পরিচালনা দেখা যায়।
লাবু ভাই পাঁচজনকে সাথে নিয়ে স্টুডিওতে ঢোকেন, সেখানে রিল্যাক্স করার একটা সোফা আছে। স্টুডিওতে এই মুহূর্তে রেকর্ডিং চলছেনা, রেকর্ডেড প্রোগ্রাম চালু করে রেখেছে আখতারের সহকারী ডি.জে. লুৎফা। সোফায় বসার পর ঠান্ডা ড্রিংকস আসে, সবার জন্য কোক, রেশমা ম্যাডামের জন্য চিল্ড বেলের শরবত।
খেতে খেতে রেশমা বলতে থাকেন,
'লাবু ভাই, বলছিলামনা আপনাকে ঐ ঝামেলাটার কথা। ইনি এসেছেন সেজন্যই। ' বলে হাসনাইনের দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন রেশমা।
'ও,আচ্ছা। সো ইউ গাইজ আর গন্না গীভ হার প্রোটেকশান ফর দ্য নেক্সট ফিউ উইকস, আই সী' লাবু বলে।
'অনেকটা সেরকমই, আমার দুটো ঈগলস আই রেখে এসেছি নীচে, আর আমি যে মিস রেশমার সাথে আধঘন্টার মতো সময় চেয়েছি কথা বলার জন্য সেটা আপনারা স্ক্যাজুলে রেখেছেন আশা করি। ' হাসনাইন কথা বলতে বলতে কিছুটা স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করে।
'অফ কোওর্স, দ্যাটস নট বিগ আ ডীল। আধঘন্টা কেন, য়্যু স্টীল হ্যাভ মোর দ্যান এন আওয়ার, ম্যান। ডোন ওয়ারি, ডোন ওয়ারি' লাবু ভাই বিরক্তিকর ইংরেজীতে বলে যেতে থাকে, 'বাই দ্য ওয়ে ইয়াং অফিসার, হোয়াট'স দ্যাট ঈগল'স আই?'
'হা হা হা, লাবু ভাই আপনি কিচ্ছু জানেননা।
' অন্যপাশ থেকে কথা শুনতে থাকা লুৎফা হেসে উঠে, 'ওটা টিকটিকি'
'ঠিকঠিকি!মীন লিজার্ড? হোয়াটস .... ওহ আই সী আই সী' লাবু ভাই মিটি মিটি হাসতে হাসতে চেক করে কেউ তার বোকামোতে হাসছে কিনা। দেখে সবার মুখে হাল্কা হাসির রেশ। লাবু ভাই কি যেন আনতে যাবে ভাব দেখিয়ে বেরিয়ে যায়।
'লুৎফা, আমি মি. হাসনাইনের সাথে প্রাইভেটলি কিছু কথা বলতে চাই। একটু স্পেস দিতে পারবে?' রেশমা কাজের কথায় আসে।
'হুমমম', কিছুক্ষণ ভেবে লুৎফা পাশের রুমে লাবুভাইয়ের দিকে যেতে যেতে বলে,'লাবু ভাই, স্যারের অফিস রুমটাতো আজ খালি, তাইনা?'
একটু পরেই স্টুডিও রুমে আবার ঢুকে লুৎফা বলে,
'ম্যাডাম, সারের রুমটা ব্যবহার করতে পারেন। '
'হাসনাইন সাহেব, এখন শুনবেন?' রেশমার কণ্ঠে তাড়া।
'আমার কোন সমস্যা নেই' হাসনাইন বলে।
(চলবে ...)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।