যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে, ঘড়ির ভিতর লুকাইছে
প্রথম অংশ এখানে
*****************************************************************
৪.
সন্ধ্যা সাড়ে নয়টার দিকে হেরিটেজ ক্লাব ভবনের ঠিক বাহিরেই কার্ণিশের নীচে বৃষ্টির হালকা আঁচ সহ্য করতে করতে সিগারেট হাতে মুখ নীচু করে ভেবে যাচ্ছে হাসনাইন। আজকের কেইস না, একসপ্তাহ আগে ঘটে যাওয়া গায়িকা রেশমার কেইসটা নিয়ে। রেশমা কোনভাবেই মুখ খুলছেনা কেন সে খুনটা করেছে। খুনটা যে সে নিজে করেছে সেটা তো স্বীকার করে নিয়েছেই, এখন কারণটা ঠিকমতো বললেই তো হাসনাইনের কাজ শেষ হয়ে যায়।
বৃষ্টি থামছেনা, অবিরাম বারিধারা যাকে বলে।
হাসনাইন দেখতে পেল একটা তেলাপোকা টাইপের পোকা ড্রেনের পাশের মেঝে বরাবর হেঁটে যাচ্ছে, পোকাটার সরু সরু ভেজা পায়ের ক্রমাগত এগিয়ে যাওয়া মেঝেতে একটা সুন্দর পানিতে আঁকা নকশা তৈরী করেছে। হাসনাইনের হঠাৎ মনে পড়ে, "উইড়া যায়রে পঙ্খী তাহার পইড়া থাকে ছায়া", হুমায়ুন আহমেদের বইয়ে পড়েছিল। এখানে কি বলা যায়, হাসনাইন ভাবে, "হাইটা যায়রে পোকা তাহার পইড়া থাকে ..."। আর এগুতে পারেনা হাসনাইন। ওসব কাব্য মেলানো তার কাজ না, সে বরং কেইস নিয়েই ভাবা শুরু করে।
রেশমার মতো বিখ্যাত গায়িকাকে ফাঁসিয়ে দেয়ার ফলে হাসনাইন এখন রীতিমতো হিরো। গত একসপ্তায় অন্ততঃ বিশটা টিভি প্রোগ্রামে সাক্ষাৎকার দিতে হয়েছে, যদিও বেশীরভাগ সময়ই "চলমান মামলার কথা বলা যাবেনা" বাক্যটি ব্যবহার করতে হয়েছে তাকে। ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা টিভিগুলোর ব্যাঙাচি রিপোর্টারদের অবস্থা দেখে সে কিঞ্চিৎ হতাশ। এরকম চলমান মামলায় কোন ধরনের প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা উচিত সে ধারনাটুকুও তাদের নেই। সে তুলনায় পত্রিকাগুলোর কাভারেজ ভালো, লেখার মানও যুতসই।
তিনটা প্রেস কনফারেন্সে তাকে যোগ দিতে হয়েছে এপর্যন্ত। এদিকে আবার নিজের ডিপার্টমেন্টেও সে হিরো, পুরো মালার বিবরণ শুনে তার বস্ ডিটেকটিভ শাহাদাৎ তো বলেই দিলেন, "হাত ময়লা না করলে হাসনাইন দেশের সেরা ডিটেকটিভ হবে"। যদিও "হাত ময়লা" করার ব্যাপারে তাঁর নিজের নামডাক আছে; হয়তো অভিজ্ঞতার আলোকেই ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন।
শুধু তাই না, শাহাদাৎ স্যার হাসনাইনের জন্য আলাদা একটা বড় রুমেরও ব্যবস্থা করে দিয়েছেন অফিসে, যদিও রুম হাতে পাবার পরদিনই হাসনাইনের সাথে সাথে তার দুই সহকারী কালাম আর রাজুও ঢুকে পড়েছে সে রুমে। হাসনাইন কিছু বলেনি।
শুধু তাই না, দুই সহকারী পরদিন কোন এক বসের অনুমতি নিয়ে চারটা সিঙ্গেল সোফাও এনে ফেলেছে রুমে। সেখানে মূলতঃ তাসের আড্ডা হয়। তাস খেলা ডিটেকটিভদের জন্য ফরজ, কারো কিছু বলার নেই। এমন হাসনাইনের কাছে আজকের কেইসটা বলতে গেলে পানিভাত, গিললাম আর হজম করে ফেললাম। প্রায় সব কিছুই প্রমাণিত, আসামীও হাতেনাতে ধরা।
একে জিজ্ঞাসাবাদ করারও কিছু নেই, জবানবন্দীর ফর্মালিটি সেরে প্রমাণগুলোকে সাজিয়ে শুধু পাবলিক প্রসিকিউটর অফিসে পাঠালেই হবে। প্রসিকিউটর যে এক সিটিঙেই খুনীকে আদালতে পাঠিয়ে দেবেন তাও প্রায় নিশ্চিত।
হাতের সিগারেট শেষ করে আরেকটি সিগারেট ধরাতে যাচ্ছিল হাসনাইন, এমন সময়েই কালাম বের হয়ে এল ভেতর থেকে।
"হাসনাইন ভাই, প্রমাণ ট্রোমান তো সব জোগাড় করে রাখলাম, দেখবেন নাকি একবার?"
"কি কি পাওয়া গেল?" হাসনাইন নিরুৎসাহিত গলায় জিজ্ঞেস করে।
"একটা ক্রিস্টালের এ্যাশট্রে, দুই টুকরা, দুটোই মোটামুটি মিলে যায়।
রক্তে মাখানো, আর প্রচুর ফিঙ্গারপ্রিন্টও দেখা গেছে এ্যাশট্রেতে। আর পাওয়া গেছে একটা মোবাইল ফোন, রক্তের ছিটাসহ; আর পাওয়া গেছে একপ্যাকেট সিগারেট, প্যাকেটের ভেতর লাইটার। সম্ভবতঃ ভিকটিম আলমগীর খানের। সিগারেটের প্যাকেটের উপরও রক্তের ছাপ। "
"রুমে আর কোথায় কোথায় রক্ত আছে?"
"সারা মেঝেতে ছড়াছড়ি।
টেবিল, চেয়ারেও লেগেছে। তাছাড়া আসামীর জামাকাপড়েও প্রচুর রক্ত লেগে আছে। স্যাম্পল ম্যাচিংয়ের জন্য সব জড়ো করেছেন ইন্সপেক্টর রাব্বি, উনি গুলশান থানার। "
"তাই নাকি? তাহলে তো কাজ ইজি হয়ে গেল। তুমি এক কাজ করো, যে ঘরটায় খুন হয়েছে সে ঘরটা সীল করে দাও।
আমি একটু পরে দেখতে যাব। আর পারলে ইন্সপেক্টর রাব্বিকে বলো আমি তার সাথে কথা বলতে চাই। "
মুহূর্তেই ভেতরে চলে গেল কালাম, ঠিক যেন আলাদিনের চেরাগের দৈত্য। এমন অনুগত ছেলে আজকাল পাওয়াও বিরল, হাসনাইন ভাবে। সিগারেট টানতে টানতে আবারও হেঁটে যাওয়া পোকাটিকে দেখতে থাকে হাসনাইন, এমন সময়েই ইন্সপেক্টর রাব্বী এসে প্রায় চিৎকার করার মতো করেই বললেন, "আআআরে, হাসনাইন যে! কি খবর? কি খবর?"
একসপ্তাতেই হাসনাইনের সম্মান যে পরিমাণ বেড়েছে তা দেখে সে নিজেও অবাক।
ইন্সপেক্টর রাব্বী তার চেয়ে অনেক সিনিয়র, অথচ যেন হাসনাইনকে দেখে স্বর্গ পেয়েছেন হাতে।
"এইতো আছি, রাব্বী ভাই। ভালোই আছি। কি অবস্থা কেইসের? সব তো মনে হয় ক্লিয়ার, নাকি?"
"হ্যাঁ, হ্যাঁ। আর বোলোনা।
মাথাগরম ছেলেপিলে, রাগের মাথায় আঘাত করে ফেলেছে, লিথাল আঘাত বুঝলে, ব্যাড লাক আর কি!"
"একটু বিস্তারিত বলবেন?" হাসনাইন বেশ বিনীতভাবে অনুরোধ করে।
"অবশ্যই অবশ্যই" রাব্বির গলা থেকে যেন মধু ঝরে পড়ে। গুলশান থানায় ফোন আসার পর থেকে তারা কিভাবে এত জ্যামের ভেতরেও শর্টকাট রাস্তা দিয়ে পাঁচ মিনিটের মাথায়ই চলে আসলেন বাহিনী নিয়ে, এবং কতটা কায়দা করে তার জওয়ানেরা আসামীকে ক্যাঁক করে ধরল, সব পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বললেন রাব্বী। সবশুনে হাসনাইনও নিশ্চিত, রায়হান নামের ছেলেটাই খুনী। হয়ত রাগের মাথায় আঘাত করে বসেছে।
এর শাস্তি অবশ্য মৃত্যুদন্ড হবেনা, তবে দেশের প্রখ্যাত একজন শিল্পী, অন্যকথায় একজন বিশেষ সম্পদ, তাঁকে মারার শাস্তিটা একটু ভারীই হবে। তাছাড়া পাবলিক সেন্টিমেন্টও আছে, খবরের পাতাগুলোতে বেশী পরিমাণে ফোকাস পেলে হয়তো মৃত্যদন্ডই দিতে হবে ছেলেটিকে।
ইন্সপেক্টর রাব্বী অলরেডী একবার রায়হানের পরিবারের কাছ থেকে জবানবন্দী নিয়েছেন, তারা যতটুকু জানেন সবই বললেন। হাসনাইন যেটা জানতে পারল সেটা হলো যে "টাকডুমাডুমডুম" নামের কোন এক নাটকে রায়হানকে কাস্ট করার কথা ছিল আলমগীর খানের, সেটাই ফাইনাল হবার কথা ছিল আজ। জীবনে প্রথম টিভি সিরিয়ালে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র পাবার জন্য রায়হান খুব উত্তেজিত ছিল গত কয়েকদিন।
রাব্বি, হাসনাইন, দুজনেই একমত হলেন, রায়হানকে যে কাস্ট করার কথা ছিল সম্ভবতঃ আলমগীর খান সেটা নাকচ করে দিয়েছেন, এবং সেজন্যই রায়হান রাগের বশে খুন করে ফেলেছে আলমগীরকে। টাকডুমাডুম নাটকের অন্যান্য কলাকুশলীদের কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করে সেটা কনফার্ম করে নিলেই হবে।
পুরো কেইসের দায়িত্বে যেহেতু হাসনাইনকে পাঠানো হয়েছে সিআইডি থেকে, তাই তাকে একটা রিপোর্ট লিখতে হবে। তবে ব্যাপারটা নিয়ে সে খানিকটা মনোক্ষুন্ন হয়েছে, কারণ এত সহজ একটা কেইস কালামও রিপোর্ট করতে পারে। শুধু শুধুই শনিবার সন্ধ্যার আড্ডাটা মাটি হয়েছে তার।
অবশ্য অভিনেতা আলমগীর খান খুন হয়েছে শুনে সে নিজেও শুরুতে উৎসাহ নিয়েই কেইসের দায়িত্ব নিয়েছে, তবে এই মুহূর্তে এত সহজ অপরাধী হয়ে যাওয়াতে ঘটনাতে আর কোন থ্রিল বাকী নেই তার জন্য। মূল ঝামেলাটা যাবে উকিলদের উপর দিয়ে, আসামী রায়হানের খুনের ব্যাপারে কোন পরিকল্পনা ছিলনা, এই ব্যাপারটা প্রমাণ করাই এই মামলার মূল ঝামেলা। দু'হাতে আড়মোড়া ভেঙে হাসনাইন রিলাক্সড হয় এবং একই সাথে কিছুটা পানসে বোধ করতেও শুরু করে।
৫.
হেরিটেজ ক্লাবের বড় কনফারেন্স রুমে এসে জড়ো হয়েছেন হালের তারকাদের অনেকেই। এদের প্রায় সবাই আলমগীর আর রায়হান, দুজনকেই চেনেন।
হাসনাইন আর রাব্বি যখন কনফারেন্স রুমে এসে দুটো চেয়ারে বসল, তখন অনেকেই এগিয়ে আসলেন তাদের নিজ নিজ মন্তব্য জানানোর জন্য। এর মধ্যে অধিকাংশের কথা শুনেই হাসনাইন যা ধারনা করতে পারল, তা হলো, রায়হান নামের আসামীটি খুবই সোজা-সরল টাইপের এক ছেলে। বেশ বোকাও। অবশ্য রক্তের মাখামাখি, পুলিশকে ফোন করা, আবার পালিয়ে ক্লোজেটে ঢোকা -- সবকিছু শুনে এমনিতেও সে একই রকম ধারনা করতে পেরেছিল। তবে এই ধারনার সাথে সাথে সবার আরেকটি মন্তব্যও তার মনের মধ্যে বিঁধে রইল; সেটা হলো কেউই ভাবতে পারছেনা রায়হানের মতো অমন নির্বোধ টাইপের ছেলে এতবড় একটা খুন করে বসবে।
এরই মাঝে বিপুল নামের মাঝবয়েসী একজন এসে বললেন তিনি এই ক্লাবের মেইনটিন্যান্সের দায়িত্বে আছেন, মামলা গঠনে সাহায্য সহযোগিতা করতে পারবেন। কোন প্রশ্ন থাকলে জিজ্ঞেস করতে। হাসনাইন বলল, "আমার কয়েকটা খটকা আছে, একটু পরিস্কার করে দিলেই হয়। "
"হ্যা, বলুন। " বিপুলের উদার সম্মতি।
"পুলিশ বলেছে তারা এসে ডেডবডি আর আসামী রায়হানকে ছাড়া আর কাউকে দেখেনি। অন্য কারো কি থাকার কোনই সম্ভাবনা নেই? যে ধরুন ঘটনাটা দেখেছে। "
"না সম্ভবতঃ, স্যার", খানিকটা মেয়েলী কন্ঠে বিপুল মহাউৎসাহে বলে যান,"কারণ আমাদের ক্লাবের নিয়মগুলো খুবই ওয়েল মেনটেইনড, যেমন ধরুন যে কেউ চাইলেই কোন একটা রুম ব্যবহার করতে পারেনা। প্রথমে সেটা বুকিং দিতে হয়, শুধু দোতলা তিনতলার লিভিং-কাম-ডাইনিং এলাকা ছাড়া। যেমন আজও সাড়ে ছয়টার পর বুকিংয়ের রেকর্ডে দেখা যাচ্ছে।
ওহ স্যার, যেটা বলা হয়নি, আমাদের আবার অনলাইন বুকিং সিস্টেম আছে। তো দেখা যাচ্ছে যে, আলমগীর ভাইই শুধু বুকিং দিয়েছেন সাড়ে ছয়টা থেকে আটটার, আর নাম লিখেছেন উনার, অভিনেতা সাদী মোস্তাফিজের আর আসামী রায়হানের। তো সাদী ভাইয়ের সাথে আমার কথা হয়েছে, উনি সম্ভবতঃ সোয়া সাতটার দিকে বের হয়ে গেছেন। উনি চলে যাবার পরই সম্ভবতঃ রায়হান এসেছিল, আর তার কিছুক্ষণের মধ্যেই মার্ডারটা হয়। "
"তাই?" হাসনাইন ধীরে ধীরে বলে, "তার মানে ঐ সময়টায় আর কেউ ক্লাবে ছিলনা।
আচ্ছা, আজ সারাদিনে আর কেউ কি ঐ রুমটা ব্যবহার করেছে?"
"মিটিং রুম তো! মানুষ অতো ব্যবহার করেনা, বেশীরভাগই দোতলা তিনতলার আড্ডাঘরে কাটায়, বিশেষ করে শনিবারে। " পাশের টেবিলের কম্পিউটারের মনিটর অন করে চেক করতে করতেই বিপুল বলেন, "ও, দেখা যাচ্ছে, মিশুদের ব্যান্ডের মিটিং ছিল আজ। তিনটা থেকে পাঁচটা। "
"ওরা এসেছিল?" হাসনাইন জিজ্ঞেস করে।
"দাঁড়ান চেক করি।
ঐতো মিশুরাও আছে। " বলেই বিপুল ছুটে যায় মিশুদের কাছে, মিশুরাও সবাই একসাথে আসে। জানা যায় যে মিশুরাও এসেছিল আজ, তিনটা থেকে পাঁচটা। কোনরকম সন্দেহজনক কিছু তাদের চোখে পড়েনি, এমনকি রায়হান বা সেরকম কাউকেও আশেপাশে ঘুর ঘুর করতে দেখেনি। কাজে লাগতে পারে বলে হাসনাইন ব্যান্ডের সব সদস্যের হাতের আঙুলের ছাপ রেখে দিল।
তারপর বিপুলের দিকে তাকিয়ে বলল, "আচ্ছা, বিপুল সাহেব। আরেকজন যে আছেন, সাদী মোস্তাফিজ। উনার সাথে কি কথা বলা যাবে? উনি তো আবার বিশাল তারকা। হা হা হা। "
হাসনাইনের হাসির সাথে কেউ তাল মিলালনা।
তবে বিপুল আন্তরিকভাবেই বলল, "সাদী ভাইও একটু আগেই জেনেছেন মার্ডারের কথা, উনিও আসছেন এদিকে। "
"যাক ভালই হলো। " হাসনাইন স্বগতোক্তির মতো করে বলল, "একদিনেই সব কাজ শেষ। "
রাত দশটা পেরুনোরও কিছু পরে অভিনেতা সাদী মোস্তাফিজ এসে ঢুকলেন ক্লাবে। তাঁর দুচোখ লাল হয়ে আছে, কান্না থামাতে পারছেননা।
সবাই এগিয়ে গেলে তিনি বলতে লাগলেন, "আহারে, একটু আগেই তরতাজা লোকটার সাথে কথা বললাম, আহারে!"
হাসনাইন এগিয়ে যায়, সাদীর সাথে হাত মেলায়। নিজের পরিচয় দিয়ে বলে, "দুয়েকটা প্রশ্ন করব স্যার, যদি কিছু মনে না করেন। "
"কেন্ কি মনে করব? অবশ্যই করেন, বলেন কি বলতে হবে?" সাদী ভীষন সপ্রতিভ।
"সামান্য কিছু প্রশ্ন আর কি, এই অনেকটা ফর্মালিটিজের মতো। আমাদেরকেও রিপোর্ট করতে হয় তো, স্যার।
" সাদীর অভিভাবকসুলভ ব্যক্তিত্বের কাচে হাসনাইন অকারণ বিনয়ে গলে পড়ে।
"না না, কোন সমস্যা নাই, আমাদেরও একটা দায়িত্ব আছেনা?"
"আপনি ঠিক কয়টার দিকে বের হয়েছেন মনে আছে কি?" হাসনাইন প্রশ্ন করে।
"হুমম, একদম নিশ্চিত তো বলতে পারবনা, তবে যতদূর মনে পড়ে করিডোরের ঘড়িটাতে তখন সাতটা বিশের মতো বাজে। "
"আচ্ছা, ধন্যবাদ। আরেকটা প্রশ্ন, আপনি বের হয়ে যাবার পথে কাউকে দেখেছেন? বিশেষ করে রায়হানের মতো দেখতে বা সেরকম সাইজের কাউকে চোখে পড়েছে?"
"না, পড়েনি।
আমার গাড়ী পার্ক করা ছিল রাস্তার ওপাশে, আমি গাড়ীতে উঠে চলে গেছি। তেমন কাউকে দেখিনি। এখন রাস্তায় সেরকম কেউ আমাকে ক্রস করেছে কিনা বলতে পারবনা। "
"অনেক ধন্যবাদ স্যার। " হাসনাইন এখনও আবেগাপ্লুত, "আরেকটা কথা জিজ্ঞেস করি স্যার?"
"অবশ্যই, তবে আমি আলমগীর ভাইরে দেখতে আসছি।
উনার ডেডবডি কোথায়?"
"আছে, এখনও এখানেই আছে, একটু পরে উনার বাসায় নিয়ে যাবে। আমাদের প্রমাণাদি নেয়ার পরেই। তো স্যার, যেটা জানতে চাইছিলাম, আলমগীর স্যারের সাথে আপনার কথা হয়েছে একঘন্টার মতো, তাইতো? আপনার কি কোন কিছু অদ্ভুত মনে হয়েছে তার ব্যাপারে?"
খানিকটা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে সাদী। তারপর গলা নামিয়ে বলে, "আমি জানিনা, আমার অবজাবেশনে ভুলও হতে পারে। তবে তাঁর কথাবার্তায় মনে হয়েছে উনার মেজাজ কিছুটা খিঁচড়ে আছে।
সম্ভবতঃ তাঁর রিসেন্ট কিছু নাটক নিয়ে চিন্তায় ছিলেন। "
"আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, স্যার। " হাসনাইনের স্বরে কৃতজ্ঞতার কমতি নেই।
"আমাকে তো আবার সাক্ষ্য-টাক্ষ্য দিতে ডাকবেননা" সাদী মুচকি হেসে মজা করেন।
"না স্যার, মনে হয় লাগবেনা।
কেইসটা তো খুবই সিম্পল। "
"গুড, গুড" বলতে বলতে সাদী অন্যদিকে চলে যান।
তবে কাজে লাগতে পারে বলে সাদীরও ফিঙ্গারপ্রিন্ট রেখে দেয় হাসনাইন। সাদী খানিকটা বিরক্ত হয়, আবার এমন ভাব করে যে মামলার স্বার্থে সে ব্যাপারটা মেনে নিচ্ছে।
কনফারেন্স রুম ত্যাগ করার সময় হাসনাইন দেখতে পায় যে রুমের দরজার পাশে একদম কোণার দিকে একটি মেয়ে একা দাঁড়িয়ে আছে।
মেয়েটির সাথে চোখাচোখি হতেই হঠাৎ করে হাসনাইন কেমন যেন খুব চমৎকার বোধ করতে শুরু করে। হঠাৎ করেই তার এমন অনুভূতি হয় যেন মেয়েটিকে সে আগে কোথাও দেখেছে। আবার মনে হয়, এই মেয়েটিকেই কি সে খুঁজছিল এতদিন?
তবে মেয়েটিকে দেখে সে যতটা অবাক হয়, তার চেয়েও বেশী অবাক হয় যখন মেয়েটা তার দিকেই এগিয়ে আসতে থাকে। রুম থেকে বের হবার সাথে সাথেই মেয়েটি হাসনাইনকে পাকড়াও করে, কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠে, "ইনস্পেক্টর সাহেব, বিশ্বাস করুন, ভাইয়া অমন মানুষ না। ভাইয়াটা এত ভাল মানুষ আপনি ভাবতেও পারবেননা।
ভাইয়া কোনভাবেই খুন করতে পারেনা, কোনভাবেই না। আপনি ওকে বাঁচান। " হুঁহুঁ করে কাঁদতে থাকে মেয়েট।
হাসনাইন বিব্রত বোধ করে, কি বলবে বুঝে উঠতে পারেনা। মেয়েটির উচ্চারণ করা প্রতিটি শব্দ তার বুকের কোথাও তীরের মতো বিঁধে যেন।
তার মনে হয় একজন বোন এমন আকুল শুধু তখনই হতে পারে যখন সে নিশ্চিত তার ভাই খুনী না। একবার ভাবে জিজ্ঞেস করে যে কিভাবে সে এতটা নিশ্চিত। আবার ভাবে, এই মেয়ে তো এখানে ছিলনা, সে তো শুধু বলতে পারবে তার ভাইয়াটা মাটির মানুষ। তবুও মেয়েটির আকুতিভরা চোখের দিকে চেয়ে হাসনাইনের মন গলে যায়, সে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলে, "আপনি আপনার এই কথাগুলো আদালতে বলতে পারেন। আমরা পুলিশেরা শুধু ঘটনাস্থলের প্রত্যক্ষদর্শী বা অপরাধের সাথে কোনরকম কানেকশন আছে এমন লোকদের জবানবন্দি নেই।
আসামীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হ্যান্ডল করেন আদালতের উকিল। " মেয়েটির চোখের হতাশা হাসনাইনের চোখ এড়ায়না, যে বোঝে তার বলা সান্ত্বনাবাক্যগুলো
কোন কাজ করেনি।
কনফারেন্স রুম থেকে ঘটনাস্থলের রুমে গিয়ে এক এক করে জব্দ করা প্রমাণগুলো দেখতে থাকে হাসনাইন। সবগুলো জিনিসকেই আলাদা আলাদা ভিনিল প্যাকেটে ভরা হয়েছে, যাতে নতুন কোন ফিঙ্গারটিপ না লেগে যায়। জিনিস খুব বেশী না; একটা সিগারেট বাক্স, একটা মোবাইল ফোন, ভাঙা এ্যাশট্রের দুটো আলাদা টুকরো দুটো আলাদা প্যাকেটে, রুমের কয়েকটি চেয়ারের ছবি আর সেগুলো থেকে তুলে নেয়া ফিঙ্গারপ্রিন্ট, এবং একইভাবে টেবিলের ওপর রক্তের দাগের ছবি আর ফিঙ্গারপ্রিন্টের ছবি।
একইসাথে গুলশান থানা থেকে সিআইডি রিপোর্টের জন্য রায়হানের শার্ট, জুতো, প্যান্ট, দশ আঙুলের ছাপ, সবকিছু নিয়ে আসা হয়েছে। একটা চেয়ার টেনে একটা একটা করে জিনিসে চোখ বুলায় হাসনাইন।
জব্দ করা সবগুলো প্রমাণের মাঝে চোখ বুলাতে বুলাতে উথে দাঁড়ায় এবার, হেঁটে হেঁটে ঘরের চারপাশটা দেখতে থাকে হাসনাইন। দেয়ালে বিশাল আকৃতির ছবি, জানালায় দামী ভারী পর্দা, ঘরের এককোণে রাখা চল্লিশ ইঞ্চি টিভি, একপাশে টেবিলে রাখা টেলিফোন, অন্যপাশে দেয়ালে ঝুলতে থাকা ইন্টারকম আর এন্টিকের মতো বিশালাকায় ঘড়ি। মার্বেল পাথরের মেঝেতে অভিজাত নকশা।
এসব দেখতে দেখতেই হঠাৎ থমকে যায় হাসনাইন, কি যেন একটা তাকে খোঁচাচ্ছে, সেটাকে মনে করে দেখার চেষ্টা করে কিছুটা সময়। হঠাৎ পিছু ফিরে তাকায় সে, কি যেন দেখতে থাকে মনোযোগ দিয়ে, এবং তার পরপরই মুখে একটা বিস্তৃত হাসি এনে নিজেই নিজেকে শুনিয়ে বলে, "গোয়েন্দা হাসনাইন, এটা আসলে অত সহজ কেইস না!"
প্রায় ছুটে বেরিয়ে যায় হাসনাইন ঘর থেকে, একটু আগের মেয়েটিকে খুঁজতে। মেয়েটিকে খুঁজে পেলে এখনই সে বলতে পারবে, "আপনি একটুও ভাববেননা, একটুও কাঁদবেননা। আপনার ভাইয়া দোষী নয়, তাকে আমি বাঁচাতে পারব, অবশ্যই পারবো। "
এক ধরনের অপার্থিব আনন্দে থরথর করে কাঁপতে থাকে গোয়েন্দা হাসনাইন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।