আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ফারজানা মাহবুবার দুর্নীতি

উঁকি দাও ফুল!

ফারজানা মাহবুবা তার সাম্প্রতিক রচনায় এমন কিছু বক্তব্য রেখেছেন হুমায়ুন আজাদ সম্পর্কে বক্তব্য দিতে গিয়ে যা তার দুর্নীতিপরায়ন পণ্ডিতি পরিস্কার করেছে। তার লেখা সম্পর্কে বলার আগে অন্য একটা বিষয় বলা দরকার, হুমায়ুন আজাদ তার গ্রন্থে ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস এর বহু বক্তব্য ব্যবহার করেছেন বলেই তাকে এঙ্গেলস এর শিষ্য বলা শুদ্ধ হবে না। এঙ্গেলস এর রচনার সাথে পরিচিত যে কেউ সহজেই উপলদ্ধি করবেন, হুমায়ুন আজাদ বড়জোর পুঁজিবাদী সমাজ সম্পর্ক ও নারীবাদের গণ্ডীতেই আবদ্ধ, এঙ্গেলস এর বহু ঐতিহাসিক বক্তব্য উদ্ধৃত করলেই তার রচনা কর্মে স্থুল ভোগবাদী প্রবণতা চাপা থাকেনি। যাই হোক, ফারজানা হুমায়ুন আজাদ ও এঙ্গেলস কে নিয়ে কিছু সার সিদ্ধান্ত করেছেন, যাতে নারী মুক্তি সম্পর্কে উভয়ের বক্তব্য নাকি বোঝা যাবে, যেমন: [ এক- বেরিয়ে যাও পরিবার থেকে! ‘…পিতৃতন্ত্র নারীর জন্যে যে-পেশাটি রেখেছে, তা বিয়ে ও সংসার; এ-ই পিতৃতন্ত্রের নির্ধারিত নারীর নিয়তি…। ’ পৃঃ২৩৩ বিপ্লবী এংগেলসের কথাকে কোট করে ডক্টর আবার বলেছেন, ‘বিয়ে ও সংসার নারীর সম্ভাবনার সমাপ্তি'’।

পৃঃ২৩৩ ‘…পশ্চিমে থাকা, খাওয়া, কামযাপন করা সম্ভব সংসার পাতা থেকে অনেক সহজে; পুবে বিয়ের বাইরে কাম যাপন প্রায় অসম্ভব ব’লে আজো বিয়ের প্রতি তরুণদের আগ্রহ রয়েছে। বদ্ধ সমাজ বিয়েতে প্ররোচিত করে, মুক্ত সমাজ বিয়েতে অনীহ করে। ’ পৃঃ২৩৮ কিন্তু হায় হায়, যে পশ্চিমের এত গুনগান গাইলেন ডক্টর আজাদ, সে পশ্চিমেই একি অবস্থা মেয়েদের?? প্রতি দুই মিনিটে এমেরিকার অন্তত একজন নারী সেক্সুয়াল এবিউজড’র শিকার হচ্ছেন। প্রতি ছয়জনে একজন এমেরিকান নারীর সেক্সুয়াল এবিউজিং’র ভিকটিম। এদের মধ্যে ৪৪% মেয়ে আঠারো বছরের নীচে এবং ৮০% মেয়ে ৩০ বছরের নীচে! সেখানে ২০০৫-২০০৬ এ এধরনের বাৎসরিক গড় ঘটনা ঘটেছে ২৩২,০১০টি।

অর্থাৎ, মাসিক ১৯,৩৩৪টি! (http://www.rainn.org/statistics/) এই হলো মুক্ত সমাজে মুক্ত নারীর অবস্থা! একটু আমাদের বদ্ধ(!) সমাজের সাথে তার তুলনা করা যাক। অগাস্ট ২০০৪ এ বাংলাদেশে রিপোর্টেড সেক্সুয়াল হ্যারাসম্যান্ট’র সংখ্যা ৭০৬ (রিপোর্ট করা হয়নি তাদের সংখ্যা কম নয়, কিন্তু তা শুধু আমাদের দেশেই না, সেইম এমেরিকাতেও প্রচুর মেয়ে পরবর্তীতে আরো বেশী হ্যারাসমেন্টের শিকার হওয়ার ভয়ে রিপোর্ট করেনা)। (http://www.suicide.org/) কোথায় ১৯,৩৩৪ আর কোথায় ৭০৬!! ] _ এ ক্ষেত্রে দেখা দরকার এঙ্গেলস পিতৃতন্ত্রে নারীর অবস্থানকেই চিহ্নত করেছেন, ব্যক্তিগত ভাবে নারীকে পরিবার থেকে বেরিয়ে যাবার প্রেসক্রিপসন দেননি। এঙ্গলস এর কাছে পরিবার একটি ঐতিহাসিক প্রথা, ঐতিহাসিক প্রয়োজনে একদা এর জন্ম, ঐতিহাসিক কারণেই এর বিলু্প্তি ঘটবে এক সময়। ব্যক্তিগতভাবে পরিবার ত্যাগ করা একেবারেই পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক টানাপোড়নের কারণে পশ্চিমে ঘটে থাকে।

তার সাথে এঙ্গেলস সমাধান এর সম্পর্ক নেই। বরং এই বিচ্ছিন্নতাই যে নারীর স্বাধীনতার জন্য যথেষ্ট না, তাই তার কাজের মূল সার। দ্বিতীয়ত, ইউরোপে এবং মার্কিন দেশে ধর্ষনের উচ্চহার নারী সম্পর্কে পণ্যসুলভ এবং দখলী মনোবৃত্তির ফল। যারা প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন কিংবা দশ বছর আগে চিনে গিয়েছিণলন, নারীর স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা সম্পর্কে বহু মুগ্ধ বক্তব্য দিয়েছেন তারা, সমাজতন্ত্রের বহু সমালোচান সত্তেও। আবার, একেবারে আদিবাসী বহু জাতিতেও ধর্ষণ এর ধারণাও পাওয়া যাবে না, অপরাধটির অস্তিত্ব পরের কথা।

এঙ্গেলস কেবল এই দুই পরিস্থির সাদৃশ্য কেন ঘটে, তাই বুঝতে আমাদের সাহায্য করেন। দুই আর তিন নম্বর সমাধান হুমায়ুন আজাদের নিজস্ব বক্তব্য, তার সাথে আমার ভিন্নমত রয়েছে। কিন্তু চার! বাপরে!! [চার- তোমাকে মেনে নিতে হবে বিপ্লবী এংগেলসের সমাজতান্ত্রিক সমাধান! ‘নারীজাতির ঐতিহাসিক মহাপরাজয়’ অধ্যায়ে ডক্টর আজাদ বিপ্লবী এংগেলসকে আঁকড়ে ধরেছেন নারী মুক্তির অবলম্বন হিসেবে। কারন এংগেলসের স্বপ্নের সমাজতান্ত্রিক সমাজে নারী-পুরুষের অর্থনৈতিক পজিশন এক। লেখকের ভাষায়, ‘ এংগেলস স্বপ্ন দেখেছেন এক শোষনহীন সমাজের;… ওই সমাজে সামাজিক উৎপাদনের মধ্যে আবার ফিরে আসবে নারী- এটাই তাদের মুক্তির প্রথম শর্ত; এবং ওই সমাজে উৎপাদনের উপায়গুলো হবে সমাজের সম্পত্তি… পরিবারের রূপ থাকবেনা এখনকার মতো, এখন পরিবার হচ্ছে সমাজের একক, এংগেলসের সমাজে তা হবেনা।

সেখানে ব্যক্তিগত গৃহস্থালি পরিণত হবে সামাজিক শিল্পে। ’পৃঃ৬৮ বেশতো! শুনতে তো খারাপ লাগেনা! কিন্তু ইতিহাস একি কথা বলে?? এংগেলসীয় স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্যে যখন শত শত মানুষের তাজা রক্তের পথ পাড়ি দিয়ে মহামান্য বিপ্লবী এংগেলসগন হাতে তুলে নিলেন সোভিয়েট ইউনিয়নের ক্ষমতা, প্ল্যাটোর ‘স্যাক্রেট ম্যারেজ’ থিউরীর কাছাকাছি তাদের ব্যক্তিগত গৃহস্থালিকে সামাজিক শিল্পে পরিণত করন প্রকল্পের অংশ হিসেবে বানিয়েছিলেন বেশ কিছু ডরমেটরী। গিনিপিগ হিসেবে তাতে আনা হয়েছিল সমাজের বাছাই করা বেশ কিছু উচ্চশ্রেণীর নারী-পুরুষ। সব ধরনের সামাজিক ও ধর্মীয় প্রথাকে আসতে দেয়া হয়নি হাজার মাইলের কাছাকাছিও। তারা মিলিত হতেন অবাধে।

চিন্তা করতেন অবাধে। জীবনকে যাপন করতেন অবাধে। কিন্তু হায়! শুদ্ধতম মানুষ সৃষ্টির এ প্রকল্প মুখ থুবড়ে মাথা ঘুরে পড়ে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায় মাত্র এক বছরেই!! (তথ্যসূত্র- Tawhid: Its Implication for Life and Thought; Ismail Al Raji Al-Faruqi, IIIT, Virginia, USA).] _ বিশেষ ভাবে বাছাই কৃত মানব-মানবীকে প্রজাতি রক্ষায় অগ্রাধিরকার দেয়ার এ তত্ত্বকে বলা হয় ইউজেনিকস, একদা ইউরোপের বহু দেশে, জাপানে এবং মার্কিন মুল্লুকে এর আইনী বৈধতাও ছিল বহুলাংশে। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্কে এ কথা ঘোর শত্রুও বলবে না। বরং তারা বিশ্বব্যাপী ইউজেনিকস বিরোধি মতাদর্শিক লড়াইয়ে নেত্বৃত্ব দেয়।

উল্লেখ্য যে, জাতিসংঘ ও ইউনেস্কো ঘোষিত ইউজেনিকস বিরোধি মতাদর্শিক দলিলটিও তাদের চাপেই গৃহীত হয়েছিল। ছোট্ট আর একটি কথাও এখানে বলা দরকার, বংশ, রুপ কিংবা অন্য কোন বৈশিষ্ট্য দেখে বিয়ের প্রথাও আদিম ধরনের ইউজেনিকস ই বটে। যা হোক, ভুতুরে দলিল ব্যবহার করে তিনি এই অসৎ কাজটি করেছেন। এঙ্গেলস এর গ্রন্থটি পাঠ করার দরকার মনে করেনিন। করলে এবং বুঝতে পারলে এমত জেনেরালাইজেশন করা মুশকিল হতো।

কিন্তু মুশকিল হলো, এঙ্গেলস এর এই বইটি নৃবিজ্ঞানের সাধারণ পাঠ্য, যদিও এর বহু সিদ্ধান্ত আধুনিক নৃ বিজ্ঞানীদের কেউ কেউ অযথাযথ মনে করেন। তারপরও তাদের মাঝে এর মৌলিক প্রতিপাদ্য নিয়ে ভিন্নমত নেই, সেটি হলো পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্র ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহে উদ্ভুত। এঙ্গেলস শুধু বাড়তি এটা বলেন যে, এগুলা সর্বদা থাকবে না। এই অসাধুতার পরিচয় তিনি দিয়েছেন বেশ সাহস করেই। অবশ্য আর একটি সম্ভাবনার কথা ফেলে দেয়া যায় না।

আমি জানি না, ফারজানার অ্যাকাডেমিক ডিসিপ্লিন কি, কিন্তু নৃবিজ্ঞান নিয়ে তিনি যে মুর্খতার পরিচয় দিয়েছেন, তাতে মানবিক আধুনিক বিদ্যার সাথে তার পরিচয়ের অভাবই বোঝা যায়। সেক্ষেত্রে, এই ধরনের ইনফ্যান্টাইল জেনারালাইজেশন বা বালসুলভ সাধারণীকরণই লেখাটির ছত্রে ছত্রে প্রকাশিত।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.