সর্বদা আপডেট
‘স্বামীর নির্যাতনে অতিষ্ঠ রিতা আশ্রয় চেয়েছিল শ্বশুরের কাছে। তিনি আশ্রয় দেননি, বরং পুলিশের ভয় দেখিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে যেতে বলেছেন। না গেলে তালাক দেওয়ার হুমকিও দিয়েছিলেন। আর কোনো পথ খোলা ছিল না ওর। শেষমেশ বিষ খেয়েছে, দুই সন্তানকেও খাইয়েছে।
’ এ কথা বলতে বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন জুরাইনের ফারজানা কবির রিতার মা মাজেদা বেগম। বাসাভর্তি মানুষ তাঁকে ঘিরে আছে। সবার চোখে পানি, সেই পানিতে যেন ধুয়ে গেছে সান্ত্বনার সব ভাষা।
এরই মধ্যে একজন বললেন, ফারজানা নিজে না হয় মরতেন, কিন্তু সন্তানদের কেন মারলেন? আরেকজন বললেন, বাঁচার কোনো পথই খোলা ছিল না! দুই শিশুসন্তানসহ মায়ের এই অস্বাভাবিক মৃত্যু নিয়ে এমন হাজারো প্রশ্ন মানুষের মনে। প্রশ্ন পুলিশের কাছেও: কীভাবে শিশুরা ছাদ-লাগোয়া দেয়াল পর্যন্ত উঠে তাদের কথা লিখল? অথবা তিনজনের লাশ কীভাবে পরিপাটি করে বিছানার ওপর কাঁথা দিয়ে ঢাকা ছিল।
আত্মহত্যার পর কি এভাবে থাকা সম্ভব?
পুলিশের ওয়ারী অঞ্চলের উপকমিশনার তৌফিক মাহবুব চৌধুরী বলছেন, আসামিদের গ্রেপ্তার করা হলে এসব প্রশ্নের জবাব মিলবে।
রাজধানীর জুরাইনের আলমবাগে মা ফারজানা কবির রিতা এবং তাঁর দুই সন্তান কবির ইশরাক পাবন (১২) ও রাইসা রাশমিন পায়েলের (১০) মৃত্যুর ঘটনায় ফারজানার স্বামী রাশেদুল কবির, শ্বশুর সাংবাদিক শফিকুল কবির, শাশুড়ি, দুই ননদসহ আটজনকে আসামি করে মামলা হয়েছে। গত শুক্রবার রাতে কদমতলী থানায় এ মামলা করেন ফারজানার মা মাজেদা বেগম। মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মৃত্যুতে প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। পুলিশ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলাটি গ্রহণ করেছে।
গতকাল রাতে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করেনি পুলিশ।
এদিকে ফারজানা ও তাঁর দুই সন্তানের লাশের ময়নাতদন্ত স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে সম্পন্ন হয়েছে। গতকালই তাদের লাশ আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়। এটা আত্মহত্যা না অন্য কিছু, প্রাথমিকভাবে তা বলতে পারেননি চিকিত্সকেরা।
গত শুক্রবার আলমবাগের বাসা থেকে পুলিশ তিনজনের লাশ উদ্ধার করে।
এর মধ্যে ফারজানা হলেন ইত্তেফাক-এর বিশেষ প্রতিনিধি শফিকুল কবিরের ছেলে রাশেদুল কবিরের স্ত্রী। মৃত্যুর আগে তিনি ও তাঁর সন্তানেরা আত্মহত্যার কারণ ও পারিবারিক বিরোধের নানা অভিযোগের কথা ঘরের দেয়াল, মেঝে, বাথরুমে ও কাগজে লিখে রেখে যায়। পাবন ও পায়েল দেয়াললিখনে তাদের মৃত্যুর জন্য দাদা-দাদি ও বাবাকে দায়ী করে।
পুলিশের উপকমিশনার তৌফিক মাহবুব চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, শফিকুল কবির ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগের তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ। তবে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন আসার পর এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যাবে।
আর আসামিদের গ্রেপ্তার করা গেলে আরও অনেক বিষয় স্পষ্ট হবে।
মামলা: রাজধানীর কদমতলী থানার দায়িত্বরত কর্মকর্তা এনামুল হক জানান, মামলায় ফারজানার মা মাজেদা বেগম অভিযোগ করেন, তিন বছর আগে তাঁর মেয়ে তাঁকে জানিয়েছিলেন বাসার কাজের মেয়ে (মামাতো বোন) রাজিয়া সুলতানা স্মৃতির সঙ্গে রাশেদুলের অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। রাশেদুল ওই মেয়েটিকে বিয়ে করবেন বলেও হুমকি দিচ্ছেন। পরে তাঁরা জানতে পারেন, রাশেদুল মেয়েটিকে বিয়ে করে অন্যত্র বসবাসও করছেন। কিন্তু রাশেদুল বিয়ের কথা অস্বীকার করেন।
তিনি বলেন, মে মাসের প্রথম সপ্তাহে ফারজানা তাঁকে জানান, শ্বশুর শফিকুল কবির ও পরিবারের লোকজন তাঁকে বাসা থেকে বের হয়ে যেতে বলেছেন। না গেলে তালাক দেওয়া হবে বলেও হুমকি দেওয়া হয়। ফারজানা আরও অভিযোগ করেন, তাঁর কাছ থেকে স্ট্যাম্পে জোর করে সই নেওয়া হয়েছে। মামলায় মাজেদা বলেন, শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টায় ফারজানার গৃহপরিচারিকা জিন্নাত আরা এসে জানায়, ফারজানা ও তাঁর দুই সন্তান মারা গেছে। তিনি দ্রুত বাসায় গিয়ে মেয়ে ও নাতিদের বিকৃত চেহারা দেখতে পান।
পরে তিনি জানতে পারেন গাড়িচালক আল আমিনকে দিয়ে তাঁর মেয়ে ও নাতিরা বিষাক্ত দ্রব্য কিনে আনে। মাজেদা এ মামলায় শফিকুল কবির, তাঁর স্ত্রী নূর বানু, স্বামী রাশেদুল কবির, স্বামীর দ্বিতীয় স্ত্রী স্মৃতি, দুই ননদ সুখন কবির ও কবিতা কবির, সুখনের স্বামী দেলোয়ার হোসেন ও গাড়িচালক আল আমিনকে অভিযুক্ত করেন। নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে মামলাটি দায়ের করা হয়।
কদমতলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কাজী আয়ুবুর রহমান বলেন, আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। ”
সবাই পলাতক: জুরাইনে শফিকুর রহমানের বাড়িটি এখন তালাবদ্ধ।
শফিকুর রহমান ও তাঁর স্ত্রী আগে থেকেই নারায়ণগঞ্জের বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। মামলার পর তাঁরা গা ঢাকা দিয়েছেন। এখন ফোনেও পাওয়া যাচ্ছে না। রাশেদুল ও তাঁর স্ত্রীও উত্তরার বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছেন।
ফারজানার জিডি: ফারজানার দুলাভাই কাজী মোহাম্মদ আরিফ অভিযোগ করেন, ফারজানাকে আগে থেকেই প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হচ্ছিল।
সর্বশেষ গত ৭ জানুয়ারি এমন একটি হুমকির ঘটনায় ফারজানা কদমতলী থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। জিডিতে বলা হয়, বেশি বাড়াবাড়ি করলে সন্তানসহ ফারজানাকে অপহরণ করা হবে। কদমতলী থানার দারোগা হাফিজউদ্দিন এ বিষয়টি তদন্ত করেন।
চালককে গাড়ি উপহার: মাজেদা বেগম তাঁর মামলায় উল্লেখ করেন, গাড়িচালক আল আমিনকে দিয়ে তাঁর মেয়ে ও নাতিরা বিষাক্ত দ্রব্য আনায়। এর বিনিময়ে চালককে গাড়িটি দিয়ে দেয়।
চালক গাড়িটি নিয়ে এখন উধাও। কদমতলী থানার ওসি বলেন, ফারজানার কাছে পাওয়া চিরকুটে এ কথা উল্লেখ রয়েছে।
চাপ প্রয়োগ: ফারজানার দুলাভাই ভাই কাজী আরিফের অভিযোগ, গত ৬ মে শফিকুর পুলিশ ডেকে এনে ফারজানাকে ভয় দেখান এবং তাঁকে দিয়ে আপসনামায় সই করতে বাধ্য করেন। ফারজানার মামা আব্বাস দেওয়ান বলেন, কদমতলী থানার এএসআই গোলাম কিবরিয়া ওই দিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বাসায় ছিলেন। তাঁর উপস্থিতিতে শফিকুল কবির বাড়ি ছাড়ার কাগজে সই নেন।
এ ছাড়া রাশেদুল তাঁর দ্বিতীয় বিয়েতে আপত্তি নেই—এমন একটি দলিলে সই নেন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে এএসআই গোলাম কিবরিয়া ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ওই দিন সকাল সাড়ে ১০টা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা পর্যন্ত তিনি শফিকুল কবিরের বাসায় ছিলেন। সেখানকার বাসিন্দা টিটু ও চানমিয়া সেখানে ছিলেন।
ময়নাতদন্ত: ফারজানা ও তাঁর দুই সন্তানের লাশ শুক্রবার বিকেলে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে আনা হয়।
কিন্তু তখন চিকিত্সক না থাকায় ময়নাতদন্ত হয়নি। গতকাল সকালে ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়। ফারজানার পরিবারের লোকজন অভিযোগ করেন, হাসপাতালে হিমঘর না থাকায় লাশে পচন ধরেছে। চেহারা বিকৃত হয়ে গেছে। সলিমুল্লাহ মেডিকেলের চিকিত্সক মোহাম্মদ মাকসুদ ময়নাতদন্ত করেন।
তিনি প্রথম আলোকে বলেন, লাশ বিকৃত হওয়ায় শরীরে কোনো চিহ্ন তাঁরা দেখতে পাননি। শ্বাসরোধ করার লক্ষণও নেই। লাশের ভিসেরা রাসায়নিক পরীক্ষার জন্য মহাখালীর পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে প্রতিবেদন পাওয়া গেলে জানা যাবে মৃত্যুর প্রকৃত কারণ।
তবে গতকাল সলিমুল্লাহ মেডিকেল হাসপাতালের মর্গে শফিকুল কবিরের লোকজনকে দেখা যায়।
আনোয়ার নামের এক ব্যক্তি প্রথম আলোকে বলেন, তিনি শফিকুল কবিরের খালাতো ভাই। তাঁরা দুই সন্তানের লাশ নিতে এসেছেন। ফারজানার মায়ের বাড়ির লোকজন এ কথা পুলিশকে জানান। পুলিশ তিনটি লাশ ফারজানার দুলাভাই কাজী আরিফকে বুঝিয়ে দেয়। বিকেলে লাশ আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়।
পুলিশের প্রশ্ন: পুলিশের কর্মকর্তারা জানান, ফারজানা ও দুই সন্তানের দেয়াললিখন ও হাতে লেখা চিরকুট থেকে তাঁরা প্রাথমিকভাবে মনে করছেন, এটি আত্মহত্যা। তবে এখনো কিছু প্রশ্নের জবাব মেলেনি। একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, পুরো বাড়ির দেয়ালজুড়ে যত লেখা, সেগুলো কত দিনে লেখা হয়েছে। আবার অনেক লেখা একেবারে ছাদ-লাগোয়া দেয়াল পর্যন্ত। তাহলে শিশুরা এত ওপরে উঠল কীভাবে।
আবার গৃহপরিচারিকা পুলিশকে জানিয়েছে, বাড়ির সব কক্ষের দরজা খোলা ছিল। প্রশ্ন হলো, কেন সব দরজা খোলা? তিনজনের লাশ ছিল পরিপাটি করে বিছানার ওপর কাঁথা দিয়ে ঢাকা। আত্মহত্যার পর কি এভাবে থাকা সম্ভব? বাচ্চাদের একটি ঘর ছিল এলোমেলো, আবার আসবাব ও টাইলস পর্যন্ত ভাঙা ছিল। প্রশ্ন হলো, কে এসব ভাঙল? লাশের সুরতহাল প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সবার চেহারা বিকৃত ছিল। পুলিশ কর্মকর্তাদের প্রশ্ন, তাহলে কবে তাদের মৃত্যু হয়েছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।