আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নির্বাসিতের আপনজন। পর্ব-১৭(ক)।

যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

আমি আগেই বলেছি যে আমি ঢাকার ছেলে নই। ঢাকাতে পড়তে আসবার আগে আমি বেড়ে উঠেছি একটি মাঝারি আকারের শহরে। শহরটির নাম খুলনা। এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে যে তাতে কি হয়েছে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথার মাঝখানে খুলনার কাহানী বয়ান করার যৌক্তিকতা কি? খুবই খাঁটি কথা।

আমার দেশের বাড়ী খুলনা হোক নাকি নেত্রকোণা হোক তাতে কি যায় আসে? আসলে যায় আসে। শুধুমাত্র খুলনাতে আমার বাড়ী বলে একটি পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলাম, যেটি আমার বাড়ী নেত্রকোণা হলে নিঃসন্দেহে হোতনা। এই ঘটনাটিও ঘটেছিল যখন আমি মাস্টার্স করছি তখন। ততদিনে কোর্সগুলো শেষ, পরীক্ষা দেয়াও হয়ে গেছে। যারা নন-থিসিস গ্রুপে ছিল তারা ইতিমধ্যে পাশ করে ফেলেছে।

আর বাকী আমাদের তখন কাজ বলতে থিসিসের গবেষণাকে গুছিয়ে আনা, আর বসে আস্তে আস্তে থিসিস লেখার কাজটি শুরু করে দেয়া। তখন বেশ আরামের জীবন চলছে। ইচ্ছেমত সময়ে ডিপার্টমেন্টে যাই, ইচ্ছেমত সময়ে চলে আসি। যখন ইচ্ছে বসে আড্ডাতে রাজা-উজির মারি। উড়ে যায় কাপের পর কাপ চা, আর সিগারেটের পর সিগারেট।

বুঝতে পারি শিগগীরই এই মধুময় জীবনের ইতি ঘটবে, শুরু হবে চাকরি খোঁজার পর্ব। যে ক'দিন হাতে পাই,অনাহারী মানুষের মত চেটেপুটে খাই আমরা সময়ের প্রতিটি সেকেন্ড, প্রতিটি পল-অনুপল। এই ঘটনার সূত্রপাতও একটি রোদেলা বিকেলের আড্ডায়। বরাবরের মতো সেদিনেও কার্জন হলের সবুজ ঘাসের লনে আমরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছি। যদিও আমরা তখন "সিনিয়র ব্যাচ", তারপরেও অড্ডার বিষয়বস্তু বা ভাষা নির্বাচনে কোন "সিনিয়র ব্যাচ" সুলভ গাম্ভীর্য্য বা প্রজ্ঞার লেশমাত্রও থাকেনা।

পৃথিবীর যাবতীয় উদ্ভট জিনিসেই যেন আমাদের বেশী আগ্রহ। ভাগ্যিস-আমাদের আশেপাশে চেনা কেউ থাকেনা। থাকলে তার নিঃসন্দেহে কানে আঙ্গুল দিতো। এই প্রসংগে একটা কথা বলতে ইচ্ছে করছে। বলাই বাহুল্য, এটি আমার একান্ত ব্যক্তগত মত।

এর সপক্ষে আমার তেমন কোন শক্ত যুক্তি নেই। কেন জানিনে আজকাল মনে হয় যে যারা ছাত্রজীবনে প্রেম করে, বিশেষতঃ যারা সহপাঠিনীর সাথে প্রেম করে, তারা কিভাবে যেন ক্রমে ক্রমে তাদের বন্ধুদের থেকে একটু পৃথক হয়ে যায়। সেটি বোধকরি সময়ের স্বল্পতা হেতু। এর ফল হিসবে আমার মনে হয় তারা নিজেদেরকে কিছু সুন্দর স্মৃতি আহরণ করা থেকে বঞ্চিত করে। যেহেতু আমার বন্ধুমহলের প্রায় কেউই "প্রেমরোগে" আক্রান্ত হয়নি, তাই বোধকরি তারা সবাই মিলে তৈরী করেছিল সুরম্য একট "বান্ধব-আলয়" যার চারটি দেয়াল গাঁথা হয়েছিল ভালবাসা আর মমতা দিয়ে।

যে ঘরটিতে আশ্রয় মিলেছিল আমার মতো নড়বড়ে একটি মানুষের। বিরুদ্ধ প্রকৃতির দারুণ শৈত্য থেকে যে ঘরটি আমাকে রক্ষা করেছিল। আমি জানি, অনেকেই আমার উপরের কথাগুলো পড়ে নাক কুঁচকে বলবেন, "এ আর নতুন কথা কি? যেহেতু আপনি প্রেম করেননি (বা কেউ আপনার প্রেমে পড়েনি, আহা চুক চুক চুক), আংগুর ফলকে আপনার কাছে তো টক বলে পরিগণিত হবেই। প্রেমিকেরা হয়তো বন্ধুদের সাহচর্য্য থেকে কিঞ্চিত বঞ্চিত হয়, কিন্তু তার বিনিময়ে সে পায় প্রেমিকার সান্নিধ্যের মতো একটি দুর্লভ রত্ন। যতদিন সেটির প্রকৃত মূল্য বুঝতে না পেরেছেন তত দিন এ বিষয়ে কথা বলা ঠিক হবেনা।

" কথাটি এজন্যেই আমি বলতে চাইনি। আমি যেটা বলতে চাই, প্রায়শঃই তা ভুল ভাবে বলি, আর লোকে তার উলটো অর্থ করে ফেলে। আসলে আমি যা বলতে চাইছি, তা হোল আমি ভাগ্যবান যে আমার কাছের বন্ধুরা প্রেম করেনি। করলে হয়তো বা তাদের নিয়ে এত স্মৃতি থাকতো না আমার। যাই হোক-যা বলছিলাম।

সেদিনের সেই আড্ডায় যথারীতি চলছিল আউল-বাউল আলাপন। মনোয়ার বললো,"কেমন যেন বোরিং লাগছে। একটা ব্রেক নিতে পারলে ভাল হোত। " মিজান বললো,"কি রকম ব্রেক?" "কোন এক জায়গায় বেড়াতে গেলে ভাল হোত। " "কেন- এই না আমরা চিটাগং, কক্সবাজার, টেকনাফ ঘুরে এলাম (পর্ব-৬)।

" "সেটা ঠিক। কিন্তু দু তিন দিনের জন্যে কয়েকজনে মিলে কোথাও থেকে ঘুরে এলে মন্দ হোতনা। " ইমামুল সায় দেয়। "আসলে মনোয়ারের কথাটা কিন্তু ঠিক। আমরা আমদের দেশটাকেই ভাল করে দেখতে পারলাম না।

কত সুন্দর সুন্দর জায়গা আছে। এই ঢাকা শহরে থাকতে থাকতে কেমন যেন হাঁপিয়ে উঠছি। " আমি বলাই বাহুল্য তখন বরাবরের মতো চিৎ হয়ে শুয়ে আকাশ দেখছি আর সিগারেট খাচ্ছি। এর পরদিনই আমার বাড়ি যাওয়ার কথা। মাথার মধ্যে তখন আমি কি কি জিনিস সাথে নিতে হবে তার লিস্টি বানাচ্ছি।

এক, নোংরা জামা-কাপড়, দুই, মিনারের দেওয়া গল্পের বইগুলো, তিন, আরো নোংরা জামা-কাপড়, ইত্যাদি। ঢাকার বাইরে থেকে আসা ছেলেমেয়েদের জীবনের একটি আনন্দময় জিনিস হচ্ছে বাড়ীতে যাওয়া। তাই ছুটিছাটা এলেই মনের গহনে একটি সুর বইতে শুরু করে। যে সুখ থেকে ঢাকার ছেলেপেলেরা বঞ্চিত হয়। তাদের কাছে ছুটি জিনিসটাই বোরিং, শুধু চুপচাপ বাড়িতে বসে থাকা।

সে আমলে তেমন কিছু আর করবারও ছিলনা। আগের সপ্তাহেই ছোট ভাই মিনারের (পর্ব-১২) চিঠি এসেছে। "দাদা- ছুটি শুরু হলেই চলে এসো। কয়েকটা দারুন গল্পের বই জমিয়ে রেখেছি তোমার জন্যে। " এবার অনেক দিন বাড়ী যাওয়া হয়নি।

ঢাকা থেকে খুলনা যেতে হয় বাসে করে। মাঝে পড়ে পদ্মা নদী, ফেরীতে করে নদী পেরোতে হয়। নদী পার হলেই মনে হয় এইতো এসে গেছি। আমি মনে মনে দেখতে পাই যে রিকশা থেকে নেমে কোনমতে ব্যাগটাকে টানতে টানতে ঢুকে পড়ছি বাড়ীতে। মা কে বলছি,"মা-খিদে লেগেছে।

যা আছে তাই দাও। " মা হাসছেন আমার কথা শুনে। ছোট বোনটা ইতিমধ্যে আমার ব্যাগ খুলে সেখানে নোংরা জামাকাপড়ের বহর দেখে ছদ্ম ঘেন্নায় নাক কুঁচকে আছে। "কিরে-তুই কার কথা ভাবছিস?" পেটে আকস্মিক খোঁচা খেয়ে আমার চিন্তার ব্যাঘাত ঘটে। ধড়মড় করে উঠে বসি।

দেখি আলমগীর দাঁত বের করে হাসছে। "তুই কি ভাবিস বলতো দেখি। তোকে আমরা সেই কখন থেকে ডাকছি। " "আমি আছি আমার মনে। তোরা ফালতু দেন-দরবার করছিস, করতে থাক।

আমাকে নিয়ে টানাটানি কেন?" "আছে, দরকার আছে। " "কি দরকার বল। " এই পর্যায়ে মনোয়ার আলাপে ঢুকে পড়ে। "তোর বাড়ী না খুলনায়?" "হ্যাঁ-তাতে কি হয়েছে?" "সুন্দরবনটাতো খুলনাতেই, নাকি?" "তাইতো জানতাম। ইদানিং কালের মধ্যে যদি সেটা মুভ না করে থাকে।

" "বেশী ফাজলামী করবি না। যা জিজ্ঞেস করছি তার জবাব দিবি শুধু। " "আচ্ছা-ঠিক আছে। বেশী ফাজলামী করবো না, কম ফাজলামী করবো। তোর এই জাতীয় ইন্টারোগেশনের কারণটা কি একটু জানতে পারি?" "আমরা প্ল্যান করছি কোথায় কয়েকদিনের জন্য বেড়াতে যাবার।

সুন্দরবনটাও আমাদের লিস্টে আছে। " "তা আমি কি করবো? আমি তো কালই বাড়ী চলে যাচ্ছি। " "তুই কি করবি মানে? আমরা যদি খুলনাতে যাই তাহলে তুই আমাদেরকে সুন্দরবন দেখানোর বন্দোবস্ত করবি। কি পারবি না?" "পারবো না কেন? খুলনার ছেলে আর সুন্দরবন দেখাতে পারবো না এটা কোন একটা কথা হোল?" "গুড। " আমি আবার শুয়ে পড়ি।

এইসব কথার কোন মানে হয়না। এইজাতীয় প্ল্যান আগেও বহুবার করা হয়েছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই হয়নি। শুধু একবার আমরা সোনার গাঁ বেড়াতে যেতে পেরেছিলাম। আমাদের দৌড় ওই পর্যন্তই। আর এনারা যাবেন সুন্দরবন? গুলিস্তান বাস স্টেশন পর্যন্ত যেতেই এরা পথ হারিয়ে ফেলবে।

সেবার বাড়ীতে যাওয়ার দুদিন পর খবর পেলাম হঠাৎ করে বাস ধর্মঘট শুরু হয়েছে। বেশ সিরিয়াস বলেই মনে হোল, শিগগীর মিটমাট হবে বলে মনে হচ্ছেনা। মা বললেন, "এই সুযোগে থেকে যা আরো কিছুদিন। তোর তো দেখাই পাইনা একদম। " মিনার মহা উৎসাহে আরো একগাদা বই এনে নামিয়ে দিলো বিছানার উপরে।

আমাদের বাড়ীতে তখন একটি নতুন কাজের লোক রাখা হয়েছে। সেই মহিলার একটি ছোট মেয়ে আছে। মেয়েটির বয়েস হয়তো চার কি পাঁচ বছর হবে। তার নাম খাদিজা, সংক্ষেপে খাদি। তার মাকে সবাই 'খাদির মা' বলেই ডাকে।

খাদি মেয়েটি খুবই শান্ত। তার তিনটি বৈশিষ্ট্য আমি খেয়াল করলাম। মেয়েটি দেখতে গোলগাল, তার গায়ের রং কচকুচে কালো, আর তার চোখজোড়া বড়বড়। সারাদিন সে ঘরের কোণায় চুপ করে বসে থাকে আর বড়বড় চোখ মেলে সবাইকে দেখে। মাঝে মাঝে তার মা তাকে ডেকে বলে,"খাদি-মামাদের জন্য চা নিয়ে যা।

" মেয়েটি এই কাজটি করতে পেরে বড়ই খুশী হয়। সে দৌড়ে চলে যায় রান্নাঘরে চায়ের কাপটি আনবার জন্য। একদিন আমি একা ঘরে বসে বই পড়ছি। খাদি যথারীতি চা নিয়ে এলো। টেবিলের উপর কাপটি রেখে বললো,"বেইমান মামা-আপনার চা।

" কথাটি শুনে আমি চমকে উঠলাম। চোখ তুলে তাকিয়ে দেখি ততক্ষণে খাদি ঘর ছেড়ে চলে গেছে। বেইমান মামা? আমি বেইমান হলাম কিভাবে? নাহয় আজকাল বেশী ঘনঘন বাড়ী আসতে পারিনা, কিন্তু তাই বলে সবাই আমাকে বেইমান হিসেবে ভাববে। অভিমানে আমার মনটা বিষন্ন হয়ে গেল। পরে মাকে বললাম,"তোমরা কি আমার উপরে রেগে আছো?" মা বলাবাহুল্য এ কথায় সাত হাত পানির নীচে।

"কেন রাগবো কেন?" "তাহলে খাদি আমাকে বেইমান মামা বলে ডাকছে কেন? নিশ্চয়ই তোমরা আমার সম্পর্কে খারাপ কিছু একটা বলেছো। " দুঃখে আর অভিমানে আমার গলা বন্ধ হয়ে আসে। মা প্রতিবারের মত আমার এই কথাতেও হাসেন। কি প্রচন্ড ধৈর্য্যশীলা এই মহিলা। তার কথা অন্যকোথাও বলবো, এখন তার কথাতে গেলে খামাখা চোখে পানি আসবে।

মা হেসে বলেন,"খাদি তোকে বেইমান বলে কেন ডাকবে? সে তো তোকে দেখেনি আগে, সে ভেবেছে তুই এখানে বেড়াতে এসেছিস। তাই সে তোর নাম দিয়েছে মেহমান মামা, সেটাই তোর কানে বেইমান মামা শুনাচ্ছে। " আমি আশ্বস্ত হই। কয়েকদিন পরের কথা। বাস ধর্মঘট জমে উঠেছে।

আমি খুশী, পরিবারের সবাই খুশী। কোথাও যেতে হচ্ছেনা আপাততঃ। খাই-দাই, ঘুমাই আর রাত জেগে বই পড়ি। স্বর্গীয় জীবন। সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরী হয়।

গাঢ় ঘুমে জড়িয়ে থাকে চোখ। কড়া রকমের ডাক ছাড়া ঘুম ভাঙেনা। তাই খাদির নীচু গলার এক ডাকে ঘুম যায়না। সে অবশ্য থামেনা। সে ডেকেই যায়।

"বেইমান মামা-উঠেন। বেইমান মামা-উঠেন। " এক সময় উঠতেই হয়। মহা বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করি। "কি চাস এত সকালে?" সে ভয়েভয়ে বলে,"বেইমান মামা- আপনাকে বাইরে একজন ডাকে।

" খুলনাতে আমার কিছু স্কুলের বন্ধু আছে যারা সময় অসময় নেই এসে হাজির হয়। কোনমতে চোখেমুখে একটু পানি দিয়ে নীচে নামি। কোন ইডিয়েট এত সকালে এলো দেখি? বাইরে একজন না, ছয়জন। প্রত্যেকে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আস্তে আস্তে তাদের চেহারাগুলো কেমন যেন চেনা চেনা লাগে।

মিজান, শফিউল, ইমামুল, আলমগীর, মনোয়ার আর জামাল। এরা এখানে কি ভাবে এলো? আমি কি জেগে জেগেই স্বপ্ন দেখছি নাকি? ওরা আমাকে দেখে হাসতে থাকে। আমি ভ্যাবলার মত তাকিয়ে থাকি। "কিরে তোরা? এখানে?" জামাল বললো,"হ্যাঁ-সুন্দরবন দেখতে চলে এলাম। তুই না বললি সব ব্যবস্থা করে দিবি।

" যদিও খুলনা শহরেই আমার বেড়ে ওঠা, কিন্তু আমার চৌদ্দগুষ্টির কেউই জানেনা কিভাবে সুন্দরবন যেতে হয়। আতংকে আমার সারা শরীর ঘেমে ওঠে। এখন কি হবে? (বাকী অংশ পরের পর্বে। )

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।