যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।
সর্বদাবেলায়েত লিখিত কয়েকটি পোস্ট দেখে মনে হোল যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে কিছু একটা লেখা দরকার। এটা এক ধরণের ঋণ-স্বীকার বলতে পারেন। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে।
আজকের পর্বের শুরুটা করি আশির দশকের মাঝামাঝি একটি সময়ে।
ততদিনে আমার ঢাকার পড়াশুনার পাট শেষ এবং তখন আমি আমেরিকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েট স্টুডেন্ট। সেই সেমেস্টারে একটা কঠিন কোর্স নিয়েছি। বিষয়টা ছিল ডিএনএ অণুর গঠনমালার বিভিন্ন দিক। পুরো ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রি। যিনি পড়াচ্ছিলেন তিনি (আজ তিনি বেঁচে নেই) ছিলেন কিছুটা সাধু প্রকৃতির মানুষ।
শুনেছি তাঁর নাকি এক ভারতীয় গুরুও ছিল। সেভেন হান্ড্রেড লেভেল ক্লাশ, ছাত্র সংখ্যা বেশী নয়, গোটা বারো হয়তো হবে। আমি কাউলা বাদে সবাই সাদা আমেরিকান।
যাই হোক, ক্লাশের প্রথম দিনেই টের পেলাম কোর্সটি ভয়াবহ রকমের কঠিন। কিন্তু কি আর করা? পীর-মুর্শিদের নাম নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লাম।
গরীব দেশের অশিক্ষিত মানুষ বলে ক্লাশের অন্য ছাত্ররা বেশী পাত্তা দেয়না আমাকে। কবিগুরুর "একলা চলো রে" গানই তখন সকাল-সন্ধ্যার বীজমন্ত্র। সেই ভরসায় চলতে শুরু করলাম। কিছুদিন পর দেখি, প্রফেসর যা পড়াচ্ছেন তা আমি বেশ ভালই বুঝতে পারছি। অন্যদের মুখের দিকে তাকানো যায়না।
এমনই করুণ অবস্থা। আমি মনেমনে মিটিমিটি হাসি। এখন কেমন বুঝতাছেন, ভাইজান?
ফাইনাল পরীক্ষার রেজাল্ট বার হ'বার পর কান্নাকাটি অবস্থা। আমিই একমাত্র 'এ' পেয়েছি, অনেকেই পাশ করতে পারেনি। বোঝা গেল সাধুবাবার লেকচার সবারই মাথার উপর দিয়ে চলে গেছে।
পরে মেকআপ টেস্ট দিয়ে কোনমতে মান বাঁচলো সবার।
তারপর বেশ কয়েক মাস কেটে গেছে। একদিন আমি আর আমার এক আমেরিকান বন্ধু বব ডিপার্টমেন্টের করিডরে হাঁটছি। বব বললো যে সে একটু ঐ প্রফেসরের সাথে কথা বলতে চায়। কেন, জানতে চাইলাম।
উত্তরে বব একটু মুচকি হেসে বললো যে প্রফেসরের নাকি একটা সুন্দরী মেয়ে আছে, এবং বব মেয়েটির প্রতি একটু দুর্বল। তাই সে সুযোগ পেলেই প্রফেসরের সাথে নানান বাহানায় খেজুরে আলাপ করে থাকে। অতএব তার সাথে গেলাম।
একথা সেকথার পর বব বললো, 'তা তোমার মেয়ের খবর কি?'
প্রফেসর বললো,'ভালই। তবে সে কোন কলেজে পড়বে সেটা নিয়েই বেশ টেনশনে আছে।
'
'কোথায় তাকে পাঠাতে চাও তুমি?' প্রেমিকার সম্ভাব্য অন্তর্ধানের আশংকায় ববের মুখ শুকিয়ে আসে।
'আমি যেখানে তাকে পাঠাতে চাই সেখানে কি আর ও চান্স পাবে?'
'কি বলো? ও এতো ভাল ছাত্রী। কি এমন স্কুল যেখানে সে চান্সই পাবেনা?'
প্রফেসর মৃদু হাসেন। তারপর আমার দিকে আংগুল তুলে বললেন, 'ও যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসেছে, আমার খুব ইচছা মেয়েটিকে সেখানে পাঠানোর। নির্বাসিত, তোমার কি মনে হয় তোমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নেবে আমার মেয়েটিকে?'
কথাটা শুনবার পর বুকের মধ্যে কি যেন একটা আটকে গিয়েছিল।
কান্না পাচ্ছিল কেন যেন। আর কোন কিছুই কানে যাচ্ছিলনা তখন।
শুধু মনে পড়ছিল লাল ইঁটের কার্জন হল। কৃতগ্গতার সাথে স্মরণ করলাম আমার শিক্ষকদের। কত কষ্ট করে তাঁরা আমাকে এইসব শিখিয়েছেন।
ভাল বই ছিলনা, জার্নাল ছিলনা, ল্যাবে কেমিক্যালস ছিলনা। ব্ল্যাকবোর্ডে টানা ইকুয়েশন লিখতে লিখতে চকের গুঁড়োয় ভরে গেছে তাঁদের গায়ের জামা। তবুও একটু একটু করে হাতে ধরে কত না মায়ায় শিখিয়েছেন আমাদের।
সেদিন আমার আমেরিকান প্রফেসর তার একটি ছোট্ট কথায় আমার প্রিয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর তার শিক্ষকদের মাথায় এমন একটি মুকুট পরিয়ে দিলেন, যার হীরক-দ্যুতি চিরটা কাল আমার মনে আলো ছড়াবে।
আমি আমার সমস্ত শিক্ষকদের মনেমনে কদমবুসি করলাম।
স্যারেরা, অনেক অনেক ধন্যবাদ আমাকে শিক্ষাদানের জন্য।
পর্ব-২
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।