যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।
অকালমৃত বন্ধু চঞ্চলের উপর আমার লেখা (নির্বাসিতের আপনজন। পর্ব-৫) পড়ে দু একজন জানতে চেয়েছেন যে আমার করা প্রতিজ্ঞা মোতাবেক আমি চঞ্চলের জন্য পরে কোন "অবিচুয়ারী" লিখেছিলাম কিনা। তার উপর আমি দুটো লেখা লিখেছিলাম। প্রথমটি একটি স্মৃতিচারণ টাইপের লেখা ("হৃদয়ে চন্দনের সুবাস"), আর পরেরটি তাকে উত্সর্গীকৃত একটি কবিতা ("কেউই চেনেনি তাকে")।
দুটো লেখাই প্রকাশিত হয়েছিল। আজ দুটো লেখাই এখানে পর্ব-৫ এর (বিস্তৃত) ফুটনোট হিসেবে দিয়ে দিলাম। উৎসাহীরা পড়ে দেখতে পারেন।
হৃদয়ে চন্দনের সুবাস
তার রুক্ষ এলোমেলো চুলে জমাট বেঁধে ছিল শ্রাবণের মেঘ। দীপ্ত চোখের তারায় সোনালী মাছের মতো খেলা করতো প্রেম এবং এক অদ্ভুত ধরনের বিরহ।
একটি অসামান্য হৃদয়কে বুকে নিয়ে চারপাশকে অনায়াসে পূর্ণ করতো সে। সাহিত্যের প্রতি অপার বিশ্বস্ততা, প্রকৃতিকে ভালবাসার মতো দুর্লভ অনুভূতি এবং স্বাধীনতার হীরকখন্ডকে আঙ্গুলে পরার মতো স্পর্ধা ছিল তার। সেই মানুষটির নাম চঞ্চল। আমাদের বাঁধাধরা জীবনের মধ্যে একটি চমকে দেওয়া ব্যতিক্রম।
একসাথে পড়াশোনা করেছি বিশ্ববিদ্যালয়ে, বাজি রেখে কবিতা লিখেছি।
সে ইংরেজীতে, আমি বাংলায়। একুশে ফেব্রুয়ারীতে বাংলা একাডেমীতে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে কবিতা পড়েছি। স্কুল মাস্টারীর জীবনেও সে ছিল আমার সহকর্মী। শাহবাগের কোণায় ছোট্ট রেস্তোরাঁতে বসে চা-সিঙ্গাড়া ধ্বংশ করে সন্ধ্যের আবছায়াতে হাঁটতে হাঁটতে দুজনে একসাথে গেছি ওদের বাসায়। তার মায়ের প্রথমে বকুনি এবং পরে চমত্কার রান্না ভাগাভাগি করেছি।
মোহাম্মদপুরের বন্ধু শওকতের বাসায় রাত জেগে আড্ডা দিয়ে, তার সাথে হেঁটে নিউমার্কেট চলে গেছি পনির খেতে। বাসের প্রচন্ড ভিড়ের মধ্যেও তার রসিকতায় হেসেছি প্রাণ খুলে। আমার ঢাকার শেকড়বিহীন জীবনে ধ্রুবতারার উজ্জ্বলতায় সে দিয়েছিল সাহচর্য্য, সান্ত্বনা এবং আনন্দ। বিনিময়ে নেয়নি কিছুই।
প্রচুর লিখতো সে।
দুহাতে লিখেছিল কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ। তার দুঃখ ভালবাসার রংধনুর সাতটি রং দিয়ে সে অনায়াসে সাজিয়ে গেছে শব্দ, মানুষকে দেবার জন্য এইই ছিল তার উপহারের সর্বোত্তম আবীর। মনে আছে, আমাদের বিভাগের একজন সামান্য অথচ সত্ কর্মচারীকে নিয়ে তার লেখাটির কথা। বৃদ্ধ এবং অবহেলিত একট সত্যনিষ্ঠ প্রাণকে সে দিয়েছিল উত্সাহ। চঞ্চলকে কি তিনি কোনদিন ভুলতে পারবেন?
ভিতরে ভিতরে কি এক অজানা কষ্ট নিয়ে বেঁচে ছিল সে।
সেই যন্ত্রণার জগতে কেউ আসেনি সন্ধ্যাদীপ নিয়ে। আমি জানি, কতটা নিঃসঙ্গতায় ডুবে ছিল সে। দিনের পর দিন প্রতীক্ষা করেছে তার শূন্য ঘরের চৌকাঠে কারো পদধবনির, প্রতিদিন ভোরে কারো হাতের কোমল স্পর্শের জন্য কাঙ্গাল হয়ে ঘুম ভেঙ্গেছে তার। মানুষ ক্রমাগত দূরে সরে যাচ্ছিল, নির্বাসিত হবার দূঃখ আবৃত করছিল তাকে ক্রমশঃ। তেমনি এক একাকী ভুবনে তবুও সে পথ হেঁটেছে কবি হবার প্রদীপ্ত অহংকারে, সাহিত্যই ছিল তার দিনরাতের একমাত্র অংশীদার।
বাইরের রংচঙ্গে মোড়কে সে ঢেকে রেখেছিল তার বিক্ষত হৃদয়টিকে। বিন্দুমাত্র টের পায়নি কেউ। তবুও মাঝে মাঝে বিদ্যুত চমকের মতো আচমকা হতাশার ম্লান ছায়া স্পর্শ করে যেতো তার কণ্ঠস্বরকে।
তার রক্তে তখন ক্ষয়রোগের বীজ। বোহেমিয়ানের সাবলীলতায় সে অগ্রাহ্য করে গেছে সেই অশুভ সংকেত।
হয়তো বুঝেছিল সে। হয়তো শুনেছিল এক অলৌকিক ঘন্টধবনি, যে ডাকে আমাদের সাড়া দিতেই হয়। আমাকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করিয়েছিল তাকে নিয়ে লেখা জন্য। আশ্চর্য্য- আমরা তবুও কিছুই বুঝিনি।
সে আমাদের হারিয়ে দিয়ে চলে গেল অনায়াসে।
তার উষ্ণ হৃতপিন্ডে মৃত্যুর ঠোঁট চুমু রেখেছিল, সে স্পর্শে ছিল বিষ। একটি ছোট্ট ঘরের জন্য, শান্ত মায়াবী দুটি চোখের জন্য, কবিতা আবৃত্তির নরম ঠোঁটের জন্য, নিঃশ্বাস নেবার সুগন্ধী চুলের অরণ্যের জন্য যে মানুষটি বড় একা হয়ে গিয়েছিল, সে অবশেষে আমাদেরকেও যেন শূন্য করে দিয়ে চলে গেল। বোধের অন্তর্গত সমস্ত সম্পদ হারিয়ে আমরাও দেউলে আজ।
অনুষ্ঠান শেষ হলে যেমন বাতাসে রয়ে যায় আগরবাতির ঘ্রাণ, পোড়া সিগারেটের টুকরো, কিংবা নারীর ভুলে ফেলে যাওয়া সুগন্ধী রুমাল, তেমনি কিছু কিছু মানুষ চলে গেলেও রেখে যায় কিছু না কিছু। চঞ্চল তেমনিই একজন।
এখনো চোখ বন্ধ করলে তার হাসির শব্দ শুনি, শুনি কবিতা আবৃত্তির মন্দিরা ধবনি। স্মৃতির আগুনের আঁচে পুড়তে থাকে হৃদয়। তবুও সবকিছু ছাপিয়ে টের পাই তার অস্তিত্বের সুবাস।
কেউই চেনেনি তাকে
(চঞ্চলকে উৎসর্গীকৃত)
কেউই চেনেনি তাকে
রমনার ছায়াঢাকা নিজস্ব পথ ধরে হেঁটে যেত সে
তার রুক্ষ চুলে চুরি করে চুমু খেতো বাতাস
কৃষ্ণচূড়ার লাল প্রসাধন দেখে আনন্দে চোখে জল আসতো তার
ঘাসে মাথা রেখে ঝিঁঝিঁর সংগীত শোনা তার বড় প্রিয় ছিল
কেউই চেনেনি তাকে
না নিজস্ব পথ, না হাওয়ার মসৃন ঠোঁট, না কৃষ্ণচূড়ার রূপের আগুন
কেউই তাকে চিনতে পারেনি।
কেউই চেনেনি তাকে
একটি মেয়ের জন্য সে ভালবাসার কবিতা লিখতো
একটি নারীর শরীরে সে তার স্পর্শ রেখেছিল
একটি কিশোরীকে সে বলেছিল, "ভালবাসি তোমাকে"
একটি রমণী তাকে চেয়েও পায়নি
এরাও কেউ চেনেনি তাকে
না ভালবাসার স্পর্শ, না কিশোরীর অপাপবিদ্ধ হৃদয়, না রমণীর দেহের সুবাস
কেউই তাকে চিনতে পারেনি।
কেউই চেনেনি তাকে
আড্ডাতে বেশী কথা না বলেও বেশ জনপ্রিয় ছিল সে
জীবনের মতোই ঐশ্বর্য্যবান ছিল তার কবিতা
বই পড়তে পড়তে সে আনমনে গুণগুণ করতো সংগীত
চা ভাল হলে রেস্তোঁরার বেয়ারা বখশিস পেতো কিছু
কেউই চেনেনি তাকে
না সহৃদয় বন্ধুবর, না কবিতার পংক্তিমালা, না ছোকরা বেয়ারা
কেউই তাকে চিনতে পারেনি।
কেউই চেনেনি তাকে
শুধু সে চলে যাওয়ার পর সবাই বুঝলো
কিছু কিছু মানুষ বড় রহস্যময়ভাবে হঠাত্ শূন্যতা সৃষ্টি করে ফেলে।
আশ্চর্য্য-তখনো কেউই তাকে চিনতে পারেনি।
পর্ব-৬(ক) পড়তে ক্লিক করুন
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।