“বিচার চাই না, বাঁচতে চাই”
জাহাঙ্গীর আলম আকাশ
চরম অন্যায় আর অবিচারের শিকার একজন নির্যাতিত সংবাদকর্মী আমি। বাংলাদেশের একজন সংবাদপত্রসেবী ও মানবাধিকারকর্মীকে কথিত চাঁদাবাজির অভিযোগে গ্রেফতার ও নির্যাতনের ঘটনা সা¤প্রতিককালে বিরল। পেশাগত কারণে সুগভীর ষড়যন্ত্র আর একের পর এক মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে হয়রাণি করা হয়েছে আমাকে। এবং এ ধারা এখনও অব্যাহত আছে। স্কুলজীবনে ১৯৮৯ সালে সাংবাদিকতা নেশার সঙ্গে যুক্ত হই।
দৈনিক বাংলা, আজকের কাগজ, একুশে টেলিভিশন, এসোসিয়েটেড প্রেস অব বাংলাদেশ, সিএসবি নিউজ’র সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় হতে দর্শন বিষয়ে বিএ সম্মানসহ এমএ ডিগ্রি ও একই বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ বিষয় হতে পোস্ট গ্রাজুয়েট ডিপ্লোমা ইন সিভিক জার্নালিজম ডিগ্রি নিয়ে সাংবাদিকতাকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করি।
আমি রাজশাহী সাংবাদিক ইউনিয়নের নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক। ‘দৈনিক সংবাদ’র রাজশাহী ব্যুরো প্রধান এবং রেডিও জার্মান ডয়েচেভেলের ফ্রি-ল্যান্স সংবাদদাতা হিসেবে কর্মরত। পাশাপাশি মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব হিউম্যান রাইটস-বিআইএইচআর এর আঞ্চলিক সমন্বয়কারীর দায়িত্ব পালন করি।
পেশাগত কারণে চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ-সুবিধাবাদী গোষ্ঠী আমার ওপর ুব্ধ ছিল। এই দলভুক্তরা আমাকে বেকায়দায় ফেলার উছিলা খুঁজতে থাকে। গত জুন, ২০০৭ মাসের শুরুতে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের সূত্রপাত ঘটে। কিন্তু সিএসবি নিউজ’র স¤প্রচার বন্ধ হয়ে যাবার পর এই ষড়যন্ত্রের ডালপালা গজাতে থাকে। এর সাথে রাষ্ট্রীয় একটি বিশেষ বাহিনীর একজন কর্মকর্তার ব্যক্তিগত রাগও যুক্ত হয়।
তারই অংশ হিসেবে ৫০ হাজার টাকা চাঁদাবাজির অভিযোগ এনে আমার নামে একজন ঠিকাদার একটি মামলা করেন। যে মামলায় আমি উচ্চতর আদালত থেকে অন্তবর্তীকালীন জামিন লাভ করি। কিন্তু তারপরও আমাকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর আরও দু’টি চাঁদাবাজির মামলা চাপানো হয় আমার নামে। সংবাদপত্র ও গণমাধ্যম সংশ্লিষ্ট ছাড়াও দেশের সচেতন নাগরিক সমাজ ও বর্তমান সরকারের নীতিনির্ধারক মহলের কাছে আমার ওপর অবিচারের কাহিনী তুলে ধরাই আমার এই লেখার মূল উদ্দেশ্য।
আমি লেখক নই। সঙ্গত কারণে আমার লেখায় অনেক ত্র“টি থাকবে। সচেতন পাঠক এটা মা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন বলে আশা রাখি। দুর্নীতি, খুনি-ধর্ষক আর মানবাধিকার লংঘণের বিরুদ্ধে রিপোর্ট পরিবেশন করার একমাত্র কারণে আমার জীবন আজ চরম হুমকির সম্মুখিন। আমার নামে কেন চাঁদাবাজির সিরিজ মামলা, তা নিয়েই সর্বপ্রথমে আলোচনা করে নেয়া যাক।
রাজশাহীর বহুল আলোচিত একটি এস্টেট ‘দেলোয়ার হোসেন ওয়াকফ্ এস্টেট’। এই এস্টেট পরিচালনায় দুর্নীতির অভিযোগ রাজশাহীর কারও অজানা নয়। এনিয়ে আদালতে একাধিক মামলাও রয়েছে। ‘সংবাদ’ এ ২০০২ সালের ৯ এপ্রিল ‘রাজশাহীর দেলোয়ার হোসেন ওয়াকফ্ এস্টেট ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ নিয়োগ করা হয়েছে নতুন মোতাওয়াল্লী’ ও ২০০৬ সালের ১৭ ডিসেম্বর ‘দেলোয়ার হোসেন ওয়াকফ্ এস্টেট রাজশাহীতে নয়া মুতাওয়াল্লীকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়েছে পুলিশ’ শীর্ষক দু’টি খবর প্রকাশিত হয়। যা ছিল আমার পরিবেশিত।
সিএসবি নিউজ’ এ গত ২৫ এপ্রিল উত্তরাঞ্চলে ওয়াকফ্ এস্টেটগুলো বেহাত হয়ে যাচ্ছে শিরোনামে আমার পরিবেশিত একটি প্রতিবেদন প্রচারিত হয়। যাতে ওঠে আসে রাজশাহীর দেলোয়ার হোসেন ওয়াকফ্ এস্টেট পরিচালনায় দুর্নীতির অভিযোগ। এরই প্রেেিত এই ওয়াকফ্ এস্টেটের মোতাওয়াল্লী আবদুস সামাদের পুত্র মাহফুজুল আলম লোটন বাদি হয়ে আমার নামে চাঁদাবাজির অভিযোগ এনে মামলা করেন। দুর্নীতির দায়ে আবদুস সামাদ এস্টেটের মোতাওয়াল্লীর পদ থেকে অপসারিত হয়েছিলেন।
জনাব লোটন ২০০১ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে আওয়ামী লীগে যোগ দেন।
এর আগে ২০০০ সালের ৪ মার্চ ‘সংবাদ’ এ ‘ঘটনাস্থল রাজশাহী সন্ত্রাসীদের ভয়ে দু’টি পরিবার ঘর থেকে বেরুতে পারছে না। মামলা হয়েছে পুলিশ চুপচাপ’ শীর্ষক শিরোনামে একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল। যেটিও ছিল আমার পরিবেশিত। এরই প্রেেিত জনাব লোটন আমাকে শায়েস্তা করতে সন্ত্রাসী বাহিনী পাঠান। কিন্তু তার ক্যাডাররা ভুলবশত দৈনিক যুগান্তরের তৎকালীন প্রতিনিধি জনাব উত্তম কুমার দাসকে আহত করে।
এ ঘটনার পর আমি বোয়ালিয়া থানায় জিডি করি (জিডি নং-৩১০, তারিখ-০৭/০৩/২০০০)। এছাড়া জনাব লোটন প্রতারণা ও জালিয়াতির অভিযোগেও অভিযুক্ত। তিনি রাজপাড়া থানার মামলা নম্বর-১০, তারিখ-৭/১০/২০০৭, ধারা-৪৬৬/৪৬৮/৪৭১/৪০৬ দ.বি. এর চার নম্বর আসামি।
পেশাগত শত্র“তার বাইরেও জনাব লোটনের সঙ্গে একটি দ্বন্দ্ব আছে আমার। সেটি হলো আমার শ্বশুর এডভোকেট জনাব তাজুল ইসলাম মোহাম্মদ ফারুক।
তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ রাজশাহী জেলা শাখার বর্তমান সভাপতি। আর জনাব লোটনের ভাইপো জনাব এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন, রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্য। আমার শ্বশুরের সঙ্গে জনাব লিটনের র্দীঘদিন ধরে রাজনৈতিক গ্র“পিং চলে আসছে। ‘জামাই হিসেবে আমাকে অপমান-অপদস্ত করতে পারলে শ্বশুরকে কৌশলগতভাবে ঘায়েল করা যায়’ এমন কারণেও ‘নব্য আওয়ামী লীগার’ চাচাকে দিয়ে আমার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির মিথ্যা অভিযোগে মামলা করানো হয়েছে। এ বিষয়টি এখন রাজশাহীর মানুষের মুখে মুখে।
রাজশাহীর বোয়ালিয়া মডেল থানায় গত ২০ জুন, ২০০৭ জনাব লোটনের দাখিল করা এজাহার পুলিশ জিডি হিসেবে রেকর্ড করে (জিডি নং-১১৬০, তারিখ-২০/৬/২০০৭)। এর দীর্ঘ প্রায় চার মাস পর গত ২ অক্টোবর একই থানায় জিডির হুবহু একটি কপি এজাহার হিসেবে দাখিল করা হয়। যা মামলা হিসেবে রেকর্ড করে পুলিশ (মামলা নং-২, তারিখ-২/১০/২০০৭, ধারা-৩৮৫/৩৮৬ দ.বি.)। এই মামলায় গত ১৬ অক্টোবর আমি উচ্চতর আদালত থেকে অন্তবর্তীকালীন জামিন গ্রহণ করি। ২৩ অক্টোবর দিবাগত রাত দেড়টার পর সিভিল পোশাকধারী র্যাব সদস্যরা আমাকে গ্রেফতার করে আমার উপশহরস্থ ভাড়া বাসা হতে।
আমাকে গ্রেফতারের আগে আমার নামে পুঠিয়া থানায় দ্বিতীয় চাঁদাবাজির মামলা করা হয়। মামলা নম্বর- ১৩, তারিখ-২৩/১০/২০০৭, ধারা-৩৮৫/৩৮৭/৫০৬ দ.বি.। এই মামলার বাদি স্থানীয় বিএনপি সমর্থক জনাব আবদুল জলিল। ২০০২ সালের ১৯ এপ্রিল তার ছেলে ছাত্রদল ক্যাডার হারুণ কিশোরী ধর্ষণের ঘটনায় জনতার হাতে আটক হয়েছিলেন। এই ধর্ষণ মামলা আপোস করার জন্য বাদি আওয়ামী লীগ কর্মী জনাব আবদুল হালিমকে চাপ দেয়া হয়।
কিন্তু মামলা আপোস করতে ব্যর্থ হয়ে জিলাপির ভেতরে বিষ মিশিয়ে খাওয়ায়ে হালিমকে হত্যা করা হয় বলে অভিযোগ ওঠে। এই চাঁদাবাজি মামলার বাদি জনাব জলিল পুঠিয়ার চাঞ্চল্যকর শিউলি ধর্ষণ মামলার বাদিকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করার অভিযোগে দায়ের করা মামলার প্রধান আসামি (পুঠিয়া থানার মামলা নং-৭, তারিখ-৯/৫/২০০৫, জিআর নং-৯৯/২০০৫, অভিযোগপত্র নং-১৩৬, তারিখ-১২/৮/২০০৫, ধারা-৩০২/৩৪ দ.বি.)। ২০০২ সালের ১৯ এপ্রিল সংঘটিত চাঞ্চল্যকর ধর্ষণের ঘটনা এবং আবদুল হালিম হত্যাকান্ড নিয়ে ‘সংবাদ’ এ বহু খবর পরিবেশন করেছি আমি।
পুঠিয়া থানা বিএনপির সভাপতি ও পুঠিয়া পৌরসভার সাবেক প্রশাসক আবদুল লতিফ বিশ্বাস আমার নামে চাঁদাবাজির তৃতীয় মামলাটি করেন গত ২৫ নভেম্বর। পুঠিয়া থানার মামলা নম্বর- ২৮, তারিখ-২৫/১১/২০০৭, ধারা-৩৮৫/৫০৬ দ.বি.।
এই মামলার বাদি একটি চাঞ্চল্যকর হত্যা প্রচেষ্টা, ভাংচুর ও চাঁদাবাজি মামলার অন্যতম প্রধান আসামি। জনাব লতিফের বিরুদ্ধে পুঠিয়া থানার মামলা নম্বর-৩, তারিখ- ২/৭/২০০৭ (জিআর-১৫২/২০০৭) ধারা-১৪৭/৩২৩/৩২৫/৩০৭/৩৮৫/৪২৭/১১৪ দ.বি.। পুঠিয়ায় তাড়ির ভাটি উদ্বোধনের অভিযোগে জনাব লতিফের বিরুদ্ধে আমার পরিবেশিত একটি রিপোর্ট ‘সংবাদ’ এ প্রকাশিত হয়েছিল ২০০৩ সালের ২৩ আগস্ট। এরই প্রেেিত জনাব লতিফের রাজনৈতিক সহচর মমতাজুল আলম আমার ও ‘সংবাদ’ এর সম্মানিত সম্পাদক জনাব বজলুর রহমানের নামে একটি মানহানি মামলা করেছিলেন। যে মামলায় আমরা আদালতের মাধ্যমে খালাস পেয়েছি।
গ্রেফতারের পর আমাকে যে নির্যাতন করা হয়েছে তা আপনাদের জানানোর প্রয়োজন বোধ করছি। আমি, আমার সহধর্মিনী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ফারহানা শারমিন এবং আমাদের পাঁচ মাসের (গ্রেফতারের সময়কার বয়স) শিশুপুত্র ফিমান ফারনাদ এই তিনজন বসবাস করি রাজশাহী মহানগরীর ৫৫/২ উপশহরের ভাড়া বাসায়। গত ২৩ অক্টোবর দিবাগত রাতের ঘটনা। আমরা ঘুমিয়ে ছিলাম। রাত আনুমানিক দেড়টায় কলিংবেল বেজে ওঠে।
বিরামহীনভাবে কলিংবেল বাজায় আমাদের ঘুম ভেঙ্গে যায়। আমি ও আমার স্ত্রী ঘরের দরজা খুলে বারান্দায় বেরিয়ে আসি। এসময় আমার কোলেই ছিল শিশুপুত্র ফারনাদ। র্যাব সদস্যরা বাড়ি ঘিরে ফেলে। তিনতলা বাড়ির তিনতলা থেকে বাড়ির মালিক জনাব আবুল কাশেম ও তার পুত্র লিখন নিচে নেমে আসেন।
সিভিল পোশাকধারী ১০/১২ জন সশস্ত্র লোক আমাদেও বারান্দার দরজার কাছে আসেন। তারা নিজেদেরকে প্রশাসনের লোক পরিচয় দিয়ে আমার বাসা তল্লাশি করবেন বলে দরজা খুলতে বলেন। আমি উনাদের উদ্দেশ্যে বলি, আপনাদের পরিচয় নিশ্চিত না হলে আমি দরজা খুলবো না। তখন তারা বলেন, ‘তাড়াতাড়ি দরজা খুল, নইলে তোর খুব অসুবিধা হবে। ’ তারা আমাকে সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজ বলে গালমন্দ করতে থাকেন।
আমি বোয়ালিয়া মডেল থানায় মোবাইল করি। থানার ডিউটি অফিসার আমাকে জানান, ‘থানা থেকে আমাদের কোন লোক যায় নি আপনার বাসায়। কে বা কোন বাহিনী গেছে তা আমাদেও জানা নেই। ’ এক পর্যায়ে সশস্ত্র লোকেরা আমার কাছ থেকে মোবাইল ফোনটি কেড়ে নেয়। তারা নিজেদেরকে র্যাবের লোক বলে পরিচয় দেন।
বাড়ির মালিকের ছেলে লিখন সশস্ত্র লোকদের পরিচয় জানতে চাইলে তারা তাকে প্রহার করতে থাকেন। তখন আমি তাদের কাছে হাতজোড় করে অনুনয় করে বলতে থাকি, আপনারা উনাকে মারছেন কেন ? আপনারা কোন অন্যায় আচরণ করবেন না। আমি দরজা খুলে দিচ্ছি। আপনারা তল্লাশি করুন। কিন্তু আমার প্রতি কোন অবিচার করবেন না।
আমার ঘরে আপনাদের হাতের অস্ত্র রেখে আমাকে অস্ত্রসহ ধরে নিয়ে যাবেন না, প্লিজ।
এরপর আমার শিশুপুত্র ফিমানকে তার মায়ের কোলে দেই। আমি বারান্দার গ্রিলের দরজা খুলি। দরজা খোলামাত্র র্যাব সদস্যরা আমাকে টেনে-হিঁচড়ে দরজার বাইওে নেন। তারা আমার দু’ হাতে হ্যান্ডকাপ পরান।
আমার দু’ চোখ গামছা দিয়ে বেঁধে দেন। আমার মাথা থেকে গলা পর্যন্ত কালো কাপড়ের টুপি পরিয়ে দেয়া হয়। আমার শিশুপুত্র, স্ত্রী ও বাড়িওয়ালার সম্মুখে র্যাব সদস্যরা আমার শরীরের বিভিন্ন স্থানে এলোপাতাড়ী কিল-ঘুসি ও লাথি মারতে থাকেন। তারা আমাকে একটি মাইক্রোবাসে করে র্যাব-৫ রাজশাহীর সদও দপ্তওে নিয়ে যান। পথিমধ্যে গাড়ির ভেতরে আমাকে মারধোর করা হয়।
আমাকে অশ্লীল ভাষায় গালমন্দ করেন তারা। ‘অস্ত্র মামলায় চালান দেয়া ও ‘ক্রসফায়ার’ করার হুমকি দেখানো হয়।
র্যাব কার্যালয়ে নেয়ার পর আমার দু’হাত বেঁধে উপরে টাঙ্গিয়ে রাখা হয়। চোখ বাঁধা ও কালো টুপি পরিয়ে এবং আমাকে ঝুলিয়ে রাখা হয় সারারাত। রাতে আমার আশপাশে ৪/৫ জনের হেঁটে আসার বুটের খট খট শব্দ শুনতে পাই।
কিছুণ চুপ থাকার পর আবার একই শব্দ করে হেঁটে চলে যাবার শব্দ পাই। এভাবে সারারাতই আমিার ওপর মানসিক নির্যাতন চালানো হয়। সকাল আনুমানিক আটটার দিকে আমার হাতের বাঁধন খুলে দিয়ে আমাকে একটি ছোট রুটি পাতলা ডাল দিয়ে খেতে দেন তারা। এরপর আমাকে আবারও ঝোলানো হয়। রুটি খাওয়ানোর পর অনেকে আমার কাছে এসে আমাকে ‘সন্ত্রাসী’ ‘চাঁদাবাজ’ ‘সাংঘাতিক’ ইত্যাদি বলে গালমন্দ করেন।
সকাল অনুমান ১০ টার দিকে দুইজন এসে আমার নাম জানতে চান। যাদের কন্ঠস্বর আমার পূর্ব পরিচিত। পেশাগত কারণে এই দু’জনের সঙ্গে আমার পরিচয় এবং উনাদের সঙ্গে আমার এশাধিকবার সাাৎ হয়েছে। এরা হলেন র্যাব-৫ এর টুআইছি মেজর রাশীদুল হাসান রাশীদ ও ডিএডি হুমায়ুন কবির।
মেজর রাশীদ আমাকে বলেন, ‘এই ফকিরনির বাচ্চা, তোর এতো প্রেসটিজ কিসের ? শালা চাঁদাবাজ-সন্ত্রাসী।
তোর পাছার ভেতর ঢুকিয়ে দেবো সাংবাদিকতা। এই শুয়োরের বাচ্চা তুই আর রিপোর্ট করবি না সিএসবি নিউজ-এ। লিচু বাগানের রিপোর্ট, বেনজিরের বউয়ের কথা, খায়রুজ্জামান লিটন সাহেবের (জনাব লিটন রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য এবং আমার বিরুদ্ধে দায়ের করা চাঁদাবাজি মামলার বাদি জনাব লোটনের ভাইপো) পারিবারিক ওয়াকফ্ এস্টেট নিয়ে রিপোর্ট করবি না ? হারামজাদা তুই র্যা দেখেছিস, কিন্তু র্যাবের কাম দেখিস নি। ’ এক পর্যায়ে তিনি আমার বাম গালে থাপ্পড় মারলে আমার ঠোঁট ফেটে রক্ত বেরোতে থাকে। কিছুণ পর তিনি আমার বাম হিপে ইলেকট্রিক শক দেন।
এতে আমার শারীরীক অবস্থার অবনতি ঘটলে অনুমান সকাল সাড়ে ১০ টার দিকে আমার হাতে বাঁধন খুলে দেয়া হয়। আমাকে বসানো হয় ইলেকট্রিক চেয়ারে। প্রায় আধাঘন্টা পর ফোরে শুইয়ে আমার শরীরে লাঠি দিয়ে পেটাতে থাকেন মেজর রাশীদ ও হুমায়ুন কবির। একই সঙ্গে বুটের লাথি ও কিল-ঘুসি চলে সমানতালে। আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।
আমার জ্ঞান ফিরলে আমি বুঝতে পারি যে একটি পরিত্যক্ত রান্না ঘরে আমি খড়ের ওপর পড়ে আছি। যেখানে পোকা-মাকড় ঘুওে বেড়াচ্ছিল। দুপুর অনুমান দেড়টার দিকে আমাকে উঠে দাঁড়াতে বলেন র্যাবের দুই সদস্য। কিন্তু নির্যাতনের ফলে আমি উঠে দাঁড়াতে পারছিলাম না। এসময় ‘অভিনয় করছে শালা’ এই মন্তব্য করে মেজর রাশীদ আমার দু’পায়ের উপরে তার পায়ের বুট দিয়ে খিচতে থাকেন।
এসময় তিনি বলেন, ‘ব্যাপার মার হয় নি। শালা অভিনয় করছে। কুত্তার বাচ্চা উঠে দাঁড়িয়ে নিজে নিজে হাঁট। নইলে আরও মারবো। শালা তোকে ক্রসফায়ার দিলে ঠিক হবি।
’
মেজর রাশীদ আমার পায়ে খিচতে খিচতে আমাকে একটি রুমে নিয়ে যান। বেলা অনুমান দু’টায় আমার মাথা থেকে কালো কাপড়ের টুপি সরিয়ে চোখ থেকে গামছা খুলে দেয়া হয়। একটি ফরমে নেয়া হয় আমার দুই হাত ও দুই হাতের সব আঙুলের ছাপ। আমার বুকে আমার নাম লিখে ডিজিটাল ক্যামেরায় ছবি তোলা হয়। এরপর পুনরায় গামছা দিয়ে চোখ বেঁধে আমার মাথায় কালো কাপড়ের টুপি পরিয়ে দিয়ে আমাকে উঠানো হয় একটি মাইক্রোতে।
বেলা আনুমানিক তিনটায় আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় বোয়ালিয়া মডেল থানায়। থানা থেকে র্যাব কার্যালয়ে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। থানায় নেয়ার সময় র্যাব সদস্যরা আমাকে হুমকি দিলে বলেন, ‘থানায় গিয়ে পুলিশের সামনে সোজা হয়ে হাঁটবি। নইলে তোকে আবার ফিরিয়ে আনবো এবং ক্রসফায়ার-এ মারবো। পুলিশ জিজ্ঞাসা করলে বলবি আমাকে মারধোর করা হয়নি।
’ বিকেল অনুমান পাঁচটার দিকে র্যাব আমাকে বোয়ালিয়া মডেল থানায় ৫৪ ধারায় হস্তান্তর করে। এরপর আমার মাথার টুপি সরিয়ে চোখের বাঁধন খুলে দেয়া হয়।
পুলিশ সন্ধ্যায় আমাকে জরুরি মতা বিধিমালার ১৬ (২) ধারায় রাজশাহীর মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে চালান দেয়। আদালতে কোন আদালতে বিচারক/ম্যাজিষ্ট্রেট ছিলেন না। আমাকে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
কারা কর্তৃপ আমাকে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারা হাসপাতালের ইমার্জেন্সী ও সার্জিক্যাল ওয়ার্ড-৪ এ ভর্তি করেন। কারা হাসপাতালে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত আমি চিকিৎসা গ্রহণ করি। কিন্তু পরিপূর্ণভাবে সুস্থ্য হয়ে ওঠার আগেই আমাকে সিভিল ৬ নম্বর ওয়ার্ডে স্থানান্তর করা হয়।
পুলিশ প্রতিবেদনের প্রেেিত গত ৮ নভেম্বর আমি জরুরী মতা বিধিমালার ১৬ (২) ধারা হতে অব্যাহতি পাই। আমাকে গ্রেফতারের মাত্র চার ঘন্টা আগে দায়ের করা দ্বিতীয় চাঁদাবাজি মামলায় আমি রাজশাহী জেলা ও দায়রা জজ আদালত থেকে জামি পাই।
এরই প্রেেিত গত ২৪ অক্টোবর, ২০০৭ থেকে ১৯ নভেম্বর, ২০০৭ পর্যন্ত রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি থাকার পর গত ১৯ নভেম্বর, ২০০৭ রাত আটটায় কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি লাভ
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।