আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শিয়া মাযহাবের ইবাদতের গুরত্বপূর্ণ ও শাখাগত আমলসমূহ নিম্নরূপ-২

আসুন সত্য ইসলামকে জানি এবং অন্যদেরকে জানাই ...

৬- আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা প্রত্যেক মুসলমানের উচিত নিজের ও সকল মানুষের সার্বিক উন্নতির জন্যে চেষ্টা ও সংগ্রাম করা। আল্লাহ তা’আলা কোরআনে বলেন: “তিনি তোমাদেরকে মাটি থেকে তৈরি করেছেন এবং তোমাদের কাছে চেয়েছেন যে তোমরা সেটিকে আবাদ কর” (সূরা হুদ, আয়াত নং-৬১)। পবিত্র কোরআন ও হাদীস গ্রন্থ সমূহে মানুষের সমস্যাদির প্রতি অমনোযোগী থাকা বা নিজ জীবনের প্রতি নিস্পৃহ ও অলসতাকারীকে তিরস্কার করা হয়েছে। অপরদিকে, যারা জীবনের অবস্থার উন্নতির জন্য, নিজ এবং আ্তীয়-স্বজনের খরচাদির জন্য চেষ্টা করে, তাদেরকে উৎসাহ দান করে আল্লাহর পথে জিহাদকারী উপাধিতে ভুষিত করেছে। জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি চেষ্টা ও সংগ্রাম হচ্ছে, আল্লাহ প্রদত্ত মানুষের অধিকারকে প্রতিরক্ষা করা যেমন; স্বাধীনতা, মূল্যবোধ সমূহ যেমন, ন্যায়, আত্মসম্মান ও সার্বভৌমত্ত্ব ইত্যাদি।

যখনই এরূপ কোন একটি গুরুত্বপূর্ণ অধিকার এবং মূল্যবোধ ক্ষতি অথবা হুমকির সম্মুখীন হয়, তখনই তা পুনর্জাগরণের জন্য চেষ্টা করা প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য, বিশেষত: যখন কোন মূল্যবোধ ব্যক্তি স্বার্থের সীমা পেরিয়ে একটি উম্মত ও জাতির স্বার্থ ও অধিকারের আগ্রাসীদের পক্ষ থেকে ধবংসের মুখোমুখি হয় তখন তা রক্ষায় সংগ্রাম করা অপরিহার্য্য। কোরআন করীমে বলা হয়েছে: “যাদের উপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে (তাদের) অনুমতি দেওয়া হয়েছে; কেননা তারা নির্যাতিত হয়েছে এবং অবশ্যই আল্লাহ্ তা’য়ালা তাদের জয়ী করাতে সর্বশক্তিমান”। “যারা অন্যায়ভাবে নিজ বাসস্থান থেকে বহিষকৃত হয়েছে, তাদের “আল্লাহ তা’য়ালা আমাদের প্রতিপালক” এই কথা বলা ব্যতীত কোন অপরাধ ছিল না, আর যদি আল্লাহ্ তা’য়ালা এক গোষ্ঠীর দ্বারা অপর একটি গোষ্ঠীকে প্রতিহত না করতেন, তাহলে বিভিন্ন প্রার্থনার স্থানগুলি যেমন; সন্ন্যাসীদের আশ্রম, খৃস্টানদের গীর্জা, ইহুদীদের উপাসনালয়ে এবং বিভিন্ন মসজিদে যেখানে খুবই বেশী আল্লাহর স্মরণ করা হয়, বিধবস্ত হয়ে যেত; অবশ্যই আল্লাহ তা’য়ালা সহায়তা দেবেন যে তার দীনকে সহায়তা করবে; কেননা আল্লাহ্ তা’য়ালা অপরাজেয় এবং শক্তিমান” “তারা এমন যে, যদি পৃথিবীতে তাদেরকে ক্ষমতা দেয়া হয় তবে তারা নামাজ কায়েম করবে, যাকাত প্রদান করবে, (অপরকে) নেককাজ করতে বলবে এবং অসৎকাজে বাধা দিবে; আর সমস্ত কাজের পরিণামের ক্ষমতাধীন হচ্ছে আল্লাহ তা’আলা” (সূরা হজ্ব, আয়াত নং-৩৯-৪১)। “কেন তোমরা অসহায় পুরুষ, নারী এবং অসহায় শিশুদের রক্ষা করতে আল্লাহর পথে জিহাদ করনা? যারা এরূপ প্রার্থনা করে থাকে, হে আমাদের সৃষ্টিকর্তা আমাদেরকে এই শহর থেকে যার অধিবাসিরা অত্যাচারী, বের করুন এবং আপনার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য দায়িত্বশীল কর্তা এবং সহায়তাকারী প্রেরণ করুন” (সূরা নিসা, আয়াত নং-৭৫)। অবশ্য জিহাদ, অন্যান্য ব্যক্তিগত ক্ষেত্রেও হয়ে থাকে যেমন; নিজের জান, মাল, পরিবারবর্গ বা কারো মর্যাদা রক্ষার কারণে হতে পারে।

বিভিন্ন হাদীস অনুযায়ি, যখন কোন ব্যক্তি নিজের বাসগৃহ অথবা পরিবারকে রক্ষা করতে নিহত হয় তবে, যুদ্ধের ময়দানে শহীদ হওয়া সৈনিকের ন্যায় শহীদ হয়েছে। জিহাদ অবশ্যই জুলুম ও অত্যাচার নির্মূল এবং সত্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা অব্যাহত থাকতে হবে। কোরআনে বলা হয়েছে: “তাদের (অত্যাচারিদের) সাথে যুদ্ধ কর, যতক্ষণ না ফিৎনা ও বিশৃঙখলা দূর হয়ে যায়” (সূরা বাকারাহ, আয়াত নং-১৯৩)। অবশ্য বিশ্বজীবন একটি মানদণ্ডে প্রকৃত জিহাদ, মানুষের জীবনসূত্র থেকেই শুরু হয়েছে এবং এখনও পর্যন্ত কল্যাণ ও অকল্যাণ, হক্ব ও বাতিল, আল্লাহর অনুসারী এবং শয়তানের অনুচরের মধ্যে অব্যাহত আছে। এই যুদ্ধ কম-বেশী শেষ জামানা পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে এবং ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর হুকুমতে, বিশ্বজনীন ন্যায় প্রতিষ্ঠা ও সুযোগ সুবিধা ও সম্পদের ন্যায় ভিত্তিক বন্টন হওয়ার মাধ্যমে পরিসমাপ্তি ঘটবে এবং এভাবে সকল বিবাদের উৎস ও যুদ্ধের অবসান ঘটবে।

জিহাদ বিভিন্ন পদ্ধতিতে যেমন; লেখার মাধ্যমে, ভাষায় প্রকাশ করে, অস্ত্র ব্যবহারে অথবা অন্য যে কোন প্রকারেই হোক না কেন, ইবাদতের একটি অংশবিশেষ এবং অবশ্যই খালেস নিয়তে আঞ্জাম দিতে হবে। অর্থাৎ আল্লাহ্ তা’য়ালার জন্য এবং শরীয়তসম্মত পন্থায় ও ন্যায়নিষ্ঠা সহকারে হতে হবে। কেউ যেন বস্তুগত উদ্দেশ্যে অথবা নিজের বা নিজ গোত্রের মর্যাদালাভের জন্য বা নির্দিষ্ট কোন দল বা গোষ্ঠির জন্য বা কোন অন্যায় উদ্দেশ্যে আঞ্জাম না দেয় যেমন; ক্ষমতা ও সম্পদ লাভের জন্য অন্যের ভূমিকে জোরপূর্বক হস্তগত করাকে জিহাদ বলে গণ্য না করে। প্রকৃতপক্ষে, জিহাদ, সমস্তকিছুর পূর্বে মুজাহিদের অভ্যন্তরেই শুরু হয়ে থাকে। বাতিল ও বাহ্যিক সমস্যাদির উপর জয়ী হওয়ার পূর্বে, অবশ্যই প্রবৃত্তির কামনা ও বাসনাগুলির বিরূদ্ধে যুদ্ধ করে নিজের অন্তরকরণকে সমস্ত শয়তানি চিন্তা থেকে মুক্ত করতে হবে এবং এই হৃদয় যার মালিক শুধুমাত্র আল্লাহ্ তা’য়ালা, সেখানে তিনি ব্যতীত অন্যকিছুকে প্রবেশ করার অনুমতি দিয়ে মানবিক মর্যাদাকে নষ্ট করা যাবেনা।

কোরআনে বলা হয়েছে: “হে নাফসে মুতমায়েন্নাহ” অর্থাৎ এই প্রশান্ত আ্তা, আল্লাহর পছন্দনীয়ভাবে এবং সন্তুষ্টির সাথে তার দিকে ফিরে যাও এবং আমার বিশিষ্ট বান্দাগণের অন্তর্ভুক্ত হয়ে আমার বেহেশ্তে প্রবেশ কর (সূরা ফজর, আয়াত নং-২৭-৩০)। মশহুর রেওয়ায়াতসমূহ অনুযায়ী, একদিন হযরত মুহাম্মাদ (সা.) তাঁর কিছু সাহাবাকে যখন ইসলামের শত্রুদের সাথে জিহাদে জয়ী হয়ে ফিরছিল বল্লেন: “সাবাস! তাদেরকে যারা ক্ষুদ্রতম জিহাদে জয়ী হয়েছে এবং বৃহত্তম জিহাদের দায়িত্ব গ্রহণ করেছে” সাহাবারা সবাই আশ্চর্যের সাথে হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর নিকট প্রশ্ন করল যে সেটি কোন যুদ্ধ যা সশস্ত্র শত্রুর হুমকি এবং আক্রমণের বিপদ থেকেও বড়? হযরত মুহাম্মাদ (সা.) উত্তরে বললেন: “বৃহত্তম জিহাদ হচ্ছে, নিজের নফসের (আ্তা) সাথে জিহাদ করা” অর্থাৎ নফসের কুচিন্তাসমূহের বিরোধিতা করে নিজেকে শোধন করাই হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ এবং কঠিন জিহাদ। অবশেষে, আল্লাহর পথে জিহাদ করা মুজাহিদদের কিছু বৈশিষ্ট, আল্লাহ তা’য়ালার বাণী থেকেই বর্ণনা করব: “যারা ঈমান এনেছে এবং আল্লাহর পথে নিজেদের জান ও মাল দিয়ে জিহাদ করেছে, আল্লাহর নিকট তারা উচ্চমর্যাদা সম্পন্ন এবং তারাই মুক্তিপ্রাপ্ত” “তাদের প্রতিপালক তাদেরকে তাঁর বিশেষ রহমতের, বেহেশ্তি বাগানসমূহ যেখানে সর্বপ্রকার নেয়ামত চিরস্থায়ী থাকবে এবং পূর্ন সন্তুষ্টির সুসংবাদ দিয়েছেন” “সেখানে তারা অনন্তকাল থাকবে এবং নিশ্চয় শ্রেষ্ঠ পুরস্কার আল্লাহ্ তা’য়ালার নিকট আছে” (সূরা তওবা, আয়াত নং-২০-২২)। ৭-৮. আমর বিল মারুফ ওয়া নাহি আনিল মুনকার সৎ কাজে উপদেশ এবং অসৎ কাজে বাধা দেওয়া, দুটি ওয়াজীব কাজ যা প্রত্যেক বালেগ মুসলমানকে অবশ্যই যেরুপে ধর্মীয় আহকামের গ্রন্থগুলিতে বিস্তারিত উল্লেখ হয়েছে, সেরূপে আমল করতে হবে। চতুর্দিকে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনার প্রতি অমনোযোগী থাকা কোন মুসলমানের পক্ষে সম্ভব নয়।

প্রত্যেক মুসলমানের সামাজিক দায়িত্বের কিছু অংশবিশেষ হচ্ছে যে, মানবিক ও দ্বীনি মূল্যবোধগুলির দিকে লক্ষ্য রাখা এবং যখনই ইচ্ছাকৃতভাবে কোন একটির প্রতি লক্ষ্য করা হবেনা অথবা লঙঘন করা হবে, তখন অবশ্যই একটি উত্তম পরিকল্পনার সাথে নিজের অভিযোগ জানিয়ে, অপরাধীকে তা সঠিকভাবে আঞ্জাম দেবার জন্য আহবান জানাতে হবে (বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন: সূরা আলে ইমরান, আয়াত নং-১০৯-১১৩, সূরা আ’রাফ, আয়াত নং-১৯৯, সূরা তওবা, আয়াত নং-৭১-১১২, সূরা হজ্ব, আয়াত নং-৪১)। ৯-১০. তাওয়াল্লী ও তাবাররী তাওয়াল্লী হচ্ছে ওয়াজীব কর্মসমূহের অন্যতম; অর্থাৎ আল্লাহ তা’য়ালা ও তার প্রিয়জনদেরকে ভালবাসা যাদের প্রথম সারিতে রয়েছেন হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এবং তাঁর আহলে বাইত (আ.) গণ। এই ওয়াজীবের অন্তর্ভুক্ত অপর কর্মটি হচ্ছে তাবাররী; অর্থাৎ আল্লাহ ও তার প্রিয়জনদের শত্রুদের প্রতি শত্রুতা পোষণ এবং তাদের থেকে দূরে থাকা। প্রকৃতপক্ষে “তাওয়াল্লী ও তাবাররী” ঈমানের একাংশ যা বিভিন্ন হাদীসগ্রন্থে, দীনের তাবু বলে পরিচিতি পেয়েছে যা ধর্মীয় অভিভাবকের কর্তৃত্ব অর্থাৎ বেলায়েতের স্তম্ভ ব্যতীত প্রতিষ্ঠিত হবেনা এবং ঈমান, আল্লাহকে ভালবাসা ও তারই জন্য বন্ধুত্ব করা এবং তাঁরই জন্য তাঁর শত্রুদের শত্রু গণ্য করা ব্যতীত অন্যকিছু নয় (উছুলে কাফি, আল ঈমান ওয়াল কোফর অধ্যায়, দায়াইমুল ইসলাম পরিচ্ছেদে, খণ্ড-১, এই বিষয় এই পরিচ্ছেদের অন্যান্য হাদীসসমূহেও বর্ণিত হয়েছে)। উদাহরণ স্বরূপ, ইমাম বাকের (আ.) বলেনে: “ইসলাম পাঁচটি বিষয়ের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত: নামায, রোজা, যাকাত, হজ্ব এবং ধর্মীয় শাসন কর্তৃত্ব, কিন্তু ধর্মীয় শাসন কর্তৃত্বের ন্যায় কোন বিষয়ের প্রতিই আহবান জানান হয়নি ”।

ইমাম সাদিক (আ.) হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর থেকে বর্ণনা করেন: “একদা হযরত মুহাম্মাদ (সা.) নিজের সাহাবাদের নিকট প্রশ্ন করলেন: ঈমানের সর্বাপেক্ষা মজবুত এবং প্রতিষ্ঠিত অঙ্গ কোনটি?” সাহাবাগণ বল্লেন আল্লাহ ও তাঁর রসুল (সা.)-ই ভাল জানেন। কিছু ব্যক্তি নামায, কিছু ব্যক্তি যাকাত, কিছু ব্যক্তি হজ্ব ও ওমরা (হজ্বের মওসুমের বাইরে এহরামসহ কাবা গৃহের তাওয়াফ ও সা’ঈ) এবং কিছু ব্যক্তি জিহাদের কথা বলেন। হযরত মুহাম্মাদ (সা.) বললেন: “এ সমস্তকিছুই গুরত্বপূর্ণ কিন্তু ঈমানের মজবুততম অঙ্গটি হচ্ছে “আল্লাহর জন্য বন্ধুত্ব করা এবং আল্লাহর জন্য বিদ্বেষ করা এবং আল্লাহর প্রিয়জনদেরকে ভালবাসা এবং আল্লাহর শত্রুদের থেকে দূরে থাকা” (উছুলে কাফি, আল ঈমান ওয়াল কোফর অধ্যায়, আলহুববু ফিল্লাহি ওয়াল বোগযু ফিল্লাহি পরিচ্ছেদে, খণ্ড-৬)। ফাযিল ইবনে ইয়াসার বলে: “ইমাম সাদিক (আ.)-এর নিকট ভালবাসা এবং বিদ্বেষ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে ভালবাসা এবং বিদ্বেষ কি ঈমানেরই অঙ্গ? হযরত সাদিক (আ.) উত্তরে আমাকে বললেন: “ঈমান কি ভালবাসা ও বিদ্বেষ ব্যতীত অন্য কিছু?” (উছুলে কাফি, আল ঈমান ওয়াল কোফর অধ্যায়, আলহুববু ফিল্লাহি ওয়াল বোগযু ফিল্লাহি পরিচ্ছেদে, খণ্ড-৬, হাদীস নং-৫ ও তাওয়াল্লী ও তার্বারী সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য: শহিদ আয়াতুল্লাহ দাস্তগেইবের লেখা গোনাহানে কাবিরা গ্রন্থটি দেখুন, খণ্ড-২, পরিচ্ছেদ-৩৯, একটি ওয়াজীব পরিত্যাগ, পৃ.-২২২-২২৫)।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.