আসুন সত্য ইসলামকে জানি এবং অন্যদেরকে জানাই ...
শিয়াদের বিশ্বাস ও কর্মসমূহ পর্যালোচনার পূর্বে শিয়া দৃষ্টিভঙ্গিতে ইসলাম পরিচিতির উত্সসমূহের সাথে পরিচিত হওয়া আবশ্যক। এ অধ্যায়ে শিয়া চিন্তাধারার উত্সসমূহ অর্থাৎ ইসলামী যে কোন বিষয়ে অধ্যায়ন ও গবেষনার ক্ষেত্রে শিয়া মতে অবশ্যই যে উত্সসমূহের উপর নির্ভর করা উচিৎ তা নিয়ে আলোচনা করব। শিয়াদের দৃষ্টিতে ইসলামী বিষয়সমূহ হোক তা বিশ্বাসগত, নৈতিক বা ফিকাহ সম্পর্কিত অবশ্যই তা কোরআন, সুন্নাত, আকল ও ইজমার মধ্যে হতে এক বা একাধিক উত্স হতে গৃহীত হতে হবে।
কোরআন করীম :
কোনরূপ সন্দেহ ছাড়াই সমস্ত মুসলমান বিশেষভাবে শিয়া মাযহাবের অনুসারীদের নিকট কোরআন শরীফ একটি মূল এবং গুরুত্বপূর্ণ উত্স বলে বিবেচিত। অন্যদিকে কোরআন সমস্ত মুসলমানদের ঐক্যের কারণ।
মুসলমানদের মধ্যে দলগত সাংস্কৃতিক পার্থক্য থাকলেও তারা, সকলেই এই পবিত্র কিতাব (কোরআন)-কে জীবনের পথচলার ক্ষেত্রে আল্লাহ তা'য়ালার পক্ষ থেকে তাদের পথ প্রদর্শক হিসেবে জানে। আর সেই অতীতের ন্যায় বর্তমানে ও ইসলামী বিশ্বে শুধুমাত্র এক প্রকার কোরআন, কোনরূপ কম বা বেশী এবং কোনরূপ পার্থক্য ছাড়াই বিদ্যমান রয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ, এই বিষয়ে শিয়াদের দৃষ্টি লক্ষ্য করা যেতে পারে; আমরা বিশ্বাসী যে, কোরআন শরীফ আল্লাহ তা'য়ালার পক্ষ থেকে এবং তাঁরই প্রেরিত নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর উপর নাযিল হয়েছে যা সমস্ত কিছুর ব্যাখ্যাকারী এবং চিরন্তন মুজিযাহ। কোরআন শরীফের ভাষার প্রাঞ্জলতা, সুস্পষ্টতা, বাস্তবতা, সত্যতা, সুগভীর জ্ঞান এবং অন্যান্য অনেক কারণে কেউই কুরআনের সমতুল্য কিছু লিখতে পারবেনা এবং তাতে কোনরূপ পরিবর্তনও আনতে পারবে না।
যে কোরআন আজ আমাদের মাঝে আছে হুবহু সেই কোরআনই হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর উপর নাযিল হয়েছিল।
অতএব যদি কোন ব্যক্তি এছাড়া অন্যকিছু দাবী করে তবে সে, সন্দেহবাদী, অপরাধী অথবা পাপাচারী। আর যে কোন রূপেই সে ভুল পথে গিয়েছে, কেননা কোরআন আল্লাহ তা'য়ালার কালাম এবং তার বাণী। অতএব 'সামনে ও পিছন কোন দিক থেকেই তার মধ্যে ভুলভ্রান্তি প্রবেশ করতে পারে না (সূরা ফুছছেলাত, আয়াত নং-৪১,৪২)।
...আমারা বিশ্বাসী যে অবশ্যই কোরআন শরীফকে আমাদের কথা ও কার্যকলাপ দিয়ে শ্রদ্ধা ও সম্মান করতে হবে, আর কোরআন শরীফের একটা অক্ষরকেও যেন অসম্মান না করা হয় এবং কোন নাপাক ব্যক্তি যেন তা স্পর্শ না করে। কোরআন বলেছে: “...শুধুমাত্র পবিত্র ব্যক্তি ব্যতীত কেউ তা স্পর্শ করতে পারবে না” (সূরা ওয়াকিয়াহ, আয়াত নং-৫৬-৭৯, মোজাফফার, আকাইদুল ইমামিয়াহ, পৃ.-২৬)।
শিয়ারা কুরআনের সমস্ত প্রকার বিকৃত হওয়াকে প্রত্যাখ্যান করে যেরূপে পূর্বে বলা হয়েছে, শিয়ারা কোরআন সম্পর্কে কোন প্রকার (শব্দ বা কথা) পরিবর্তন বা বিকৃতিকে অস্বীকার করে এবং এই বিষয়ের উপর বিশ্বাসী যে, হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর উপরই যে কোরআন নাযিল হয়েছিল সেই কোরআন আজ আমাদের মাঝে রয়েছে।
কোরআন পরিপূর্ণ এবং কখনই কেউ কুরআনের অন্য কোন পাণ্ডুলিপি পায় নি যা বিদ্যমান ও প্রচলিত পাণ্ডুলিপির বিপরীত। প্রাচীন কালের হস্তলিখিত অনেক অনুলিপি যা ইমাম (আ.)-গণের যুগে সংকলিত হয়েছিল এবং এখনও পাওয়া যায়, তা হুবহু আমাদের কাছে থাকা এই কুরআনের অনুরূপ।
কোরআন শরীফ সরাসরি বর্ণনা করে যে, আল্লাহ তা'য়ালা সেটি (কোরআন)-কে সমস্ত প্রকার পরিবর্তন ও বিকৃতি থেকে রক্ষা করবেন। 'অবশ্যই আমরা, যিকির (কোরআন)-কে নাযিল করেছি ও অবশ্যই আমরা সেটি (কোরআন)-কে রক্ষা করব' (সূরা হিজর, আয়াত নং-৯, ১৫।
এই বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন যে কেউই কোরআনে কিছু বেশী করা হয়েছে তা বলেনি। কোরআনে বিকৃতির ব্যাপারে যে কেউ যা কিছু বলেছে তা শুধুমাত্র কম অর্থাৎ কোন সুরা থেকে কিছু কমে গেছে বলে বলেছে। অতএব, যখনই কুরআনের কোন আয়াত এই বিষয়কে (বিকৃত হওয়ার) প্রত্যাখ্যান করে তখন সে আয়াতের ভিত্তিতে এরূপ সন্দেহের সঠিক জবাব দেওয়া সম্ভব।
আল্লামা সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ হুসাইন তাবাতাবায়ি, তার 'আলমিযান' নামক মুল্যবান তফসীরে এই বিষয়ে বলেন: ... কোরআন, জীবন্ত ও চিরস্থায়ী যিকর, যা কখনই শেষ এবং বিস্মৃত হবে না। কোরআন সকল প্রকার বিকৃতি (বেশী-কম) থেকে সংরক্ষিত আছে।
'কোরআন আল্লাহ তা'য়ালার পক্ষ থেকে আসা এবং আল্লাহ তা'য়ালার জ্ঞান, সত্যতা, বাস্তবতার বর্ণনাকারী' আর এটি হচ্ছে কুরআনের বৈশিষ্ট্য। অতএব কোন প্রকার পরিবর্তন যা এই বৈশিষ্টের (ধরন বা আকৃতির) উপর প্রভাব ফেলতে পারে, তা থেকে সংরক্ষিত।
আর এ কারণে, যে আয়াতটি উপরে উল্লেখ হয়েছে তা এই বিষয়ের প্রতি নির্দেশ করে যে 'আল্লাহ তা'য়ালার এই কিতাব, সর্বদা সর্বপ্রকার বিকৃত ও পরিবর্তন থেকে সংরক্ষিত আছে এবং থাকবে।
সুন্নত
কোরআন করীমের পর শিয়া মাযহাবের চিন্তাসমুহ এবং ইসলাম পরিচিতির, গুরুত্বপূর্ণ উত্স হচ্ছে 'হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর সুন্নত' যা হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর বক্তব্য এবং কার্যসমূহের সমষ্টি। প্রকৃত অর্থে এটি হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর এক প্রকার মর্যাদা যার প্রবক্তা হচ্ছে কোরআন, কেননা কোরআন শরীফের আয়াত অনুযায়ী, হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর কর্তব্য হচ্ছে কোরআন ব্যাখ্যা করা (সূরা নাহল, আয়াত-৪৪) এবং কোরআনের হিকমত ও কোরআনের শিক্ষাদান করা (সূরা জুমা, আয়াত-২) ।
হযরত মুহাম্মাদ (সা.) সমস্ত মুমিনদের জন্য পূর্ণ আদর্শ স্বরূপ (সূরা আহযাব, আয়াত-২১)। হযরত মুহাম্মাদ (সা.) কখনই তাঁর কামনা-বাসনা এবং নিজ ইচ্ছায় কথা বলেন না (সূরা তুর, আয়াত-৩)। মুসলমানদের কর্তব্য হচ্ছে যা কিছু হযরত মুহাম্মাদ (সা.) তাদেরকে দিয়েছেন, তা গ্রহণ করা এবং যা কিছু থেকে বিরত থাকতে বলেছেন, তা থেকে দূরে থাকা (সূরা হাশর, আয়াত-৭)।
শিয়ারাও অন্যান্য মুসলমানদের অনুরূপ উল্লেখিত আয়াতসমূহ এবং অন্যান্য আয়াতগুলি যাতে হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর মর্যাদা সম্পর্কে বলা হয়েছে, সেগুলির উপর ভিত্তি করে এবং হযরত মুহাম্মাদ (সা.) যে আল্লাহ তা'য়ালার বাণী পৌছানোর জন্য সরাসরি ভাবে তাঁরই (আল্লাহ) পক্ষ থেকে মনোনীত হয়েছেন সে বিষয়ে পূর্ণ অবগতির কারণে, হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর প্রতি গভীর ভালোবাসা ও ভক্তি এবং তার নির্দেশের আনুগত্য থাকে। পরবর্তীতে নবুওয়াত প্রসঙ্গে এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর আহলে বাইত (আ.)
মুসলমানদের মধ্যে বাহ্যত যে, ইসলাম সম্পর্কে জানার ক্ষেত্রে হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর আহলে বাইতের প্রণীত শিক্ষা সঠিক হওয়া এবং তাদের অনুসরণ নির্ভরযোগ্য হওয়ার বিষয়ে, কোন মতবিরোধ নেই, বিশেষ করে আহলে সুন্নতের দৃষ্টিতে, কেননা তারা হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর সমস্ত সাহাবিকে হুজ্জাত ও দলিল বলে মনে করে (মুসলমান সুন্নি সম্প্রদায়ের মধ্যে যে দৃষ্টিভঙ্গি বেশী প্রচলিত তা হচ্ছে, যদি কেউ হযরত মোহাম্মদ (সা.)-কে নিজ চোখে দেখে থাকে এবং তাঁর উপর ঈমান রাখে তবে তাকে হযরত মোহাম্মাদ (সা.)-এর 'সাহাবি' বলে গণ্য করতে হবে। আর 'মাযহাবে সাহাবি' বলতে তাদের প্রত্যেকের বক্তব্য এবং সম্পাদিত কর্মগুলিকে হুজ্জাত বলে গণ্য করাকে বোঝায়। এই দৃষ্টির প্রেক্ষাপটে হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর আহলে বাইত যেমন আলী (আ.) ও ফাতিমা যাহরা (সা.) সর্বদা হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর সাথে ছিলেন এবং তার সাথে অতি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল, সুতরাং ইসলামকে জানার ক্ষেত্রে তাদেরকে নির্ভরযোগ্য কর্তৃপক্ষ বলে গণ্য করা উচিত্)।
এই বিষয়টি, আহলে বাইত সম্পর্কে হযরত মুহাম্মাদ (সা.) থেকে বর্ণিত হাদীস গুলি এবং ইমাম আলী (আ.) ও হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর পরিবার বর্গের জ্ঞান ও মর্যাদা সম্পর্কে, সুন্নি আলেমগণের বক্তব্যগুলি পর্যালোচনা করলে, স্পষ্ট হবে।
উদাহরণ স্বরূপ, ইমাম মালিক বলেন: জাফর ইবনে মোহাম্মাদের থেকে বেশী জ্ঞানী, চরিত্রবান, পরহেজগার, ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিকে কেউই নিজ চোখে দেখে নি, নিজ কানে শোনে নি এবং কারো অন্তরেও এরূপ কিছু কখনই আসেনি (ইবনে শাহ্রে আশুব, আলমানাকিব, খণ্ড-৪, পৃ.-২৪৭)।
শেইখ মুফিদ (মৃত্যু-৪১৩ হিজরি) 'ইরশাদ' গ্রন্থে বলেছেন: ইসলামী বিভিন্ন মাযহাবের চার হাজার বিশ্বস্ত রাবি ইমাম জাফর সাদিক (আ.) থেকে হাদীস বর্ণনা করেছে।
এমতাবস্থায়, ধর্মের ক্ষেত্রে আহলে বাইত (আ.)-এর উপর নির্ভর করার বিষয়টিতে আর কোন সন্দেহ থাকেনা এবং একারণেই অনেক সুন্নি আলেম, যেমন মরহুম শেইখ শালতুত (যিনি মিশরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ও বিখ্যাত আলেম ছিলেন) সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন যে, মুসলমানরা ফিকাহ শাস্ত্রের মাসলা মাসায়েলের ক্ষেত্রে পাঁচটি মাযহাবের থেকে -জাফারি, হানাফি, হাম্বালি, মালেকি ও শাফেয়ি- যে কোন একটি মাযহাবের অনুসরণ করতে পারবে।
আর এর কারণ হচ্ছে, আমরা যদি এ দাবী নাও করি যে, ইমাম সাদিক (আ.) ও আহলে বাইত (আ.)-এর অন্যান্য ইমামগণ রাসূল (সা.)-এর সুন্নত সম্পর্কে অবগত হওয়ার ক্ষেত্রে অন্যান্য ব্যক্তিদের হতে অধিকতর সুবিধাজনক অবস্থায় ছিলেন, তবে এ দাবী অবশ্যই করতে পারব যে, অবশ্যই এ সুযোগ অন্যদের থেকে তাদের কম ছিলনা। আবু হানিফা, হানাফি মাযহাবের প্রবক্তা, দুই বছর ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-এর ছাত্র ছিল এবং আহলে সুন্নতের অনেকেই যারা পরবর্তীতে বিখ্যাত ব্যক্তি বলে পরিচিত তাদেরকে ইমাম (আ.)-গণের সরাসরি অথবা কোন না কোন মাধ্যমে ছাত্র বলে গণ্য করা হয়। সুতরাং ইসলাম পরিচিতির ক্ষেত্রে অন্যান্য বিশেষ উত্সগুলির পাশাপাশি হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এর আহলে বাইত (আ.)-এর জ্ঞানসমূহ ও তাদের অনুসৃত নীতি গ্রহণ করার জন্য জ্ঞানী ব্যক্তিদের এবং সত্য-সন্ধানীদের কাছে আশা করা যায়।
যেহেতু আহলে বাইত (আ.)-এর শরণাপন্ন হওয়ার বিষয়টি আমাদের কাছে পরিষ্কার হওয়ার পর আমরা এখন এই বিষয়টির পর্যালোচনা করব যে আহলে বাইত (আ.)-এর শরণাপন্ন হওয়ার প্রয়োজনীয়তা আছে কি না? আর এই প্রশ্নের সঠিক জবাবের জন্য হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর হাদীসসমূহ যা আহলে সুন্নতের আলেমগণ বর্ণনা করেছেন এবং শিয়া ও সুন্নি মাযহাবও একমত, আলোচনা করব। এই হাদীসগুলি সম্পর্কে আলোচনা করার পূর্বে, আহলে বাইত (আ.)-এর পক্ষ থেকে উপস্থাপিত শিক্ষার প্রতি লক্ষ্য করা অতি প্রয়োজন, যা সম্পূর্ণরূপে কোরআন এবং হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর সুন্নতের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। কখনই যেন এরূপ ভাবা না হয় যে, হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর আহলে বাইত (আ.)-এর ইমাম (আ.)-গণ নিজেদের থেকে বা নিজ ইচ্ছার বশবর্তী হয়ে কোন কিছু বর্ণনা করেন। শিয়াদের গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থগুলি যেমন; উছুলে কাফিতে আহলে বাইত (আ.)-এর থেকে বর্ণিত প্রচুর হাদীস আছে যা এই বিষয়টিকে প্রমাণ করে থাকে যে, যা কিছু আমাদের ইমাম (আ.)-গণ বলেছেন, তা সরাসরিভাবে অথবা তাদের পিতাগণের মাধ্যমে হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর কাছ থেকে প্রাপ্ত ছিলেন।
আহলে বাইত (আ.)-এর শরণাপন্ন হওয়ার ক্ষেত্রে 'হাদিসে ছাকালাইন' একটি সুপরিচিত হাদীস যা শিয়া এবং সুন্নি মাযহাব উভয়ই বর্ণনা করেছে।
এই হাদীসটি হযরত মুহাম্মাদ (সা.) বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেমন, আরাফাত দিবসে, (তাঁর সর্বশেষ হজ্বে) এবং জিলহজ্ব মাসের আঠারো তারিখে ঐ হজ্ব থেকে ফেরার পথে 'গাদীর' নামক স্থানে বলেছিলেন। এই হাদীস বর্ণনাতে কোন কোন ক্ষেত্রে শাব্দিক কিছু পার্থক্য থাকলেও ভাবার্থে কোন পার্থক্য নেই। উদাহরণ স্বরূপ; কিছু বর্ণনাতে এরূপ এসেছে যে, হযরত মুহাম্মাদ (সা.) বলেছেন: 'হে মানব সকল! আমি তোমাদের মাঝে দুইটি মুল্যবান জিনিস আমানত রেখে যাচ্ছি: আল্লাহর কিতাব (কোরআন) ও আমার আহলে বাইত। যতক্ষণ পর্যন্ত ঐ দু'টিকে দৃঢ়ভাবে আকড়ে ধরবে পথভ্রষ্ট হবে না'।
এরূপ হযরত মুহাম্মাদ (সা.) থেকে অন্য হাদীসে এসেছে: আমি তোমাদের মাঝে দুইটি মুল্যবান জিনিস রেখে যাচ্ছি, যদি আমার পরে সেগুলি কে দৃঢ়ভাবে আকড়ে ধর তাহলে কখনই পথভ্রষ্ট হবে না।
একটি আল্লাহর কিতাব (কোরআন) যা আসমান থেকে সরাসরি জমিনে আসা একটি রশি স্বরূপ, অপরটি আমার আহলে বাইত। এই দুইটি কিয়ামত দিবস পর্যন্ত একে অপরের থেকে পৃথক হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত 'কাউছার' ঝর্নার নিকট আমার সাথে মিলিত হবে। সতর্ক থেক যে আমার পর সেগুলির (কোরআন ও আহলে বাইত) সাথে কিরূপ ব্যবহার করবে।
এই হাদীস থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, হযরত মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহ্ তা'য়ালার কিতাব (কোরআন) ও তাঁর আহলে বাইত (আ.)-এর সাথে মুসলমানদের, অন্ততপক্ষে কিছু সংখ্যক মুসলমানদের ব্যবহারের বিষয়ে চিন্তিত ছিলেন।
অন্যক্ষেত্রে হযরত মুহাম্মাদ (সা.) বলেছেন: আমি দুইটি প্রতিনিধি তোমাদের মধ্যে রেখে যাচ্ছি: প্রথম আল্লাহর কিতাব (কোরআন) যা আসমান থেকে জমিন পর্যন্ত ঝুলন্ত একটি রশির ন্যায় আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে আমার আহলে বাইত।
এ দুইটি এক অপরের থেকে পৃথক হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না 'কাউছার' ঝর্নার নিকট আমার সাথে মিলিত হবে।
উল্লেখিত হাদীসগুলি আহলে সুন্নতের বেশীরভাগ সূত্রেই পাওয়া সম্ভব, যেমন; সহিহ মুসলিম, ৮ম খণ্ড, পৃ.-২৫, হাদীস-২৪০৮, মুসনাদে আহমাদ, ৩য় খণ্ড, পৃ.-৩৮৮, হাদীস-১৭০২০, সুনানে দারেমি, ২য় খণ্ড, পৃ.-৪৩২৭ এবং সুনানে তিরমিযি, ৫ম খণ্ড, পৃ.-৬৪৩২, হাদীস-৩৭৮৮। অনুরূপ হাদীস (ইবনে আছিরের লিখিত) উসদুল গাবাহ গ্রন্থের ২য় খণ্ড, পৃ.-১৩ ও (বাইহাকির লিখিত) আল সুনানুল কোবরা গ্রন্থের ২য় খণ্ড, পৃ.-১৯৮ এবং কানযুল উম্মাল ১ম খণ্ড, পৃ.-৪৪ ইত্যাদি গ্রন্থে উল্লেখ হয়েছে। এই হাদীসের ভাবার্থ নিয়ে আলোচনা করার এখন উপযুক্ত সময়, অর্থাৎ হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর আমানত স্বরূপ রেখে যাওয়া দুইটি মুল্যবান জিনিস 'কোরআন ও আহলে বাইত' যা মুসলমানরা যদি দৃঢ়ভাবে আকড়ে ধরে পথভ্রষ্ট হবে না। এই হাদীস থেকে সুস্পষ্ট বোঝা যায় যে, কোরআন এবং আহলে বাইত সর্বদা একে অপরের সাথে সমন্বিত থাকবে এবং কখনই একটি অপরটির পরিপন্থী হবে না।
কেননা, এর বিপরীত হলে হযরত মুহাম্মাদ (সা.) মুসলমানদেরকে ঐ দু'টি (কোরআন ও আহলে বাইত)-কে অনুসরণ করতে বলতেন না।
এছাড়াও যদি এই দুইটি মূল্যবান জিনিসের মধ্যে ঐক্য এবং সমন্বয় না থাকতো, তাহলে সমস্ত মানুষেরাও বিস্মিত ও হতবাক হয়ে যেত যে, কোন দিকে যাবে এবং কি তাদের করণীয়। যদিও হাদীসের প্রথম অংশ থেকেই এই ব্যাখ্যাটির ইঙ্গিত পাওয়া যায়, তবুও হযরত মুহাম্মাদ (সা.) হাদীসের শেষাংশে এই বিষয়ের উপর ইঙ্গিত করে বলেছেন : 'ঐ দু'টি (কোরআন ও আহলে বাইত) একে অপরের থেকে পৃথক হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না 'কাউছার' ঝর্নার নিকট আমার সাথে মিলিত হবে'।
অবশেষে এই হাদীসের ফলাফল এই দাড়াঁয় :
◘ হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর জামানা থেকে (শুরু হয়েছে) কিয়ামত পর্যন্ত, আল্লাহর কিতাব এবং হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর আহলে বাইত (আ.) সর্বদা একে অপরের সাথে থাকবে।
◘ এরূপ কেউ বলতে পারবেনা যে আল্লাহ্ তা'য়ালার কিতাব যথেষ্ট, সুতরাং হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর আহলে বাইত (আ.)-এর কোন প্রয়োজন নেই, অথবা এর বিপরীত।
কেননা সুপষ্টতার সাথে হযরত মুহাম্মাদ (সা.) বলে গেছেন: আমি দু'টি মূল্যবান জিনিস আমার উম্মতের মধ্যে রেখে যাচ্ছি, অবশ্যই এ দু'টি মূল্যবান জিনিসকে দৃঢ়ভাবে আকঁড়ে ধরতে হবে যাতে করে পথভ্রষ্ট না হও।
◘ হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর আহলে বাইত (আ.), সমস্ত প্রকার দোষ-ত্রুটি থেকে মুক্ত, কখনই ভুলপথে যাবে না এবং সর্বদা হক্বের সাথে থাকবে।
◘ হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর আহলে বাইত (আ.)-কে কুরআনের অনুরূপ অবশ্যই কিয়ামত দিবস পর্যন্ত থাকতে হবে। অতএব, আহলে বাইত (আ.) কখনই (যদিও তা অল্প সময়ের জন্যেও হয়ে থাকে) এই পৃথিবী থেকে অবিচ্ছিন্ন ও তাতে অনুপস্থিত থাকবে না বরং অবশ্যই তাদের মধ্যে থেকে একজনকে পৃথিবীর বুকে থাকতে হবে।
এখানে উল্লেখিত অন্য হাদীস, 'হাদীসে সাফিনাহ্' যা শিয়া, সুন্নি ও নির্বিশেষে সকল মুসলমান হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর থেকে বর্ণনা করেছে যে তিনি বলেছেন: জেনে রেখ যে, উম্মাতের মাঝে আমার আহলে বাইত (আ.)-এর স্থান হচ্ছে হযরত নুহ (আ.)-এর নৌকা স্বরূপ, যারাই সেটিতে আরোহন করবে মুক্তি পাবে এবং যারাই অস্বীকার করবে পথভ্রষ্ট হল।
'সাফিনা' হাদীসটি সুন্নী মাযহাবের বিভিন্ন গ্রন্থে যেমন; হাকিম নিশাবুরির মুসতাদরাকের ৩য় খণ্ড, পৃ.-১৪৯-১৫১, নাবাহানির আল-আরবাইন এবং ইবনে হাজারের আসসাওয়াইকুল মুহরিকাহ গ্
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।