আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শিয়া মাযহাবের উত্পত্তি

আসুন সত্য ইসলামকে জানি এবং অন্যদেরকে জানাই ...

শিয়া শব্দের পারিভাষিক অর্থ আরবি ভাষায় শিয়া শব্দের প্রকৃত অর্থ হচ্ছে, এক, দুই অথবা একদল অনুসারী। শিয়া শব্দটি কোরআন শরীফে কয়েকবার এই অর্থে ব্যবহার হয়েছে। উদাহরণস্বরুপ: আল্লাহ তা'য়ালা হযরত মুসা (আ.)-এর একজন অনুসারীকে তাঁর শিয়া বলেছেন (সূরা কিছাছ, আয়াত-১৫)। অন্যক্ষেত্রে হযরত ইব্রাহীম (আ.) কে হযরত নুহ (আ.) এর শিয়া বলে পরিচয় দেয়া হয়েছে (সূরা ছাফ্ফাত, আয়াত-৩৭,৮৩)। ইসলামের প্রারম্ভে শিয়া শব্দটি প্রকৃত বা অভিধানিক অর্থে, বিভিন্ন ব্যক্তির অনুসারীগণকে বলা হত।

যেমন, কিছু রেওয়ায়েতে আলী ইবনে আবি তালিব (আ.)-এর শিয়া এবং কিছু রেওয়ায়াতে মোয়াবিয়া ইবনে আবি সুফিয়ানের শিয়া বলে ইঙ্গিত করা হয়েছে। কিন্তু এই শব্দটি ক্রমান্বয়ে দ্বিতীয় বা পারিভাষিক অর্থে পরিবর্তন হয় যার অর্থে শুধুমাত্র ইমাম আলী (আ.)-এর অনুসারীগণকে এবং যারা তার ইমামতের উপর বিশ্বাসী তাদেরকে শিয়া বলা হয়। শাহরেস্তানি (মৃত্যু-৫৪৮ হিজরি) আল মিলালু ওয়াননিহাল নামক গ্রন্থে যা বিভিন্ন দ্বীন ও মাযহাব সম্পর্কে লেখা একটি গুরুত্বপূর্ণ সূত্র, এইরূপ বলেছেন: 'শিয়া হচ্ছে তারাই যারা ইমাম আলী (আ.)-কে বিশেষভাবে অনুসরণ করে এবং তার ইমামত ও খেলাফতকে হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর ইচ্ছা এবং তারই শিক্ষাদানের ফল স্বরূপ বলে মনে করে (শাহরেস্তানি, আল মিলালু ওয়াননিহাল, খণ্ড-১,পৃ.-১৪৬)। এই সংজ্ঞাটি যথার্থ, কেননা শিয়ারা এই বিশ্বাসের উপর বিশ্বাসী যে হযরত আলী (আ.)-কে অনুসরণ করার কারণ হচ্ছে হযরত মোহম্মাদ (সা.)-এর আদেশ ও তারই ইচ্ছাস্বরূপ, না হযরত আলী (আ.)-এর নিজ ইচ্ছা, যেরূপ শিয়া ব্যতীত অনেকেই মনে করে হযরত মুহাম্মাদ (সা.) তাঁর স্থলাভিষিক্ত নির্ধারণের দায়িত্ব জনগণের উপর অর্পণ করে গিয়েছেন এবং তার মৃত্যুর পর এমন ব্যক্তির অনুসরণ করেছে যাকে তারা নিজেরাই সকিফাতে নির্ধারণ করেছিল। অবশ্যই উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে যে আবু বকর ইবনে আবি কোহাফা যে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হয়েছিল সে নিজে এই বিশ্বাসের উপর বিশ্বাসী ছিল যে অবশ্যই স্থলাভিষিক্ত নির্ধারণ করতে হবে এবং উমর ইবনে খাত্তাবও ছয়জনের একটি পরামর্শ পরিষদ গঠন ও তার সমস্ত কর্মসূচী নির্ধারণ করে গিয়েছিলেন, যাতে করে এই কমিটির মধ্যে থেকে একজনকে নিজের স্থলাভিষিক্ত হিসাবে নির্ধারণ করতে পারে।

আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, যে আলী (আ.) চতুর্থ খলীফা ছিলেন এবং সমস্ত মুসালমানরা তাকে নির্বাচন করেছিল কিন্তু তিনি তৃতীয় খলীফা উছমান বিন আফ্ফানের মৃত্যুর পর, খেলাফত দায়িত্বকে বাধ্য হয়ে মেনে নেন। হাসান ইবনে মুসা নো'বাখতি (মৃত্যু-৩১৩ হিযরি) শিয়া মাযহাবের একজন বিখ্যাত গবেষক তার ফিরাকুশ শিয়া নামক গ্রন্থে এরুপ বলেন: শিয়া, ইমাম আলী (আ.)-এর দল ও গোষ্ঠী। তারা হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর জামানায় এবং তার পরেও শিয়া নামে পরিচিত ছিল এবং আলী (আ.)-এর অনুসারী ও তার ইমামতের উপর বিশ্বাসী । শেইখ মুফিদ (মৃত্যু-৪১৩ হিযরি) একজন বিখ্যাত আলেম, শিয়া শব্দের ব্যাখ্যাতে এরূপ বলেন: শিয়া হচ্ছে তারাই যারা ইমাম আলী (আ.)-কে অনুসরণ করে এবং তাঁকে হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর অব্যবহিত পরে তার স্থলাভিষিক্ত হিসেবে মেনে থাকে (মুফিদ, আওয়ায়েলুল মাকালাত, পৃ.-৩৬)। (শিয়া মাযহাবের অনুসারীদেরকে পরবর্তীতে ইমামিয়া বলা হত) শেইখ মুফিদ শিয়া মাযহাবের নামের পরিবর্তন ও ইমামিয়া বলার কারণে বলেন: এই সংজ্ঞাটি তাদের ক্ষেত্রে বলা হয় যারা ইমামতের প্রয়োজনীয়তা ও তা সব জামানাই (যুগেই) অব্যাহত থাকার এবং সুস্পষ্টভাবে ইমাম (আ.)-কে নির্ধারণের প্রয়োজনীয়তা, এছাড়াও তার নিষপাপত্ব ও পরিপূর্ণতার উপর ঈমান রাখে (মাছদার, পৃ.-৩৭)।

এমতাবস্থায় বলতে পারি শিয়া মুসলমান বলতে তাদেরকে বোঝায় যারা হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর অসিয়ত ও তার স্থলাভিষিক্তের উপর এরূপ বিশ্বাস রাখে: ক)- হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর স্থলাভিষিক্তির পদ একটি ঐশী পদ। খ)- যেরূপ হযরত মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহ তা"য়ালার পক্ষ থেকে মনোনীত হয়েছেন, সেইরূপ তার স্থলাভিষিক্তও আল্লাহর পক্ষ থেকে মনোনীত এবং হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর দ্বারা মানুষের মাঝে উপস্থাপিত হবে। গ)- ইমাম আলী (আ.), হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর ঠিক পরবর্তী স্থলাভিষিক্ত। শিয়া মাযহাবের সূচনা সাধারণত এই প্রশ্ন হয়ে থাকে যে শিয়া মাযহাব কোন সময় থেকে শুরু হয়েছে। ইমামত সম্পর্কে অনেক হাদীস বিভিন্ন সূত্রে শিয়া এবং অন্যান্য মাযহাব থেকে বর্ণিত হয়েছে যা পরবর্তিতে "শিয়া মাযহাবের আক্বাইদ" নামক অধ্যায়ে উল্লেখ ও পর্যালোচনা করা হবে।

এখানে আমরা হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এর থেকে বর্ণিত হাদীসগুলি যেখানে কোন গোষ্ঠীকে আলী (আ.)-এর শিয়া বা অনুসারী বলে স্মরণ করেছেন সেগুলি, অতঃপর এই বিষয়ের উপর উল্লেখিত দলিলগুলি যা বিভিন্ন হাদীসসমূহে ও ইসলামী ইতিহাসে এসেছে এবং আমাদের আলোচ্য বিষয়কে বুঝতে সহায়তা করবে, সেগুলি উল্লেখ করব। যে সমস্ত হাদীসগুলি এখানে উল্লেখ করা হবে তা আহলে সুন্নাতের গুরুত্বপূর্ণ সূত্রগুলি থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। উল্লেখিত হাদীসগুলি (যা এই বিষয়ে বর্ণিত হয়েছে) শুধুমাত্র উদাহরণ স্বরূপ আনা হল কিন্তু এ বিষয়ক অন্যান্য হাদীসগুলি এই সূত্রে অথবা অন্যান্য সূত্রে পাওয়া যাবে। ১- ইবনে আসাকির (মৃত্যু ৫৭১ হিজরি) জাবির ইবনে আবদুল্লাহ আনসারি থেকে বলেন: একদিন আমরা হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এর নিকট ছিলাম যখন আলী (আ.) প্রবেশ করলেন। এমন সময় হযরত মুহাম্মাদ (সা.) বললেন: 'তারই কসম, যার হাতে আমার জীবন, এই ব্যক্তির (আলী) ও তার শিয়ারা (অনুসারী) কিয়ামত দিবসে মুক্তিপ্রাপ্ত হবে' অতঃপর সূরা বাইয়েনার সাত নং আয়াতটি নাযিল হয় 'অবশ্যই যারা ঈমান এনেছে এবং নেককাজ করবে সমস্ত মানব জাতির থেকে তারা উত্তম'।

এর পর থেকে যখন হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এর সাহাবাগণ আলী (আ.)-কে দেখতেন, বলতেন মানুষের মধ্যে উত্তম ব্যক্তি এসেছে (ইবনে আছাকির, তারিখে ইবনে আছাকির, খণ্ড- ২, পৃঃ- ৪৪২, সুয়ুতি, আদ্দুররুল মানছুর, খণ্ড-৮, পৃঃ-৫৮৯০)। ২- ইবনে হাজার (মৃত্যু-৯৭৪ হিজরি) ইবনে আববাস থেকে বর্ণনা করে যে : হযরত মুহাম্মাদ (সা.) সূরা বাইয়েনার সাত নং আয়াতটি নাযিল হওয়ার পর আলী (আ.)-কে বলেন: 'ঐ (উত্তম) ব্যক্তি তুমি এবং তোমার শিয়ারা। তুমি এবং তোমার শিয়ারা কিয়ামতের দিনে উপস্থিত হবে যখন আল্লাহ তা'য়ালা তোমাদের উপর সন্তুষ্ট এবং তোমরাও তাঁর উপর সন্তুষ্ট। আর তোমার শত্রুরা উপস্থিত হবে রাগান্বিত অবস্থায় এবং তাদের গর্দান ধরে নিয়ে যাওয়া হবে' (ইবনে হাজার, আছছাওয়াইকুল মোহরিকাহ, অধ্যায়-১১)। এই গ্রন্থেই ইবনে হাজার উম্মে সালামা থেকে বর্ণনা করে : এক রাতে হযরত মুহাম্মাদ (সা.) যখন তার বাড়ীতে ছিল, তাঁর কন্যা ফাতিমা (সা. আ.) ও তাঁর সাথে আলী (আ.) প্রবেশ করেন।

অতঃপর হযরত মুহাম্মাদ (সা.) বলেন: "হে আলী, তুমি ও তোমার সাহাবাগণ বেহেশত্বাসী। তুমি ও তোমার শিয়ারা বেহেশতবাসী"। ৩- ইবনে আছির (মৃত্যু-৬০৬ হিজরি) বলেন: হযরত মুহাম্মাদ (সা.) আলী (আ.)-কে উদ্দেশ্য করে বলেন : "হে আলী, তুমি আল্লাহর সম্মুখে উপস্থিত হবে এমন অবস্থায় যে, তুমি ও তোমার শিয়ারা আল্লাহর উপর সন্তুষ্ট এবং আল্লাহ তা'য়ালা তোমাদের উপর সন্তুষ্ট আর তোমার শত্রুরা উপস্থিত হবে রাগান্বিত এবং তাদের গর্দান ধরা হবে' এবং হযরত মুহাম্মাদ (সা.) তাঁর নিজ হাতে গর্দান ধরে দেখিয়ে দেন (ইবনে আছির, আননিহায়াহ, কামাহ ধাতুমূল)। অন্যান্য আরো হাদীস আছে যেখানে হযরত মুহাম্মাদ (সা.) আলী (আ.)-কে "আমাদের শিয়া' বলে সম্বোধন করেছেন। এবং এই ব্যাখ্যাটি পুর্বে উল্লেখিত সংজ্ঞাগুলির সাথে একমত, যেমন আমরা পূর্বে বলেছি শিয়া হচ্ছে তারাই যারা হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর শিক্ষাদানের ফলে ইমাম আলী (আ.)-কে অনুসরণ করে, না আলী (আ.)-এর নিজ সিদ্ধান্তে।

প্রকৃত অর্থে আলী (আ.)-এর শিয়া, অর্থাত্ত হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর শিয়া। উদাহরণ স্বরূপ, ইবনে আসাকির হযরত মুহাম্মাদ (সা.) থেকে বর্ণনা করেছে যে : 'অবশ্যই বেহেশ্তে একটি ঝর্না আছে যা ফুলের মধুর থেকেও মিষ্টি, মাখনের থেকেও নরম, বরফের থেকেও ঠাণ্ডা এবং তার সুগন্ধ মেশকের থেকেও বেশি। ঐ ঝর্নার তলদেশে যে মাটি আছে তা থেকে আমি এবং আমার আহলে বাইত তৈরি হয়েছে আর আমাদের শিয়ারাও ঐ মাটির অংশ বিশেষ থেকে তৈরি হয়েছে' (তারিখে ইবনে আছাকির, খণ্ড-১, পৃ.-১৩১)। অন্যান্য অনেক হাদীস আছে যেখানে হযরত মুহাম্মাদ (সা.) আলী (আ.)-কে 'তোমার বংশধরের শিয়া' বলে সম্বোধন করেছেন। এই উক্তিটিও পূর্বের আলোচ্য বিষয়ের সমর্থক।

কেননা পূর্বে আমরা বলেছি, শিয়া হচ্ছে ইমাম আলী (আ.)-এর অনুসারী এবং তার ইমামতের উপর বিশ্বাসীগণ। ঠিক যেরূপ আমরা তৃতীয় অধ্যায়ে এই বিষয়ের উপর বিস্তারিত আলোচনা করব যে, শিয়া মাযহাবিগণ এই বিষয়ের উপর বিশ্বাসী যে, ইমাম আলী (আ.) হচ্ছেন প্রথম ইমাম এবং তারপর 'ইমামত বিষয়টি' হযরত ফাতিমা (সা. আ.) ও তাঁর বংশের থেকে আল্লাহ তা'য়ালা যাদেরকে মনোনীত এবং হযরত মুহাম্মাদ (সা.) উপস্থাপন করেছেন, তাদের মধ্যে অব্যাহত থাকবে। উদাহরণ স্বরূপ, যামাখশারি (মৃত্যু-৫২৮হিজরি ) তার নিজ গ্রন্থে 'রাবিউল আবরার' বলেন: হযরত মুহাম্মাদ (সা.) বলেছেন: 'হে আলী, যখন কিয়ামত দিবস আসবে, আমি আল্লাহ তা'য়ালার রহমত ও অনুগ্রহে আশ্রয় নেব এবং তুমি আমার প্রতি আশ্রয় নিবে, তোমার সন্তানরা তোমার প্রতি আর তাঁদের শিয়ারা (অনুসারীরা) তাদের কাছে আশ্রয় নিবে। ঐ সময় দেখবে যে আমাদেরকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়' (সুবহানি, আল মিলালু ওয়াননিহাল, খণ্ড-৬, পৃ.-১০৪)। অবশ্যই উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে যে কোরআন শরিফের আয়াত অনুযায়ী 'নবুওয়াত' বিষয়টিও নবীদের বংশে উত্তরাধিকার হিসেবে ছিল।

কোরআন শরিফে বলা হয়েছে : 'ও অবশ্যই আমরা নুহ ও ইব্রাহীমকে পাঠিয়েছি এবং নবুওয়াত ও কিতাবকে তাদের বংশে স্থিত করেছি' (সূরা তুর, আয়াত নং-২৬)। উদ্দেশ্য হচ্ছে যে, যারা নবুয়াত প্রাপ্তির প্রয়োজনীয় যোগ্যতার অধিকারী ছিল (অর্থাত্ত যারা আল্লাহ তা'য়ালার পক্ষ থেকে মনোনীত হওয়ার জন্য উপযুক্ত যোগ্যতার অধিকারী ছিল) তারা হযরত নুহ এবং ইব্রাহীম (আ.)-এর বংশ থেকে নবুওয়াতের দায়িত্ব লাভ করেছিল। উপরোক্ত হাদীস এবং ইমামত বিষয়ের হাদীস (যা পরবর্তিতে বলা হবে) ছাড়াও অন্যান্য দলিল আছে যেগুলি পর্যালোচনা করলে, শিয়া নামের এক গোষ্ঠী বা দল কে হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর সময়ে সৃষ্টি হওয়াকে একটি স্বাভাবিক বা জরুরী বিষয় বলে মনে হবে। যেমন, মক্কায় যখন হযরত মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহ তা'য়ালার পক্ষ থেকে তার নিজ আত্মীয় স্বজনদের দাওয়াত করেন এবং সরাসরি ইসলাম প্রচার করার দায়িত্বে নিযুক্ত হন, হযরত মুহাম্মাদ (সা.) তাদেরকে নিজ গৃহে দাওয়াত করেন এবং প্রয়োজনীয় খাবার প্রস্তুত করেন। খাওয়া শেষে হযরত মুহাম্মাদ (সা.) তাঁর রিসালাত সম্পর্কে বলেন এবং উপস্থিত মেহমানদেরকে ইসলাম ধর্মের প্রতি দাওয়াত দিয়ে এরূপ বলেছিলেন: তোমাদের মধ্যে যে ইসলাম ধর্মকে মেনে নিয়ে আমাকে সাহায্য করবে, আমার “ওয়াছি” ও 'প্রতিনিধি' হবে।

সবাই চুপ করেছিল। শুধুমাত্র যে ব্যক্তি হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর ইসলাম দাওয়াতে জবাব দিয়েছিলেন, তিনি হলেন আলী (আ.) এবং তখন তিনি তের বছরের কিশোর ছিলেন। হযরত মুহাম্মাদ (সা.) আলী (আ.) -কে বসতে বললেন এবং দ্বিতীয় ও তৃতীয় বার পুনরায় ইসলামের প্রতি দাওয়াত করলেন। প্রত্যেক বারই, শুধুমাত্র আলী (আ.) তাঁর আহবানে সাড়া দিয়ে ছিলেন। অতঃপর, হযরত মুহাম্মাদ (সা.) আলী (আ.)-এর প্রস্তুতি এবং আল্লাহ তা'য়ালার ইচ্ছার প্রতি তার আত্মসমর্পণকে মেনে নিয়ে, আল্লাহ তা'য়ালার নির্দেশে আলী (আ.)-কে তার স্থলাভিষিক্ত হিসেবে ঘোষণা করেন (এই ঘটনাটি, শিয়া ও সুন্নি মাযহাবের বিভিন্ন সূত্রে উল্লেখিত হয়েছে।

সুন্নি সূত্রের মধ্যে বলা যেতে পারে যেমন; তাবারী, তারিখুল উমাম ওয়াল মুলুক (ম ৩১০ হিজরি), খণ্ড-৩, পৃ.-৬২,৬৩। ইবনে আছির, আলকামিলু ফিততারিখ, (ম ৬৩০ হিজরি), খণ্ড-২, পৃ.-৪০, ৪১। মুসনাদে ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল, মুসনাদে আল আশারাহ বিল জান্নাত, হাদীস নম্বর ৮৪১)। একটি গুরুত্বপুর্ণ বক্তব্যে হযরত মুহাম্মাদ (সা.) আলী (আ.)-কে সর্বদা হক্বের সাথে, অর্থাত্ত সমস্ত ভুল-ভ্রান্তি ও অযথা কাজ থেকে মুক্ত বলেছেন। প্রকৃতপক্ষে প্রাসাঙ্গিক ভাবে মুসলমান এবং সমস্ত সত্য-সন্ধানীদের কাছে চেয়েছেন যে তাকে আলী (আ.) অনুসরণ করে।

উম্মে সালামা বলেন যে, হযরত মুহাম্মাদ (সা.) বলেছেন: "আলী (আ.) সর্বদা হক্বের সাথে এবং কোরআন ও হক্ব সর্বদা আলী (আ.)-এর সাথে আর কিয়ামত পর্যন্ত একে অপরের থেকে পৃথক হবে না' এই হাদীসটি ইবনে আববাস, আবু বকর, আয়েশা, আবু সাইদ খুদরি, আবু লাইলি এবং আবু আইয়্যুব বর্ণনা করেছেন (গাফ্ফারি, শিয়া বা প্রকৃত ইসলাম, গ্রন্থ অনুযায়ী, পৃ.-১০, এই হাদিসটি শিয়া সূত্র ছাড়াও অন্য মাযহাব থেকে পনেরটি সূত্র হতে উল্লেখিত হয়েছে। যেমন; দেখুন: হাকিম নিশাবুরির মুস্তাদরাক গ্রন্থে, ইবনে হাজারের ছাওয়ায়িকুল মুহরিকাহ গ্রন্থে, মুত্তাকি হিন্দির কানযুল উম্মাল ও ইয়ানাবিউল মুওয়াদ্দাহ গ্রন্থে)। এছাড়াও হযরত মুহাম্মাদ (সা.) থেকে বর্ণিত যে তিনি বলেছেন: 'আল্লাহ তা'য়ালা আলী (আ.)-কে রহমত করুন। হে আল্লাহ, সর্বদা হক্বকে আলী (আ.)-এর সাথে স্থিত কর (আত তিরমিযি, সুনান, কিতাবুল মানাকিব, হাদিস নং-৩৬৪৭)। হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এরূপ কয়েকবার আলী (আ.)-কে ইসলামের বিষয়ে তাঁর সাহাবাগণের মধ্যে সর্বজ্ঞানী হিসেবে উপস্থাপন করেছেন।

যেমন, হযরত মুহাম্মাদ (সা.) বলেছেন: 'হিকমতের (প্রজ্ঞার) দশটি ভাগ আছে যার নয়টি আলী (আ.)-কে এবং শুধুমাত্র একটি সমস্ত মানুষের মধ্যে ভাগ করা হয়েছে (ইবনে কাছির ( মৃত্যু-৭৭৪ হিজরি), আলবিদায়া ওয়ান্নিহায়াহ, খণ্ড-৭, পৃ.-৩৫৯)। অনেক পরে, দ্বিতীয় খলীফা হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর এই বক্তব্যগুলির প্রতি সমর্থন জানিয়ে বলেছিল: 'আল্লাহ তা'য়ালা যেন আলী (আ.)-এর অনুপস্থিতিতে আমাকে কোন জটিল সমস্যার সম্মুখীন না করেন' (উদাহরণ স্বরূপ, দেখুন এই গ্রন্থে, ইবনে হাজার, আল ইছাবাহ ফি তামিযিস সাহাবাহ এবং ইবনে কাছির, আল বিদায়াতু ওয়ান্নিহায়াহ, খণ্ড-৭, পৃ.-৩৬)। উপরোক্ত বক্তব্য ছাড়াও, ইসলামের জন্য ইমাম আলী (আ.)-এর আত্মোসর্গী ভূমিকা পালন ছাড়াও যে গুরুত্বপুর্ণ কাজগুলি করেছেন, তা আমাদের সবার জানা প্রয়োজন। কেননা, সেগুলি জানলে মুসলমানদের মাঝে ইমাম আলী (আ.)-এর স্থান ও মর্যাদা বুঝা যাবে। উদাহরণ স্বরূপ, যখন মক্কার মুশরিকরা হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-কে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল, আল্লাহ তা'য়ালা হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-কে ঐ পরিকল্পনাটি অবগত করেন।

হযরত মুহাম্মাদ (সা.) আলী (আ.)-এর কাছে জিজ্ঞেস করলেন, 'তুমি কি প্রস্তুত আছো আমার স্থানে শয়ন করতে। যাতে করে শত্রুরা মনে করবে যে, মুহাম্মাদ বাড়িতেই আছে এবং আমি কোন অসুবিধা ছাড়াই মক্কা থেকে হিজরত করতে পারি'। আলী (আ.) এই কাজটি অতি আনন্দের সাথে গ্রহণ করেন। আর এই সত্য ঘটনার প্রেক্ষাপটে এই আয়াত নাযিল হয়: 'এবং মানুষের মধ্যে এমন কেউ আছে যে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিজের জীবন উত্সর্গ করে দেয়' (সূরা বাকারা, আয়াত নং-২০৭)। আর হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের দিন থেকেই ইসলামী পঞ্জিকা শুরু হয়েছিল।

আলী (আ.) ইসলামের স্বার্থে অনেক কাজ করেছেন, যা ইতিহাসের গ্রন্থগুলিতে, শিয়া ও সুন্নি হাদীস গ্রন্থসমূহে এসেছে। যেমন, হযরত আলী (আ.)-এর বদরের যুদ্ধে, খন্দকের যুদ্ধে, হুনাইনের যুদ্ধে ... অংশগ্রহণ ও মৌলিক ভূমিকা পালন করা। পূর্বে যেরূপে বলা হয়েছে, সঠিকভাবে ইমামত সম্পর্কে এবং বিশেষভাবে হযরত আলী (আ-এর ইমামত সম্পর্কে রাসুল (সা.) বর্ণিত হাদীসগুলি স্বতন্ত্রভাবে আলোচিত হওয়া উচিত্। কিন্তু এখানে আমরা সুপরিচিত 'হাদীসে গাদীর' সম্পর্কে বলে বক্তব্য শেষ করব। হযরত মুহাম্মাদ (সা.) তাঁর শেষ হজ্ব সফর (হাজ্বাতুল বিদা) থেকে ফিরে আসার পথে, তার সাথে থাকা হাজার হাজার মুসালমানদেরকে, ঐ স্থানে অবস্থিত ক্ষুদ্র জলাশয় যার নাম ছিল 'গাদীর' একত্রিত হতে বললেন।

হযরত মুহাম্মাদ (সা.) একটি উঁচুস্থানে (যা উটের পিঠের উপর বসার আসন তৈরি করা হয়েছিল) দাড়িয়ে বললেন: 'আমি যার মাওলা ও অভিভাবক, এই আলী হচ্ছে তার মাওলা ও অভিভাবক'। এই কথা শেষ হতেই উপস্থ

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.