৫ম পর্ব
অপারেশনে গেলে আমি আগে খুজি কিশোরি কোন্ বাড়ীতে আছে। এখন সোনা দানার চেয়ে কিশোরি আমার কাছে দামী। সুন্দরি মহিলা এখন আর আমার মনে ধরেনা। বারন্ত কিশোরি দেখলে আমি দিশেহারা হয়ে যাই। এমনও হয়েছে রাস্তা থেকে কিশোরি ধরে নিয়ে এসেছি।
যতদিন ইচ্ছে আটকে রেখে আমার মনের তৃপ্তি মিটিয়েছি। এমনি যখন আমাদের রাজত্ব চলছিল হঠাৎ একদিন আমাদের কমান্ডার বলল, মুক্তি আর ইন্ডিয়ার সৈন্যরা আমাদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে। সারেন্ডার করা ছাড়া উপায় নাই। তখনই আমার মনে প্রশ্ন এল যুদ্ব তো শুরু হয়নি। তাহলে সারেন্ডার করব কোথায়।
আমি তো এসেছিলাম ইন্ডিয়ার সৈন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ব করতে। কোথায় ইন্ডিয়ার সৈন্য। এতদিন যেসব মানুষ খতম করেছি সবাই তো নিরীহ মানুষ। তাদের হাতে কোন অস্্র ছিলনা। মুক্তি তো একটাও ধরতে পারলাম না।
তাহলে যুদ্বটা করলাম কোথায়! এখন সারেন্ডার করলে উপায় কি হবে! আমাদের আর কোন ক্ষমতা থাকবেনা। আশেককে জিজ্ঞেস করলাম: কোথায় ইন্ডিয়ার সৈন্য?
বর্ডার মে।
আর মুক্তি?
সব বাঙাল মুক্তি হ্যায়। সব বাঙাল হিন্দু হ্যায়। যত পার খতম কর।
হাই কমান্ডের আদেশ।
তার পরদিন আমাদের হাই কমান্ড মুজাহিদ এসে সবাইকে ডেকে ভাষন দিল, মুক্তি আর ইন্ডিয়ার সৈন্য ঢাকার জয়দেবপুর পৌছে গেছে। আজ কালের মধ্যেই আমরা সারেন্ডার করতে যাচ্ছি। তার আগেই যত বুদ্বিজীবি আছে সব শেষ করতে হবে। সে একটা নামের লিষ্ট দিল।
সেই মতে আমরা কয়েকটা দলে ভাগ হয়ে সবাইকে ধরে এনে মিরপুরে যেখানে সব লাশ ফেলা হয় সেখানে খতম করে দিলাম। আশেক খুব খুশি হয়ে বলল, তুম তোমারা গাও মে চালা যাও। আর আমরা পাকিস্তানি সৈন্যের সাথে সারেন্ডার করে তাদের সাথে পাকিস্তান চলে যাব। যাবার আগে তোমাকে কিছু তুফা দিব। আমার আর আসলামের বাড়ী আছে।
আমাদের বাড়ীগুলো তুমি নিয়ে নাও। দশ নম্বরে ইসমাইলের এক ষ্টেশনারী দুকান ভি হ্যায়। ও ভি লে লাও। দাম যা পার তাই দাও। তার নিজের এবং আসলামের বাড়ী আছে।
বাকীরা সব রিফিউজি। সরকারি বাড়ীতে থাকে। এদেশে আসার পর পাকিস্তান সরকার তাদের থাকার ব্যবস্থা করেছিল।
আশেকের কথা আমার মনে হল খুবই বুদ্বিমানের কাজ। আমি বললাম, হ্যা, তোমাদের বাড়ীগুলো এবং দোকান আমি কিনব।
আমার কাছে তখন লুট করা লক্ষ লক্ষ টাকা আর সোনাদানা। লুট করা একটা সুটকেসের ভেতর রাখি। আশেক ইসমাইল আর আসলামকে ডেকে ব্যবস্থা করতে বলল। তারা কয়েক ঘন্টার মাঝে সব ব্যবস্থা করে ফেলল। বাড়ীর দলিল পত্র এনে আমার হাতে দিল।
আর দোকানের চাবী। আমি নাম মাত্র মূল্য দিয়ে দিলাম।
রাতে সবাই গেল দশ নম্বরে। সেখানে হাই কমান্ড মুজাহিদ ভাষন দিল। কাল সারেন্ডার করবে।
ভাষনে বলা হল যে যেভাবে পার আতœরক্ষা কর। যারা আর্মির সাথে থাকতে চাও তারা এখনি জড়ো হও। আশেক আমাকে কানে কানে বলল, তুম লেবাস বদল কার লও আওর তোমরা গাও মে চালা যাও। আমিও ঠিক এমনই একটা চিন্তা করছিলাম। রাতে ঘরে ফিরে আমার দাড়ি ফেলে দিলাম।
আমার লুট করা সোনা দানা টাকা পয়সা লুট করে আনা একটা পুরনো সুটকেসে ভরলাম। পাকিস্তানি কোর্তা ছেড়ে প্যান্ট সার্ট পরলাম। তারপর আশেকের বাড়ীতে গিয়ে উঠলাম। এটা এখন আমার বাড়ী। তার কাছাকাছি আরও দুটা বাড়ীর মালিক এখন আমি।
পরের দিন সকাল থেকেই ঢাকা শহর উৎসবে মেতে গেল। মুক্তিদের জয়। জয়ের উৎসব। আমি নিজেও সেই মানুষের কাফেলাতে যোগ দিলাম। যাতে আমার উপর কারও কোন সন্দেহ না হয়।
সবাইর সাথে আমিও মেতে রইলাম এই উৎসবে। তারপর একদিন সুযোগ বুঝে আমার সুটকেস নিয়ে রওয়ানা দিলাম আমার গ্রামের বাড়ীর উদ্দেশ্যে। দেখলাম আমার আপনজন সবাই আমার জন্য খুব চিন্তায় ছিল। আমি একটা গল্প ফেঁদে বসলাম। বললাম, এতদিন আমাকে পাকিস্তানি আর্মি কেম্পে আটকে রেখেছিল।
তাদের অনেক টর্চারের কথাও বললাম যা আমি নিজে করেছি বাঙালিকে। শুধু মাদ্রাসায় পড়ি বলে তারা আমাকে প্রানে মারেনি। ১৬ই ডিসেম্বরে ছাড়া পেয়ে প্রানে বেঁচে এসেছি। আমার কথা সবাই বিশ্বাস করল। আর্মির হাত থেকে কেউ ফিরে আসেনা, ময়মুরুব্বির দোয়ায় আমি যে ফিরে এসেছি সেটাই বড় কথা।
দেশে তখনও সরকারি আদেশ চলেনি। মুক্তিবাহিনীর কমান্ডারের আদেশেই সব চলে। আমি তাদের কাজে সাহায্য করতে লাগলাম। যখন যেখানে যা লাগে আমি এগিয়ে যাই। রাজাকার আর পাকিস্তানি বাহিনীকে যখন তখন গালাগালি করি।
মানুষের সাথে গভীরভাবে মিশে গেলাম। আর মনে মনে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষন করতে লাগলাম।
কিন্তু আমার মাথা থেকে কিশোরির চিন্তা যায় না। যখন তখন আমি দিশেহারা হয়ে পড়ি।
একদিন শুনলাম শেখ মুজিবুর রহমান সব রাজাকারকে ক্ষমা করে দিয়েছে।
মনে মনে খুশি হলাম। আমি ফিরে গেলাম ঢাকায়। আমার নিজের বাড়ীতে। সেখানে বেশ কিছু মানুষের সাথে ভাব করে নিলাম। বিহারীরা নেই।
সব নতুন মানুষ। দুটা বাড়ী ভাড়া দিলাম। একটায় আমি থাকি। আর প্রতিদিন দোকানে বসি। আমি এখন ব্যবসায়ী।
খুব ব্যস্ত। কিন্তু কিশোরি কোথায় পাই!
দোকান বন্ধ করে সন্ধ্যা হলেই বেরিয়ে পড়ি। সবগুলো বেশ্যাপাড়া ঘুরে বেড়াই। কিশোরির খোজে। দুএক জায়গায় মিলেছে।
জানতে পারলাম বেশিরভাগই আর্মি কেম্প থেকে বেঁচে এসেছে। এর মাঝে পরিচয় হল দুজন বেশ্যা দালালের সাথে। তাদের সাথে কন্ট্রাক্ট হল তারা আমাকে কিশোরি সরবরাহ করবে। সুন্দরি কিশোরি। টাকার কোন অসুবিধা হবেনা।
সেভাবেই চলল। প্রায় প্রতি রাতে আমার ঘরে কিশোরি আসে। আমি আমার তৃপ্তি মিটাই। দিনের বেলায় আমি অন্য মানুষ।
ব্যবসা খুব ভাল চলছে।
একা পারিনা। একজন কর্মচারী নিয়োগ দিলাম। তারপর আরও একজন। আমি মাঝে মাঝে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াই। সেই সব জায়গায় যাই যেসব জায়গায় লাশের স্তুপ তৈরি করেছিলাম।
সেসব বাড়ীর সামনে যাই যার প্রতিটি মানুষকে খতম করেছি। শিশুসহ। অনেকগুলো বাড়ীর কথা আমার মনে আছে। দেখলাম কিছু কিছু বাড়ী এখনও খালি পড়ে আছে। তখন মাথায় বুদ্বি এল এসব বাড়ী তো দখল করা যায়! এমনি বিহারীর অনেক বাড়ীও খালি পরে আছে।
খুজে খুজে বের করলাম কয়েকটা। তারপর তহশিল অফিসে গিয়ে একজনের সাথে রফা হল। জাল দলিল করে আমার নামে রেজিষ্ট্রি করলাম তিনটা বাড়ী। ঢাকা শহরে এখন আমি ছয়টা বাড়ীর মালিক। ভাবতেই গর্বে বুকটা ফুলে উঠে! (চলবে)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।