তিন দিন পর কাসেমকে নিয়ে উপস্থিত হলাম উকিলের অফিসে। উকিল আমাদের দেখে কুশল বিনিময় করে বসতে বলল। আমরা বসার পর উকিল আমার দিকে চুপচাপ তাকিয়ে রইল কিছুক্ষন। তারপর বলল, দেখ আমার পঁচিশ বছর ওকালতি জীবনে এমন অদ্ভুত মক্কেলের দেখা পাইনি। সে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মেরেছে।
দোষ স্বীকার করে সে একটা ষ্টেটমেন্ট দিয়েছে। তাতে মনে হয় তার বড় ধরনের শাস্তি হয়ে যাবে। আমি ভেবে দেখলাম তাকে সব দোষ দেয়া যায়না। সে ঘাবড়ে গেছে এবং ভয়ে ভাল করে কথাও বলতে পারেনা। বোধ হয় পুলিশের চাপে পড়ে এবং ভয়ে এসব জবানবন্দী দিয়েছে।
পুলিশ তার উপর খুব চাপ দিয়েছে। কারন এদেশে সে আছে মাত্র দুবছর। তার অতীত সম্বন্ধে কিছুই জানা নেই। তার অতীত জানতে হলে তার দেশে যেতে হবে। তাই তাকে খুব চাপ দিয়ে তার মুখ থেকেই তার অতীত জেনে নিল।
সে নাকি বিরাট ষ্টেটমেন্ট। তাতে মামলার সবকিছু তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে।
কি দিয়েছে সে জবানবন্দী?
আমি তো এখনও কিছুই দেখিনি। দোভাষীর সাহায্যে সে তার নিজের ভাষায় বলেছে আর তা এখন টাইপ হচ্ছে। একটা কপির জন্য আমি দরখাস্ত করেছি।
কাল পরশুর মাঝে পেয়ে যাব। তখন বুঝতে পারব কোন্ দৃষ্টি নিয়ে মামলা লড়তে হবে। জবানবন্দী না দেখে এখন কিছুই বলতে পারবনা। তোমরা বরং দুদিন পর আস। সব দেখে আলোচনা করা যাবে।
আমরা সেখান থেকে বেরিয়ে দুজন অনেকক্ষন চুপচাপ হাটলাম। সাবওয়ের কাছে এসে কাসেম বলল, কাকা, কে হতে পারে জবানবন্দী?
কি আর হবে? বোধ হয় দোষ কিছু করেছে যা আমরা জানি না এবং তা স্বীকার করেছে। এদেশে দোষ স্বীকার করলে অনুকম্পার দৃষ্টিতে শাস্তি হয়। জবানবন্দী দিয়ে বোধ হয় ভালই করেছে। তারপর সারা পথ দুজনের আর কোন কথা হয়নি।
দুদিন পর আবার যখন উকিলের অফিসে গেলাম উকিল তখন অন্য মক্কেলের সাথে ব্যস্ত। আমাদের দেখে উঠে এল এবং বলল: আমি এখন একটা বড় মামলার মক্কেলের সাথে ব্যস্ত আছি। জবানবন্দীর কপি আমি পেয়েছি, তার নিজের ভাষা বাংলা এবং ইংরেজি দুটোই আছে। আমি ওই মক্কেলের সাথে কথা শেষ করে আসতে আসতে তুমি বরং জবানবন্দীটা এক নজর দেখে নাও। এই বলে সে একটা ফাইল আমার হাতে দিয়ে পাশের কামড়ায় চলে গেল।
আমি ফাইলটা খুলে দেখলাম। প্রথমেই বাংলায় জবানবন্দী। তার নীচে ইংরেজিতে টাইপ করা। নিজের ভাষাতেই পড়তে স্বাচ্ছন্দ বোধ করলাম। বাংলায় ৬২ পৃষ্ঠা।
এতবড় জবানবন্দী! কি লিখেছে এত সব! কতক্ষনে শেষ করব! বেচারা! ভয়ে মুখে যা এসেছে তাই বোধ হয় বলেছে। দেখা যাক কি বলেছে।
আমি পড়তে শুরু করলাম:
জবানবন্দী
আমার নাম আলহাজ মুহাম্মদ ইয়াসিন হাওলাদার। বাড়ী বাংলাদেশের .. জেলার .. গ্রামে। পিতা মৃত মুহাম্মদ আতর আলী হাওলাদার।
স্থায়ী ঠিকানা ...বাংলাদেশ। বর্তমান ঠিকানা ... কানাডা।
আমি আমার গ্রামের মাদ্রাসায় লেখাপড়া করতাম। আমার যখন উনিশ বছর বয়স তখনই আমার পিতা আমার বিয়ে দেন আমাদেরই গ্রামের শুক্কর বেপারীর একমাত্র মেয়ে ষোড়সি আমেনার সাথে। তাতে করে আমেনার বাবার সব সম্পত্তির ওয়ারিশান হই আমি।
আমি যখন মাদ্রাসার ফাজিল শ্রেনীতে পড়ি তখন দেশে যুদ্ধ শুরু হয়। তখন আমার বয়স বাইশ বছর। আমার মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল কলিমুল্লা সাহেব আমাকে খুব স্নেহ করতেন। তিনি একদিন বললেন, দেশটা ইন্ডিয়া নিয়ে যাচ্ছে। এই পাক ওয়াতানকে রক্ষা করা প্রতিটি মুসলমানের দায়ীত্ব।
এখন জিহাদের সময়। বসে থাকলে চলবেনা। দেশটা রক্ষা কর। চলে যাও রাজাকার বাহিনীতে। যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়।
বাঁচলে গাজী, মরলে শহীদ মানে বেহেস্ত নসীব।
কলিমুল্লা হুজুরের একটা চিঠি নিয়ে আমি ঢাকার মিরপুরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। আমার স্ত্রী আমেনাকে বলে এলাম আমি হুজুরের কাজে ঢাকা যাচ্ছি, ফিরতে কতদিন লাগবে জানিনা।
যে ঠিকানায় এস পৌছলাম সেটা একটা ছোট একতলা বাড়ী। চিঠি যার নামে দিয়েছে তার নাম মৌলানা ইকবাল আনসারী।
দরজায় একটা লোকের সাথে দেখা হতে ইকবাল আনসারীর নাম বলতেই ভেতরে নিয়ে গেল। দেখলাম তিনি একজন জবরদস্ত আলেম। মাথায় পাক কিস্তি টুপি, মুখে কাচাপাকা চাপ দাড়ি। পরনে লম্বা শেরোয়ানি। হাতে পানের ডিবা।
পানের রসে ঠুট লাল হয়ে আছে। সালাম দিয়ে চিঠিটা তার হাতে দিতেই তিনি খুলে পড়লেন। তারপর বললেন, মেরা দুস্ত তুমকো ভেজা, তুম বাঙাল হ্যায়, উর্দু জানতে হো?
মাদ্রাসায় আমি আরবীর চেয়ে উর্দুতে ভাল রেজাল্ট করতাম। ভাল বলতে পারি। বললাম, জি হুজুর, উর্দু জানতে হো।
হামার সাথ বাঙাল নেহি হ্যায়। জু বুলেগা সব কার সেকতা হু?
জি হুজুর, কাজ করতেই তো এসেছি। এই দেশকে শত্র“র হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। তাই যুদ্ধে যোগ দিতে এসেছি। আমাকে সুযোগ দিন দেশের খেদমত করার।
তিনি খুশি হয়ে ডাক দিল, আশেক! ইদার আও। পাশের রুম থেকে আশেক নামক লোকটি এসে দাড়াল। তার মাথায় পাগড়ী, লম্বা দাড়ি, পরনে পাকিস্তানি শেরুয়ানি। ইকবাল হুজুর বললেন, ইয়ে আদমি কো মেরা দুস্ত ভেজা। উসকু সব কুচ শিখা লও।
এক পিস্তল দে দও।
সেই থেকে আমার নতুন জীবনের যাত্রা শুরু। (চলবে)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।