আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পর্ব ২: ষড়যন্ত্র, বেঈমানী ও বিশ্বাসঘাতকতার মোকাবেলায় শহীদ তিতুমীর

আওরঙ্গজেব

পর্ব: দুই ===== পর্ব ১: এখানে দেখুন। চতুর্মুখী হামলা: সঙ্গত কারণে তখন দেশে ছিল ইংরেজ শাসন। তিতুমীর ইংরেজদের বিরুদ্ধে কোন বিদ্রোহী ছিল না। কিন্তু হিন্দু জমিদার, অত্যাচারী স্খানীয় ও ইংরেজ নীলকরদের ষড়যন্ত্রে তিতুকে চিত্রিত করা বিদ্রোহী সন্ত্রাসী হিসেবে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সাথে তিতুমীরের ব্যক্তিগত কোন সংঘাত ছিল না।

গুজব অনুযায়ী দেশী-বিদেশী নীলকর, পাদ্রী ও স্বার্থানেðষী হিন্দু জমিদারদের পক্ষ থেকে বারাসাতের জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট মি: আলেকজান্ডারের কাছে তিতুমীরের বিরুদ্ধে অনবরত উত্তেজনাকর রিপোর্ট ও চিঠিপত্র সরকারকে ভাবিয়ে তোলে। বশিরহাটের দারোগা রামরাম চক্রবর্তী তিতুমীর ও তার লোকজন সম্পর্কে যেসব কাল্পনিক, মিথ্যা, বিদ্বেষপ্রসূত, বিকৃত রিপোর্ট সরকারের কাছে প্রদান করে এবং হিন্দু জমিদারগণ ও কালেক্টর এবং জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট অনবরত লিখতে থাকে। লেখালেখির ভিত্তিতে ম্যাজিস্ট্রেট তিতুমীরকে দমন করার জন্য গভর্নরের নিকট লেখে। সাথে সাথে গভর্নর আবার এই রিপোর্টের ভিত্তিতে নদিয়ার কালেক্টর ও আলীপুরের জজকে নারকেলবাড়ীয়াতে গিয়ে সরেজমিনে তদন্ত সাপেক্ষে প্রতিকারের ব্যবস্খা গ্রহণ করতে নির্দেশ দেন। গভর্নরের আদেশ পেয়ে নদিয়ার কালেক্টর অনাকাঙ্খিতভাবে কৃষäদেব রায়কে দ্রুততার সাথে দেখা করতে বলেন।

আলীপুরের জজ সাহেব তখন নদিয়ায় অবস্খান করছিলেন। কৃষäদেব রায় নারকেলবাড়ীয়া পৌঁছালে কালেক্টর ও জজ সাহেব তাকে তাদের বজরার পথ প্রদর্শক হিসেবে নিয়ে রওনা হন। এদিকে কালেক্টর ও জজ সাহেবদের আগমনকে কেন্দ্র করে একটি স্বার্থানেðষী মহল পরিকল্পিতভাবে মুসলমানদের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করার জন্য প্রচার করতে থাকে যে, শেরপুর নীলকুঠির মুসলিম বিদ্বেষী ম্যানেজার মি: বেনজামিন অনেক সন্ত্রাসী ও অস্ত্রশস্ত্রসহ নারকেলবাড়ীয়া আক্রমণের জন্য রওনা করেছে। খবর শুনে তিতুমীরের লোকজন স্বাভাবিকভাবে গোলাম মাসুমের নেতৃত্বে তাদের বাধা দেয়ার জন্য অগ্রসর হয়। বজরা এসে বারঘরিয়া ঘাটে ভিড়লে তিতুমীরের লোকজন দেখলো বজরায় তাদের পূর্ব দুশমন কৃষäদেব ওদের সাথে উপস্খিত সঙ্গত কারণে তাদের প্রতিরোধ যুক্তি সঙ্গত হয়ে উঠলো।

এই সুযোগে কৃষäদেব কালেক্টর ও জজ সাহেবকে বললো, 'হুজুর, ঐ দেখুন তিতুমীরের প্রধান সেনাপতি গোলাম মাসুম আপনাদের বজরা আক্রমন করার জন্য এতদূর পর্যন্ত এসেছে'। সাহেব তখন গুলী চালানোর নির্দেশ দিলেন। উভয় পক্ষের বহু লোকজন হতাহত হলো। পরে অবস্খা বেগতিক দেখে কালেক্টর যুদ্ধ স্খগিত রেখে নদীর মাঝখানে গিয়ে আত্মরক্ষা করলো। এইভাবে হিন্দু জমিদাররা তিতুমীরের লোকজনকে মিথ্যা সংবাদ পরিবেশন করে বজরা আক্রমণ করায়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী সরকারকে ক্ষেপিয়ে তুলেছিল।

এই যাত্রায় কৃষäদেব তার কুটচালে সফল হয়েছিল। ফলে বারাসাতের জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট মি: আলেকজান্ডারের তিতুমীর সম্পর্কে দারুন নেতিবাচক ধারণা জন্মে। তিতুমীরকে সাবধান করার জন্য বশিরহাটের নতুন দারোগাকে আদেশ দেন। নতুন দারোগা নারকেলবাড়ীয়াতে না গিয়ে থানায় বসে তিতুমীর সম্পর্কে একটি মিথ্যা রিপোর্ট তৈরি করে। রিপোর্টের ফলে জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট মি: আলেকজান্ডারকে তিতুমীরের বিরুদ্ধে সরকারের নিকট কড়া রিপোর্ট লিখতে হয়।

পরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী সরকার কর্নেল স্টুয়ার্ডকে সেনাপতি করে একশত ঘোড়া, তিনশত পদাতিক সৈন্য, দু'টি কামানসহ নারকেলবাড়ীয়াতে রওনা করায় ১৩ নবেম্বর ১৮৩১ সালে। আর স্বয়ং আলেকজান্ডার নারকেলবাড়ীয়ায় একজন হাবিলদার, একজন জমাদ্দার, পঞ্চাশ জন বন্দুক ও তরবারীধারী সৈন্য নিয়ে নারকেলবাড়িয়ার কাছাকাছি বাদুড়িয়ায় উপস্খিত হন। পরে বশিরহাটের দারোগা সিপাই-জমাদ্দার নিয়ে বাদুড়িয়া আলেকজান্ডারের সাথে মিলিত হয়। অত:পর প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয় এতে উভয় পক্ষের লোক হতাহত হয়। গোলাম মাসুমের নেতৃত্বের বীরত্ব দেখে আলেকজান্ডার বিস্মিত হয়।

যুদ্ধে দারোগা ও একজন জমাদ্দার মুসলমানদের হাতে বন্দী হয়, বারাসাতের জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট মি: আলেকজান্ডার প্রাণ রক্ষার্থে পলায়ন করে। তিতুমীরের শেষ পরিণতি: পরের দিন হিন্দু ও ইংরেজদের যৌথ আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ১৪ নবেম্বর তিতুমীরের লোকজন তার হুজরার বাহির দিকে মোটা মোটা বাঁশের মজবুত খুঁটি দিয়ে ঘিরে বেষ্টনী তৈরি করে, ইতিহাসে এই বাঁশের বেষ্টনীকে 'তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা' নামে পরিচিত। কর্নেল স্টুয়ার্ড তিতুমীরের হুজরার প্রধান দ্বারে পৌঁছে দেখেন এক ব্যক্তি সাদা তহবন্দ, সাদা পিরহান ও সাদা পাগড়ি পরিহিত অবস্খায় আল্লাহর ধ্যানে নিমগ্ন আছে। স্টুয়ার্ড মুগ্ধ ও বিস্ময় বিমুঢ় হয়ে পথ প্রদর্শক রামচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়কে জিজ্ঞাস করলেন, 'এই ব্যক্তিই কি তিতুমীর'? রামচন্দ্র, বলল 'হ্যাঁ, সে নিজেকে তিতু বাদশা বলে প্রচার করে। হুজুর, আপনার আগমনে তারা বাহানা পরিবর্তন করেছে।

' স্টুয়ার্ড রামচন্দ্রকে বলল, 'তিতুকে বলুন, বড়লাট লর্ড বেন্টিংক-এর পক্ষ থেকে আমি সেনাপতি হিসেবে এসেছি। তিতুমীর যেন আমার কাছে আত্মসমর্পণ করে। তবে উত্তরে সে যা বলবে তা আমাকে হুবহু বলবেন। ' অথচ রামচন্দ্র তিতুমীরকে বলল, 'আপনি কোম্পানী সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এখন জপমালা ধারণ করেছেন। আসুন, তরবারী ধারণ করে বাদশার যোগ্য পরিচয় দিন।

' শুনে সাইয়েদ নিছার আলী তিতুমীর বললেন, 'আমি কোম্পানী সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিনি। হিন্দুদের ন্যায় আমরাও কোম্পানী সরকারের প্রজা। জমিদার নীলকরদের অত্যাচার দমন এবং মুসলমান নামধারীদের প্রকৃত মুসলমান বানানোর জন্য সামান্য চেষ্টা করছি মাত্র। ' তিতুমীরের জবাব শুনে রামচন্দ্র দোভাষী হিসেবে কর্নেল স্টুয়ার্ডকে বলল, 'হুজুর, তিতুমীর আত্মসমর্পণ করবে না, যুদ্ধ করবে। সে বলে, সে তোপ ও গোলাগুলীর তোয়াক্কা করে না।

সে আরো বলে, সে তার ক্ষমতাবলে সবাইকে টপ টপ করে গিলে খাবে। সে এই দেশের বাদশা, কোম্পানী আবার কে?' দোভাষীর কাজ করতে গিয়ে রামচন্দ্র যে কোন আগুনে ঘি ঢেলে দিলো তা সকলের কাছে পরিষ্কার। অত:পর যুদ্ধের ফলাফল কি হলো তা সহজেই অনুমেয়। সুশিক্ষিত ইংরেজ সৈন্য মেজর স্কটের পরিচালনায় ও তাদের ভারী কামানের গুলীর সামনে লাঠি আর সড়কির দ্বারা কতক্ষণ টিকে থাকা যায়। তথাপিও তিতুমীর, গোলাম মাসুম ও তাদের লোকজন ভীতসন্ত্রস্ত না হয়ে, বাতিলের কাছে মাথা নত না করে জীবনের শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে লড়াই করে ২৫০ জন আহত হয় এবং ৫০ জনের সাথে ঊনপঞ্চাশ বছর বয়সে সাইয়েদ নেছার আলী তিতুমীর শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করে ইতিহাসে অক্ষয় পুরুষ হিসেবে স্খান করে নেয়।

লেখক: ­ মুহাম্মদ ওয়াছিয়ার রহমান মন্টু, একজন এনজিও কর্মকর্তা। সূত্র: এখানে। ১৪.১১.২০০৭

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.