ধোঁয়ায় মোড়ানো পৃথিবী আমার। যেখানে নেই সত্য মিথ্যার তামায় মোড়ানো কোন খোলস। চারপাশে শুধু ধোঁয়া। ধোঁয়ার মাঝেই আমি তৈরি করেছি আমার স্বপ্নের আগামী। শেষ পর্যন্ত চাকরিটা ছেড়েই দিল শুভ্র।
আসলে জীবনটা বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য একটা পিছুটান থাকতে হয়। পিছুটান না থাকলে একসময় জীবনের প্রতি টানও কমে যায়। শুভ্রের মতো স্বাধীনচেতা ছেলেকে বেঁধে রাখার জন্য কঠিন বাঁধনের প্রয়োজন। বাঁধন হয়তো একসময় ছিল। কিন্তু শুভ্রের উদাসী মন সে ব্যাপারে সচেতন ছিল না।
এখনো পিছন ফিরে তাকালে শুভ্র সে বাঁধনকে সংজ্ঞায়িত করতে পারে না। সেটা আসলে কি ছিল?! প্রেম, ভালবাসা, মায়া নাকি তার চেয়েও বেশি কিছু ???
শুভ্রদের বাড়িওয়ালার মেয়ে নিশি। নিশিদের বাড়ির পাশেই একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ। নিশিদের তিনতলা বাড়ির ছাদেই কৃষ্ণচূড়াটি ডালপালা মেলেছে। ছাদে গেলেই নিশি প্রায় দেখে একটি ছেলে ভাবলেশহীনভাবে কৃষ্ণচূড়াটির পাশে বসে আছে।
চোখের সীমানায় নিতান্ত জড়বস্তু পড়ে থাকলেও সেটা হৃদয়ের ব্যাসার্ধে ঢুকে পড়তে খুব বেশি সময় নেয় না। একদিন শেষ বিকেলে হঠাৎ এক নারীকণ্ঠের ডাকে শুভ্রের অবচেতন মন সচেতন হল।
–কি সব আকাশপাতাল ভাবেন সবসময়? আমাকে কিছু কৃষ্ণচূড়া পেড়ে দিন।
নিশি এমনভাবে কথাগুলো বলল যেন কৃষ্ণচূড়া পেড়ে দেওয়া শুভ্রের দৈনন্দিন কাজের ভিতরে পড়ে। গল্পটা সেদিনের কৃষ্ণচূড়াতে শেষ হলেই ভাল হতো!
এরপর থেকে নিশি প্রতিদিনই ছাদে আসত।
নিশিও শুভ্রের প্রিয় শেষ বিকেলের অপেক্ষায় থাকত। অন্যদিকে শুভ্রের বিবাগী মন নীলকস্তূরী চাঁদ এর জোছনার অপেক্ষায় থাকত। চাঁদের আলো লাগেনা, সূর্যের আলোও লাগেনা, শুধু যে রূপের আলোয় পৃথিবী ভাসিয়ে দেওয়া যায় নিশিকে না দেখলে সেকথা শুভ্রের আজীবন অজানা থেকে যেত। কিন্তু শুভ্র তখনো তার অবচেতন মনের কানাকানি শুনতে অভ্যস্ত ছিল না।
হেলাল হাফিজ একটা কবিতায় লিখেছিলেন, “অতো বেশী নিকটে এসো না, তুমি পুড়ে যাবে”।
নিশি পুড়ল, শুভ্রকেও পোড়াল। তবে শুভ্র যে পুড়ছিল সেটা শুভ্র নিজেই জানতোনা। যখন জানলো তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে।
নিশি অনেকদিন ছাদে আসেনা। শুভ্র সেদিন কি মনে করে নিশিদের দারোয়ানের কাছে নিশির কথা জানতে চাইতেই তিনি বললেন, “নিশি আপার তো বিয়া ঠিক।
ছেলে……………………” এরপর কোন কথাই শুভ্রের কানে ঢুকল না। শুভ্রের কোথায় যেন একটা টান পড়ল। শুভ্রের তো এমন হওয়ার কথা না। তবে আজ কেন মনে হচ্ছে শত-সহস্র বছর ধরে যে তরী তার হৃদয়ের ঘাটে নোঙর করা ছিল, ইচ্ছে হলেই সে তরীতে গিয়ে বসত, আজ সে তরী তার অজান্তেই অজানা গন্তব্যে যাত্রা করল।
অনেক কষ্টে নিশির দেখা পেল শুভ্র।
সেই পরিচিত কৃষ্ণচূড়ার পাশে দুজনই অনেকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল। শেষপর্যন্ত নিশিই নীরবতা ভাঙাল।
–তুমি আমার বিয়েতে আসবানা; কথাটা বলেই নিশি চলে গেল।
শুভ্রের কেবলই মনে হতে লাগল নিশির যতটা প্রকাশিত তার পুরোটাই স্বপ্ন আর যতটা অপ্রকাশিত তার পুরোটাই কল্পনা। নিশি ছিল আধেক স্বপ্ন আর আধেক কল্পনা।
স্বপ্ন আর কল্পনার মাঝেই শুভ্রের বাস্তব পথ হারিয়েছিল।
প্রায় দুবছর পর নিশি তার স্বামীসহ আমেরিকা থেকে এসেছে। নিশিদের কৃষ্ণচূড়াটা মারা গেছে। নিশি চলে যাওয়ার পর শুভ্র আর কখনও ছাদে যায়নি। গতকাল চাকরী থেকে ফিরার সময় সিঁড়িতেই নিশির সাথে শুভ্রের দেখা।
অনেকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার পর সেই নিশিই প্রথমে কথা বলল।
–তুমিতো আমায় একেবারেই ভুলে গেলে; বলল নিশি।
–তোমাকে মনেই বা রেখেছিলাম কবে যে ভুলে যাব না; কথাটা বলার পর শুভ্রের কাঁচের চোখের নিচে জমে থাকা পানি আর গোপন থাকল না।
আজ শুভ্র চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। শুভ্র দূরে কোথাও চলে যাবে যেখানে কৃষ্ণচূড়া আছে।
নজরুলতো বলেই গেছেন, “প্রাপ্তিতে ভালবাসা পূর্ণতা পায় না। অপ্রাপ্তিতেই বেঁচে থাকে পাওয়ার তৃষ্ণা”।
শুভ্রকে না পেয়েও যে কতখানি পেল নিশি তা বুঝল শুভ্রের দেওয়া শেষ এক লাইন এর চিঠিতে,
“তোমাকে প্রতিদিনই একবার করে ভুলি” ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।