আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কমান্ডার , স্যালুট টু ইউ এগেইন



কমান্ডার, স্যালুট টু ইউ এগেইন ফকির ইলিয়াস যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিষয়ে বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ। সে প্রমাণটি আমরা গেল দু’সপ্তাহে আবারও দেখলাম। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানী, সম্মানিত সেক্টর কমান্ডাররা ইতোমধ্যে ‘সেক্টরস কমান্ডার ফোরাম’ গঠন করেছেন। এই ফোরাম দেশে-বিদেশে অবস্খানরত লাখ লাখ বাঙালির কাছে সমাদৃত হয়েছে ইতোমধ্যে। এই ফোরাম ঘোষণা দিয়েছে ৬৪টি জেলায় মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত মানুষকে আইনি সহায়তা দেবে।

অত্যন্ত সাহসী কথা। গেল ৩৬ বছরে কোন সরকার, রাষ্ট্রপক্ষ এমন ঘোষণা দেয়নি। যদি দিতো তবে হয়তো অনেকেই এগিয়ে এসে যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্খা গ্রহণে উদ্যোগী হতেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের উপ-সেনাপতি এবং সেক্টর কমান্ডাররা যেসব বক্তব্য দিয়েছেন, তা আমাদের আবারও একাত্তরে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে। মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, যুদ্ধাপরাধীদের নির্বাচনে অংশ নেয়া অনভিপ্রেত।

তিনি আরও বলেছেন, যে কেউ আইনের আশ্রয় নিতে পারেন। সে দরজা এখনও খোলা আছে। সেক্টর কমান্ডাররা জানিয়েছেন, তারা সুষ্ঠু প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মামলার ব্যবস্খা করবেন। তবে যেহেতু এরা স্বাধীন বাংলাদেশের বিপক্ষে অবস্খান নিয়েছিল, সেহেতু মামলাগুলোর বাদি রাষ্ট্রপক্ষকেই হতে হবে। প্রিয় কমান্ডারবৃন্দ, এই জাতি আপনাদের স্যালুট করছে।

প্রচলিত আইনে এসব মামলার বিচার সম্ভব কি না কিংবা মামলা করে যথাশীঘ্র সম্ভব কোন সুবিচার পাওয়া যাবে কি না তা নিয়েও হচ্ছে নানা কথা। উদাহরণ হিসেবে আসছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা, জাতীয় চার নেতা হত্যা মামলার বিচারের কার্য প্রক্রিয়ার কথাও। ‘বিব্রতবোধ করা’ কিংবা পূর্বের ক্ষমতাসীনদের অনিচ্ছার কারণে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা এখনও রয়ে গেছে বিভিন্ন অনিশ্চয়তার মাঝে। যদি বিশেষ ট্রাইব্যুনালে এ বিচার শুরু হতো, তবে হয়তো এতদিনে রায় কার্যকর হতে দেখতে পেত বাঙালি জাতি। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রচলিত আইনের প্রতি অগাধ বিশ্বাসই মামলাটিকে এখনও বর্তমান পর্যায়ে রেখেছে।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এভাবে প্রচলিত আইনের ধারায় নিবদ্ধ করে কালক্ষেপণ সমীচীন হবে কি-না তাও ভেবে দেখার প্রয়োজন রয়েছে। ওয়ান-ইলেভেনের পর বাংলাদেশে অনেক অসম্ভবই সম্ভব হয়েছে, যা কোনদিন কল্পনাও করা যেত না। এরই ধারাবাহিকতায় গেল ছত্রিশ বছরের অসমাপ্ত কাজটি বর্তমান সরকার শেষ করে যাওয়ার প্রচুর সুযোগ রয়েছে। কারণ খুনি, পিশাচ, নরঘাতকদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর ঐতিহাসিক ক্ষণটি অত্যন্ত স্বর্ণোজ্জ্বল হয়েই থাকবে বাঙালির ইতিহাসে। দুই বাংলাদেশে ঘাতক রাজাকার, আলবদর-আলশামসদের বিচারের যখন ঐক্যবদ্ধ দাবি উঠেছে, তখনই আমরা সেই পুরনো শকুনদের চরিত্র আবারও দেখছি।

এটা অজানা নয় রাজাকার-আলবদরদের বিভিন্ন স্তর রয়েছে। রয়েছে তাদের ‘বুদ্ধিজীবী মহল’ও। সাবেক সচিব শাহ আব্দুল হান্নান, মীর কাশেম আলী কিংবা ব্যা. আবদুর রাজ্জাকের মতো ব্যক্তিরা তাদের ‘সুশীল সমাজ’। তাদের এসব তথাকথিত সুশীলরা প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে গেল তিন দশক থেকেই মওদুদীবাদী মোনাফেকি পারপাস সার্ভ করে আসছে। অত্যন্ত দু:খ ও বেদনার কথা হচ্ছে, বাংলাদেশের অনেক মুক্তমনা, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি বুঝে হোক না বুঝে হোক ইসলামী ব্যাংকসহ এই ব্লকের বিভিন্ন ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা আমানত রেখে পক্ষান্তরে রাজাকারদের হাতকেই শক্তিশালী করেছে।

বিএনপির কথা বাদই দিলাম, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালেও রাজাকারি ব্লকের ব্যাংক, বীমা, হাসপাতাল, স্কুল, কলেজ, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, ক্লিনিক, কারখানা-মিলসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সহযোগিতা পেয়েছে আওয়ামী সরকারের কাছ থেকে। আওয়ামী ও রাজাকার ব্যবসায়ী কাম-রাজনীতিকরা মিলেমিশে একই ব্যবসায় পুঁজি বিনিয়োগ করেছে। এদের বিরুদ্ধে কিছু বলা তো দূরের কথা, তাদের পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমেই আজ এ পর্যন্ত নিয়ে আসা হয়েছে। আমরা দেখে খুব অবাক হচ্ছি, আজ রাজাকারদের বিচারের দাবিতে জাতি সোচ্চার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ‘সেমি রাজাকার’ নামের একটি বোদ্ধা মহলও নানাভাবে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে। তারা বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে কলাম লিখে, বিবৃতি দিয়ে, টিভি টক শোতে বলতে চাইছে, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করার অর্থ হচ্ছে ইসলামকেই নিষিদ্ধ করা।

এসব বেওকুফ এভাবেই বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের দৃষ্টি অন্যত্র ফেরাতে চাইছে। এসব কলাম লেখক বলছে, বাকশাল কায়েম করতেই নাকি ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি তোলা হচ্ছে। এমনকি তারা পূর্বের মতো আবার ‘ভারতের চর’ ‘বামপন্থী চেলা’ প্রভৃতি শব্দাবলিও ব্যবহার করতে শুরু করেছে। এটা প্রতিটি সচেতন বাঙালিই জানেন মওদুদীবাদী বিশ্বাসঘাতকদের আঁতে ঘা লাগলেই তারা নানা প্রলাপ বকে। ভারত বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ সমর্থন দিয়েছিল।

১০ হাজার ভারতীয় সৈন্য প্রাণ দিয়েছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য। ভারতীয় জনগণ তাদের বেতনের টাকা, সিনেমার টিকেটের সঙ্গে অতিরিক্ত কর প্রদান করে কোটি কোটি বাঙালি শরণার্থীকে সাহায্য করেছিল। গেল ৩৬ বছরে বাংলাদেশ কি ভারতের ‘সেবাদাস’, ‘তাঁবেদার’ হয়ে গেছে? না যায়নি। বরং নিজামী গিয়ে বাজপেয়ির সঙ্গে বৈঠক করেছেন হিন্দু ও মুসলিম মৌলবাদের শিকড় শক্ত করার জন্য। জামায়াত-বিএনপি জোটই গোপন চুক্তি করে ফেনসিডিল থেকে দিয়াশলাই পর্যন্ত আমদানি করেছে ভারত থেকে।

কমিশনের অর্থ না পাওয়ার ক্ষোভে টাটা কোম্পানিকে বাংলাদেশ থেকে ফিরিয়ে দিয়েছে ‘হাওয়া ভবন'পন্থিরা। সেই ভারতের প্রতি রাজাকারদের ‘বড়গলা’ দেখলে করুণা করতেই ইচ্ছে করে। তাদের মুখে মানায় এসব কথা। এসব তস্করবৃত্তির প্রকৃত উদ্দেশ্য কী?তারা কি মানুষের স্বার্থ দেখে? তিন . বাংলাদেশে বেশ কিছু 'ক্লিন সেভড' সাংবাদিক-সম্পাদক আছেন, যারা খুব কৌশলে রাজাকারদের সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছেন। এরা লাল গোলাপ হাতে ভালবাসা সড়কে বসবাস করলেও রাষ্ট্র, বাঙালি জাতি, বাংলা সংস্কৃতির প্রতি এদের নূন্যতম কোন দরদ নেই।

এরাই বলে বেড়ায়, মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হননি। যারা সত্য ইতিহাস ও মিথকে অস্বীকার, বিকৃত করতে চায় এদের চেয়ে বড় রাষ্ট্র শত্রু আর কে থাকতে পারে? এই দেশে যারা ‘আল্লাহর আইন চাই, সৎ মানুষের শাসন চাই’ এই বাণীর প্রবক্তা, তাদের এমপিরা কোন্ কোন্ চরম অপরাধের দায়ে গ্রেফতার হচ্ছেন তা দেখছেন দেশবাসী। তাদের নির্বাচনী ওয়াদা পরণ তো দরের কথা, তারা যা করেছে তা হচ্ছে মন্ত্রী-আমলা হয়ে বিভিন্ন সেক্টরে নিজেদের লোক বসিয়ে দলকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করেছে। অত্যন্ত পরিতাপের কথা, তা জানার পরও বাংলাদেশের এক শ্রেণীর জ্ঞানপাপী এদের কাজকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে মঞ্চে নেপথ্যে। এই দু’সপ্তাহের জাতীয় দৈনিকগুলোতে তাদের লেখা, মìব্য প্রতিবেদন, কলাম পড়লে তা আরও স্পষ্ট হবে।

গর্বের কথা হচ্ছে, এসব মধ্যস্বত্বভোগীদের নিয়ে বাঙালি জাতির ভাবার কিংবা শঙ্কার কোন কারণ নেই। এ পার্যন্ত প্রতিটি রাজনৈতিক দলই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চেয়েছে। ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’-এর এই বিশ্ব রাজনীতিতে এখনও এই সত্যটি জোরাল আছে, খুনি হায়েনাদের কেউ প্রশ্রয় দিচ্ছে না। এই যে সত্যের বিজয়, সে পথেই দাঁড়াচ্ছে বিশ্বের আপামর মানুষ। বাংলাদেশে তেমন দাবি এরই একটি অংশ মাত্র।

না, বাংলাদেশে কোন যুদ্ধাপরাধীকে জনগণ ক্ষমা করে দেয়নি। ১৫ আগস্টের পর্ব পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন জেলে বাইশ হাজারেরও বেশি রাজাকার-আলবদর বন্দি ছিল। জাতির জনক হত্যার পরবর্তী সরকারগুলো কৌশলে এদের ক্রমে ছেড়ে দেয়। জিয়া-সায়েম সরকার ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর দালাল আইন সম্পূর্ণ বাতিল করে দিয়ে দেশের সব জেল থেকে সব রাজাকার, আলবদর, আলশামসদের যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তি দিয়েছিলেন। রাজনীতিতেও তাদের নিজ স্বার্থে পুনর্বাসিত করে তারাই।

একাত্তরের গণহত্যার বিবরণ দিতে গিয়ে ‘সেক্টরস কমান্ডার ফোরাম’ তাদের বক্তব্যে একটি বর্ণনা দিয়েছে যা পড়ে আমার গায়ে কাঁটা দিয়েছে; শিউরে উঠেছি। তারা বলেছেন, ‘এই গণহত্যার ব্যাপকতা ও বিশালতা ছিল সুপরিকল্পিত। প্রায় সত্তর ভাগ শহীদের দেহাবশেষ জলা এবং নদীতে ভেসে না গেলে গণকবরের সংখ্যা কী বিশাল হতো তা কল্পনা করা যায় না। ’ তাদের যুক্তিতে কি সত্যের উদ্ভাস! এই হচ্ছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। মানবতার বিরুদ্ধে এমন অপরাধ বিশ্বে খুব কমই সংঘটিত হয়েছে।

সেসব ধর্ষিতার কেউ কেউ এখনও বেঁচে আছেন দু:সহ যাতনা নিয়ে। এরা কি সে সব ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী নন? শহীদ বুদ্ধিজীবীদের বিধবা স্ত্রী রা কি এখনও বলে যাবেন না সেসব জল্লাদ দোসরদের কথা? যারা বাসা থেকে এসে নিয়ে গিয়েছিল বাংলার কৃতী বুদ্ধিজীবীদের? মৌলবাদীদের দাপটে পাকিস্তানের অবস্খা আজ কেমন, তা দেখছে বিশ্ববাসী। একটি অশুভ চক্র বাংলাদেশকেও পাকিস্তানের কলোনি বানাতে এখনও তৎপর। এই চক্রকে সমূলে উৎখাত করা না গেলে রাষ্ট্রীয় অস্তিত্ব হুমকির মুখোমুখি হতে পারে। মহান মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডাররা যে প্রত্যয়ী উদ্যোগ নিয়েছেন তা ছড়িয়ে দিতে হবে দেশে-বিদেশে প্রতিটি বাঙালির মাঝে।

সার্বিক সাহায্য-সহযোগিতায় যে যে প্লাটফর্মে আছেন সবাই এগিয়ে এলেই এই মাইলফলকটি স্খাপিত হবে। নিউইয়র্ক, ৬ নভেম্বর ২০০৭ ---------------------------------------------------- (দৈনিক সংবাদ/ ঢাকা / ৯ নভেম্বর ২০০৭ শুক্রবার প্রকাশিত)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.