হয়তো আমি কোন কিছু সম্পর্কে নিশ্চিত নই
দর্শক-শ্রোতা কিংবা জনগণের বিচারিক ক্ষমতা থাকা উচিত কি-না, সে বিষয়ে হয়তো কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছা যাবে না বা সে পথে যাওয়াও উচিত নয়। কারণ দর্শক-শ্রোতা কিংবা জনগণ কী বিচার করবে, সেই বিষয়টিই নির্ধারণ করবে সেখানে তাদের বিচারিক ক্ষমতা থাকা উচিত কি-না; কিংবা থাকলে কতটুকু। রাজনীতিতে দর্শক-শ্রোতা বা জনগণই মূল বিচারক। তারাই বিচার করে পূর্ববর্তী সরকারের শাসন তাদের কতটুকু কাজে লেগেছে; তারাই নির্ধারণ করে পরবর্তীতে কাদের দ্বারা তারা শাসিত হতে চায়। আবার বিশেষায়িত জ্ঞানের ক্ষেত্রে জনগণের বিচারিক ভূমিকা খুবই খাটো, কিংবা অনেক ক্ষেত্রে নেই বললেই চলে।
রুশ বিপ্লবের মহানায়ক লেনিন বলেছিলেন, বিজ্ঞান কখনও গণভোটে নির্ধারিত হয় না। অর্থাৎ সেখানে জনগণ কখনোই বিচারকের ভূমিকা নিতে পারে না। পৃথিবীর সব মানুষ কোন এক বিষয়ে একমত হলেও তা মিথ্যে হয়ে যেতে পারে বিজ্ঞানীর একটিমাত্র পরীক্ষার বদৌলতে। কোপার্নিকাস যখন বলেছিলেন, পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরে, তখন চার্চসহ সেদেশের অধিকাংশ মানুষ তাকে সমর্থন করেনি। কিন্তু কোপার্নিকাসই এখন প্রতিষ্ঠিত সত্য।
তাই খুব জোর দিয়েই বলা যায়, বিশেষায়িত জ্ঞানের ক্ষেত্রে দর্শক-শ্রোতা কিংবা আপামর জনগণকে বিচারক বানানো ঠিক নয়, জনগণেরও এক্ষেত্রে বিচারক হওয়া উচিত নয়। তাতে ভুল সিদ্ধান্তে আসার সম্ভাবনা বাড়ে বহুগুণে।
সা¤প্রতিক সময়ের উপমহাদেশের কয়েকটি সাড়াজাগানো অনুষ্ঠানের বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে কিছু বলার জন্য এ কথাগুলোর অবতারণা। এর মধ্যে সবচাইতে জনপ্রিয় ইন্ডিয়ান আইডল। প্রশান্ত তামাং এ বছর দর্শকদের বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে ইন্ডিয়ানদের মনোজগতে আইডল হয়েছেন।
শোনা যায়, বিচারকদের নাকি রায় গিয়েছিলো অমিত পলের ঝুড়িতে। এই ইন্ডিয়ান আইডলের মতোই আমাদেরও কিছু এ ধরনের অনুষ্ঠান আছে। যেহেতু ইন্ডিয়ান আইডল অনুষ্ঠানটি অন্য দেশের, এবং এই লেখার কোনো উপযোগিতাই থাকবে না সেটির জন্য, তাই আমাদের দেশের এ ধরনের অনুষ্ঠানের দিকে নজর ফেরানো যেতে পারে। আমাদের দেশে এ ধরনের অনেক প্রতিযোগিতা হয় কিন্তু আমি শুধু ক্লোজ আপ ওয়ান প্রতিযোগিতাটিই মনোযোগ দিয়ে দেখেছি, তাই আমার বক্তব্য আবর্তিত হবে এই প্রতিযোগিতা ঘিরেই। তবে সংশ্লিষ্ট সব প্রতিযোগিতার উদ্দ্যেশেই আমি কথাগুলো বলতে চাই।
ক্লোজআপ ওয়ান নামের এই অনুষ্ঠানটি দু’বছর আগে শুরু হয়েছে এবং গত বছরও তাদের কার্যক্রম চলেছে। অনুষ্ঠানের মান, উপযোগিতা ইত্যাদি নিয়ে কথা বলেছেন অনেকেই এবং অধিকাংশই এর প্রশংসা করেছেন; কিছু বিষয়ে প্রশ্নও উঠেছে ইতোমধ্যে। বিচারকদের পাশাপাশি দর্শকদের এসএমএসের রায় নিয়ে প্রতিযোগীদের যে পদ্ধতিতে মূল্যায়ন করা হচ্ছে, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
ক্লোজআপ ওয়ানের বাছাইপর্ব পার হয়ে প্রতিযোগীরা যখন মূল পর্বে আসেন, তখন বিচারকদের পাশাপাশি দর্শকদের এসএমএসের মাধ্যমে ভোট দেয়ার আহ্বান জানানো হয়। দর্শক ও বিচারকদের রায়ের আনুপাতিক মাত্রা সমান অর্থাৎ ৫০ ঃ ৫০।
প্রথম বছরই দেখা গেছে, বিচারকরা যাকে বেশি নম্বর দিয়েছেন, সেই প্রতিযোগী হয়তো দর্শকদের এসএমএস (বা ভোট) কম পেয়ে বাদ পড়েছেন কিংবা অন্য প্রতিযোগীর তুলনায় পেছনে পড়ে গেছেন। উল্টো চিত্রও অবশ্য ছিলো, তবে তা কম। দ্বিতীয়বারে এ প্রবণতা খানিকটা কম দেখা গেলেও দর্শক ও বিচারকদের রায় অনেক ক্ষেত্রেই মিলেনি। ফলে অনেক প্রতিযোগী যোগ্যতা অনুযায়ী মূল্যায়িত হন নি, অতি বা অবমূল্যায়িত হয়েছেন।
দর্শকদের রায়ের পেছনে কী কী ফ্যাক্টর কাজ করে? প্রথমত, জোরোলো এলাকা-মানসিকতা।
একজন প্রতিযোগী তুলনামূলক খারাপ পারফরম্যান্স করেও তার এলাকার (নিজ জেলা বা উপজেলা) ভোট বেশি পেয়ে এগিয়ে যেতে পারেন। এখানেই সৃষ্টি হয় এক বিরাট বৈষম্য। এ মানসিকতায় মেহেরপুর জেলার একজন প্রতিযোগী তার এলাকা থেকে যে ভোট পাবেন, স্বাভাবিকভাবেই রংপুর এলাকার প্রতিযোগী পাবেন তার চাইতে অনেকগুণ বেশি ভোট। একইভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রতিযোগীর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ভোট পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে বেশি। সেই তুলনায় মফস্বলের একটি কলেজের প্রতিযোগী কি অবমূল্যায়িত হবেন না? সব দর্শক এই ছকে পড়েন তা নয়, কিন্তু এটিই স্বাভাবিক ধারা।
দ্বিতীয়ত, বিচারকরা যখন প্রতিযোগীর অন্য কোন গুণ বা সীমাবদ্ধতার কথা দর্শকদের সামনে তুলে ধরেন, তখন তার ভোট পাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায় বহুগুণ। কোন বিচারক যদি বলেন (উদাহরণগুলো কাল্পনিক, তবে এ ধরনের কথা বিচারকরা প্রায়ই বলেন), ‘তুমি যে এত কষ্ট করে অসুস্থ শরীর নিয়েও গান করতে এসেছ, তাতে আমরা খুশি হয়েছি’ কিংবা ‘তোমার কৃষক পিতা তোমাকে দারিদ্র্যতার মধ্যেও গান শিখিয়েছেন, তুমি খেতে না পেলেও নিয়মিত চর্চা চালিয়ে গিয়েছ’- সেগুলো নিশ্চয়ই দর্শকদের মধ্যে প্রণোদনা সৃষ্টি করে, প্রতিযোগীর প্রতি সহানুভূতি সৃষ্টি হয়। ফলে তারা দর্শকদের ভোট কিছুটা হলেও বেশি পান। প্রথমবারের প্রতিযোগিতায় রাজীব বিচারকদের কাছে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েও প্রথম হতে পারেননি। দর্শকদের বিপুল ভোটের কারণে নোলক প্রথম হয়েছেন।
নোলক অবশ্যই প্রতিভাবান, না হলে এতগুলো ধাপ পেরিয়ে চূড়ান্তপর্বে আসতে পারতেন না; কিন্তু বিচারকদের কাছে সর্বোচ্চ নম্বর না পেয়েও দর্শকদের রায়ে প্রথম হওয়াতে কিছুটা বোধহয় অতৃপ্তি থেকে যায়। প্রতিযোগিতার মাঝে এই ধরনের মন্তব্যের অর্থ হচ্ছে দর্শক সেন্টিমেন্টের মাধ্যমে সেই প্রতিযোগীকে কিছুটা হলেও সুবিধা পাইয়ে দেওয়া, যা প্রতিযোগিতার স্পিরিট নষ্ট করে। পাশাপাশি এটিকে এক ধরনের পরোক্ষ পৃষ্ঠপোষকতার মত বলেও মনে হয়। যারা বিভিন্নভাবে সুবিধাবঞ্চিত তাদের অবশ্যই পৃষ্ঠপোষকতা করতে হবে, তবে তা প্রতিযোগিতার আগে। প্রতিযোগিতায় নামার পর কাউকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সহায়তা করা হলে পুরো প্রতিযোগিতাটিই এক ধরনের পক্ষপাতদুষ্টতায় ভোগে।
যে ধরনের বক্তব্য দর্শকদের সেন্টিমেন্ট উস্কে দেয়, বিচারকদেরও উচিত সে ধরনের বক্তব্য না বলা।
দর্শকদের কাছ থেকে নিশ্চয়ই বিচারকদের মতো খুঁটিয়ে দেখার এবং সে অনুযায়ী রায় আশা করা যায় না। ব্যতিক্রম দর্শকও আছেন, আছেন বোদ্ধা দর্শকও যারা যোগ্য প্রতিযোগীকেই ভোট দিয়েছেন, কিন্তু তাদের সংখ্যা যে খুবই কম, তা বোধহয় বলার অপেক্ষা রাখে না। দর্শক মূলত প্রতিযোগীদের বাহ্যিক কিছু বিষয় বিবেচনা করে ভোট দেন, বিচারকের মতো বিশেষায়িত জ্ঞানের প্রয়োগ দিয়ে নয়। তাই বিচারকদের পাশাপাশি দর্শকদের কাছ থেকে ভোট নিয়ে সে অনুযায়ী রায় দেয়া অনুষ্ঠানের নৈর্ব্যক্তিকতা ক্ষুণ্ন করার পাশাপাশি বিচারকদের পারঙ্গমতাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে।
এ প্রক্রিয়া এটাও স্বীকার করে নেয় যে, দর্শক ও বিচারকের বিচারিক ক্ষমতা সমান, যা কোনভাবেই প্রতিযোগিতামূলক মানসিকতা বা মনোভাবের মধ্যে পড়ে না।
কেউ বলতে পারেন, দর্শকদের রায় দেয়াটা শুধু প্রতিযোগীদের মূল্যায়নের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি অনুষ্ঠানে দর্শকদের অংশগ্রহণও নিশ্চিত করে। সেটা অবশ্যই ঠিক। পার্টিসিপেটরি বা অংশগ্রহণভিত্তিক কর্মকাণ্ড এখন সবজায়গায়ই চর্চা করা হচ্ছে। দর্শক যেন নিজেকে অনুষ্ঠানের অংশ মনে করে, তা নিশ্চিত করার চেষ্টা চালানো হয় এর মাধ্যমে।
কিন্তু দর্শকদের অংশগ্রহণের সীমা ও মাত্রা কতটুকু থাকা উচিত, সেটি নিয়ে প্রশ্ন আছে। দর্শক অংশগ্রহণের নামে এমন কিছু করা উচিত নয়, যা অনুষ্ঠানের মানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। এ ধরনের প্রতিযোগিতায় দর্শকদের অংশগ্রহণে প্রত্যক্ষভাবেই লাভবান হচ্ছে মোবাইল ফোন অপারেটরগুলো। দর্শকদের লাভ নিজেকে বিচারক ভাবার আত্মতুষ্টি পর্যন্ত। কিন্তু দর্শকদের এ ধরনের অংশগ্রহণ অনুষ্ঠানের মান বাড়িয়েছে কি-না, তা ভাবা যেতে পারে।
বিচারিক ক্ষমতা না দিয়েও দর্শক কীভাবে অনুষ্ঠানের অংশ হতে পারে, তা নিয়ে অন্য আলোচনা হতে পারে। এবং সেটা করা সম্ভবও। কিন্তু তার আগে উদ্যোক্তাদের ভাবতে হবে- তারা শুধু বিচারকদের দিয়েই প্রতিযোগীদের মূল্যায়ন করবেন, নাকি দর্শক সেন্টিমেন্ট ব্যবহারের মাধ্যমে মূল্যায়ন প্রক্রিয়াকে তথাকথিত ‘ভিন্নমাত্রা’ দেবেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।