মিডিয়া
জানো নওরিতা আমি যখন ক্লাস সিক্সে পড়ি তখন বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিলাম ?
-কেন বলোতো ? তোমাকে খেতে দিতোনা বুঝি? নাকি বাদরামো করতে পারতেনা, কোনটা?
এসব কিছুই না। অলক এখনও জানেনা ঠিক ১১ বছর বয়সে অলক কেন বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিলো।
ড্রইং রুমের চারপাশে সবাই গোল হয়ে বসে আছে। মাঝখানে মাথা নিচু করে আমি দ্বাড়ানো, আমার বাবা ওয়ালী আহমেদ ড্রইং রুমের এক পাশে আমার পড়ার টেবিলের তালা দেয়া ড্রয়ারটা ভাঙ্গার চেষ্টা করছেন, ছোট ভাই রনি খুব কৌতুহলী হয়ে দেখার চেষ্টা করছে ড্রয়ার থেকে কি বের করছে তার বাবা। ওয়ালী আহমেদ বিকট শব্দে ড্রয়ারের তালা ভাঙ্গতে সমর্থ হলেন এবং সেখান থেকে বের হলো স্টিকার এ্যালবাম,স্ট্যম্প বুক ও বিদেশী কয়েন।
এর মধ্যে আমির খান ও অমিতাব বচ্চনের বেশ কয়েটি ভিউ কার্ড ও ছিলো। আমার দীর্ঘ দিনের সঞ্চয় করা সমস্ত সম্বলের এমন দূর্দশা দেখে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আমার কিছুই করার ছিলোনা। এবার ওয়ালী আহমেদ সাহেব ম্যাচের কাঠি জালালেন, ড্রয়ার থেকে উদ্ধার করা পুরোনো ষ্টাম্প, ভিউকার্ড আর স্টিকার একে একে ফেলতে লাগলেন আগুনের উপর।
রনি এতক্ষন দড়জার পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলো। পুড়ে যাওয়া স্টিকারগুলো তার খুব পছন্দ হয়েছে।
সে জলন্ত আগুনে পুড়তে থাকা কিছু ষ্টিকার তুলে নেয়ার চেষ্টা করলে মা রেগে যান, ” খবরদার একদম ধরবিনা এগুলো, সব পুড়ে ফেলো, এসব ষ্টিকার, ভিউকার্ড, ষ্ট্যম্প পোদ্দারী করেই তো নষ্ট হয়েছে তোমার ছেলে, আবার নতুন করে আরেক যন্ত্রনা তৈরীর কোন দরকার নেই” মায়ের এক ঝাড়িতে রনি হাতে নেয়া ষ্টিকারগুলো আবার আগুনে ছুড়ে ফেলেছে।
কমিশনার আবদুল বারি এতক্ষন চেয়ারে বসে ছিলেন , সম্পর্কে আমার মামা হন তিনি। খুবই বদরাগী স্বভাবের এই লোকটাকে পরিবারের সবাই ভয় পায়। তাই যে কোন দেন দরবারের সময় তিনি আসেন বিবাদ মিটাতে, তিনি এবার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। বিনা বাক্য ব্যয়ে তিনি তার পা থেকে জুতা খুলে আমার চুল ধরে একাধারে পেটাতে থাকলেন।
আমি আমার ক্ষুদ্র পুচ্ছ দেশে অসংখ্য জুতার বাড়ি হজম করতে থাকলাম। এক পর্যায়ে আমি হাউ মাউ করে কেঁদে ফেললাম। ”আমি তো পালাইনি, আমাদের কে ছেলে ধরা নিয়ে গিয়েছিলো, আমি আর ফরিদ প্রাইভেট পড়ে বাসায় ফিরছিলাম হঠাৎ একটা ট্রাক এসে আমাদের সামনে থামলো, আমাদের মুখে কাপড় চেপে বললো ট্রাকে উঠতে,আমাদেরকে ট্রাকে তুলে নিয়ে গেলো...... আমার আর কিছুই মনে নেই”।
হু হু হু.....
এবার বাবা এগিয়ে এসে আমার কাট টেনে ধরলেন। ”ছেলে ধরা ট্রাকে তুলে তোদেরকে নিয়ে গিয়েছিলো”? মিথ্যা কথার আর জায়গা পাসনা? তাহলে ঘরের আলনা থেকে তোর সব জামা কাপড় গুলো কে সড়ালো? ট্রাক ওয়ালা এসে বাসা থেকে কাপড় চোপড় নিয়ে গেছে?
এই কথা বলার পর আমার আর কিছুই বলার নেই , সব কিছুই পরিস্কার হয়ে গেছে ।
সবাই বুঝে গেছে যে আমি বাসা থেকে পালিয়েছিলাম। এবার আর কোন মিথ্যা গল্পই সাজানো যাচ্ছেনা।
ঘটনার দিন সকাল বেলা স্বাভাবিক নিয়মে আমি রশিদ স্যারের বাসায় অংক পড়তে গিয়েছিলাম। যথারীতি ফরিদও একই চিটারের বাসায় পড়তে আসে। ফরিদের আগে থেকেই প্রস্তুতি ছিলো, ব্যগ ভর্তি ভিডিও ক্যাসেট আর একটা কাটিং গ্রেপস নিয়েই তার প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছিলো ফরিদ।
আমি বাড়ী ফিরে এসে আলনা থেকে দুটো ট্রাউজার আর সার্ট নিলাম, হাতে টাকা ছিলোনা, কিন্তু আলমারিতে রাখা পুরস্কারের কিছু প্রাইজবন্ড ছিলো, সব মিলে চারশত টাকা । বেলা নয়টা নাগাদ ঢাকার বাস ধরলাম আমি আর ফরিদ।
কুমিল্লা হতে ঢাকা যেতে তখন দুই দুইটা ফেরি পার হতে হতো। আমার সেকি উত্তেজনা, ফেরিতে চড়বো, ঝাল মুড়ি ,শশা , সিদ্ধ ডিম.... কতো কিছু খাবার আছে। ফেরিতে উঠে আমি ফরিদ কোনটাই বাদ রাখিনি।
ঢাকার সায়েদাবাদ নেমে আমার খুব ভয় হচ্ছিল, সেই প্রথম আমার ঢাকা দেখা। ফরিদ অনেকবার এসেছে। তাই ফরিদ আগে হাটছে আমি পিছন পিছন, সায়েদাবাদের পাশে রেল ক্রসিং এ এসে আমরা স্কুটার নিলাম, রাজধানী ঢাকা দেখে আমার চোখ ছানা বড়া। এতো দিন যা কিছু দেখতাম টেলিভিশনের পর্দায় এখন সব কিছু আমার চোখের সামনে, ফরিদ আমাকে একে একে সব চিনাতে লাগলো, চব্বিশ তলা বিল্ডিং , শিশু পার্ক, যাদুঘর,সোহরাওয়ার্দি উদ্যান.....। শিশু পার্কের সামনে এসে মিশুকের মাস্কট দেখে আমি প্রায় মাথা বের করে চিৎকার করে উঠলাম এইতো মিশুক এইতো মিশুক, তখন সাফ গেমসের মাস্কট হিসাবে মিশুক চরিত্র দারুন তুঙ্গে।
যাদুঘরের সামনে এসে আমরা নামলাম। সিদ্ধান্ত হলো পুরো যাদুঘর প্রথমে দেখবো, একে একে শিশু পাকর্, চিড়িয়াখানা তার পর অন্য কিছু। কাউন্টারে ব্যাগ রেখে যাদুঘরের কিছু অংশ ঘুরে বাংলাদেশের মানচিত্রের কাছে গিয়ে কুমিল্লা শহরের জায়গায় বাতি টা জালিয়ে দেখলাম ঢাকা কতটা দূরে। যাদুঘর দেখে , চিড়িয়াখানা দেখা শেষ করে শেষ চক্কর শিশু পার্কে। তখন ঢাকা শিশুপার্ক নতুন হয়েছে মাত্র।
নতুন নতুন রাইডে উড়াল পাখির মতো চড়ে বেড়াচ্ছি আমি আর ফরিদ।
দিন ভর ঘুরে খুব ক্লান্ত হয়ে পড়লাম দুজনেই। পকেটের টাকা ও প্রায় শেষ হবার পথে। ফরিদ বললো বাসার সবার জন্য মন খারাপ লাগছে। আমি বললাম আমারও খারাপ লাগছে।
চল ফরিদ ফিরে যাই....। ফরিদ বললো, ফিরে গেলে কপালে মাইর একটাও মাটিতে পড়বেনা এইটা বুঝছ ! কিন্তু দোস্ত থাকবি কোথায় ? খাবি কি ? আর স্কুলে যাবোনা ? নানান প্রশ্ন মাথায় খেলতে লাগলো।
সব কিছু ভেবে দুইজন কমলাপুর ষ্টেশনে এসে হাজির, তখন রাত ৯ টা, রাত ১১ টায় তুর্ণা নিশিথা ট্রেনে কুমিল্লা ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম।
কিন্তু আমরা এতক্ষন কোথায় ছিলাম এই উত্তর কি দেবো? এক মত হলাম দুজনেই, আমরা প্রাইভেট পড়ে বাড়ী ফিরছিলাম তখন ছেলেধরা আমাদের মুখ বন্ধ করে ট্রাকে তুলে ঢাকা নিয়ে গিয়েছিলো। আমরা পালিয়ে বাসায় চলে এসেছি।
টেলিফোনের অপর প্রান্তে অলক নওরিতার হাসির শব্দ শুনতে পেলো। নওরিতা হাসি থামাতে পারছেনা।
-এই নওরিতা হাসছো কেন?
এবার অলকও নওরিতাকে অনুসরন করছে, টেলিফোনের দুই প্রান্তে অলক আর নওরিতা দুজনই হেসে চলেছে অনবরত।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।