সমবেত চেষ্টায় অংশগ্রহন।
মেয়েরা বড়ো অভাগা। কথাটা আমাকে বলেছিল বড়আপা। যে বয়সে আমি ছাদে উঠে জীবনানন্দ পড়ি জ্যোৎস্না রাতে,টেলিফোনে একের পর এক বন্ধুর সাথে আড্ডা মারি,রাত ৯টা/১০টায় কোন কারন দর্শানো ছাড়াই বেরুতে পারি ঘর থেকে তখন বড়আপা আমার চেয়ে দুই বছরের বড় হয়েও সেটা পারে নি কোন দিন।
ঘরের বাইরে সন্ধ্যা বিকেলে বের হওয়া তো অনেক পরের বিষয়,তার পক্ষে ছাদে উঠাতেই ভীষন কড়াকড়ি ছিল।
না সেটা পর্দা প্রথার জন্য না। নারীর প্রতি অবহেলা বা নারীকে দ্বিতীয় শ্রেনীর নাগরিক করে রাখার কোন সংস্কৃতি আমাদের পরিবারে ছিল না।
তবু বড়আপাকে এই ঘেরাটোপে থাকতে হতো কারন বাইরে হায়নারা ওত পেতে থাকতে পারে।
আমার চেয়ে লেখাপড়ায় অনেক ভালো হওয়া সত্ত্বেও
(একটা স্ট্যান্ড,একটা স্টার) বড়আপাকে কুকড়ে থাকতে হতো সবসময়। যদি পাড়ার গোড়ায় কেউ শিস বাজিয়ে দেয়,কেউ যদি একটা নোংরা চিঠি ছুড়ে দেয় কিংবা যদি কেউ এসিডই ছুড়ে মারে..এই ভয়ে মা তার মেয়েকে আগলে রাখতেন সবসময়।
সেই বড়আপা এখন কানাডায়। একটি অনিয়মিত ইংরেজী ব্লগ আছে ওর। সেখানে মাঝে মাঝেই টুকিটাকি লিখে,যেহেতু মাঝে মাঝে লিখে তাই নিয়মিত তার ব্লগ ভিজিট করা হয় না আমার। সে যখন লিখে তখন আমাকে মেইল করে জানায়,আমি সেটা পড়ে আসি। তার বন্ধু বান্ধব আর আমাদের বিশাল কাজিন সমাজের বাইরে তার পাঠক বোধ হয় নেই ।
তবু তার লেখা আমাকে মুগ্ধ করে। এই দেশের যে কোন রাজনৈতিক ইস্যুতে কিংবা উৎসব পার্বনে তার লেখার ধার ও চিন্তার আমি মুগ্ধ পাঠক।
নারীদের এই ব্লগিংটাকে আমার বেশ ভালো লেগেছে।
কঠিন বাস্তবতা হচ্ছে আমাদের দেশে নারীদের অধিকার পর্যুদস্ত। ঘরে বাইরে তাদের কথা শোনার অবসর কারো নেই।
অথচ তাদের অনেকেই পড়াশোনায়,চিন্তা ভাবনায় আমাদের অনেকের চেয়েই অনেক বেশি জানেন এবং জানাতে পারেন।
ব্লগিং তাদের জন্য একটি চমৎকার মাধ্যম হতে পারে এই দেশে। যে মেয়েটির অধিকার নেই বাইরে বের হয়ে বিভিন্ন আড্ডা বা সভাসমিতিতে যাওয়ার এবং কথা বলার ,সেই নারী অনায়াসেই তার ব্লগের পাতায় সেই কথাগুলো শেয়ার করতে পারেন বাকী সবার সাথে।
সমাজের সকল সুস্থ মানসিকতার মানুষের উচিত এই পথটি সুগম করে দেয়া।
বিশ্বে নারী ব্লগারদের সংখ্যা বাড়ছে।
পিউ এর সাম্প্রতিক গবেষনা অনুযায়ী মোট ব্লগারদের কমপক্ষে অর্ধেক সংখ্যাই নারী ব্লগার উন্নত বিশ্বে। দূ:খের বিষয় আমাদের দেশে এই সংখ্যা খুবই খুবই কম।
জনপ্রিয়তম বাংলা ব্লগ সাইট সামহোয়্যারকে বিবেচনা করেই দেখা যাবে যে এখানে নারী ব্লগারদের সংখ্যা খুবই হাতে গোনা।
এর পেছনে মূল কারনটি হচ্ছে এখনও আমাদের পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা। নারীকে অবদমিত করার ,যৌন হয়রানি করার যে অন্ধকার মানসিকতা আমাদের সমাজের অনেক কুৎসিত মানুষ ধারন করেন সেটা তারা নিকের আড়ালে থেকে এই ভার্চুয়াল জগতেও প্রকাশ করতে চান।
খুব অবাক হয়ে ভাবার বিষয় হচ্ছে যে সমাজের যে অংশটুকুকে আলোকিত মনে করি আমরা সেই শিক্ষিত,সুশীল সমাজ যার মাঝে কিছু সাংবাদিকও আছেন তারা নারীদের প্রতি খুবই বাজে আচরন করে থাকেন।
উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে সামহোয়্যারে বর্তমানে যে মডারেশন চালু হয়েছে সেটিও সামহোয়্যার করতে বাধ্য হয়েছে এরকমই একটি নারী অবমাননার ঘটনায় যেখানে একজন জনপ্রিয় ব্লগারের কাপড় খুলে ফেলা জাতীয় নোংরা ইঙিত করেছিলেন একজন।
সামহোয়্যারের বর্তমান মডারেশনে ব্লগাররা সন্তুষ্ঠ। এই মডারেশন যে নতুন নতুন ব্লগারকে এখানে লিখতে উৎসাহিত করছে,ইউজার বেড়ে যাওয়ার সাম্প্রতিক রেশিওটি তারই একটি উজ্জল প্রমান ।
কিন্তু এই কঠিন মডারেশনের মাঝে থেকেও কিছু মানুষ তাদের অন্ধকার মানসিকতা ছাড়তে পারছেন না।
এমনকি একজন মডারেটরকে পর্যন্ত আক্রমন করা হয়েছে তার নারী নামের কারনে।
সাম্প্রতিক আরেকটি ঘটনায় দেখা যাচ্ছে যে আরো একজন ব্লগার (যিনি পূর্বোক্ত ব্লগার যার কুকান্ডের জন্য কারনে নীতিমালা চালুর বিষয়টা সিরিয়াসলি ব্লগাররা এপ্রিশিয়েট করেছিলেন সেই ব্লগারের ঘনিষ্টজন) একজন নারী ব্লগারকে একই ভাবে খুবই খারাপ কথা বলেছেন।
আশ্চর্যের বিষয় এই কাজটি করার পর,পুরো ব্লগাস্ফিয়ার প্রতিবাদের ঝড়ে উত্তাল হলেও তিনি নূন্যতম সৌজন্যের সাথে সরি বলতেও রাজি হন নি এখন পর্যন্ত। বরং তার সহকর্মী ও সহব্লগাররা এই প্রতিবাদের ঘটনায় বিরক্ত হয়ে বলছেন,"একটি কমেন্ট হজম করতে না পারলে এখানে আসা কেন?"
যেন মনে হচ্ছে নারীদের প্রতি বাজে কমেন্ট করাটাই স্বাভাবিক এবং এটি হজম বা সহ্য না করাটা সেই নারীরই ব্যর্থতা।
কী দূ:খের কথা,লেখাপড়া করে ,ভালো পরিবেশে কাজ করেও এদের পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয় নি!
সুতরাং আমি মনে করি আমরা যারা ব্লগ কমিউনিটিকে একটি সুন্দর বাগান হিসেবে গড়ে তুলতে চাই (আরিলের এই কথাটি মনকে দোলা দিয়ে গেছে আমার) তাদের সকলেরই উচিত হবে একসাথে কাজ করে যাওয়া এবং আমাদের সহব্লগারদেরকে নারী হিসেবে বাজে টৃট না করে মানুষ হিসেবে টৃট করা ।
পৃথিবী ব্যাপী নারী ব্লগাররা আজ অনেক শক্ত অবস্থানে । তাদের নিজস্ব নেটওয়ার্ক দ্রুতই সম্প্রসারিত হচ্ছে।
এ বছরই ৮০০ নারী ব্লগারের অংশগ্রহনে অনুষ্ঠিত হয়েছে ব্লগহার -২০০৭।
তোড়জোর শুরু হয়েছে পরবর্তী সম্মেলনের।
সেই সম্মেলনে আমাদের নারী ব্লগারদের যুক্ত হওয়া প্রয়োজন ।
দরকার আমাদের নারী ব্লগারদের কন্ঠ পৌছে দেয়া বিশ্বব্যাপী। যাতে করে পৃথিবীকে জানানো যায় যে আমাদের মতো পশ্চাৎপদ সমাজেও নারীরা তাদের কথা বলার জন্য ব্লগিংয়ে এগিয়ে এসেছেন।
আমি আশাকরি আরো নতুন নতুন নারী ব্লগাররা আমাদের ফুলের বাগানে ফুল হয়ে ফুটবেন।
সেই পরিবেশ নিশ্চিত করার দায়িত্ব আমাদের বাকী সবার ।
--------------------------------
আমাদের উদ্যমী নারী ব্লগাররা ব্লগহার সংক্রান্ত ওয়েবসাইটটি এখানে পাবেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।