যেতে চাও যাবে, আকাশও দিগন্তে বাঁধা, কোথায় পালাবে!
পূর্ববর্তী পর্বে শিক্ষার মান পর্যালোচনায় পাবলিক ও বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামুলক চিত্র নিয়ে আলোচনা শুরু করেছিলাম, এই পর্বে এই বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনা করা হলো। গত পর্বের (শিক্ষার মান পর্যালোচনায় পাবলিক ও বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামুলক চিত্র - ১) লেখায় বিভিন্ন ব্লগার এর মন্তব্যে এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু ব্যাপার উঠে এসেছে। আশা করি এই পর্বের লেখাটি তাদের প্রকৃত অবস্থা বুঝতে সাহায্য করবে।
শিক্ষার মানের যে সূচকগুলির আলোকে তুলনামূলক আলোচনা করবে সেগুলি আপনাদের সুবিধার জন্য আবারও উল্লেখ করছি -
- ভর্তি প্রক্রিয়া - পাঠক্রম ও বিষয়ের ব্যপ্তি
- ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত - মেধা যাচাই প্রক্রিয়া
- গবেষণা - গবেষণা প্রকাশনা ও এর
- পাশকৃত গ্র্যাজুয়েটদের গন্তব্য - আন্তর্জাতিক ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল কোলাবরেশন
বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা মানের প্রকৃত অবস্থা
-----------------------------------------------
# অধিকাংশ বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধা যাচাই ভর্তি প্রক্রিয়ার পূর্ব শর্ত নয়। তারা যে যতটা পারছে ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি করছে।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের পর্যালোচনায় সন্তোষজনক বলে বিবেচিত কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয় কিছু কিছু বিষয়ে একটি শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বা বুয়েট এ ভর্তি শিক্ষার্থীদের পাঁচ থেকে ছয়গুন শিক্ষার্থী ভর্তি করছে । অথচ তাদের অবকাঠামোগত ও শিক্ষা উপকরণের সুযোগ-সুবিধা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বা বুয়েট এর এক দশমাংশেরও কম।
# অধিকাংশ বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব কোনো ক্যাম্পাস নেই, বিশ্ববিদ্যালয়গুলি পরিচালিত হচ্ছে ভাড়া বাড়িতে। প্রায় সকল বিশ্ববিদ্যালয় অনাবাসিক, কোনা ছাত্রাবাস নেই। যার ফলে ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার প্রকৃত মেজাজটিই অনুপস্থিত।
# বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলির বিষয় ও পাঠক্রমের ব্যপ্তি অত্যন্ত কম। শুধু বাজার চলতি কিছু বিষয়কে পুঁজি করে গড়ে ওঠা এই সকল প্রতিষ্ঠানকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাতারে আদৌ ফেলা উচিত কি না তা অবশ্যই বিবেচ্য।
# অত্যধিক উঁচু টিউশন ফি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়ে স্বনির্ভরতা আনলেও, প্রায় সকল বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা কার্যক্রম সম্পূর্ণরূপেই অনুপস্থিত। গবেষণা উপযোগী গবেষণাগার গড়ে তোলার উদ্যোগও পরিলক্ষিত হয়না। ফলে শিক্ষাদান পরিণত হয়েছে ব্যবসায়।
অধিকাংশ বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবহারিক বিষয়ের কাস হবার মত ল্যাবরেটরীও নেই। ছাত্র-ছাত্রীগণ ব্যাচেলর ডিগ্রী লাভ করছে দায়সারা একটি দুটি ব্যবহারিক ক্লাশ করে!!
# বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক অনুপাতও একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় চলছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্ট টাইম শিক্ষক দিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব শিক্ষক মন্ডলীর সংখ্যা নিতান্তই অপ্রতুল। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এ বিষয়ে কিছু আশাব্যন্জক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
# একটি দুটি ব্যতিক্রম ছাড়া বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা কার্যক্রম অনুপস্থিত থাকায় গবেষণা প্রকাশনা ও এর মান নিয়ে প্রশ্ন তোলা অবান্তর । যেখানে ব্যবহারিক ক্লাস করানোর মত ল্যাবরেটরী অ-প্রতুল, সেখানে গবেষণা উপযোগী ল্যাবরেটরী অধিকাংশ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়েরই পরিকল্পনাতেই নেই। ফলে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলি কেবলমাত্র পুঁথিগত বিদ্যা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। নামে বিশ্ববিদ্যালয় হলেও নতুন জ্ঞান সৃষ্টির প্রক্রিয়া ও উদ্যোগ সেখানে একেবারেই নেই বললেই চলে।
# বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মেধা যাচাই প্রক্রিয়া এখনো সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে উন্নীত হতে পারেনি।
এ বিষয়ে কোন সমন্বিত প্রক্রিয়াও নেই। বিশ্ববিদ্যালয়গুলি তাদের নিজস্ব উপায়ে মেধা যাচাই করে সার্টিফিকেট প্রদান করছে। অনেক ক্ষেত্রেই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ জি পি এ ধারী ছাত্রও কর্মক্ষত্রে প্রয়োজনীয় দক্ষতা দেখাতে ব্যর্থ হচ্ছে যা তাদের মেধা যাচাই প্রক্রিয়াকে আরো প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
# বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অত্যন্ত ইতিবাচক দিক হচ্ছে তাদের আন্তর্জাতিক কোলাবরেশন। গবেষনার ক্ষেত্রে এই কোলাবরেশন অনুপস্থিত থাকলেও ছাত্র-ছাত্রীগণ ক্রেডিট ট্রান্সফার এর মাধ্যমে উন্নত বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে পড়ার সুযোগ পাচ্ছে।
বেশ কিছু বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় ইন্ডাষ্ট্রিয়াল কোলাবরেশন নিয়ে চিন্তাভাবনা করছে। ইতোমধ্যে সীমিত পরিসরে কিছু কাজও হচ্ছে।
# অধিকাংশ বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি পজেটিভ দিক হচ্ছে উন্নত শিক্ষার পরিবেশ এবং সেশন জট বিহীন, ছাত্র রাজনীতির প্রভাব মুক্ত একটি নিরাপদ শিক্ষা ব্যবস্থা ।
# ইদানীং কালে কিছু বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় হতে পাশকৃত গ্র্যাজুয়েটগন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটদের সাথে প্রতিযোগীতা করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিযুক্ত হচ্ছেন এবং তাদের যোগ্যতার পরিচয় দিচ্ছেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয় অধিকংশ বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় হতে পাশ করা গ্র্যাজুয়েটদের সামগ্রিক নিয়োগ পরিস্থিতি এখনো আশাব্যঞ্জক নয়।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলির শিক্ষার মান কোন ক্রমেই উঁচু দরের নয় এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলি থেকে বহু পিছিয়ে আছে। তাই বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলির সত্যিকারের বিকল্প বা সহযোগী হিসাবে গড়ে উঠছেনা। এমতাবস্থায় দেশের শিক্ষার শিক্ষার মানের সার্বিক উন্নতিতে আমাদের প্রধান ফোকাস হতে হবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলি, এবং সেই সাথে প্রচেষ্টা চালাতে হবে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের মান উন্নয়নে।
পরবর্তী পর্ব থেকে পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান উন্নয়নে প্রস্তাবনা গুলি তুলে ধরব।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।