চলে যেতে যেতে বলে যাওয়া কিছু কথা
ট্রেন যখন ষ্টেশনে প্রবেশ করছে তখন ভোরের আলো নরম আলো পরশ বুলাতে শুরু করেছে সর্বত্র। ঘুম ঘুম চোখে ট্রেন থেকে নেমে দাড়ালাম। সোহেলের আমার জন্য অপেক্ষা করার কথা। ষ্টেশনে খুব বেশী মানুষজন নেই। সহজেই সোহেলকে পেলাম, একটি বেঞ্চির উপর ঠায় বসে আছে, যেমনটি তাকে বলেছিলাম গতবার এসে।
ট্রেন থামবে পাচ দশ মিনিটের জন্য, আপাতত উলটো পথেই সোহেলকে নিয়ে রওয়ানা দেব। তাই নিরাপদ হবে, ফিরতি ট্রেনের জন্য ঘন্টাখানেক বসাটা হবে বিপদজনক।
বছর দুই আগে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে সোহেলের সাহচর্য পেয়েছিলাম গাইড হিসাবে। সোহেলের মা আমার দাদাবাড়িতে টুকটাক কাজকর্ম সেরে দিতেন। পরে জেনে অবাক হয়েছিলাম কাজের মহিলার ছেলেটি স্কুলের ফাষ্ট বয়।
ছেলেটি খুব যত্ন করে গ্রাম ঘুড়িয়ে দেখিয়েছিল। দুদিনের মধ্যে শিখিয়ে দিয়েছিল কিভাবে পুকুরে সাতার কাটতে হয়। মায়া পড়ে গিয়েছিল ছেলেটির জন্য, আবার বয়সের দুরত্বটআ দুতিন বছরের হওয়াতে পরষ্পরের বন্ধু হয়ে গিয়েছিলাম আমরা। বয়সে আমি ছিলাম বড়।
পরের বার আবার যখন সুযোগ পেলাম গ্রামে বেরিয়ে আসার, তখন অবাক হলাম আর কষ্ট পেলাম সোহেলের স্কুল ছেড়ে দেয়ার খবর শুনে।
সোহেলকে তার এক মামা কাজের কথা বলে জেলা শহরে নিয়ে গিয়েছে। সোহেলের মাকে জিজ্ঞাসা করলে, উনি সংসারের কষ্টের কথা জানালেন, আরো জানালেন সিন্ধান্তটা ছিল নাকি সোহেলের বাবার। পাচশত টাকার মাইনেতে একটি প্রেসে চাকুরি হয়েছে ওর।
বাসায় ফিরে এসে শহরের ব্যস্ততাতে ডুবে গিয়েও সবস্তি পেলাম না। একটি প্রতিভাবান আর সৎ ছেলের বাকী জীবনটা কাটবে কারখানার একটি অন্ধকার স্যাস্যাত কুটুরিতে, ভাবতেই কষ্টে মন বিদ্রোহী হয়ে উঠছিল।
মাসখানেক আগে সোহেলের কারখানার ঠিকানা জোগাড় করে দেখা করতে গিয়েছিলাম ওর সাথে। আমাদের পরিবারটি সচ্ছল, তাই বাবাকে রাজী করাতে সক্ষম হয়েছিলাম আর্থিক সহায়তা দিয়ে সোহেলের লেখাপড়া চালিয়ে যাবার জন্য। সোহেলে রাজী হল কারখানা থেকে পালিয়ে আসার পরিকল্পনায়। কয়েক মাসেই শুকিয়ে গিয়েছিলা ও কাজের চাপে। তাই আমার পরিকল্পনায় আমি আরো মরিয়া হয়ে উঠলাম।
পালিয়ে আসা ছাড়া উপায়ও ছিলনা ওর। ওর মামা ছিল মুলত দালাল গোছের একজন। টাকার বিনিময়ে বিভিন্ন কারখানায় শিশু শ্রমিক সরবরাহে ভাল আয় রোজগার ছিল লোকটার। নিজের ভাগ্নেরও রেহাই মেলেনি। তাই তার মামা কখনো মেনে নিত না ওর কারখানা ছেড়ে আসাটা।
পরিকল্পনা মত আমি এসেছি সোহেল উদ্ধার অভিযানে।
কিরে দেরি করছিস কেন ঝটপট ট্রেনে উঠে পর।
কোন উত্তর না দিয়ে মাথা নিচু করে বসে রইল সে।
পাশে বসা আরেকটি ছেলের দিকে দৃষ্টি গেল আমার, এতক্ষন লক্ষ করিনি।
ও কে?
১৫ দিন আগে ওর মা কাজে দিয়া গেছে, কিছুতেই থাকতে চাইছিল না।
আমি বোঝায়া রাখছি। আমারে ছাড়া কিছুতেই থাকতে চায় না। কিংক্রতব্যবিমুঢ় হয়ে দাড়িয়ে রইলাম আমি কিছুক্ষন।
তারপর বললাম, প্রথম প্রথম তুই ও তো কান্নাকাটি করতিস, এক সময় ওর ও সবকিছু সহা হয়ে যাবে।
ওরে ছাইড়া যামু না আমি।
এবার ওর কন্ঠের দঢ়তায় হবাক হলাম আমি। বুঝতে পারলাম আমার অভিযান ব্যর্থ হতে চলেছে।
মনটা খারাপ হলেও একটি বালকের দায়িত্বশীল আচরনে, মনে এক ধরনের প্রশান্তিও অনুভব করলাম।
কয়দিন পরে কি আমি আবার আসব। সোহেলকে শুধালাম আমি।
সরাসরি উত্তর না দিয়ে অন্য কাহিনী শুনালো সে আমায়।
কারখানার ম্যানেজারকে রাজি করিয়ে দুবেলার সবার পড়াশুনার ব্যবস্থা করা হয়েছে। পড়াশুনা করানোর দায়িত্ব সোহেলের। স্থানীয় একটি সমাজ উন্নয়নমুলক ক্লাব সাহায্য করছে ওদেরকে।
একসময় ট্রেন ছাড়ার সময় হল।
ভারাক্রান্ত মনে ট্রেনে চাপলাম আমি। ধীরে ধীরে ট্রেন চলতে শুরু করেছে। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম দুটো ছেলে অপরাধী চেহারা নিয়ে মাথা নিচু করে বসে আছে, কান্না পেল আমার, কোনমত নিজেকে সামলিয়ে অন্যদিকে দৃষ্টি ফেরালাম আমি।
বাসায় ফিরে বাবাকে সব জানালাম। বাবা কিছুক্ষন চুপ থেকে বললে, ওরা নিজেদের ভবিষত নিজেরাই গড়ার উদ্যোগ নিয়েছে, এটি ত আশার কথা।
আর আমি সোহেলের মাঝে ভবিষত প্রজন্মের নেতৃত্ব দেখতে পেলাম, যা সাহসী, সত আর দায়িত্বশীল, নিজের স্বার্থ জলান্জলি দিতে যার একটুও বাধে না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।