আল্লাহ ছাড়া আর কোন সৃষ্টিকর্তা নেই । হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) আল্লাহর বান্দা ও রাসূল ।
হযরত আদম (আঃ) কে নিয়ে মানব সৃষ্টির যে বর্ণনা আল-কুরআনে আল্লাহপাক উল্লেখ করেছেন সেটা কম বেশী আমরা সবাই জানি । কিন্তু আমরা কি কখনও ভেবে দেখেছি যে, কেন আল্লাহ মাটির তৈরী আদম (আঃ) কে সেজদা করতে বলেছিলেন তার থেকেও উত্তম উপাদান দিয়ে তৈরী- অর্থাৎ নূর দিয়ে দিয়ে তৈরী ফেরেশ্তাদেরকে ? স্বাভাবিকভাবে এটা মনে হতে পারে যে, ফেরেশ্তারা মানুষের থেকে উত্তম এবং মর্যাদাশীল যেহেতু তারা নূরের তৈরী । তারা আল্লাহর বেশী নিকটবর্তী এবং দিন রাত তারা আল্লাহর হুকুম পালনে নিযুক্ত ।
তাদের দ্বারা আল্লাহর নাফরমানীমুলক কোন কাজ হয় না ।
এখন কেন আল্লাহ সুবহানাতায়ালা সেই ফেরেশ্তাদেরকে প্রথম সৃষ্ট মানুষকে সেজদা করতে বলেছিলেন, সেটা এখন একটু বিশ্লেষণ করা যাক ।
সূরা বাকারায় নিম্নোক্ত বর্ণনা রয়েছে -
'৩০. আর তোমার পালনকর্তা যখন ফেরেশ্তাদিগকে বললেনঃ আমি পৃথিবীতে একজন প্রতিনিধি বানাতে যাচ্ছি, তখন ফেরেশ্তাগণ বলল, তুমি কি পৃথিবীতে এমন কাউকে সৃষ্টি করবে যে দাঙ্গা-হাঙ্গামার সৃষ্টি করবে এবং রক্তপাত ঘটাবে ? অথচ আমরা নিয়ত তোমার গুনকীর্তন করছি এবং তোমার পবিত্র সত্তাকে স্মরণ করছি । তিনি বললেন, নিঃসন্দেহে আমি জানি, যা তোমরা জান না ।
৩১. আর আল্লাহ তা'আলা আদমকে শিখালেন সমস্ত বস্তু-সামগ্রীর নাম ।
তারপর সে সমস্ত বস্তু-সামগ্রীকে ফেরেশ্তাদের সামনে উপস্হাপন করলেন । অতঃপর বললেন, আমাকে তোমরা এগুলোর নাম বলে দাও, যদি তোমরা সত্য হয়ে থাক ।
৩২. তারা বলল, তুমি পবিত্র ! আমরা কোন কিছুই জানি না, তবে তুমি যা আমাদিগকে শিখিয়েছ (সেগুলো ব্যতীত) , নিশ্চয়ই তুমিই প্রকৃত জ্ঞান-সম্পন্ন, হেকমতওয়ালা ।
৩৩. তিনি বললেন, হে আদম, ফেরেশ্তাদেরকে বলে দাও এসবের নাম । তারপর যখন তিনি বলে দিলেন সে সবের নাম, তখন তিনি বললেন, আমি কি তোমাদেরকে বলিনি যে, আমি আসমান ও যমীনের যাবতীয় গোপন বিষয় সম্পর্কে খুব ভাল করেই অবগত রয়েছি ? এবং সেসব বিষয়ও জানি যা তোমরা প্রকাশ কর আর যা তোমরা গোপন কর !
৩৪. এবং যখন আমি হযরত আদম (আঃ) কে সেজদা করার জন্য ফেরেশ্তাদেরকে নির্দেশ দিলাম, তখনই ইবলিশ ব্যতীত সবাই সিজদা করলো ।
সে (নির্দেশ) পালন করতে অস্বীকার করল এবং অহংকার প্রদর্শন করল । ফলে সে কাফেরদের অর্ন্তভূক্ত হয়ে গেল ।
সূরা আল-আ'রাফে বর্ণিত হয়েছে যে -
১১. আর আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি, এরপর আকার-অবয়ব তৈরী করেছি । অতঃপর আমি ফেরেশ্তাদেরকে বলেছি - আদমকে সেজদা কর তখন সবাই সেজদা করেছে, কিন্তু ইবলিশ সে সেজদাকারীদের অর্ন্তভূক্ত ছিল না ।
১২. আল্লাহ বললেনঃ আমি যখন নির্দেশ দিয়েছি, তখন তোকে কিসে সেজদা করতে বারণ করল ? সে বললঃ আমি তার চাইতে শ্রেষ্ঠ ।
আপনি আমাকে আগুন দ্বারা সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে সৃষ্টি করেছেন মাটির দ্বারা ।
১৩. [আল্লাহ] বললেন, তুই এখান থেকে যা । এখানে অহংকার করার কোন অধিকার তোর নাই । অতএব তুই বের হয়ে যা । তুই হীনতমদের অর্ন্তভূক্ত ।
আল্লাহ তায়ালা আদম (আঃ)কে সৃষ্টি করার পর উনাকে বিভিন্ন বস্তুর নাম শিখালেন অর্থাৎ উনাকে জ্ঞান প্রদান করলেন । তারপর যখন ফেরেশ্তাদেরকে সেসব বস্তুর নাম বলতে বললেন তখন তারা তাতে অসমর্থ হলো । কারণ আল্লাহ তাদেরকে জ্ঞান প্রদান করেন নি । এই জ্ঞানের কারণেই মানব জাতি অন্যান্য সমস্ত সৃষ্টি অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ । ফেরেশ্তা ছাড়াও আমাদের জানা মতে আল্লাহর আরো যেসমস্ত সৃষ্টি আছে তাদের আল্লাহ পাক কাউকে মানুষের মত জ্ঞান প্রদান করেন নি ।
সেজন্য মানুষ সমস্ত সৃষ্টি অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ - আশরাফূল মাখলুকাত । এই জ্ঞানের শ্রেষ্ঠত্বের কারণে আল্লাহ ফেরেশ্তাদেরকে আদম (আঃ) কে সেজদা করতে বলেছিলেন । এটা হলো সম্মানের সিজদা - অন্য কিছু নয় ।
আমরা জানি মহানবী (সাঃ) কে পশুরা সেজদা করতো । সেগুলোও ছিলো সম্মানপূর্বক সেজদা ।
কারণ এক স্রষ্টার সৃষ্টি হিসেবে সকল সৃষ্টি সমান হবার কথা কিন্তু জ্ঞানের কারণে মানব জাতি অন্য সকল সৃষ্টি অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হয়ে গেল । আর মহানবী (সাঃ) কেও আল্লাহ শ্রেষ্ঠ জ্ঞান দান করেছিলেন এবং বিজ্ঞানময়-হেকমত কোরআন উনার উপরই নাযিল করা হয়েছে ।
পৃথিবীতে মহানবী (সাঃ) -ই মনে হয় একমাত্র ব্যক্তি যিনি কোন বিদ্যালয়ে বা কোন ব্যক্তির কাছে জ্ঞান অর্জন না করেও সব থেকে শ্রেষ্ঠ হয়েছেন - আল্লাহ প্রদত্ত ঐশী জ্ঞানের কারণে-ই । এটা আজ বিশ্ব স্বীকৃত ।
এখন আমরা যদি পৃথিবীর প্রাণীকূলের দিকে তাকাই তাহলে এমন অনেক প্রাণী-ই পাব যারা শারীরিক দিক দিয়ে মানুষ অপেক্ষা অনেক শক্তিশালী - যেমন- বাঘ, সিংহ, হাতি, ঘোড়া, বন মানুষ ইত্যাদি ।
কিন্তু পৃথিবীকে ডোমিনেট বলেন, ব্যবহার বলেন আর নেতৃত্ব-ই বলেন সব কিছু কিন্তু মানুষ-ই করছে । কিসের জোরে মানুষ এটা করছে ? জ্ঞান-বিদ্যা-বুদ্ধির জোরে । আর কোন কিছুর জোরে নয় । দশটা মানুষও একটা বাঘের সঙ্গে খালি হাতে লড়াই করে পারবেনা আবার সঠিক অস্ত্র হাতে থাকলে একজন মানুষই যথেষ্ট । সুতরাং জ্ঞানই মানুষকে শ্রেষ্ঠ করেছে - অন্য কিছু নয় ।
আবার যদি সমাজের দিকে তাকাই তাহলে দেখব সমাজের সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তিগণই সমাজে সবচেয়ে শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে থাকেন । অনুরূপভাবে জ্ঞানে-গুণে শ্রেষ্ঠ জাতিরাই দুনিয়াতে নেতৃত্বর আসনে বসে থাকে । মুসলমানগণ যত দিন জ্ঞানের চর্চ্চা করেছে ততদিন তারা দুনিয়াতে সেরা ছিলো আর আজ জ্ঞান বাদ দিয়ে ভোগ-বিলাসে মত্ত হওয়ায় তারা সে আসন থেকে ছিটকে পড়েছে ।
মানুষকে আল্লাহপাক এই জ্ঞান প্রদান করার কারণ হলো তাকে তিনি এই পৃথিবীতে উনার প্রতিনিধিস্বরূপ প্রেরণ করেছেন । পৃথিবীর সবাইকে আল্লাহ রিজিক প্রদান করলেও একমাত্র মানুষের উপরই স্রষ্টার হুকুম পালন এবং উনার প্রদত্ত দ্বীন দ্বারা জীবন পালন করার আদেশ প্রদান করা হয়েছে ।
নিম্নে জ্ঞানের কিছু ফযীলত বর্ণনা করা হলোঃ
হাদীসে আছে -
১. যে ব্যক্তি জ্ঞান অন্বেষণে চলে , আল্লাহ তাকে জান্নাতের পথে চালাবেন ।
২. ফেরেশ্তারা জ্ঞান অন্বেষণকারীর কাজে সন্তুষ্ট হয়ে তার জন্য পাখা বিছিয়ে দেয় ।
৩. একশ রাকআত নফল নামায পড়া অপেক্ষা জ্ঞানের কোন অধ্যায় শিক্ষা করা উত্তম ।
৪. জ্ঞান অন্বেষণ করা প্রত্যেক মুসলমানের উপর ফরয ।
৫. ঈমানদার আলেম ঈমানদার আবেদ অপেক্ষা সত্তর গুণ শ্রেষ্ঠ ।
৬. জ্ঞানী ব্যক্তি ও এবাদতকারীর মধ্যে একশ স্তরের ব্যবধান রয়েছে । প্রত্যেক দুস্তরের মাঝখানে এতটুকু দুরত্ব রয়েছে, যতটুকু একটি দ্রুতগামী ঘোড়া সত্তর বছরে অতিক্রম করতে পারবে ।
৭. সাহাবায়ে কেরামগণ আরজ করলেনঃ ইয়া রাসূলূল্লাহ, কোন আমলটি উত্তম? তিনি বললেনঃ আল্লাহ পাক সম্পর্কিত জ্ঞান । সাহাবীগণ আরজ করলেনঃ আমরা উত্তম আমল সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করছি । তিনি বললেনঃ আল্লাহ সম্পর্কিত জ্ঞান ।
আবার বলা হলঃ আমরা আমল সম্পর্কে প্রশ্ন করছি, আপনি এলেম সম্পর্কে বলছেন ! তিনি বললেনঃ এলেমের সমন্বয়ে অল্প আমল উপকারী হয় এবং মূর্খতার সমন্বয়ে অধিক আমলও নিষ্ফল হয়ে যায় । '
সবশেষে বলা যায় - আল্লাহর জ্ঞান অসীম । তিনি উনার সামান্য জ্ঞানের অল্প কিছু মানুষকে দান করেছেন । জ্ঞানের চর্চ্চা দ্বারাই মানুষ আল্লাহকে খুজে পায় এবং নিকটবর্তী হয় - ধন সম্পদ এর দ্বারা নয় । জ্ঞানীগণই আল্লাহর সর্বাপেক্ষা নিকটবর্তী ।
মহানবী (সাঃ) মৃত্যুর সময় ধন-সম্পদ রেখে যান নি আর তা আহরণের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন নি । তিনি জ্ঞানের উৎস কুরআন ও হাদীস-ই রেখে গেছেন ।
হযরত আদম (আঃ) কে নিয়ে আমার পূর্বের একটি পোষ্ট
হযরত আদম (আঃ), শ্রীলংকায় অবস্হিত পবিত্র আদমের চূড়া ও সাগরের তলদেশে অবস্হিত আদমের ব্রীজ।
সূত্রঃএহইয়াউ উলুমুদ্দিন । ইমাম গাজ্জ্বালী (রহঃ)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।