আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাংলাদেশের সর্বোচ্চ শিখরে চড়লাম - (তাজিংডং- শেষ পর্ব)

ইচ্ছেমতো লেখার স্বাধীন খাতা....

যে সব পাহাড়ি ঝর্ণায় সারা বছর পানি পাওয়া যায় সাধারণত সেগুলোর আশপাশেই পাহাড়ি গ্রাম গড়ে উঠে। সিমপ্লাম্পি গ্রামটার পাশেই এমন একটি পাহাড়ি ঝর্ণা আছে। ঝর্ণাটা অবশ্য গ্রাম থেকে বেশ নিচুতে। আর গ্রামটা পাহাড়ের উপর অনেকটা মালভূমির মতো একটা জায়গায় অবস্থিত। অবশ্য পুরো জায়গাটাই কিছুটা ঢালু।

সন্ধ্যা হয়ে এসেছিল। চারদিকে উচু পাহাড়। আকাশও প্রায় দেখা যাচ্ছিলো না। গতকালকে হারিকেনটা হারিয়ে ফেলেছিলাম। টর্চের লাইট ফিউজ হয়ে গিয়েছিল।

এ সময় ঘুটঘুটে অন্ধকারেই আমরা ঝর্ণার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। ঘুটঘুটে অন্ধকারে গা ছমছম করে উঠছিল। মনে হচ্ছিল যেন, বিশাল এক কুয়ায় নামছি। পাহাড়ীদের প্রায় সবার বাড়িই বাশের মাচার উপর তৈরি। এ ধরনের বাড়িতে বন্য জীব-জন্তু আক্রমণ করতে পারে না।

এ ধরনের বাড়িগুলোতে থাকতেও খুব আরাম। এগুলো পরিবেশ বান্ধবও বটে। আমাদের তাবু এবং কার্যকলাপ কিছুটা হলেও পরিবেশের ক্ষতি কেরেছে। আমরা সেখানে কিছু প্যাকেটজাত খাবার নিয়ে গিয়েছিলাম। যেগুলোর পলিথিনের প্যাকেট আমরা ফেলেই এসেছিলাম।

আমাদের চিতকার চেচামেচি হৈ হুল্লোড়েও পাহাড়ীদের অসুবিধা হওয়ার কথা। পাহাড়ীদের বাড়ির মতো মাচার উপর তাবু টাঙ্গানোর কোনো উপায় আমাদের জানা ছিল না। এ কারণে ঠাণ্ডা মাটির উপরই তাবু টাঙ্গাতে হয়েছিল। আমাদের সঙ্গে তাপমাত্রা মাপার মতো কোনো সরঞ্জাম ছিল না। তবে আমার কাছে এ রাতটি ছিল সবচেয়ে ঠাণ্ডা রাত।

আগুন থেকে একটু দূরে গেলেই ঠকঠক করে কাপছিলাম আমি। তাবুর ভেতরে বাইরে দু জায়গাতেই খুব ঠাণ্ডা। কাড়াকাড়ি করে খাওয়া-দাওয়া সারলাম। আগুনের পাশে বসে কিছুক্ষণ গরম হয়ে তাবুতে ঢুকে শুয়ে পড়লাম। দুজন বন্ধু ঠাণ্ডায় সারা রাত আগুনের পাশেই কাটিয়ে দিল।

আগেই বলেছি, সিমপ্লাম্পি গ্রামটা কিছুটা ঢালু জায়গায় অবস্থিত। ফলে আমাদের তাবুটাও এই ঢালু জায়গায় টাঙ্গাতে হয়েছিল। রাতে ঘুমানোর সময় আমরা সবাই পাহাড়ের ঢালের দিকে গড়িয়ে চলে যাচ্ছিলাম। পরের কয়েক রাত এ স্মৃতি আমাদের তাড়া করেছিল (সমতল বিছানাকেও তখন ঢালু বলে মনে হচ্ছিলো)। জানুয়ারির ৫ তারিখ।

সকাল ৭টার সময় আমরা তাবু গুটিয়ে রওনা দিলাম তাজিংডংয়ের দিকে। গ্রামের বা দিক থেকে রাস্তাটা প্রথমে নিচের দিকে নেমে গেল। খুব ছোট একটা পাহাড়ি ঝর্ণা এবং কিছু জুম ক্ষেত দেখলাম। এগুলো পার হবার পর পথটা উপরে উঠতে লাগলো। অবশ্য আমরা যে গ্রামটা থেকে রওনা দিলাম সেটিও সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে অনেক উচু।

এ কারণে তাজিংডংকে খুব একটা উচু বলে মনে হচ্ছিলো না। সকালের কুয়াশা কেটে গিয়ে আস্তে আস্তে রোদ উঠছিল। পাহাড়ি উচু পথ থেকে বহু দূরের পর্বতের সারি দেখা যাচ্ছিলো। এ সময় আমরা তাজিংডংয়ের অনেকখানি উপরে উঠে গিয়েছিলাম কিন্তু তখনও চূড়াতে পৌছতে পারি নাই। আরও কিছুটা উপরে উঠার পর পায়ে চলা পথটা শেষ হয়ে গেল।

এবার ২০-২৫ ফিট একেবারেই খাড়া পাহাড়। অনুমান করলাম, এর উপরে উঠলেই পেয়ে যাব বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বিন্দু। এতো পথ পাড়ি দিয়ে এতো পরিশ্রম করার পর সামান্য ২০-২৫ ফিট আমাদের কাছে কোনো বাধাই মনে হয়নি। একপাশ দিয়ে গাছের কিছু ঝোপঝাড় ছিল। কয়েকজন বন্ধু সেগুলো বেয়ে উঠার চেষ্টা করছিল।

আমি ওদিকে না যেয়ে একটা বড় গাছের শিকড় ধরে দ্রুত উপরে উঠে গেলাম। তাজিংডংয়ের উপরেও দেখি বাঁশ বন। চূড়ার মাটি নূড়ি পাথর আর মোটা বালু মেশানো। এর যে পাশটা সবচেয়ে উচু সে পাশে গিয়ে দাড়ালাম। আমার জীবনে সে এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত।

আনন্দে পাশের বন্ধুকে জড়িয়ে ধরলাম। আমাদের সঙ্গে একটা বাংলাদেশের পতাকা ছিল। একটা বাশ কেটে সেটার আগায় পতাকাটা টাঙ্গিয়ে দেয়া হলো। বিশ্বাসই হচ্ছেনা আমরা বাংলাদেশের সর্বোচ্চ শিখরে। এ সময় দেখি বাকলাই আর্মি ক্যাম্পের একটি টহল দল তাজিংডংয়ে এসে উপস্থিত।

তাদের শরীরের সঙ্গে শিকল দিয়ে বাধা অস্ত্র। কেউ যেন অতর্কিত আক্রমণ করে অস্ত্র ছিনিয়ে নিতে না পারে সেজন্য এগুলো শিকল দিয়ে বাধা। এদের কয়েকজনের সঙ্গে গতকালই বাকলাই ক্যাম্পে পরিচয় হয়েছিল। চূড়ায় উঠেই তারা ওয়ারলেসের অ্যান্টিনাটা লম্বা করে নেয়। তারপর কড়কড় কড়কড় শব্দে চলতে থাকে তাদের কথোপকথন।

আর্মিদের কয়েকজনের সঙ্গে খাবার পানি ও বিস্কুট শেয়ার করা হলো। এবার বিদায়ের পালা। এ সময় আর্মিরাও কাজ শেষ করে নামতে থাকে। তাজিংডংয়ের চূড়া থেকে নামার সময় আমরা আর আগের পথে ফেরত যাইনি। নতুন পথে আমরা থানচি থানা সদরের দিকে রওনা দেই।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.