[লেবাননের প্রখ্যাতি কবি ও লেখক খলিল জিবরানের জন্ম উত্তর লেবাননের বাশহরিক শহরে ১৮৮৩ সালের ৬ জানুয়ারি, মৃত্যু এপ্রিল ১০, ১৯৩১ নিউইয়র্কে। তিনি ছিলেন একাধারে কবি, চিত্রশিল্পী, ভাস্কর, লেখক, দার্শনিক, ধর্মতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ এবং অঙ্কন শিল্পী। বহিরাগত লেখক হিসেবে নিউইয়র্কের পেন লীগের আন্দোলনে জড়িত ছিলেন। ইংরেজি ও আরবি ভাষায় লেখালেখি করেছেন। আরববিশ্বে জিবরান বিদ্রোহী সাহিত্যিক ও রাজনীতিক হিসেবে পরিচিত।
ক্লাসিক্যাল ধারা ডিঙিয়ে তিনি আধুনিক আরবি সাহিত্যে রোমান্টিক স্টাইলে রেনেসাঁর প্রবর্তন করেন। এখনো লেবাননে তাকে সাহিত্যিক বীরপুরুষ হিসেবে মান্য করা হয়। ইংরেজি ভাষাভাষীদের কাছে ১৯২৩ সালে প্রকাশিত 'দি প্রফেট' গ্রন্থের জন্য জিবরান সুপরিচিত। প্রফেট গ্রন্থ ৪০টি বিদেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। শেকসপিয়রের পর প্রফেট কাব্যগ্রন্থ সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বেস্ট সেলার বই।
]
ওই লোকটির প্রতি আমার করুণা হয় যিনি একজন মহিলাকে ভালোবেসে স্ত্রীরূপে বরণ করে নেয়। তার পদতলে মনপ্রাণ কোরবান করে দেয়। দেহের ঘাম আর রক্ত একাকার করে উৎসর্গ করে মহিলার পায়ে। নিজের হাড়ভাঙা পরিশ্রম ও কষ্টের ফসল অর্থাৎ টাকা তার হাতে তুলে দেয়। কিন্তু যখন ঘুম ভাঙে তখন দেখতে পায়, যার হৃদয় ক্রয় করতে চেয়েছিল সে অত্যন্ত আন্তরিকতা ও স্বাধীনতার সঙ্গে অন্যের দখলে চলে গেছে।
উদ্দেশ্য, নতুন পুরুষের কাছে গভীর প্রেমের স্বাদ গ্রহণ করা।
ওই মহিলার প্রতি আমার করুণা হয়, যিনি অস্থিরভাবে ঘুম থেকে জেগে ওঠেন আর দেখেন এমন একটি সংসারে তার আগমন ঘটেছে যেখানে স্বর্ণ আর মূল্যবান উপহার সামগ্রীর ছড়াছড়ি। ঐশ্বর্য, সম্মান, মান-মর্যাদার অভাব নেই আর বিনোদনের প্রচুর সামগ্রী বিদ্যমান। কিন্তু স্বর্গের সেই মদিরা যা হৃদয়কে প্রশান্তি দেয় আর বড্ড তার অভাব, যা সৃষ্টিকর্তা পুরুষের দৃষ্টি থেকে নারীর হৃদয়ে গভীরে ঝরে পড়ে।
আমি বাল্যকাল থেকে রশীদ বিন নোমানকে চিনি।
সে লেবাননের অধিবাসী। বৈরুতে তার জন্ম, সেখানেই সে বড় হয়েছে। সেখানকার এক প্রাচীন সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। পৈতৃক ঐতিহ্য আর জাঁকজমকপূর্ণ রীতিনীতি সে বজায় রেখেছিল। মধ্যপ্রাচ্যে তখন দৈনন্দিন জীবনের যে প্রাচীন জীবনধারা প্রচলিত ছিল, তাদের সেই রীতিনীতি সে অনুসরণ করত।
সে অত্যন্ত ধর্মভীরু ছিল। অধিকাংশ লেবাননীর মতো বাহ্যিক জিনিসের ওপর খেয়াল রাখে অথচ কোনো কিছুর গভীরে প্রবেশ করে না। সে হৃদয়ের প্রতিধ্বনি কোনোদিন শুনতে পায়নি। বাইরের চাকচিক্য দেখেই সবকিছু সে ভুলে থাকত, জীবনের রহস্য সম্পর্কে সে ছিল নির্বিকার। তার অন্তর যেন প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছে আর কৃত্রিম সান্ত্বনা খুঁজে পেয়েছে।
তিনি এমন লোক, সহজে নিজের ভালোবাসা বা ব্যর্থতার কথা সবার সামনে স্বীকার করে নিতেন। যখন ওই পথ থেকে ফেরার কোনো পথ থাকে না, তখন সে নিজের অসহায়তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করত। অবশেষে সে সবার হাসির খোরাকে পরিণত হতো।
রশীদ বিন নোমানের চরিত্রের বৈশিষ্ট্য হলো, সে রোজহানিকে বিয়ে করল সত্য; কিন্তু সত্যিকারের প্রেমের ছায়া রোজহানির হৃদয় থেকে তার হৃদয় পর্যন্ত পেঁৗছেনি, যার পরিণতিতে স্বর্গের সুখ পাওয়া যায়।
কয়েক বছর অনুপস্থিত থাকার পর আমি বৈরুতে ফিরে এসেছি।
বৈরুতে এসেই রশীদ বিন নোমানের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম, তাকে মনমরা ও বিষণ্ন মনে হলো। তার চোখেমুখে জীবনের তিক্ততার ছাপ সুস্পষ্ট। সে তার ব্যর্থ জীবনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করছিল। তার দুরবস্থা সম্পর্কে জানতে গিয়ে প্রশ্ন করলাম, 'তোমার কী হয়েছে রশীদ? ছেলেবেলা থেকে তুমি ছিলে হাসিখুশি। কালরাত কি তোমার যৌবনের সুন্দর সব কিছু ছিনিয়ে নিয়েছে।
আমার খাতিরে হৃদয়ের বেদনা ও শারীরিক দুর্বলতার কথা খুলে বল। '
সে আমার দিকে এমনভাবে তাকাল যেন তার সোনালি দিনের স্মৃতি পুনরায় সতেজ হয়ে উঠেছে, যা তার ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। সে বিষণ্ন ও কম্পিত কণ্ঠে জবাব ছিল। মানুষ যদি ঘটনাক্রমে বন্ধুকে হারায় তবে পুনরায় বন্ধু পেয়ে যায়, আর কাছে সান্ত্বনা খুঁজে পায়। স্বর্ণ ও সম্পত্তি হারালে যদি লোকটি সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হয় তবে কিছুক্ষণের জন্য দুর্ভাগ্যের কথা চিন্তা করে চিন্তিত হয় সত্য; কিন্তু তা আবার মন থেকে দূর করে দেয়।
কিন্তু মনের শান্তি যদি হারিয়ে যায় তা কিভাবে ফিরে পাওয়া যায়? এতে মাথা ঠিক থাকার কথা নয়।
সে তার তুলট হাত বাড়িয়ে দিয়ে দুঃখ-বেদনা ভুলে যাওয়ার কথা বলবে আর বন্ধু আস্থা ফিরে আনার জন্য আশার বাণী শোনাবে। জীবনের সেই সুন্দর পাখিকে হৃদয়ের গহিন পিঞ্জরে বন্দী করেছ সত্য; কিন্তু যতই ভালোবাসনা কেন বড় হলে সে পাখি একদিন উড়াল দেবে শূন্য আকাশে। আবার ভূপৃষ্ঠে ফিরে এসে অন্য খাঁচায় বন্দী হয়। আর পুরনো জায়গায় ফিরে আসে না।
এখন আমি কী-ই বা করতে পারি? ধৈর্য আর সান্ত্বনার বাণী কে শোনাবে তাকে? তুমি কেন আশা আর স্বপ্নের জন্য প্রাণ বিসর্জন দেবে? এমন কার শক্তি আছে যা তার অশান্ত হৃদয়ে শান্তি এনে দিতে পারে?
বেদনার্ত হৃদয়ে এসব কথা বলার পর রশীদ বিন নোমান ঢুলতে ঢুলতে ওঠে দাঁড়ায়। সে হাত বাড়িয়ে দেয় কিন্তু নিষ্প্রাণ, তার চেহারা নিষ্প্রভ, আমার দিকে এমনভাবে তাকায় যেন ভূত দেখেছে। তার চেহারার রং পাল্টে যায়। সে চিৎকার করে বলল, 'উক্ত দারিদ্র্যের বেড়াজালে আবদ্ধ ছিল। আমি মূল্যবান পোশাক মণিমুক্তা দিয়ে সাজিয়ে তুলি।
তাকে ঘোড়ার গাড়িতে ঘুরে বেড়াতে দেখে মেয়েরা হিংসা করত। আমি তাকে মনে-প্রাণে চাইতাম আর তার পদতলে সব কিছু উৎসর্গ করি। উক্ত মহিলার সত্যিকারের বন্ধুতে পরিণত হই, তার জীবনসঙ্গী আর অনুরক্ত বিশ্বস্ত স্বামী। সে আমাকে ধোঁকা দিল। আমাকে ত্যাগ করে অন্যের কাছে চলে গেল।
তাও আবার যে লোকটির কাছে গেল, সে ছিল দরিদ্র আর তার অভাবের সংসারের সে রুটি খেয়ে জীবনযাপন করত, যা দেখে আমারই লজ্জা পায়। তার জীবন ছিল আমার কাছে ঘৃণ্য।
আমি সেই মেয়েটিকে ভালোবেসেছিলাম। সেই সুন্দরী পাখিটিকে খাইয়ে-পরিয়ে মানুষ করেছি আর হৃদয়ের পিঞ্জরে স্থান দিয়েছি। সে আমার হাত থেকে উড়াল দিয়ে অন্য পিঞ্জরে বন্দী হয়েছে।
সে পবিত্র স্বর্গের পরী, তোমার স্বর্গের বাগানে বসবাস করত, এখন পেত্নীতে পরিণত হয়েছে। সে নিজের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে অন্ধকারে চলে গেছে, আমাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য এ পৃথিবীতে রেখে গেছে। সে দু'হাতে মুখ ঢেকে নেয় আর চুপ হয়ে যায়। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, 'এ পর্যন্ত তোমাকে বলার ছিল। এর বেশি কিছু আর জানতে চেয়ো না।
আমার দুর্ভাগ্যের জন্য দুঃখ কর না? একে নীরব দুর্ভাগ্য মনে করে চুপচাপ থেক। হয়তো এই নীরবতা আমাকে নিঃশেষ করবে আর আমি শান্তিতে মরতে পারব। '
আমার দু'চোখ অশ্রুসজল হয়ে ওঠে, আবেগে আপ্লুত। আমি তার কাছ থেকে নীরবে বিদায় নেই। আমার কথায় এমন ক্ষমতা ছিল না যা তার আহত হৃদয়কে সান্ত্বনা দিতে পারে।
তার অন্ধকার জীবনকে আলোকিত করার জন্য আমার কাছে কোনো মশাল ছিল না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।