অস্থির প্রতিদিন পত্রিকার পাতা উল্টাতেই যেন চোখে পড়বে বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনাকাঙ্খিত নিত্যনতুন অনেক ঘটনা যা দেশের উচ্চশিক্ষাকে একটি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করে তুলছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেমন আছে সরকারী দলের ছাত্রসংগঠন অপ্রতিরোধ্য ছাত্রলীগ, বাম ঘরানার ছাত্র সংগঠন, তেমনি আছে বিরোধীদলের ছাত্রসংগঠন ছাত্রদল, ছাত্রশিবির যাদের অভ্যন্তরীন বিভিন্ন দ্বন্দ্বে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উদ্ভুত পরিস্থিতি সরকারকে যতটা না বিব্রত করছে তারচেয়েও বেশি বিব্রত করে তুলছে উচ্চ শিক্ষার জন্য ভর্তি হওয়া সাধারণ শিক্ষার্থী ও তাদের অবিভাবকদের। এছাড়া এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কিছু অংশ যারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থক। তাঁরা ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকতে ক্ষমতার সুপরিকল্পিত অপব্যবহার ও সামান্য কিছু স্বার্থের বিনিময় সরকারী ছাত্রসংগঠনগুলোকে মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার যা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উচ্চশিক্ষার পরিবর্তে বাংলাদেশী ষ্টাইলের নোংরা রাজনীতির উচ্চঅনুশীলনকেন্দ্রে পরিণত করেছে। বাংলাদেশী স্টাইল এ কারণেই আমি বলি যে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অতিদলীয়করণ এবং এ ধরণের বিভৎস ও হিংসাত্মক রাজনীতি পৃথিবীর অন্য কোথাও আছে বলে কখনো নজর কাড়ে নাই।
গত শনিবার আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপে সংঘর্ষের ঘটনায় রাব্বী নামে ১০ বছরের এক শিশু গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছে।
সাম্প্রতিক লক্ষ করা যায় যে, প্রশাসনের বিভিন্ন কর্মকা-ের প্রতিবাদ জানাতে আন্দোলনরত সদ্য রংপুরের রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের ছোড়া তরল এসিডে আহত হয়েছেন দু'জন শিক্ষক। আর এই ঘটনার জের ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনের মুখে এবং উদ্ভুত পরিস্থিতি মোকাবেলায় অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। মূলত রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক পর্যায়ে ভিসিপন্থি ও সরকারপন্থিদের পারিবারিককরণ, স্বজনপ্রীতি, দলীয়করণের মাত্রাতিরিক্ত অপব্যাবহারের কারণে সাধারণ শিক্ষকরা ফুঁসে উঠেছিল অধুনা প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয়টিতে।
ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারদলীয় ক্যাডাররা শিক্ষকদের পিটিয়েছিল।
পুলিশের থেকে অস্ত্র নিয়ে ছাত্রনেতারা গোলাগুলি শুরু করেছিল। এতে চরম দুর্ভোগের সামনে পড়ে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। মূলত ক্ষমতার অপব্যবহার ও অতিরিক্ত দলীয়করণ দ্বারা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সেখানে একাধিপত্য বিরাজ করায় দীর্ঘদিন ধরে এ অস্থিরতা বিরাজ করছিল। কিন্তু গণআন্দোলনের মুখে একপর্যায়ে সেখানে ভিসি ও প্রো-ভিসিকেও অব্যাহতি দেয়া হয়। অন্যদিকে এর আগে ঢাকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সশস্ত্র ক্যাডারদের হাতে সাধারণ একজন দর্জি বিশ্বজিৎ দাসের হত্যাকা-ের ঘটনা সারাদেশে ব্যাপক আলোড়ন তুলেছিল।
ওই ঘটনায় ছাত্রলীগের ভূমিকা এবং এ ঘটনায় দোষীদের বাঁচাতে সরকারের নির্লজ্জ ভূমিকা বেশ সমালোচিত হয়েছিল।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে লক্ষ করলে দেখা যায় যে এখানে তৎকালীন ভিসির মাত্রাতিরিক্ত একনায়কসুলভ আচরণ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে দলীয়করণ, আত্মীয়করণ ও অঞ্চলপ্রীতির ফলে দলমত নির্বিশেষে সকলেই তাঁর এহেন কর্মকান্ডের বিরুদ্বে ফুঁসে উঠেছিল। তাছাড়া ছাত্রলীগের হাতে জুবায়ের হত্যা এবং সাংস্কৃতিক কর্মীদের উপর ভিসিপন্থি ছাত্রলীগের হামলা ভিসি পতন আন্দোলনকে আরো ত্বরান্বিত করেছিল। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা যায় হল দখলকে কেন্দ্র করে একটি দলের সাধারণ সম্পাদক, খোদ ছাত্রলীগ কর্মী ফারুক এবং সর্বশেষ দেশীয় অর্থে পদ্মাসেতু নির্মাণের চাদা আদায়ে এক ছাত্রকে প্রাণ দিতে হয়েছে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়েই এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে।
কোথাও শুরু হয়েছে ভিসি তাড়ানোর আন্দোলন, কোথাও ছাত্রলীগের উন্মত্ততা শিক্ষার পরিবেশকে বিঘিœত করছে।
সিলেটের এম.সি কলেজের ঐতিহ্যবাহী ছাত্রাবাসে আগুন গিয়ে পুড়িয়ে দেয়ার পরে শিক্ষামন্ত্রী চোখের জলে ভাসলেও সে আগুনের পরশমণি আজও দাপিয়ে বেড়ায় দেশের সবকটি শিক্ষাঙ্গণ। দেশে ৩৪টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। বলতে গেলে সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এই অশান্তি, অস্থিরতা আমাদের উচ্চশিক্ষার মানকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। সরকার সমর্থক ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের মাত্রাতিরিক্ত ভর্তি বানিজ্য, টেহুারবাজি, নিয়োগবানিজ্য, খুন-জখম, অপহরণ ও চাঁদাবাজি এখন কিছু নেতাকর্মীর পেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায় যে বর্তমান আওয়ামিলীগ সরকারের চার বছরে ২৬ জন নিরীহ ছাত্রকে হত্যা করা হয়েছে যার সরাসরি অভিযোগ ছাত্রলীগের দিকেই।
এছাড়া ১০ টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১২ সালেই ১০ জনকে হত্যা করা হয় এবং ৭৮ জন শিক্ষার্থীকে আহত করা হয়। ফলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি হওয়ার ক্ষেত্রে এসব ঘটনা অবহিত মেধাবী শিক্ষার্থী ও তাদের অবিভাবকগন তাদের আগ্রহ একেবারেই হারিয়ে ফেলেছেন। প্রথম আলোয় প্রকাশিত একটি রিপোর্টে দেখা যায় যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিচ্ছু অধিকাংশ গোল্ডেন এ প্লাসপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীরা বাংলা ও ইংলিশে পাশ করতে পারেনি। আর এ ঘটনা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মেধাবী শিক্ষার্থীরা না আসা কিংবা শিক্ষার মান কমে যাওয়ার কথাকেই জানান দেয়।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়ে থাকেন সাধারণত সংশ্লিষ্ট বিভাগের মেধাবী শিক্ষার্থীরা যারা লেখাপড়া শেষ করে উচ্চতর ডিগ্রী অর্জন করে থাকে। কিন্তু শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধার চেয়ে দলীয় পরিচয় এবং লবিংকে গুরুত্ব দিয়েই নিয়োগে ব্যস্ত থাকেন সরকারপন্থি ভিসিরা। শিক্ষক হিসেবে তার ব্যক্তিগত পছন্দ, দলীয় আনুগত্য, আত্মীয়তা প্রাধান্য পাচ্ছে। মেধাবীরা শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের ক্ষেত্রে বাদ পড়ছেন। অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের ভালো ফলাফলও অনেকাংশে শিক্ষকদের ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।
তাই ফলাফলের বিচারে মেধাবী শিক্ষার্থী বাছাই করা অনেক কঠিন হয়ে যায়।
বাংলাদেশের অতীতের দিকে তাকালে লক্ষ করা যায় যে, তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে লেখাপড়া কওে অনেক শিক্ষার্থী বিভিন্ন গঠনমূলক ও স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে বিভিন্ন আন্দোলনে নেতৃত্ত্ব দিয়েছেন এবং আন্দোলনকে চাঙ্গা করে দেশের বৃহত্তর স্বার্থকে উদ্ধার করেছেন। এ সমস্ত শিক্ষার্থীদের কিছু অংশ বর্তমানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে সংশ্লিষ্ট থাকলেও সে রাজনৈতিক দলে তাদের অতীতের দেশপ্রেমময় সংগ্রাম, নীতি-নৈতিকতার কথা ভূলে গিয়ে দলের আনুগত্য প্রদর্শনে সদা ব্যস্ত থাকে। তারা রাষ্ট্র, সমাজ ও সাধারণ গণমানুষের স্বার্থের কথা ভূলে গিয়ে দলীয় স্বার্থকে গুরুত্ব দিয়ে থাকে। ফলে তারা কখনোই নিজ দলের কোন ত্রুটিকে স্বীকার করা দুরে থাক, বিভিন্ন অপরাধে সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগেও দলীয় নেতাকর্মীদেরকে বাঁচাতে শত মিথ্যাচার করতেও কুণ্ঠাবোধ করেননা।
দলের সাফাই দেখে বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে থাকা বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন অপরাধ করেও পার পেয়ে যাচেছ এবং এ প্রেক্ষিতে তারা সন্ত্রাসী কার্যক্রম, খুন, গুম প্রভৃতিতে নব উদ্দ্যেমে লিপ্ত হচ্ছে। এমতাবস্থায় আমরা লক্ষ করি যে সরকারী দলের ছাত্রসংগঠনগুলো সর্বদা সাধারণ ছাত্রদের রক্তে তাদের হাত রঞ্জিত করছে। রাব্বীর মত দশ বছরের শিশুদের রক্তেও তাদের হাত রঞ্জিত করতে ইতস্তত বোধ করেনা।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বর্তমান ও অতীত অবস্থা যাচাই করে অতিসত্তর উপযুক্ত ব্যবস্থা না নেয়া হলে অদূর ভবিষ্যতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মান আরো অবনতি ঘটবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতিকে দলীয় রাজনীতির উর্দ্বে না রাখতে পারলে এখান থেকে কেবল হিংসাত্মক ও অপরাজনীতির শিক্ষা নিয়েই ছাত্ররা দেশের হাল ধরবে যা বাংলাদেশের ভবিষ্যত রাজনীতির জন্য এক কাল হয়ে দাড়াবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সত্যিকারার্থে উচ্চশিক্ষার সুষ্ঠ পরিবেশ বজায় রাখতে হবে।
মেধাবী শিক্ষার্থীরা যাতে সংশ্লিষ্ট বিভাগে তাদের ক্যারিয়ার গড়ার মাধ্যমে শিক্ষাক্ষেত্রকে আরো উন্নত করতে পারে সে ব্যবস্থা নেয়ার কার্যকরী ও আন্তরিক উদ্দ্যোগ নিতে হবে। অতীতের গৌরবোজ্জল প্রকৃত ছাত্ররাজনীতিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরিয়ে আনতে হবে। দলীয় রাজনীতির উর্ধে রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক কার্যক্রমকে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে নিতে হবে এবং শিক্ষার মানকে বিশ্বমানে রুপ দেয়ার জন্য সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। তাহলে দেশের তরুন মেধাবী শিক্ষার্থীরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার আগ্রহ ফিরে পাবে যা বিশ্ববিদ্যালয়ের অতীত গৌরবোজ্জল স্থানে ফিরে যেতে পারবে এবং আদর্শ ছাত্র, শিক্ষক, রাজনৈতিক নেতৃত্ত্ব, প্রকৃত দেশপ্রেমিক হিসেবে এখান থেকে জনশক্তি বের হয়ে আগামীর সোনার বাংলাদেশ গড়তে উপযুক্ত ভূমিকা পালন করবে।
নেছার উদ্দিন
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।