প্রথম পর্ব
...সেদিন দূর্গম দুদুকছড়ার হাইড আউটে শান্তিবাহিনী প্রধান সন্তু লারমার সঙ্গে তেমন কথা হয়নি। লিডার বললেন, আপনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এতো কষ্ট করে আমাদের ক্যাম্পে এসেছেন, আমি খুব খুশী হয়েছি। আপনার সঙ্গে কথা হবে কাল সকালে।
রাতে সামান্য ভাত -- মুরগির মাংস খেয়ে শুয়ে পড়া গেলো। রাত্রিবাসের তাঁবুটিকে পাহারা দিচ্ছিলো শান্তিবাহীর সশস্ত্র যোদ্ধারা।
পথকান্তিতে ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসে দ্রুত। ...একজন গেরিলা কমান্ডার এসে ফিসফিস করে বলেন, সেনা বাহিনী বা বিডিআর ক্যাম্প আক্রমন করলে আপনি ভয় পাবেন না। গোলাগুলি শুরু হলে আপনি শুধু মাটিতে শুয়ে থাকবেন। আমরা আপনাকে জীবন দিয়ে রা করবো। ...
পরদিন খুব ভোরে চা -- নাস্তা খেতে খেতে কথোপকথন হয় সন্তু লারমার সঙ্গে।
দীর্ঘ সাক্ষাতকারটি লিখে নেওয়া হচ্ছিলো। লিডার রেকর্ড ব্যবহার করার অনুমতি দিলেন না। আর তাকে সহায়তা করছিলেন শান্তিবাহিনীর শীর্ষ নেতা রূপায়ন দেওয়ান; শান্তিবাহিনীতে যিনি মেজর রিপ নামে পরিচিত।
কথোপকথনে সন্তু লারমা যা বললেন, তা অনেকটা এরকম: কথায় কথায় আমাদের বলা হয়, আমরা বিচ্ছিন্নতাবাদী, বিভেদপন্থী, রাষ্ট্রদ্রোহী -- ইত্যাদি। কিন্তু আমরা তা নই।
আমরা এদেশের অখণ্ডতায় বিশ্বাসী। তাছাড়া আমাদের প্রতিষ্ঠিত স্কুল -- কলেজগুলোতে নিয়মিত জাতীয় পতাকা উড়ানো হয়। গাওয়া হয় জাতীয় সংগীত। আমাদের স্কুল -- কলেজেও একুশে ফেব্রুয়ারি, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস পালিত হয়। আর আমরা কোনোভাবেই ভারতের মদদপুষ্টও নই।
আমার যুদ্ধ পরিচালনা করছি, এ দেশের সাধারণ পাহাড়ি মানুষের জন সমর্থন নিয়েই। তারাই আমাদের যুদ্ধের মূল শক্তি।
সন্তু লারমা জোর দিয়ে বলেন, আপনি গেরিলা যুদ্ধের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখবেন, এ রকম কোনো যুদ্ধই কোনো একটি দেশের ওপর নির্ভর করে বা জনসমর্থন ছাড়া টিকে থাকতে পারে না। আর আমরা সশস্ত্র সংগ্রাম করছি প্রায় দুই দশক! এটি খুব সাধারণ ব্যাপার নয়।
কিন্তু বলা হয়, আপনারা ভারতীয় সীমান্ত অবাধে ব্যবহার করছেন।
... এ কথার জবাবে গেরিলা নেতা বলেন, সারা বিশ্বেই গেরিলারা কোনো না কোনো সীমান্ত ব্যবহার করেছে। ১৯৭১ সালেও মুক্তি বাহিনীর গেরিলারা ভারত সীমান্ত ব্যবহার করেছে। সেভেন সিস্টার খ্যাত অঞ্চলেও তাই হচ্ছে। তাই আমরা তা করলে দোষ হবে কেনো?
তাহলে পরিস্থিতি এখন ১৯৭১ সালের মতোই? সন্তু লারমা বলেন, অনেকটা তাই। আর দেখুন জঙ্গল জীবন অনেক কঠিন।
আমরা তো আর শখ করে অস্ত্র হাতে তুলে নেইনি। এখানে রোমান্টিকতার কোনো প্রশ্নই নেই। এই যুদ্ধ আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের সমস্ত পথই বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমরা অনিয়মতান্ত্রিক পন্থায় সশস্ত্র গেরিলা যুদ্ধের রণনীতি বেছে নিয়েছি। আমরা শান্তিকামী বলেই সরকারের সঙ্গে আলোচনার পথও খোলা রেখেছি।
আর ১৯৭১ সালের সঙ্গে এই যুদ্ধের পার্থক্য হচ্ছে, তখন পাকিস্তান এদেশের সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করেছে। কিন্তু এখন এদেশের সেনা বাহিনী এদেশেরই পাহাড়ি জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালাচ্ছে। এটি হচ্ছে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠিকে বুলেটে উড়িয়ে দেওয়ার জন্য সেনা অপারেশন। আত্নরক্ষার অধিকার তো সকলেরই আছে তাই না? আর আমরা লড়ছি পাহাড়ে আঞ্চলিক সায়ত্ত্বশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য। তবে সাধারণ বাঙালিদের সঙ্গে আমাদের কোনো বিরোধ নেই।
সন্তু লারমার এটিই ছিলো এদেশের কোনো গণমাধ্যমকে দেওয়া প্রথম সাক্ষাতকার। সাক্ষাতকারটিকে বিশ্বাসযোগ্য করতে লিডারের সঙ্গে গেরিলা পরিবেষ্টিত হয়ে এই আলোকচিত্রটি তোলা হয়। ছবি তোলেন রূপায়ন দেওয়ান।
দুপুরে ভাত খেয়ে আবারো পানছড়ি হয়ে খাগড়াছড়ির উদ্দেশে যাত্রা। সন্তু লারমা কিছুটা পথ এগিয়ে দেন।
বিদায় বেলায় বলেন, পারলে আমাদের কথা লিখবেন। কেউ আমাদের কথা বলে না!
সে সময় দৈনিক আজকের কাগজে ছবিসহ সাক্ষাতকারটি হুবহু প্রকাশিত হয়। ভারতীয় ইংরেজী সাপ্তাহিক 'ইন্ডিয়া টুডে' একই সাক্ষাতকারটি ছবিসহ ফলাও করে প্রকাশ করে। সাপ্তাহিক খবরের কাগজে দুই পর্বে ছাপা হয় সন্তু লারমার প্রথম সাক্ষাতকারের ইতিবৃত্ত। ফরাসী বার্তা সংস্থা এএফপি'র তৎকালীন বিশেষ সংবাদদাতা নাদিম কাদের সংস্থার পক্ষে সন্তু লারমার দুটি আলোকচিত্র চড়া দামে কিনে নেন।
(শেষ) #
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।