আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

স্বপ্নের ইটালী: কিছু স্বপ্ন কিছু দুস্বপ্ন

অজানা গন্তব্যহীন পথে হঠাৎ নানা ক্ষুদ্র, মাঝারি, বৃহৎ উদ্দ্যেশ্যের জন্ম হয় নিজের মাঝে, । সেই গন্তব্যহীন পথে নানা নতুন নতুন উদ্দ্যেশ্যের পিছনে আমার ছুটে চলা, আমার বিরামহীন পথ চলা। মিয়া মোজাম্মেল হক , বয়স ৪৮। ইতালীতে আছেন প্রায় এক বছর হল। স্বপ্নের ইউরোপে পাড়ি দেন এলাকার এক দালালের মাধ্যমে।

কেমন আছেন জিজ্ঞাস করতে বলে উঠলেন, কেমন থাকব ভাই সবইতো দেখেতেছেন। আজ দু মাস হল ঘর বাড়া দিতে পারছি না। ভোর বেলা বাজারে যাই আর বিকালে ফিরি। কখনো বিক্রি হয় কখনো হয় না এই আমার অবস্থা। দেশে ফার্মেসী ছিল আমার।

ছেলে মেয়ে নিয়ে ভালোই ছিলাম। ছেলে এখন ইউনিভার্সিটিতে আর মেয়েটা স্কুলে পড়াশুনা করছে। এলাকার পরিচিত এক লোক বলল, দেশে কয় টাকা ইনকাম করেন, তার ছেড়ে ইউরোপে চলে যান, সেখানে মাসে লাখ টাকা ইনকাম। কাজ একটা আমি ব্যবস্থা করে দিব। তার কথায় আশ্বস্ত হয়ে কৃষি ভিসায় ইতালীতে আসা।

এসে দেখি তার উল্টো। দেশে ফার্মেসী আর কিছু জায়গা জমি বিক্রি করে এলাম। এখন আমি এখানে ইলিগ্যাল তারপর বেকার। কে আমাকে কাজ দিবে কে আমাকে থাকা খাওয়ার টাকা দিবে। প্রতি মাসে ৪০ হাজার টাকা থাকা খাওয়ায় খরচ।

সব দোষ আমারই, আমি কেন এ বয়সে বিদেশ এলাম। চোখের পানি ধরে রাখতে পারলেন না তিনি। মোজ্জাম্মেল মিয়ার মত এমন অনেককে দেখা যায় ৫০ এর কাছাকাছি বয়স, যারা দালালের খপ্পরে পড়ে আসেন ইতালীতে । তাদের সবাই এমন অবস্থা। এখানে একটা নিয়ম আছে, বয়স যত বেশি হবে সরকার কাজের ক্ষেত্রে টেকস তত বেশি হয়।

তাই যাদের বয়স বেশী তাদের এমনিতেই কাজ পাওয়া দূরহ, তারপর যদি বৈধ কাগজ না থাকে তবে কাজ মেলানো অসম্ভব। সারা বিশ্ব জোড়ে মন্দা চলছে। এ মন্দার প্রভাব ইতালীতে কম লাগেনি। এখানে এখন চরম খারাপ সময় যাচ্ছে এটাই সত্যি। ব্যবসা, বানিজ্য, চাকরী সব ক্ষেত্রে মন্দা ভাব।

যারা আগে থেকে ইতালীতে আছেন তাদের হয়তো সমস্যা নাই। কিন্তু নতুনদের পড়তে হয় নানা সমস্যায়। তাছাড়া বর্তমানে সহজে ভিসা পাওয়ায়, কৃষি ভিসার আওতায় প্রচুর বাংলাদেশীর আগমন হচ্ছে। প্রতিদিনই নতুন লোকের আগমন ঘটছে। এখানে এলে মোটামুটি মানের একটা কাজ পেলে যেমন লাখ টাকা ইনকাম সম্ভব।

তেমনি কাজ না পেলে প্রতি মাসে ৩০ -৪০ হাজার টাকা গুনতে হবে থাকা খাওয়া বাবদ। এখানে আসাটা যেমন একটা সুযোগ, তেমনী কারো কারো জন্য অভিশাপও বটে। যদি সুযোগ থাকে তবে সুযোগটা কাজে লাগানোও জরুরী। সবারই আসার আগে ভালোভাবে জেনেশুনে আসা দরকার। জানা দরকার কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি ।

ইতালীতে দীর্ঘ দিন বসবাসরত, হোসাইন মোহাম্মদ মোসারফ কাজ করেন একটা ট্রাভেল এজেন্সীতে। তিনি জানান, আরো ৫ বছর আগে ইটালীর অবস্থা এমন ছিল না। আগে এত লোক ছিল না সত্য কিন্তু চাকরীর বাজারটা আগের মতনই আমি মনে করি। একটা লোক আপনাকে কেন কাজে নিবে, আপনার কি কোয়ালিটি আছে সেটা একটু চিন্তা করুন। আমরা এখানে যারা আসি, আমরা ভাবি গেলেই কাজ পেয়ে যাব ।

এখানে এখনো কাজের সুযোগ আছে। আমাদেরকে সে সুযোগ নেয়া জানতে হবে। আমাদের এখানে নতুনদের সবচেয়ে বড় সমস্যা ভাষা। ভাষা না জানলে কাজ পাওয়া অনেক কষ্টকর। নতুনদের বলব ভাষার উপর জোর দেন।

ভাষাটা শিখতে পারলে একটা না একটা ব্যবম্থা এখানে হবেই। যারা কৃষি ভিসার আওতায় যারা আসতেছে, তারা এসেই এখানে অবৈধ হয়ে যায়। তাই কৃষি ভিসায় আসার আগে অবশ্যই ভাবার দরকার। দুলাল সরকার, ২০০৯ সালে ইতালীতে আসেন। এসেই কাগজ করার একটা সুযোগ পেলেন।

২০০৯ এর ডিক্লারে কাগজ জমা দেন এক বাংলাদেশীর মাধ্যমে। জমা বাবদ প্রায় ৫০০০ ইউরো খরচ করেন। ৩ মাস পর জানতে পারেণ, তার মালিকের সবই ভুয়া। মালিকের নামে কোন লোকই নেই। দুলাল সরকারেরমত এমন অনেকে পাওয়া যায়, যারা বাংলাদেশী দালালের মাধ্যমে টাকা দিয়ে সর্বস্ব হারাতে হয়েছে।

ইতালি মানবাধিকারের দেশ। ইংল্যান্ডের পরে সবচেয়ে বেশী বাংলাদেশী এখানে বাস করে। যখন কোন দেশে থাকার অনুমতি মিলে না, তখনও ইতালির দরজা খোলা। কিছু দিন পর পর এরা সাধারন ক্ষমায় সবাইকে থাকার বৈধতা দেয়। এখানে এলে বৈধতার একটা ব্যবস্থা হয় বা হচ্ছে, সেই ভেবে সবাই এখানে যেভাবেই হোক থাকার চেষ্টা করে।

অথচ সবচেয়ে নির্বরযোগ্য হিসাবে বাংলাদেশীদের বিশ্বাস করে, আরেক বাংলাদেশীদের সব হারাত হয়। পড়তে হয় নানা প্রতারনায়। কমিউনিটি ব্যক্তিত্ব জনাব নুরুল আলম সিদ্ধিকী , বাংলা কমিউনিটির নানা সমস্যা এবং নানা হয়রানির চিত্র তুলে ধরেণ। তিনি নতুন আগতদের উদ্দেশ্যে বলেন, আসার আগে ভাবুন। দালালের কথায় কান দেবেন না।

লাখ লাখ টাকার স্বপ্ন তারা দেখায় কিন্তু বাস্কব চিত্র ভিন্ন। এখানে যারা আসে তারা মিনিমাম ৭ লাখ থেকে শুরু করে কেউ কেউ ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ করেণ। এখানে এখন কাজের সঙ্কট, যদি কাজ না পান তবে দেশ থেকে সর্বনিন্ম ৪০ হাজার মাসে আনতে হবে। আবার যদি কাজও পান, সেক্ষেত্রে মাসে হয়ত ৭০০ -৮০০ ইউরোর কাজ আপনি পাবেন। সব খরচ বাদে আপনি হয়তো মাসে ২০ হাজার টাকা দেশে পাটাতে পারবেন।

সে হিসাবে আপনি যে টাকা খরচ করে এসেছেন তা তুলতে আপনাকে ৭-৮ বছর লাগবে। আমার পরামর্শ যারা আসবেন , আসেন তবে দালালের মাধ্যমে না এসে, কোন আত্মীয়ের মাধ্যমে যদি আসতে পারেন তবে সেটা অনেক ভালো। তাছাড়া আসার আগে কাজের ব্যপারটা জেনে নিন। ইটালীতে প্রকট এক সমস্যার নাম ফ্যামিলি ভিসায় আসা নারী। আমাদের দেশে থেকে ফ্যামিলি ভিসায় বেশির ভাগ নারীরা আসে।

তারা এখানে এসে নানা সমস্যায় পতিত। দেখা যাচ্ছে এখানে আসার পর স্বামী তার খোজ নিচ্ছেনা । আবার অনেককে দেখা যায় তালাক দিতে। এক্ষেত্রে ভিকটিম কিন্তু নারীরাই। নানা দিক থেকে হয়রানীর শিকার নারীরা।

জনাব নুরুল আলম সিদ্ধিকী বলেন, আমার দেখা অন্তত ৩০ টা পরিবার আছে, যারা ফ্যামিলি ভিসায় এখানে আসেন। এখানে একটা নিয়ম আছে, স্বামীর কাজের ভিত্তিতে প্রতি মাসে স্ত্রীকে ১৪০- ১৫০ ইউরো দেয়া হয়। এখানে স্বামী কখনোই এ টাকাটা তার স্ত্রীকে দেয় না। আবার ইউরোপের আইনের দোহাই দিয়ে তারা দেনমোহরও দেন না। এখানে আসার পর তালাক প্রাপ্ত নারীরা একদিকে ইসলামী আইনে দেনমোহর পান না।

তালাক প্রাপ্ত নারীদের রাস্তায় নামা ছাড়া কিছুই করার থাকে না। অনেক মহিলাকে দেখেছি ৪-৫ সন্তান নিয়ে বিপাকে পড়তে। তাই আমি সবাইকে বলব, আপনারা যারা এখানে যেকোন ভিসায় আসবেন। আসার আগে ভালোভাবে জেনেশুনে বুঝে আসুন। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.