রাহিল আর আমি আজ দুপুর দু'টোয় চট্রগ্রাম পৌঁছে গেছি। আবহাওয়া ভাল এবং শান্ত, শহর এলাকা থেকে বেশির ভাগ পানি নেমে গেছে।
৩/৪টি উপদ্রুত এলাকার কথা শুনে অবশেষে আমরা রওনা দিলাম দিলাম কুসুমবাগ, খুলশির দিকে। দেখলাম, এলাকার যত কাছাকাছি এগোচ্ছি, বালুর পরিমান তত বাড়ছে। রাস্তা পরিস্কার করার জন্য বালু সরিয়ে নেয়া হচ্ছে ট্রাকে করে।
ঘটনাস্থলে পৌছানোর শেষ ১০০ মিটার আমাদের হাঁটতে হলো কাদা আর পানির মধ্য দিয়ে।
১১ই জুন সকাল ১০টার দিকে এখানে পাহাড়ের একটি বড় অংশ ধ্বসে মারা যায় সাতজন মানুষ। কয়েকজনকে পাওয়া গেল দর্শনার্থীদের সাথে কথা বলতে, যদিও সংগঠিত সাহায্য প্রদান এখনো শুরু হয়নি।
একুশ বছরের ছেলে হুমায়ুনের সাথে আমাদের আলাপ হলো। সুগঠিত সুন্দর ছেলে; শুধু নেই নিশ্চিত ভবিষ্যত।
তার মা মারা গেছে; মারা গেছে চার বছরের ছোট্ট ভাই, দুই বছর বয়সী ছোট্ট বোন। ১২ ও ১৫ বছর বয়সি অন্য দুই ভাই হাসপাতালে - ছোটটির অবস্থা সংকটাপন্ন। টিনের পাত আর ইটের ধংসস্তুপের নিচে চাপা পড়েছিল সে। হুমায়ুনের বাবা বেঁচে আছে, চেষ্টা করছে জীবিত দুই ভাইয়ের চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ জোগাড় করতে।
এদেরই এক প্রতিবেশী এখন কোমায়, রক্তস্বল্পতায় আক্রান্ত।
রক্তের গ্রুপ এ বি পজিটিভ, যা সহজলভ্য নয়। রক্ত পাওয়া গেলে সে বেঁচে যাবে, আর নাহলে স্ত্রী ও শিশু সন্তানকে ফেলে সে চলে যাবে বহুদূরে; যে শিশুকে অবিশ্বাস্য প্রচেষ্টায় তারা তুলে এনেছে কাদার মরনফাঁদ থেকে।
এদের দরকার এখন সবকিছুই - আশ্রয়, খাদ্যসামগ্রী, পরিধেয় বস্ত্র, ঔষধ চিকিৎসা সেবা এবং অবশ্যই অর্থ।
আমরা তাদেরকে অর্থ বা প্রতিশ্রুতি কোনটাই দিয়ে পারিনি। শুধু দেখেছি এবং ফিরে এসেছি ভারাক্রান্ত মন নিয়ে।
কিন্তু সাথে নিয়ে এসেছিলাম হুমায়ুনকে, তার ছোটভাইটিকে দেখতে যাবার জন্য। অন্তত: কিছুটা সময় ও সেবা তো তাদের দিতে পারি।
হাসপাতালের বিছানায় তার ভাইটি শুয়ে ছিল, একা। পায়ে অল্প ক্ষত। আজ হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেবে।
কিন্তু তার হৃদয়ের ক্ষতটা আরো অনেক বেশি বড়। সে জানে ফিরে এসে মাকে, ছোট বোনকে সে আর কখনো ফিরে পাবে না। আমরা তাকে আর কি সাহায্যই বা করতে পারি? শুধু এটুকুই বলতে পারি যে মা যেখানেই থাকুক তোমাকে দেখতে পাবে, তুমি বড় হও, মা তাতেই শান্তি পাবে। যদিও পনেরো বছর বয়সী এক কিশোরকে এ কথা বলা শক্ত - কারন সে জানে মা তাকে আর কখনো নাম ধরে ডাকবে না, কোলে তুলে নিবে না আর কোন দিন।
উপরতলায় রয়েছে তার অন্য ভাইটি, আরো ছোট, আরোও অনেক বেশি আহত।
ঘাড়, হাত, বুকে ক্ষত, পেছনটা যেন থেতলে গেছে। সে শুধু জানে সে হাসপাতালে, এখনো জানেনা ঘরে মা তার পথ চেয়ে বসে নেই, সত্যি বলতে কি ফিরে যাবার মত ঘরই তাদের নেই। কে বোঝাবে তাকে?
পাশের বিছানায় শুয়ে আছে তার প্রতিবেশী, অচেতন, নি:শ্বাস ভারী। গুড়ো হয়ে যাওয়া দু'পায়ে পুরু ব্যান্ডেজ, সারা শরীরে অসংখ্য কাঁটাছেড়া। পাশে বসে থাকা স্ত্রী তাদের শিশু সন্তানকে খাওয়াচ্ছিল।
মুখে এক ধরনের পরাজয়ের ছাপ, নিয়তিকে সে মেনে নিয়েছে। তার মনে শুধু একই চিন্তা, তার স্বামী সুস্থ হয়ে উঠুক, একটু খানি রক্ত প্রাপ্তি এবং চিকিৎসকদের একটুখানি সময় আর মনোযোগ!
আমরা সেখানে কিছুটা সময় ছিলাম, আমাদের স্বল্প সামর্থ্য দিয়ে তাদের সান্তনার বাণী শুনিয়েছিলাম। আর কথা দিয়েছি যে আগামীকাল আবার ফিরে আসবো।
খারাপ ভাবে আহত এবং মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর এখন আরো সাহায্য প্রয়োজন ঠিকই তবে জীবন ফিরিয়ে দেবার চেয়ে বড় সাহায্য আর কি হতে পারে? তারা ফেরীওয়ালা পরিবার, অগ্রাধিকার তালিকায় তাদের নাম মোটেও উপরের দিকে নয়, তবুও হাসপাতালের কেউ কেউ তাদের দেখে যাচ্ছে। তার স্ত্রীর অনুরোধে আমরা চিকিৎসকের কাছে গিয়েছি।
আর কিছু না হোক তিনি তার সাধ্যমত করবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন।
অন্ধকারের জন্য আমরা আর অন্য কোথাও আজ যেতে পারিনি। তবে কাল সকালে লেবুবাগান থেকে আবার শুরু করবো।
এখন প্রশ্ন হলো, ব্লগার হিসাবে এবং অবশ্যই একটি বড় পরিবারের সদস্য হিসাবে আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে আছি? আমাদের উচিৎ এই কাহিনীগুলো আরো বেশি মানুষকে বলা এবং সবার মাঝে ছড়িয়ে দেয়া। যারা চট্রগ্রামে আছে এবং ঢাকা থেকে যারা আসছে, সবার সাথে আলোচনা করে পরবর্তী পদক্ষেপ ঠিক করা।
চট্রগ্রামের ব্লগাররা, আপনারা কোথায়? আমার সাথে যোগাযোগ করুন ০১৭১-৫২৫২০০ এই নাম্বারে!
পুরো ব্লগ কমিউনিটি এখন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়াতে পারে, এগিয়ে আসতে পারে অন-লাইন এবং অফ-লাইন দু-ধরনের নেটওয়ার্ক নিয়েই। ক্ষতিগ্রস্থদের এখন প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদী সাহায্য। আমরা আগামীকাল হুমায়ুনের সাথে দেখা করবো, কিন্তু তারপরের দিন, পরের সপ্তাহ বা পরের মাসে তাকে কে দেখবে? সে কি পারবে তার মায়ের স্থান নিয়ে ছোট ভাইগুলোকে দেখে রাখতে আর মানুষ করতে? সময়, পরামর্শ আর সামান্য সাহায্য দিয়ে ব্লগ কমিউনিটি এ কাজটাই করতে পারে। শুধু একজন হুমায়ুনকে নয়, ভূমিধ্বসের শিকার শত শত হুমায়ুনকে সাহায্য করার মধ্য দিয়েই আমরা আবার মাথা তুলে দাঁড়াবো।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।