ভালোকে আমার ভয়,ভালো বেশীদিন থাকবেনা... মন্দকে আমার ভয়, কেননা আমি দুর্বল, আঘাত সইতে পারবোনা... সাফল্যকে আমার ভয়, ব্যর্থতাকেও ভয়... নিরন্তর ব্যস্ততার মহাকালে আমার করণীয় কিছুই নেই... যোগ্যের পৃথিবীতে আমি অযোগ্য, অধম... বিয়েবাড়ির হৈচৈয়ে মাথা ধরে যাচ্ছে। সবাই অকারণে হই হুল্লোড় করছে। এদিকে একটানা বসে থাকতে থাকতে আমার পায়ে ঝিম ধরে গেছে। একটু হাঁটতে পারলে ভাল হত। এখানে আমি প্রায় একা।
সবাই বোধ হয় নীচতলায়। অনিন্দ্যকে দেখতে পাচ্ছি। ওকে কি বলব, আমি একটু হাঁটতে চাচ্ছি। এটা কি ঠিক হবে? অনিন্দ্যই এগিয়ে এল।
-তোমার কিছু লাগবে?
-শোনো, আমার পায়ে ঝিম ধরে গেছে।
একটু হাঁটা দরকার। সেটা কি সম্ভব?
ও একবার ভাবল। তারপর চারদিক একবার দেখে নিয়ে বলল,
-এসো।
অনিন্দ্যের পিছু পিছু ছাদে উঠে এলাম। আজ ছাদে আমরা দুজন ছাড়া কেউ নেই।
অথচ অন্যদিন এসময় এখানে আমাদের অর্থাৎ আমাদের জুনিয়র গ্রুপ এর আসর মিলত। এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি ভাবতে গেলেই বুকের ভেতরটা ফাঁকা হয়ে আসছে। কত্ত স্মৃতি এই বাড়িটাকে ঘিরে..!!
-বহ্নি, কেমন লাগছে এখন?
-হ্যাঁ, ভাল।
-সবাইকে ছেড়ে যাচ্ছ বলে কষ্ট হচ্ছে?
আমি ম্লান হাসি। হ্যাঁ।
সবাইকে ছেড়ে যাওয়ার কষ্ট তো হচ্ছেই। কিন্তু অন্যরকম একটা কষ্ট ও কি হচ্ছেনা?
****
কলেজ থেকে ফিরে আমি অবাক। আজও এসেছে। গত দু'মাস ধরে প্রতি রোববার একটি করে চিঠি আসছে আমার নামে।
একই হাতের লেখা।
নামঠিকানা বিহীন। আমি ভেবে পাইনা লোকটা কে, অথচ যেভাবে তার লেখায় অবলীলায় সূক্ষ্মভাবে আমার ছোটখাটো অভ্যাসগুলোও উঠে আসে তাতে সে যে আমার খুব চেনা কেউ তা বুঝতে অসুবিধে হয়না। প্রথমে পথে ঘাটে, কলেজে, বন্ধুদের, স্বজনদের সবাইকে সন্দেহ হত। মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করতাম। তারপর একসময় হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দেই, ভাবি, ফালতু কেউ।
একসময় নিজেই লেখা বন্ধ করে দেবে। কিন্তু লেখা বন্ধ হয়না, চলতেই থাকে, নিয়মিতভাবে, প্রতি রোববার। ধীরে ধীরে চিঠির শব্দগুলোর প্রতি আমার মনোযোগ বাড়তে থাকে। ওর সাথে সাথে আমিও শ্রাবনের জোছনা দেখার জন্যে অধীর হয়ে অপেক্ষা করি। বুঝতে পারি আমি চিঠির জন্যে অপেক্ষা করতে শুরু করেছি।
অপেক্ষাটা একসময় ভালবাসায় পরিণত হয়ে যায়। বাসায় সবাই চিঠির ব্যাপারটা জানত। শুধু জানতোনা আমার মনের ভেতরের কথা। জানত যখন হিমালয়ের বাড়ি থেকে আসা প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলাম। বাবাকে গিয়ে জানালাম, বাবা স্তম্ভিত হয়ে গেলেন।
অচেনা অদেখা কাউকে ভালবাসার মত ফ্যান্টাসি বাবা আমার কাছে আশা করতে পারেননি। কত যে কাঁদলাম সেই রাতে। অজানা একজনকে নিজের অসহায়ত্ব বোঝানোর জন্য নিজের উপর নির্যাতন চালাতে লাগলাম। সবার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিলাম। ঘর থেকে বের হওয়া বন্ধ করে দিলাম।
এমনি এক রোববারে এল ওর শেষ চিঠি...
....তোমাকে আমি ভালবেসেছি সত্য। কিন্তু কখনোই নিজের করে পাবার স্বপ্ন দেখিনি। সে যোগ্যতাই যে আমার নেই। এই অযোগ্য অক্ষমকে ভালবাসার মত ভুল করনা। হিমালয়কে বিয়ে করে নাও, ও তোমাকে সুখী করতে পারবে......
রাগে অপমানে নিজের উপর খুব ঘৃণা হয় আমার।
ওকে দেখিয়ে দেবার ইচ্ছে হয়। সুখ... হ্যাঁ... এবার সুখীই হব আমি। বাবাকে জানাই বিয়েতে আমার সম্মতির কথা।
****
-কই আপু, নিচে আয়, সবাই তোকে দেখতে চাচ্ছে।
তৃষা ডাকে।
আমি বর্তমানে চলে আসি। একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে। মাথায় আঁচলটা তুলে দিয়ে যাবার জন্যে পা বাড়াই।
-বহ্নি শোনো।
অনিন্দ্য পিছু ডাকে।
আমি ঘুরে দাঁড়াই।
-তোমার কাছে একটা জিনিস চাইবো, দেবে?
-আমার কাছে, কি??
-আমার চিঠিগুলো।
-চিঠিগুলো মানে????? আমি ভীষণভাবে চমকে উঠি।
-হ্যাঁ, তোমাকে ওই চিঠিগুলো আমিই লিখেছিলাম।
আমার ভাবনাগুলো সব এলোমেলো হয়ে যায়।
-তুমি...!! তুমিই সেই একজন?? এভাবে আমাকে নিয়ে খেলেছ তুমি?? কেন আড়ালে রইলে?? কেন সামনে এলেনা?
অনিন্দ্য নিষ্পাপ হাসে।
-কোন যোগ্যতা নিয়ে তোমার সামনে আসতাম? তোমাদের আশ্রিতের যোগ্যতায়?
আমি কিছুই বলতে পারিনা। শুধু ঠোঁট কামড়ে ধরে ভেতর থেকে আসা স্রোতটাকে ঠেকানোর চেষ্টা করি। অনেক কষ্টের পর বলতে পারি,
-আমাকে যেতে দিওনা অনিন্দ্য, ধরে রাখ।
-আমি তোমাকে সুখী দেখতে চাই।
--বহ্নি তাড়াতাড়ি নীচে আয়।
মায়ের ডাক শুনতে পাই।
-তোমাকে ডাকছে, যাও।
-তুমি ডাকবে না?
-না।
অনিন্দ্য মুখটা আড়াল করে দ্রুত নীচে নেমে যায়।
আর আমি ছাদে দাঁড়িয়ে চারপাশের পৃথিবীটাকে ঝাপসা হয়ে যেতে দেখি। ভীষণ ঝাপসা... ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।