অতি দক্ষ মিথ্যুক না হলে সত্যবাদিতা উৎকৃষ্ট পন্থা
কবি যখন উপন্যাস লিখেন সেটা প্রায়শই অবধারিত ভাবে হয়ে যায় কবিতার ব্যাখ্যা। কবিতা নিছক ছোটো মাপের রচনা না, এলেবেলে কয়েকটা শব্দ এদিক ওদিক সাজিয়ে ফেললেই সেটা কবিতা হয়ে উঠে না, কবিতা হয়ে উঠে না অভিধান খুলে শব্দ বাছাই করে পরপর সাজালেই- কবিতা আপনাতেই সম্পূর্ণ হয়ে উঠে।
কবিতার আঙ্গিক বা গঠনের প্রতিটা শব্দ, প্রতিটা বিরাম চিহ্ন নিজস্ব অর্থ ধারণ করে। সেই শব্দ থাকা না থাকায়- শব্দহীনতা কিংবা মাঝের ফাঁকা এলাকায় অনেকগুলো অনুভব আটকা পরে থাকে। প্রয়োজন নেই সবকিছু প্রকাশের- ধাক্কা দিয়ে আবেগের স্রোত রুদ্ধ করেছে যে পাথর সে পাথর নাড়ালেই কবিতা স্বার্থক।
শব্দের অপ্রতুলতা কিংবা ছড়িয়ে বললে লক্ষ্যচ্যুত হতে পারে এমন আশংকা থেকে কবিতার শরীর থেকে অনাবশ্যক বোকা অনুভূতিহীন শব্দগুলো খসে পরে। সকল অনুভব কবিতায় প্রকাশযোগ্য না, কবিতায় প্রকাশ করা সম্ভব না বলেই কবিরা
হয়তো গদ্যে আশ্রয় ঝুঁজেন। কবিতা না হয়ে উঠটে পারা এইসব অনুভবকে সুন্দর শব্দে সাজাতে চান এবং প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়ায় তার কবিস্বত্তা। কবিতার সীমাবদ্ধতা বুঝে যখন কবিরা এমন সহৃদয় আচরণ করে তখন ব্লগের উঠতি কবিরা ভীষণ রকম পরিশ্রমী ,তাদের নিজস্ব সংজ্ঞায় তারা কবিতা লিখে, যা কবিতায় প্রকাশ সম্ভব নয় সেটা ছোটো ছোটো লাইন সাজিয়ে কবিতার আঙ্গিকে সাজাতে চায়। হুমম বিষয়টা ভয়াবহ।
কবিতা আর উপন্যাসের ভেতরে বিস। তর প্রভেদ বিদ্যমান। রবিন্দ্রনাথের শেষের কবিতার কবিতাক্রান্ত ভাষার চমৎকারিত্ব কিংবা চমক থাকলেও অবশেষে সেটা শুধুমাত্র অমিত নামের এক বাচালের বাকসর্বস্বতা। কিভাবে কট ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বাচালতা দেখানো যায় এটা প্রতিষ্ঠা করাই বোধ হয় রবি ঠ্যাকার ইচ্ছা ছিলো।
মহাকাব্য পড়া হয় নি কোনোটাই, উপন্যাস আর মহাকাব্যের ভেতরে কোনো পার্থক্য আছে কিনা বলতে পারবো না, তবে কবির লিখিত গল্প আর উপন্যাস পড়ে কবির বিড়ম্বনা বুঝতে পারি।
কবিতায় প্রকাশযোগ্য নয় এমন অনুভবের ভীষণ সুরসুরি যখন তাড়া করে যেহেটু শব্দের নিজস্ব সীমাবদ্ধতায় সকল অনুভব সংক্ষিপ্তাকারে প্রকাশযোগ্য নয়, লক্ষ্যভেদে ব্যর্থ হতে পারে এমন আশংকায় শব্দ আর শব্দহীনতার মাঝে যেই ভাবনাগুলো রুদ্ধ থাকে সেসব সামনে আনার প্রচেষ্টায় কবি গল্প লিখতে চায়, কবি উপন্যাস লিখেও ফেলে।
বুদ্ধদেব বসুর বাসর ঘর পড়ে এমনটাই মনে হলো। ভাবনার বুদবুদ ছড়ানো কাগজের বুকে। ঘটনা নেহায়েত সামান্য- প্রেমের অধিকার বোধ আর সামাজিকতার প্রতিসাম্য-ভাবনার অনুরণন-।
পরাশর আর কুন্তলা ভালোবাসে পরস্পরকে।
নিয়তির মতো অনিবার্য এই প্রেম, দৈব নির্দেশের মতো তারা পরস্পরের প্রতি নত হবে। কবি কাম উপন্যাসিক বুদ্ধু বাবুর চাহিদা এমনটাই ছিলো।
তোমাকে দেখে মনে হলো জন্ম জন্মান্তর আমি তোমারই অপেক্ষায় আছি- তোমারই অপেক্ষায় ছিলো ামার অপুর্ণতা- এখন ঠিক সঠিক চাবির মতো তালার শুন্যতায় ডুবে গেলে আমি অবারিত আকাশ হয়ে উঠি।
এমন খাপে খাপ মন্টুর বাপ মার্কা প্রেমিক যুগলের কথা বার্তায় কিংবা বুদ্ধদেব বাবুর কথায় পুরুষ প্রেমের আঁশটে গন্ধ নাকে লাগে। পুরুষকে, পুরুষের ভাবনা আর ভাবনাহীনতাকে ধারণ করতে পারে শুধুমাত্র পুরুষ- এ ধারণাটা পরাশরকে পুরুসকামী রূপ দিলেও বোধ হয় সুশীল বুদ্ধদেব বাবুর বাসনা এমনটা ছিলো না।
অন্য একটা ধারণা সযতনে প্রবিষ্ট এখানে, নারী বস্তুসমুহের ভেতরে ভালোবাসা সৃজন করে। বস্তুকেন্দ্রীকতার অনিবার্যতা নারী চরিত্রের ভেতরে। যেখানে প্রেমাস্পদকে স্থাপন করে নাবী পূর্ণতা চায়। এই বস্তুবাদীতারর অভিযোগ বেশ নম্র। নারী মাত্রই শাড়ী বাড়ী গাড়ী আর ভিন্ন মানুষের ঘরে আড়ি পেতে শুনে পরচর্চায় মগ্ন হয় এমন অভদ্র ভাবে বলেন নি তিনি।
সুশীল সমাজের প্রতিভূ বুদ্ধদেব বাবু নম্র ভাবে বলেছেন বস্তু নারীকে আপ্লুত করে।
পরাশর বস্তুর ভোগে অনাগ্রহীনা তবে সম্পদ চাপা দেয়ে স্বাচ্ছন্দ্য হত্যা করে এমন মতবাদে বিশ্বাসী। আমাদের থাকার জন্য ছোট্ট একটা ঘর হলেই হয়- এত সব আয়োজনের কি প্রয়োজন- আমি আর তুমি মিলে দিব্যি কাটিয়ে দিতে পারি- পরস্পরের স্থানিক দুরত্ব সম্পর্কে ফাটল ধরাতে পারে।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে চালু কৌতুক ছিলো-
জানিস ও না প্রেমিকাকে নিয়ে হোস্টেলে গেছে-
সিঙ্গেল খাটে জায়গা হবে দুজনের?
আরও জায়গা থাকবে, একজনের উপর অন্যজন থাকবে না।
নিতান্ত অনিচ্ছায় তার প্রায় যুবতী শ্বাশুড়ীর চাপে একগাদা আসবাবের স্থান সংকুলান করতে বড় একটা বাসা ভাড়া নিলো পরাশর কোলকাতা থেকে 1 ঘন্টা দুরের ব্যারাক পুরে।
এখানেই তাদের বস্তুগত সংঘাত তৈরি হয়। আসবাব আমার দমবন্ধ করে দেয়
আমার সাজিয়ে রাখতে হবে
এমন সংঘর্ষ যেহেতু অন্য কোনো অভাব নেই তাই অহেটুক মান অভিমান চলে। পরাশর লেখক মানুস তবে সমস্ট উপন্যাসের কোথাও কখনই লেখার ভাবনা মাথায় আসে না তার। লিখতেও বসে না কখনও। এমন ঘটনায় সংঘাত বা দ্বন্দ্ব সবই অনুভবের দ্বন্দ্ব।
উপন্যাসটা পরাশর আর কুন্তলার অনুভবের দ্বন্দ্ব সামনে এগিয়ে যায়। এবং সেসব দ্বন্দ্ব অতিশয় স্বচ্ছল দ্বন্দ্ব। পর্ডার কাপড় কেনা- বন্ধুকে বাড়তি সময় দেওয়া- ঘরের টেবিল সরানো আর অতিথি সৎকারের সংঘাতের মতো আয়েশী মনোমালিন্য আমার বাস্তবতা থেকে অনেক দুরে।
সম্পূর্ণ উপন্যাসে চরিত্ররা যত কথা বলে ঢের বেশী বকে উপন্যাসিক। এই হলো কবির উপন্যাস পড়বার যন্ত্রনা।
বিসয়টা এমন
তারা বসেছিলো, দুরে তৃতীয়ার চাঁদ, ক্ষীন আলো, আঙ্গুলের কলি ফুটে উঠলো ফুল হয়ে- এমন ইতং বিতং নিয়ে এক পাটার পর হঠাৎ ভৌতিক সিনেমার মতো নায়ক বললে তুমি কাঁদছো।
আরও একপাতা বর্ননার পর উত্তর আসলো " কাঁদবো না কেনো? আমার কেমন যেনো লাগে। "
এখানে সংলাপ কিংবা মানুষের ভাব বিনিময় তেমন গুরুত্ব পায় না, সেই বিশেস মুহূতের্র বর্ণনাটা গুরুত্বপূর্ণ। গুরুত্বপূর্ণ আবহ।
মানুষ আর মানুষের ভেতরের অনতিক্রম্য ব্যবধান আর নারীর বস্তুকেন্দ্রীকতার সাথে পুরুষের সহজ বন্ধনহীন সম্পর্ক, তার কাছে- তাদের কাছে সহজ হওয়া যেতো- তবুও কোনো এক অদৃশ্য কারণে তারা যুক্ত থাকে- তবে তাদের এই সংযুক্ত থাকার কোনো কারণ উপস্থাপন করে না উপন্যাসটা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।