আকাশটা ভীষন গোমড়ামুখো আজ। এমন দিনে ঘুম সাধারনত বেশ ভাল হয় হাসানের। সবারি হয়। ঘুমানোর আদর্শ আবহাওয়া যাকে বলে আর কি। কিন্তু কি কারনে যেন আজ ঘুম ভেঙে গেল বেশ ভোরেই।
পাশে ঘুমোচ্ছে তার মেয়ে অনন্যা। মেয়েটার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে সে। ঠিক তার মার মত হয়েছে দেখতে। বয়স চার বছর হল। বেশ শান্ত-শিষ্ট।
তেমন একটা বিরক্ত করে না কাউকেই।
রিমি তার বউ। এই মেয়েটাকে নিয়ে ভীষন খুশী হাসান। সে একটা স্কুলের ইংরেজীর টিচার। প্রতিদিন মেয়েকে তার মার বাসায় সকালে দিয়ে আসে সে।
তারপর নিজে রওনা হয় স্কুলের উদ্দেশ্য। আর দুপুরে ছুটির পথে নিয়ে আসে। তারপর অনন্যা তার পৃথিবী।
হাসানের এখন আপন বলতে তেমন কেউ নেই। বাবা মারা গেছে যখন সে অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে তখন।
মা মারা যায় যখন সে বেকার তখন। তেমন কিছুই সে করতে পারেনি মা-বাবার জন্য। অথচ এখন সে মোটামুটি সচ্ছল। একটা প্রাইভেট মিডিয়াতে কাজ করে হাসান। পাশাপাশি টুকটাক লেখালিখি।
এখন বেশী লেখে রাজনীতি নিয়ে। মিডিয়া কাভারেজও রাজনীতির দাপট। প্রথম প্রথম ভালো লাগলেও এখন যেন বিষ লাগে তার।
তার ভাল লাগছে না আজ। রিমিকে জাগাতে গিয়েও জাগালো না সে।
এই বদ্ধ শহরে তার নিঃশ্বাস ফেলার জায়গা তার বাসার ব্যালকনিটা। ব্যালকনিটার সামনে মালিকের করা বাগানটায় এখনও যেন প্রান লেগে আছে। রিমি প্রায়ই বলে একটা ফ্ল্যাট নিয়ে নিতে। অন্তত বসবাসের একটা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হোক। কিন্তু এককালীন এতগুলো টাকাও বড় ব্যাপার।
রিমির বাবা বেশ জাদরেল ব্যবসায়ী ছিলেন। রিমি তার একমাত্র মেয়ে। রিমি প্রায়ই বলে তার বাবার টাকায় ফ্ল্যাট নিয়ে নিতে। পরে না হয় শোধ করবে। কিন্তু হাসান এড়িয়ে যায়।
রিমিও বোঝে। হাসান জানে অন্তত তার মেয়ের জন্য একটা সুন্দর ভবিষ্যতের দরকার আছে।
হাসান মফস্বলের ছেলে ছিল। ঐখান থেকেই এইচ.এস.সি পাস করে চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পায়। তাদের সংসারে তখন অভাবের প্রাচুর্য।
তবুও মা-বাবা বাধা দেয়নি। আজ নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে সে। চাকরী পাবার দু-বছর পর রিমির সাথে পরিচয় হয় তার। রিমি তার লেখার বেশ ভক্ত ছিল। উচ্চবিত্তের মেয়ে হলেও ততটা অহংকারী ছিল না সে।
তাই দীর্ঘ প্রেম ছাড়াই বিয়ে। রিমির ব্যাক্তিত্ব মোহিত করেছিল হাসানকে।
হাসান ঠিক করল আজ তাড়াতাড়ি অফিসে যাবে সে। হাত-মুখ ধুয়ে নিজেই চা বানালো সে। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এলোমেলো ভাবনাতে শেষ করল চাটা।
রিমিকে না জাগিয়েই বেরিয়ে পড়ল সে।
একটা রিকশা ধরে অফিসে পৌছল হাসান। ঢুকতে ইচ্ছে হল না কেন জানি। আজ দিনটাই যেন কেমন। মাঝে মাঝে এমন দিনগুলো মাথা খারাপ করে দেয়।
সে তার এসিস্টেন্টের মোবাইলে একটা ম্যাসেজ ছাড়ল যে সে আজ অফিসে আসবে না। তারপর মুঠোফোনটা বন্ধ করে দিল সে।
হাঁটছে অবিরাম হাসান। একটা রাস্তার দোকানে চা খেল সে। সংগে একটা সিগেরেট।
তারপর আবার হাঁটতে লাগল সে লক্ষ্যহীনভাবে। নিউমার্কেট মোড়ে একটা দোকানে সে থমকে দাড়াল। এই দোকানের ফুচকা রূপার খুব প্রিয় ছিল। আজ প্রায় বছর সাতেক পর এখানে আসল সে। নিউমার্কেটে একসময় সে আর রূপা দাপিয়ে বেড়াত।
তার আজকের এটিচিউড তৈরীই করেছিল রূপা। তার অনেক প্রিয় একজন। মফস্বলের হাসানকে এই শহরে চলতে শিখিয়েছিল রূপা। তাকে টিউশনি দিয়েছিল। নানা পরামর্শও দিত।
আজ এত বছর পর কেন যে রূপাকে এত মনে পড়ছে তার কে জানে।
রূপা তার ক্লাসমেট ছিল। এখন কানাডায় থাকে স্বামীর সাথে। এক সময় তাদের মাঝে প্রনয় ছিল বেশ। রূপার মত মেয়ে ইউনিভার্সিটিতে তার মত মফস্বলের ছেলের সাথে কেন যে বন্ধুত্ব পেতেছিল তা আজও খুঁজে পায় না হাসান।
হয়তো সিমপ্যাথি থেকে…নয়তো অন্য কিছু। কিন্তু শেষমেশ কঠিন প্রেম। ধীরে সুস্হে পোড় খাওয়া প্রেমটা যেন হারিয়ে গেল নিমেষেই।
মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে ছিল রূপা। বাবা সরকারী চাকুরিজীবি।
যখন মাস্টার্স পাস করে বেকার জীবন হাসানের তখন রূপার বাবার স্ট্রোক হয়। সে এক বিরাট কাহিনী। সেবার যেন যমের মুখ থেকে ফিরেছিলেন তিনি। চিন্তায় আর খাটুনিতে রূপা এতটুকু হয়ে গিয়েছিল। তখন রূপার ছোট ভাইয়ের এস.এস.সি পরীক্ষা চলে।
অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছিল।
অসুখ থেকে উঠেই তাই রূপাকে পাত্রস্হ করতে উঠে পড়ে লাগলেন তিনি। রূপা সম্পর্কের কথাটুকু বলেছিল বাসায়। বাবাও তাতে আপত্তি করেনি। যেহেতু দুজনি দুজনকে ভালবাসে সেখানে বাধার প্রশ্নই আসে না।
তবে রূপার বাবা আর যাই চান না কেন বেকার ছেলের হাতে মেয়েকে তুলে দিতে চাননি কখনই।
হাসান হন্যে হয়ে চাকরী খুঁজছিল। এই শহরে তার কোন বড় মাপের চাচা মামা নেই যে তাকে ওয়ান টুর ভেতর চাকরী জুটিয়ে দেবে। তবু চেস্টার ত্রুটি করেনি সে। চাকরী পেলে নিজের মাকেও শহরে নিয়ে আসবে সে।
এমন ভাবনাই ছিল তার। কিন্তু সে পারছিল না কিছুতেই। বিসিএসে প্রিলিমিনারীতে নাম এসেছিল। কিন্তু চাকরীর চিন্তায় রিটেনের প্রপ্স্তুতি মাঠেই মারা গেল। বিসিএস লং টাইমের ব্যাপার।
এদিকে কাটা গায়ে নুনের চিটার মত এক কানাডার পাত্র এসে হাজির রূপার জন্য। ছেলে রূপার খালার হাসবেন্ডের বন্ধুর ছেলে। এ যেন এক পূর্নদৈর্ঘ্য বাংলা ছায়াছবি। রূপা পালিয়ে যেতে চেয়েছিল। শেষবারের জন্য দেখা করতে এসেছিল এই নিউমার্কেটের মোড়টাতেই।
সেদিন ফিরিয়ে দিয়েছিল সে রূপাকে। ঐ তার রূপার সাথে শেষ দেখা। আর কখনও দেখা তো হয়নিই আবার খবরও পায়নি কোন।
রূপা বিয়ের ঠিক চারদিন পরি ছিল তার জন্মদিন। সেই জন্মদিনের নিরস এক সকালে একটা খাম দিয়ে যায় তার মেসের কাজ করা পিচ্ছি রফিক।
প্রতিটা জন্মদিনে রূপা তাকে ছোট ছোট অনেক গিফট দিত। আজও এগুলো তোলা আছে পুরনো ট্রান্কের কোন এক কোনায়।
সেই খামটা কি রূপা তাকে পাঠিয়েছে??? সে কি সুখি নয়?? খামটা খুলতেই দুচোখ দিয়ে জল গড়িয়ে আসে হাসানের। একটা নামকরা দৈনিক পত্রিকায় সাব এডিটর হিসেবে জয়েনের এপয়েন্টমেন্ট লেটার।
না….ঐ কাগজটাতে জয়েন করেনি সে।
সেই এপয়েন্টমেন্ট লেটারটি এখনও তার পড়ার টেবিলের ড্রয়ারে গুমড়ে কাঁদে।
হাসান হাঁটতে থাকে আবার। পালিয়ে বেড়ায় তার অতীত থেকে। চোখের সামনে মানিব্যাগের কোঠরে অনন্যার ছবি তার সামনে মেলে ধরে সে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।