আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পারুল বেহুলার দেশে

বগুড়া ভ্রমণে বের হয়েছি আমি, আরিফ স্যার (ছদ্ম নাম) এবং আরাফাত স্যার (ছদ্ম নাম)। শিক্ষক সমাজের লোক এবং সহকর্মী বলেই একে অপরকে স্যার বলে সম্ভোধন করা। হঠাৎ করেই ভ্রমণের সিদ্ধান্ত। আমরা তিন জনই ভ্রমণ পিয়াসু আর তাই এমন হঠাৎ সিদ্ধান্তেই বিভিন্ন স্থানে আমাদের এ যাবত অনেক ভ্রমণ হয়েছে। বরাবরই লোকেশনের সন্ধান দেন আরিফ স্যার।

বলে রাখা ভাল আমাদের মতের মিল মারাত্মক। অন্যদের সাথে না মিললেও আমাদের তিন জনের বোঝাপরার মাত্রা সুদৃঢ়। এবার আমাদের ভ্রমণের ক্যাশ ম্যানেজার আরাফাত স্যার। প্রতি ভ্রমণেই একজনকে এই দ্বায়িত্ব পালন করতে হয়। সবাই একটা নির্দিষ্ট পরিমান টাকা ক্যাশ ম্যানেজারের কাছে জমা করি এবং তিনি সেখান থেকে ভ্রমণের সমুদয় ব্যয় বহন করেন।

শনিবার দুপুরে কলেজের ক্লাস শেষ করে তিন জন একসাথে একটি ৪ স্ট্রোকে করে সরাসরি কল্যানপুর বাসস্ট্যান্ড। প্রথমে আরিফ স্যার নেমে কাউন্টারের দিকে হাটা ধরলেন। ভাড়া দেবেন ক্যাশ ম্যানেজার আরাফাত স্যার। আমি পাশে দাঁড়িয়ে। ভাড়া ২৫০ টাকা।

ড্রাইভারকে ৫০০ টাকার একটি নোট বের করে দিতেই সে মোচড় দিল এবং জানালো সে অপারগ। আরাফাত স্যার তার পিছনের পকেটের শোভা বর্ধনকারী মানিব্যাগটির নারী নক্ষত্র ঘেটে সব মিলিয়ে ২২০ টাকা ভাংতি বের করতে পারলেন। এরপর তিনি আমার দিকে তাকালেন। আমিও পকেট ঘেটে ৪ টি দশ টাকার নোট পেলাম। সব মিলিয়ে দশ টাকা বকশিশসহ ভাড়া চুকালাম।

বগুড়াগামী এস. আর. ট্রাভেলস বাসের টিকেট কাটলাম। ভাড়া ৩৫০ টাকা। আরাফাত স্যার দর কষাকষি করে ৩ টা টিকেট ৯০০ টাকায় ব্যবস্থা করলেন। স্যার অবশ্য এসব কাজে ওস্তাদ। গাড়ি ছাড়বে দুপুর ২.৪৫ এ।

এখনও হাতে বেশ কিছুটা সময় আছে। দুপুরের খাবার খেয়ে নেয়া যাক। পাশেই একটা হোটেলে ঢুকে আমি ও আরাফাত স্যার খেতে বসলাম। আরিফ স্যার তার সমস্যার কথা জানিয়ে খাওয়া থেকে বিরত থাকলেন। হোটেলটিতে নানা রকম ভর্তার সমাহার।

আলু ভর্তা, বেগুন ভর্তা, শুটকি ভর্তা, কলা ভর্তা, টাকি মাছের ভর্তা ইত্যাদি ইত্যাদি। আমরা গরম ভাত আর নানা রকম ভর্তা দিয়েই আমাদের খাওয়া শেষ করলাম। মাছ বা গোশত আইটেম খাইনি বলে মেসিয়ারকে এবং খাবারের বিল দেবার সময় ক্যাশিয়ারকে একটি অখুশি মনে হল। বাহির থেকে পানীয় এবং চিফস কিনে নিয়ে ছোট একটা গাড়িতে চেপে বসলাম। এই গাড়িটাই আমাদের গাবতলীতে বগুড়াগামী বড় বাসের কাছে নিয়ে যাবে।

আমাদের সিট গাড়ির সামনের দিকেই। স্যাররা দুই জন একপাশে আর আমি অন্য পাশে। আমার পাশে একজন ভদ্র লোক। বাসে বসেই বগুড়া নিবাসী বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধু মাজেদকে (ছদ্ম নাম) ফোন করলাম। ও জানালো বগুড়া নেমেই যেন ওকে ফোন করি।

ইতোমধ্যে আরো অনেকের কাছ থেকেই বগুড়ার ব্যাপারে খোঁজ খবর নিয়েছি। পথে আমরা ফুড ভিলেজ নামক রেস্টুরেন্টে হালকা নাস্তা ও কফি খেলাম। আমাদের সামনে কেবল মাত্র একটি সারি। সেখানে ৩ জন মেয়ে এবং ১ জন ছেলে। যাদের দেখে অসামাজিক কর্মকান্ডে লিপ্তদের দলভুক্ত বলে মনে হল।

তারা বগুড়ার বনানিতে নামল। আমরা আরো সমনে গিয়ে এমন একটা জায়গায় নামলাম যার নাম “ঠনঠনিয়া”। ঠনঠনিয়া বাসস্ট্যান্ড, বগুড়া। যখন বাস থেকে নামলাম তখন রাত ৮.৩০। মাজেদকে ফোন করলাম।

সে আমাদের রিক্সাযোগে সাত মাথা আসতে বলল। সাত মাথা পৌছে ওর সাথে দেখা হল। স্যারদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলাম। ও ওদের বাসায় নিতে চাইল। বগুরা শহরে জায়গা কিনে বাড়ি করেছে।

আমরা হোটেলে উঠব বলে ওর প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলাম। ওরই পরিচিত একটি হোটেলে নিয়ে গেল। সেখানে ডাবল বেডের একটি রুম ৫০০ টাকায় ঠিক করা হল। একটি ডাবল খাট এবং একটি সিঙ্গেল খাট। রুমে ব্যাগ রেখে মাজেদসহ আমরা ৪ জন বেড়িয়ে পরলাম।

তখন শীতের শুরু এরপরও বগুড়া শহরে প্রচন্ড শীত। দুটো রিক্সায় চার জন সাত মাথেকে শহর ঘুড়বো বলে চেপে বসলাম। বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী আজিজুল হক কলেজ, মেডিকেল, শহীদ চান্দু স্টেডিয়াম ঘুরলাম। এক ফাকে রাস্তার পাশের চা দোকানে রিক্সাওয়ালাদের নিয়ে চা খেলাম। সাত মাথায় ফিরে এসে দুই রিক্সাওয়ালাকে ৮০+৮০=১৬০ টাকা ভাড়া দিলাম।

কালই আবার ঢাকা ফিরব বলে ঢাকাগামী বাসের কাউন্টারে ঘুরছিলাম। টিকেট পাচ্ছিলাম না। যাও পাচ্ছি তাও আবার একেবারে বাসের পেছনের দিকে। উপায় অন্তর না পেয়ে টি.আর. ট্রাভেলস বাসের টিকেট কাটলাম। সিট পেছনের দিকে।

এবার খাওয়ার পালা। বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী আকবরিয়া হোটেলে চিংড়ি মাছের ভর্তা, খাশির মাংস দিয়ে রাতের খাবার শেষ করলাম। মাজেদ আমাদের সাথেই ছিল। এরপর জনপ্রিয় দধি সাথে করে নিয়ে হোটেলের রুমে ফিরলাম। হোটেলে দধি খাওয়া শেষে মাজেদকে বিদায় দিলাম।

তার সাথে কথা হল কাল খুব ভোরে আমরা বগুড়া স্টেশনে থাকব। রাতে ঘুমাবো শীতের রাত। গায়ে দেবার কিছু নেই। আমি ও আরাফাত স্যার হোটেলের ৩য় তলা থেকে ২য় তলায় নেমে হোটেল সংশ্লিস্ট লোকদের কাছ থেকে ল্যাপ নয় দুটো ল্যাপের কভার এবং কয়েল নিয়ে আসলাম। শীতের শুরু বলে তারা এখন শীতের ল্যাপ/কম্বল নামায়নি।

আরিফ স্যার ও আরাফাত স্যার এক খাটে আর আমি আরেকটিতে। দুই জন একটা কভার গায়ে দিয়েছেন আর আমি একাই একটা। রুমটি বদ্ধ তাও প্রচুর মশা। কয়েল জ্বালিয়ে দিলাম। শুয়ে শুয়ে তিন জন গল্প করছি।

অনেক রাত হয়ে গেছে। এদিকে বদ্ধ রুমে কয়েলেয় ধোয়ায় দম বন্ধ হয়ে আসছে। আরাফাত স্যার উঠে কয়েল নিভিয়ে দিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার মশার উপদ্রব শুরু হল। এবার স্যার ফ্যান ছেড়ে দিলেন।

আর কি ঘুম আসে। এভাবেই জরসড় হয়ে প্রায় গল্প করেই রাত শেষ করলাম। ভোরে উঠে বগুড়া রেলস্টেশনে গেলাম। উদ্দেশ্য সোনাতলা। মাজেদও এসেছে।

সেখানে পৌছেই সকালের নাস্তা করব। ঠান্ডায় সবাই জরসড়। মাইকে ট্রেন আসার ঘোষণা দিতেই টিকেট কাউন্টারে লম্বা লাইন হয়ে গেল। দুই স্যারকে রেখে আমি ও মাজেদ লাইনে দাড়ালাম। ১২ টাকার ৪ টি টিকেট কিনতে কাউন্টারে ৫০০ টাকার একটি নোট দিলাম।

ভাগ্যিস কিছু না বলেই কাউন্টার ম্যান ৪৫২ টাকা ফেরত দিলেন। কিছুক্ষণ পর ট্রেন আসলো। আমরা ট্রেনে চেপে বসলাম। অনেকদিন পর লোকাল ট্রেনে ভ্রমনের আনন্দ উপভোগ করছি। দৃশ্যত গেরিলা ছবির ট্রেনের দৃশ্যের মত।

সামনেই একটি সবুজ বোরকা পরা মেয়ে বসেছে সাথের লোকটি সম্ভবত তার বাবা। দেখতে ভালই। আমার পাশে দু একটা লোকের পর আরেকটা হালকা পেস্ট কালারের বোরকা পরা মেয়ে বসেছে। সে পুরো বগিটা মাতিয়ে রেখেছে। পুরো বগির সবাই যেখানে নিশ্চুপ বা নিজেদের মধ্যে আস্তে আস্তে কথা বলছে সেখানে সে তার সামনের লোকটির সাথে অনর্গল বকবক করেই চলেছে।

কথা বার্তায় বোঝা গেল সে স্নাতক লেভেলে পড়া কলেজ ছাত্রী এবং পিটিআই ট্রেনিং করছে তার বর্ণনা দিচ্ছে। অথচ পাশেই আমরা তিন জন কলেজ শিক্ষক আছি যারা নিশেধ করার অপারগতায় শুধুই শুনছি। স্যাররা ছবি তোলা ও ফেইস বুকে ব্যস্ত। আমরা একটা স্টেশন অতিক্রম করলাম যার নাম ছিল ‘সুখানপুকুর’। কিছুক্ষণ পর আমরা সোনাতলার আগের স্টপিজে পৌছলাম।

আমরা এখানেই নামব। এখান থেকে গ্রাম দেখতে সোনাতলা যাব। স্টেশনের পাশেই একটি ছোট হোটেলে সকালের নাস্তা সেরে নিলাম। একটা ভ্যানে উঠলাম। যে আমাদের একটু সামনে একটা বাজারে নামিয়ে দিল।

সেই বাহার থাকে নসিমন/বডবডি নামক ইঞ্জিন চালিত ত্রিচক্র যানে চরে সোনাতলার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। অনেকদুর যাবার পর আমাদেরকে সরকারি নাজির আখতার কলেজের সামনে নামিয়ে দিল। আমরা সোনাতলা চলে এসেছি। বাংলাদেশের একমাত্র পারুল গাছ দেখতে এখানে আসা। সেটি সরকারি নাজির আখতার কলেজ প্রাঙ্গনে যার অবস্থান।

গাছ দেখলাম, কলেজ দেখলাম, গছের সাথে ছবি তুললাম। স্থানীয় কিছু ছোট শিশুদের সাথেও ছবি তুললাম। এরপর ভ্যানে করে চলে এলাম সোনাতলা বাজারে। সেখান থেকে ৪ স্ট্রোক রিজার্ভ করে মহাস্থানগড়ের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। মহাস্থানগড়ে পুরনো ধ্বংসাবশেষ, পুরাকীর্তি, যাদুঘর দেখলাম।

ছবিও তুললাম। এরপর সুলতান শাহ বলখির মাজার দেখব বলে ভ্যানে চরে বসলাম। ভ্যান ড্রাইভার আমাদের একটা ছবি তুলে দিলেন। ভ্যানযোগে আমরা মহাস্থানগড় বাজারে পৌছলাম। সেখানে দিগন্ত জুড়ে সাজানো ফুলকপি, মুলার পশরা দেখে মুগ্ধ হলাম।

ছবি তুলতে ভুল করিনি। পায়ে হেটে সুলতান বলখির মাজারে পৌছলাম। মাজার ও পানি শূন্য কুপ দেখে বাজারে ফিরে এলাম। সেখান থেকে পুনরায় ৪ স্ট্রোকে করে বেহুলা-লক্ষিন্ধরের বাসর ঘর দেখতে রওনা হলাম। টিকেট কেটে ভেতরে প্রবেশ করলাম।

পুরোটা ঘুরে দেখলাম। একেবারে শীর্ষ চুড়ায় উঠলাম। প্রধান গেইটের সামনে একটি দোকানে টানানো বিভিন্ন নামের পান ও তার মুল্য তালিকা সম্বলিত ব্যানার দেখে মজা পেলাম। একটি ৪ স্ট্রোক ধরে বগুড়া শহরের দিকে রওনা হলাম। আবার আকবরিয়া হোটেলে দুপুরের খাবার সারলাম।

হোটেলের রুমে ফিরে ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে ভাড়া চুকিয়ে হোটেল ছাড়লাম। দুপুর ৩.৩০ এ আমাদের ঢাকাগামী বাস। এশিয়া সুইটস থেকে মিস্টি, দধি, সন্দেষ কিনে মাজেদকে বিদায় জানিয়ে ঠনঠনিয়া বাস স্ট্যান্ডের দিকে রওনা হলাম। বাসে চেপে বসলাম। পেছনের দিকে ছিট হলেও তেমন একটা ঝাকুনি লাগেনি, কষ্টও হয়নি।

রাত ৮.০০ টার মধ্যে আমরা কল্যানপুর বাসস্ট্যান্ডে। এবার সদরঘাটের উদ্দেশ্যে একটি ৪ স্ট্রোক ঠিক করলাম। আমি ও আরাফাত স্যার নয়াবাজার মোড়ে নেমে রিক্সাযোগে আমাদের নীড়ে ফিরলাম, আর আরিফ স্যার ৪ স্ট্রোকে করেই তার নীড়ে ফিরলেন। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।