বাংলাদেশ নিয়ে ভাবনা, প্রত্যাশা ও সম্ভাবনার সংগ্রহমালা
চার শতকের কথা লিখতে গিয়ে বেশ স্মৃতি কাতর হয়ে পড়লাম। আপন জনের কথা খুব মনে পড়ছে। খুব মনে পড়ছে আমার মায়ের কথা। মা চলে গেছেন অনেক দিন হলো। এখনও ঘুমোতে গেলে মনে পড়ে, মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলছেন:
"খোকা ঘুমুল পাড়া জুড়ুল বগর্ী এলো দেশে।
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে, খাজনা দেবো কিসে?
ধান ফুরুল, পান ফুরুল খাজনার উপায় কি?
আর ক'টা দিন সবুর কর, রসুন বুনেছি"।
মাকে বারবার জিগ্যেস করতাম, বগর্ী কি? বগর্ী কারা? এক ধরণের ভয়ার্ত দৃস্টি নিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকতাম উওরের অপেক্ষায়। মা চোখে হাত দিয়ে বলতো, "এখন ঘুমোও, পরে বলব"। আমার মনে নেই, আমার মা বগর্ী কি তা কখনো বুঝিয়েছিলেন না ভয়টাকে জিঁইয়ে রেখেছিলেন। তবে ভয়টা যে শেকড় বেঁধেছে সেই স্মৃতিটা ঝরঝরে।
মা নেই। মা চলে যাওয়ার পর মনে হয় পুরোটা দেশ আমার মা। যেখানে আমার জন্ম আর বড়ো হওয়া। যেখানে বাস করে আমার স্বপ্ন ও সম্ভাবনার সম্ভার। আমার প্রতিদিনের পদচারণা।
সেই মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে হলে ভালবাসতে হবে এই অভাগা বাংলা মাকে। কন্ঠে প্রতিধ্বনিত হতে হবে:
"আজি বাংলাদেশের হূদয় হতে কখন আপনি
তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী!
ওগো মা, তোমায় দেখে দেখে আঁখি না ফিরে..."
এখনকার মায়েরা বগর্ীর ভয় দেখিয়ে ছড়া আওড়িয়ে ঘুম পাড়াবার ফুসরৎ পান কি না সেই হিসেব নিতে যাব না। মায়ের সাথে সেই চিরায়ত নাড়ীর টানে কি জং পড়েছে সেই প্রশ্নের তাৎক্ষণিক উওর আমি পাঠকদের জন্য তুলে রাখলাম। কিন্তু আমাদের প্রতি মুহুর্ত্তের নি:শ্বাসে ও বিশ্বাসে নি:শর্তভাবে দেশের কাছে নিজেকে সমর্পন করা আমাদের অস্তিত্বের জন্য অপরিহার্য। আমাদের চেতনায় গভীরভাবে প্রোথিত করা দরকার যেখানে স্বতত: উচ্চারিত হবে:
"সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে।
সার্থক জনম, মা গো, তোমায় ভালোবেসে"\
মা জননী যদি সকল চেতনা ও প্রার্থনার কেন্দ্রবিন্দু হন তখন সেই সন্তান মাকে কিভাবে অবহেলা করবে, উপেক্ষা করবে? এমনকি তার রক্তের সাথে বেঈমানী করবে? কিভাবে নীরব থাকবে মায়ের অপমানে? মাকে যদি সত্যি সত্যি ভালবাসি তাহলে মায়ের রক্তের সাথে যারা বেঈমানী করেছে তাদের সাথেই বা কিভাবে গাঁটছড়া বাঁধব? এগুলো কি শুধু একগুচ্ছ প্রশ্ন না আমাদের আজকের নিষ্ঠুর বাস্তবতা? মায়ের প্রতি ভালবাসা আর দেশের প্রতি ভালবাসার মধ্যে ফারাকটা অনেক বেশী বলেই মায়ের কাছে ফিরে আসার বড্ডো দরকার। দেশের প্রতি অপত্য ভালবাসার গ্র্যাভিটিতে ফাটল ধরেছে বলেই তো আমরা কক্ষচূ্যত হচ্ছি, প্রচন্ডভাবে ধাক্কা খাচ্ছি। দেশের প্রতি মমত্ব ও দেশপ্রেমকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত ও উপলদ্ধি করার প্রয়োজনটা শীতার্ত মানুষের জন্য উষ্ণতার মতো জরুরী হয়ে দেখা দিয়েছে। তাই, শুধু আমাদের কন্ঠে না, আমাদের কর্মেও প্রমানিত হওয়ার দরকার:
"যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক, আমি তোমায় ছাড়ব না মা!
আমি তোমার চরণ_
মা গো, আমি তোমার চরণ করব শরণ, আর কারো ধার ধারব না মা..."\
মায়ের চরণ ধরে এধরণের বিশ্বস্ততার অঙ্গীকার আমরা আবারও কি করতে পারি না? আমরা কি পারি না অতীতের ভুলগুলো শুধরাতে? আমরা কি পারি না এই দু:খিনী বাংলা মায়ের কস্টগুলো মুছে দিতে? অবশ্যই পারি। বাংলাদেশ যদি আমাদের সমস্টিগত চেতনা, ভাবনা ও কর্মের কেন্দ্রবিন্দু হয় তাহলে আমরা আবারও ফিরিয়ে আনতে পারি আমাদের হারানো গর্ব ও অহংকার।
কে বলে আমরা পারি না? কে বিকিয়ে দিতে চায় আমাদের আত্মসওা? কে জন্ম দেয় পরাভূত ও আশাহত দু:খবোধের? যদি মন হয় স্থির আর প্রতিজ্ঞা হয় যুধিষ্ঠিরের তাহলে আমরা সবাই আবারও গেয়ে উঠতে পারি:
"নিশিদিন ভরসা রাখিস, ওরে মন, হবেই হবে।
যদি পণ করে থাকিস সে পণ তোমার রবেই রবে।
ওরে মন, হবেই হবে"\
মায়ের কথা দিয়ে শুরু করে দেশের কথায় নিয়ে এলাম আপনাদের। আড্ডার পাতায় আমার নিজের সাফল্য ও ব্যর্থতার হিসেব মেলাবার চেয়ে আপনাদের সবার মনোযোগ দেশের প্রতি নিবদ্ধ হোক এটা আমার একান্ত কামনা ও প্রার্থনা। ব্যক্তি আমি অতি তুচ্ছ ও সামান্য।
সময়ের স্রোতে আমার উপস্থিতি একেবারেই নগণ্য। সেখানে ব্যক্তি আমাকে প্রকাশ করার মধ্যে আত্মতৃপ্তি না খুঁজে দেশের জন্য কিছু করার মধ্যে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করার মধ্যে এক ধরণের অসম্ভব আনন্দ আমি খুঁজে পাই। আমরা সবাই যদি একএিত হয়ে আমাদের ভাবনার করিডোরে দেশকে নিয়ে ভাবনার প্রদীপটা জ্বালিয়ে রাখতে পারতাম, তাহলে অবশ্যই আলোকিত করতে পারতাম বাংলাদেশের মুখকে। সেটা যখন সম্ভব তখনই সার্থক হবে আমাদের এই প্রচেস্টা। তখনই আমরা গর্বিত কন্ঠে আবৃওি করব:
"বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ
খুঁজিতে যাই না আর:..."
দেশকে ভালবাসার জন্য আমার পৌন:পুনিক আবেদনে অনেকে হয়তো ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন।
অনেকের কাছে মনে হবে গালে-মুখে বড়ো বড়ো বুলি দিয়ে আমার একরৈখিক প্রকাশ কিভাবে পাঠকের সার্বজনীন সম্মতি ও সমর্থন পাবে। আমি নিজেও জানি আমার লেখায় বাস করে এক ধরণের পক্ষপাতিত্ব। সেটা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি আমার অখন্ড ও অবধ্য পক্ষপাতিত্ব। এর কোন রাজনৈতিক ডাইমেনশন নেই। খুব মনে রাখা দরকার, একমাএ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আমাদেরকে একএিত ও ঐক্যবব্ধ করতে পারে।
শোষন, নির্যাতন, পরাধীনতা ও বৈষম্যের বেড়াজাল ভাঙ্গার স্বপ্নে লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে এ দেশ স্বাধীন হয়েছে। সেই সুষম ও বৈষম্যহীন সমাজ নির্মাণের অঙ্গীকারের বিস্মৃতিতে ঘটে আমাদের চেতনার অকাল মৃতু্য। তাই, স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তি যারা একাওরে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করেছে তাদের সাথে সচেতন জনতার আপোষ কখনও হতে পারে না। যারা তাদের কৃতকর্মের জন্য অপরাধবোধ পর্যন্ত অনুভব করে না আর যারা সেই অপরাধকে জাতীয়তাবাদের প্রলেপে ঢেকে দেয়ার ব্যর্থ চেস্টা করে তারা সবাই সমানভাবে ঘৃণিত।
বাংলার মাটিতে একাওরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কোন আকস্মিক ঘটনা বা রাজনৈতিক আবিস্কার নয়।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে আমাদের পূর্বসূরীদের ব্যর্থতা ও অক্ষমতা এই গুরুতর অপরাধকে লঘু করে না, নিষকৃতির সুযোগও দেয় না। তাই, আগামী দিনে বাংলার মাটিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুধু সময়ের দাবী নয়, বরং এই বাংলা মায়ের প্রতি এটা আমাদের সময়কালের সবচেয়ে বড়ো ঋণ। নতুন প্রজন্মের কাছে এই অবিস্মৃত সত্য দিনের আলোর মতো প্রকাশ করার দায়িত্ব আমাদের সমস্টিগত। তাই, ইতিহাস সচেতন নতুন প্রজন্ম যারা এই দাবীকে নিয়ে আগামীতে কাজ করবে তাদের জন্য রইল আমার নি:শর্ত ভালবাসা।
আমার বক্তব্য যদি কাওকে ব্যথা দেয় তাহলে আমাকে নিজগুণে ক্ষমা করবেন।
আমাদের সবার ভাবনা একমূখী হবে না- তা আমি অন্তর থেকে বিশ্বাস করি। কিন্তু সত্যকে আর ইতিহাসকে বিকৃত করে কেউ যদি তৃপ্তি খোঁজে তা সময়ের বিবর্তনে ভুল প্রমানিত হবে। ইতিহাস বড্ডো ক্ষমাহীন। আমাদের ব্যর্থতার উপলদ্ধি সামনে এগোবার শক্তি দেয়, উৎসাহ দেয়, উদ্দীপনা জোগায়। তাই, হতাশার মধ্যে উৎক্রান্তি বাস করে না।
সেজন্যই আশার কথা বারবার উচ্চারিত হয়। কারণ, প্রত্যাশায় ভর করে আসে সাফল্য। আসে অন্ধকার ঘুচানো সূর্য সকাল। সেরকম সাফল্যের সকাল তৈরীর জন্য যদি আরেক জীবনও হাঁটতে হয়, তবে তাই হোক আজকের অঙ্গীকার। আমার, আপনার আর আমাদের সবার।
আড্ডার পাতায় যারা সরব ও নীরব পাঠক তাদের সবাইকে জানাই আমার শুভেচ্ছা। আপনারা সবাই আমার লেখার পেছনে উৎসাহের অনন্য উৎস। আমার সামনে এগোবার শক্তি। আড্ডার চারশত লেখা আপনারা প্রায় এক লক্ষ বিশ হাজার বার স্পর্শ করেছেন। পাঠকের প্রতি লেখকের যে দায়বদ্ধতা ও দায়িত্ববোধ থাকে তা পূরণে আমি যে খুব একটা সফল না তা আমি ভালভাবেই জানি।
তারপরেও জানাই আমার সকল পাঠকের প্রতি কৃতজ্ঞতা। ব্যক্তি আমার কথা তুলে রাখলাম আগামী কোন শতকের জন্য। চলুক আড্ডা। একেবারেই নৈর্ব্যক্তিক আড্ডা। চলুক আমাদের হাজারো ভাবনার বিস্ফোরণ।
এখান থেকে জন্ম নিক নতুন ভাবনার সিন্থেসিস। এখানেই জন্ম নিক নতুন মনন আর দেশপ্রেমের অনন্য মডেল। বাংলাদেশ হোক সারা বিশ্বের বিস্ময়, আমাদের সবার একান্ত অহংকার।
তাহলে শেষ করি এই গদবাঁধা বক্তৃতা। করতালি।
আত্মতৃপ্তি। সব এক সুতোয় বাঁধা। আড্ডায় চারশততম পোস্টিং। আমার অবরুদ্ধ ভাবনার অকস্মাৎ দীর্ঘ বিস্ফোরণ। আড্ডার পাঠকদের নীরব পদচারণ।
ক্ষমা চাই, কারণ, পাঠকরা আবারও ব্যর্থ হলেন আড্ডায় নতুন কিছু দেখার ও শোনার। তাই, এবার নতুন কোন গল্প চাই। নতুন মোড়কে ঝকঝকে প্রিন্টের নতুন কোন উপন্যাসের মোটা পরিচ্ছদ চাই। নতুন কোন কবিতার পংক্তিমালা চাই। "শেষের কবিতা"র অমিত সেই যে গভীরভাবে কলেজ জীবনের আড্ডাবাজকে নাড়া দিলো এতো বছর পরও আড্ডাবাজ সেই নস্টালজিয়া থেকে মুক্তি পেল না।
তা থেকে মুক্তির দায়ভার রেখে গেলাম নতুন প্রজন্মের কোন অনাগত লেখকের জন্য।
"তোমার হল শুরু, আমার হল সারা_
তোমায় আমায় মিলে এমনি বহে ধারা..."\
নিয়মিত পড়ুন বাংলা গ্রুপ ব্ল্লগিং [link|http://deshivoice.blogspot.com/|
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।