আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বেঁচে থাকো সর্দি কাশি: দ্বিতীয় সর্গ

সুন্দরী বালিকাদের যত্ন করে কামড়াই

[সর্দিকাশির মধ্যে বছরটা কাটলো। এখনও হাঁচি। ভাবলাম এটা নিয়ে পোস্টাবো, কিন্তু বয়স হয়েছে, লিখতে ভালো লাগে না। আবারও পুরনো লেখা তুলে দিচ্ছি। 25 সেপ্টেম্বর, 2003 লেখা গল্পের নিচে।

] 1. পাড়ার ডাক্তারের কাছে গিয়ে নাকাল হয়ে ফিরে এসেছে শিবলি। একটা বাজে সর্দি অনেকদিন ধরে জ্বালিয়ে মারছে তাকে, মুজতবা আলির পরামর্শ মানতে চাইছে না রোগটা, এক হপ্তা তো দূরের কথা, সাত দিনেও সারেনি সেটা। হাঁচি, কাশি, কফ ্#61630; আলুর মতোই নানা রকম শাখাপ্রশাখায় বাড়ছে রোগটা। হাঁচতে গেলে কফের ধাক্কায় তার দম বন্ধ হয়ে আসে, আবার কাশতে গেলে নাকটা এমন সুড়সুড় করে ওঠে যে হেঁচে কূল পায় না বেচারা। অনেকটা বাধ্য হয়েই দাবাইদাতার কাছে যেতে হয়েছে তাকে।

নইলে কথায় কথায় ডাক্তারের কাছে ছুটবে, শিবলি তেমন অমানুষই নয়। তবে কিপ্টেমি করতে গিয়েই শিবলি ধরাটা খেয়েছে। খানিকটা পয়সা খর্চা করলে সে একজন ভালো ডাক্তারের কাছে গিয়ে চিকিৎসা করাতে পারতো। কিন্তু শিবলি খতিয়ে দেখলো, ভালো ডাক্তারের ফি-টাও পরিমাণে বেশ ভালো। তাছাড়া তাঁদের যা স্বভাব, শরীরের যাবতীয় কঠিন ও তরল পদার্থগুলোকে পরীক্ষার জন্যে প্যাথলজিওয়ালাদের দিকে তাকে ঠেলে দিতে পারেন।

সেক্ষেত্রে তার মোটা টাকা গচ্চা যেতে পারে। তারচেয়ে বিনা পয়সায় আমাদের পাড়াতুতো ডাক্তার, অর্থাৎ, জামান ভাইয়ের কাছে ধর্ণা দেয়াটাই সব দিক থেকে মঙ্গলজনক। কাজেই এক বিকেলে শিবলি পদব্রজে জামান ভাইয়ের চেম্বারে হানা দিলো। এক হিসেবে, জামান ভাই খুব ভুল পাড়ায় জন্মেছেন। কিংবা বলা যায়, এ পাড়ায় জন্মে ডাক্তারি পড়েই আরো ভুল করেছেন তিনি।

অথবা বলা যায়, নিজের পাড়ায় ডাক্তারি করতে গিয়েই ধরাটা খেয়েছেন তিনি। কারণ এ পাড়ার লোকগুলো যথাক্রমে কঞ্জুষ ও স্বাস্থ্যবান, পিন্টুর মেজমামা বাদে। এ পাড়ার পিচ্চিগুলো দুর্ধর্ষ প্রকৃতির, ছেলেবেলাতেই টীকা দিয়ে দিয়ে বড়সড় রোগগুলোর হাত থেকে তাদের বাঁচিয়ে দেয়া হয়েছে, আর দিনরাত বদমায়েশি করে আর গান্ডেপিন্ডে গিলে একেকজনের গতর কেঁদো বাঘের মতো, বুদ্ধিশুদ্ধি হবার পর এরা কেউ ডাক্তারের চেহারাও দেখেনি, ডাক্তার আর রোগী কথাগুলো তারা কেবল ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের খতরনাক ট্র্যান্সলেশনগুলোতেই পড়েছে। আর ছেলেছোকরাগুলো (অর্থাৎ আমরা) অসুখবিসুখকে সাধারণত পাত্তা দেয় না। কেমন যেন তাদের স্বভাব, তারা নিয়মিত কড়া জল পান করে, কিন্তু লিভার সিরোসিসের ঝামেলায় পড়ে না, নির্বিকারচিত্তে পান-তামাক-বড়তামাক খায়, কিন্তু কখনো ক্যানসার বাধায় না।

বয়স্ক লোকজন সেই আদ্যিকালের খাঁটি ঘিদুধ খেয়ে বড় হয়েছেন, অসুখে পড়ার ঝোঁক তাদের বড় একটা নেই, তবে কদাচিৎ দু'একজন মুরুবি্ব যেন পরোপকারের উদ্দেশ্যেই অসুস্থ হয়ে জামান ভাইয়ের রোগীতে পরিণত হন। কিন্তু কষ্ট করে উজিয়ে জামান ভাইয়ের গ্যারেজ, থুক্কু, চেম্বারে যাবেন, অত তেল তাদের কারো নেই। তারা বেশির ভাগই জামান ভাইয়ের বাবার দোস্তো গোত্রীয়, তাই তাকেই খেটেখুটে বেরিয়ে গিয়ে সেইসব মরশুমি ব্যারামিদের দেখে আসতে হয়। আর এ যেন জামান ভাইয়েরই গরজ। এসব ক্ষেত্রে তার ভিজিট হিসেবে সাধারণত এক কাপ চায়ের সাথে টোস্ট বিস্কুট, কিংবা আমসত্ত্ব, অথবা ভাগ্য ভালো থাকলে বাড়িতে বয়ে নিয়ে যাবার জন্যে এক বয়াম ঘরে-বানানো-আচার জোটে।

পোড় খাওয়া ঘাগু কঞ্জুষ রোগীদের সংখ্যাই বেশি, জামান ভাই চিকিৎসা করে ওষুধ বাতলে দিয়ে শুকনো মুখে খালি হাতে তাদের বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাবার ঠিক পরপরই তারা দারাপুত্রপরিবারের সাথে গজগজ করেন, 'দেখেছো, কলিযুগের কান্ড? কতবড় পিশাচ দেখেছো, অ্যাদ্দিন পর বাড়িতে এলো, কোথায় মিষ্টিদই নিয়ে আসবে, না, খালি হাতেই লাটসাহেবের মতো গটগটিয়ে চলে এসেছে! ডাক্তার হয়ে খুব দেমাগ হয়েছে ছ্যামরার। আমরাই তো কোলেপিঠে করে মানুষ করলাম, কোন কৃতজ্ঞতা বোধ নেই! বয়স বাড়লে এটাও তার বাপের মতোই চামার হবে ্#61630; বুঝলে মকবুলের মা, এ বড় কঠিন জামানা, শ্রদ্ধাভক্তি সমাজ থেকে উঠেই গেছে ---!' রেজা সেদিন হিসেব করে বের করেছে, গ্যারেজে চেম্বার না খুলে সেটাকে গ্যারেজ হিসেবে ভাড়া দিলেও জামান ভাইয়ের হাতে বেশি পয়সা আসতো। তো, এমন একজন ডাক্তারের কাছে গিয়ে পয়সা খরচ করার কোন মানেই হয় না। শিবলি বরং চেম্বারে গিয়ে একরকম সুনামই বাড়ালো তার। কিন্তু চেম্বারে ঢুকে শিবলি বেশ ঘাবড়েই গেলো।

এক মুমূর্ষু চেহারার লোক মুখ থুবড়ে বসে আছে রোগীর খাটে, আর জামান ভাই তার পালস চেপে ধরে স্টেথোস্কোপ কানে গুঁজে ধ্যানী মুনির মতো চোখ বুঁজে বসে আছেন। এ এক অভূতপূর্ব দৃশ্য, জামান ভাইয়ের চেম্বারে পরপর দুজন রোগী! রোগা লোকটা চোখ খুলে কাতর গলায় বললো, 'ছেড়ে দিন ডাক্তার সাহেব, কিরা কেটে বলছি, এবার সব ঠিক আছে, কোন সমস্যা নেই। ' জামান ভাই চোখ খুলে সে দুটোকে বেশ রোষকষায়িত করলেন। 'তাই নাকি? আপনি গতবারও এ কথা বলেছিলেন। কিরা কেটেই বলেছিলেন, তারপর দেখা গেলো বিস্তর গন্ডগোল! কোন কিছুই ঠিকমতো কাজ করে না, সবক'টাতেই একটা না একটা গলদ ---।

' রোগী হাত জোড় করে বললো, 'এবার সব ঠিক পাবেন, আমি নিজে চেক করে দেখে এসেছি। ' জামান ভাই উঠে দাঁড়ালেন, 'ঠিক তো?' রোগী বললো, 'ঠিক!' জামান ভাই বললেন, 'আচ্ছা ঠিক আছে। আজকের মতো ছেড়ে দিলাম আপনাকে, পেনিসিলিন ইঞ্জেকশনটা আর দিলাম না। তবে হুঁশিয়ার, গতবারের মতো গন্ডগোল হলে কিন্তু আমি আপনাকে বাড়ি গিয়ে ফুঁড়ে দিয়ে আসবো। তখন কিরা কেন, আমার জন্যে খাসি মোরগ কাটলেও কোন লাভ হবে না।

' সিড়িঙ্গে লোকটা একটা ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে নক্ষত্র বেগে চেম্বার থেকে বেরিয়ে গেলো, পয়সা না দিয়েই। জামান ভাই এবার মুখ তুলে শিবলিকে দেখলেন। 'কী রে, তুই এখানে কী চাস?' কেমন যেন সন্দিহান গলায় বলেন তিনি। শিবলি মুগ্ধ হয়ে জামান ভাইয়ের চিকিৎসার ধরনটা দেখছিলো। এই না হলে ডাক্তার? ডাক্তারের ভয়ে রোগী থরহরিকম্প! শুধু তাই না, ডাক্তারের কাছে আসার আগে সে নিজেই একবার নিজেকে চেক করে আসে! তবে পেনিসিলিনটা হয়তো লোকটার ন্যায্যত পাওনা ছিলো, সেটা কেন তাকে দেওয়া হলো না, এটা ভাবনার বিষয়।

তবে জামান ভাইয়ের প্রতিশ্রুতিটাও ফ্যালনা না, রোগীর হালচাল একটু এদিকওদিক হলেই বাড়িতে গিয়ে গায়ে পড়ে দিয়ে আসবেন। বাহ! বিনা পয়সায় এমন চিকিৎসা যদি সব ডাক্তার করতো, এই দেশের লোকেরা স্বাস্থ্যে ফুলেফেঁপে একাকার হয়ে যেতো। জামান ভাই এবার বিরক্ত হয়ে বললেন, 'দাঁত কেলিয়ে আছিস কেন? কি চাস?' শিবলি ভাবনার চটকা ভেঙে বেরিয়ে এসে বললো, 'এই, এমনি। ' জামান ভাইয়ের কাছে কোন রোগের কথা যেচে পড়ে বলতে সে নারাজ। জামান ভাই ভুরু কুঁচকে শিবলিকে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বললেন, 'নাক টানছিস কেন ওরকম করে, সর্দি লেগেছে নাকি?' শিবলি কুন্ঠিত হয়ে বললো, 'এই আর কি।

' জামান ভাই দরাজ গলায় বললেন, 'আয় দেখি, তোর ওপর এই স্টেথোটা একটু পরখ করে দেখি। ' শিবলি এগিয়ে গিয়ে খাটে বসে বললো, 'ঐ লোকটা কে?' জামান ভাই বললেন, 'কোন লোকটা?' শিবলি বললো, 'এই যে, এই মাত্র চিকিৎসা করিয়ে গেলো?' জামান ভাই নাক সিঁটকে মুখ বাঁকিয়ে বললেন, 'ওহ, ঐ ব্যাটা? মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টিটিভ। আমাকে ছোটখাটো ওষুধ, প্যাড, কলম এইসব দিয়ে যায়। এই যে, এসব। ' টেবিলের ওপর রাখা প্যাড আর কলম দেখিয়ে বলেন তিনি।

শিবলি এবার বুঝতে পারে ঘটনাটা। প্যাড কলম গছানোর বদলে একটা ফ্রি চেকআপও করিয়ে যায় লোকটা। কী বুদ্ধি! একে জাতিসংঘে রিপ্রেজেন্টিটিভ বানিয়ে পাঠানো উচিত! জামান ভাই এদিকে শিবলির ভুঁড়িতে স্টেথোস্কোপ ধরে কি সব যেন শুনলেন, তারপর আনমনে বললেন, 'হুম। ' এরপর শিবলির কব্জি চেপে ধরে পালসের তালে তালে একটা পুরানো দিনের হিন্দি গান গুনগুন করলেন। তারপর শিবলিকে হাঁ করিয়ে তার জিভ গলা নাক ইত্যাদি এক ঝলক দেখে নিজের চেয়ারে ফিরে গেলেন।

তারপর একটা প্যাড টেনে নিয়ে একটা লাল রঙের কলম দিয়ে খসখস করে কী কী সব যেন লিখলেন। তারপর একটা কালো কলমে আরেক দফা কী যেন লিখলেন। তারপর সবুজ কলমটা দিয়ে কী কী সব টিক চিহ্ন দিলেন। সব শেষে নীল কলম দিয়ে একটা জবরদস্ত সই করলেন কাগজটার নিচে। শিবলি বসে বসে সব দেখছিলো, সে বললো, 'জামান ভাই, আপনাকে সিভিট দিয়ে যায় না লোকটা?' জামান ভাই বললেন, 'অ্যাঁ? সিভিট? হ্যাঁ, আছে।

এক বাক্স দিয়ে গেছে গত বছর, সেটা এখনো শেষ করা হয়নি। আমার ভাগি্নটা যখন বেড়াতে আসে তখন খুব শখ করে খায়। দাঁড়া দুই মিনিট, ভেতরের ঘরে আছে, তোকে দিচ্ছি। এখনো এক্সপায়ার করেনি, হপ্তাখানেক সময় আছে এখনো, খেতে পারবি। ' জামান ভাই ঘরের ভেতরে সিভিট আনতে চলে গেলেন, শিবলি এগিয়ে গিয়ে প্যাড থেকে প্রেসক্রিপশনটা ছিঁড়ে নিয়ে পকেটে পুরলো।

জামান ভাই খানিক বাদে ফিরে এসে বললেন, 'সিভিট সর্দির জন্যে বেশ উপকারী, খেয়ে দেখতে পারিস। আর এই ছোঁয়াচে রোগ নিয়ে পথেঘাটে ঘুরে বেড়ানোর মানে হয় না, ঘরে বসে বিশ্রাম নে। ' শিবলি একটা সিভিট মুখে দিয়ে হৃষ্টচিত্তে বেরিয়ে এসে কাছের ফার্মেসীর দিকে এগিয়ে গেলো। বিনাপয়সায় বেশ উমদা রকমের চিকিৎসা করানো গেলো। 2. কম্পাউন্ডার ভদ্রলোক প্রেসক্রিপশনটা হাতে নিয়ে মিনিটখানেক সেটার দিকে চেয়ে রইলেন।

তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে আরো মিনিটখানেক কী যেন ভাবলেন, হয়তো হায় চিল, সোনালী ডানার চিল নিয়ে আপসোস করলেন মনে মনে, তারপর কাগজটা উল্টো করে ধরে আবারো মিনিটখানেক চেয়ে রইলেন। তারপর, যুগপৎ বিফল ও বিরক্ত হয়ে, বিষম হতাশায় নাকমুখ কুঁচকে বললেন, 'কে লিখেছে এটা?' শিবলি ইশারায় জামান ভাইয়ের চেম্বারটা দেখিয়ে দিলো। কম্পাউন্ডার সাহেব নাক সিঁটকে বললেন, 'ওহ, মফিজ সাহেবের ছেলে! আমি ভেবেছিলাম এটা গালিদাস চর্মকারের কোন রাফ ছবি হয়তো! --- দ্যাখো ছেলে, আমার বয়স হয়েছে, জীবনে বহু কিছু দেখেছি, বহুদিন ধরে ওষুধের দোকানে কাজ করছি, বহু নামীদামী ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন নিয়ে কাজ করার সুযোগ হয়েছে, কিন্তু এমন বিচ্ছিরি হাতের লেখা আমি জীবনে কখনো দেখিনি। এটা কী প্রেসক্রিপশন, নাকি কোন বিমূর্ত চিত্র? এর তো আগামাথা কিছুই বোঝা যাচ্ছে না!' শিবলি মুখ সূঁচালো করে বললো, 'এমন কী জটিল হতে পারে, বলুন? ওষুধের নাম, দিনে ক'বার খাবো, আর ডাক্তারের সই --- ব্যস, এই তো। প্রত্যেকটা জিনিস আলাদা আলাদা কালিতে আমার সামনে বসে লিখেছেন ডাক্তার সাহেব।

' কম্পাউন্ডার ভদ্রলোক চোখ কটমটিয়ে শিবলির দিকে তাকান। 'বটে?' গুরুগম্ভীর গলায় বলেন তিনি। 'এতোই সোজা?' কী যেন একটা ঘটতে থাকে তাঁর মাঝে। খিচুড়ির মতোই তিনি অলক্ষ্যে ভেতরে ফুটতে থাকেন। শিবলি বিরক্ত হয়ে বলে, 'হওয়াই উচিত।

' এবার প্রৌঢ় ভদ্রলোকের বক্তৃতা সংযমের বাঁধ ভেঙে গলগলিয়ে বেরিয়ে আসে। 'পড়াশোনা করে এসবই শিখছো? সবকিছুকে সহজ বানিয়ে ফেলতে চাও? খালি আরাম আর আরাম? একখানা কাগজ এনে আমাকে গছিয়ে দিলে, সেটা আমি গড়গড়িয়ে পড়ে তোমাকে আলমিরা খুলে ওষুধ বার করে দেবো, এতই সহজ দুনিয়া? ইজ দ্য ওয়ার্ল্ড দ্যাট মাচ সিম্পল টু ইউ?' শিবলি এবার খুবই বিস্মিত হয়। ব্যাপারটা ঠিক অতটা সিম্পল বলেই জানে সে, অন্তত এতোদিন ধরে তো তা-ই হয়ে আসছে। ডাক্তার প্রেসক্রিপশন লিখবেন, কম্পাউন্ডার সেটা পড়ে ওষুধ বার করে দেবেন, ওষুধের দাম রেখে ভাঙতি পয়সা বার করে দেবেন, আর পরিচিত কম্পাউন্ডার হলে একটা কি দুটা সিভিট দেবেন সাথে, এমন সিম্পলপনার সাথেই তো যুগযুগ ধরে কাজ হয়ে আসছে। ইনার দোকানে কি এই সহজ প্রাচীন পদ্ধতি খাটে না? নূতন কোন জটিল আমলাতান্ত্রিক নিয়ম কি চালু হয়ে গেছে? শিবলিকে কি এখন নিজের দুই কপি পাসপোর্ট সাইজ ছবি সহ কোন ফর্ম ফিলাপ করে ব্যাঙ্কে টাকা জমা দিয়ে সেই জমার রসিদ দেখিয়ে ওষুধ তুলতে হবে? শিবলির ভাবনায় বজ্রপাত ঘটে, কম্পাউন্ডার ভদ্রলোক দাঁত খিঁচিয়ে বলেন, 'হাঁ করে কী দেখছো? জানো, এই কাজ কত জটিল? কত হাজারো ওষুধের নাম মুখস্থ রাখতে হয়? কত হাজারো ধরনের হাতের লেখা চিনতে হয়? কোনটা ডাবি্লউ আর কোনটা এম সেটা আলাদা করে জানতে হয়? বোঝো এসব?' শিবলি কাঁদোকাঁদো হয়ে বললো, 'একটা কিছু দিন তো, ভয়ানক সর্দি লেগেছে আমার!' কম্পাউন্ডার এবার সোজা হয়ে বসে বললেন, 'সর্দির ওষুধের জন্যে প্রেসক্রিপশন?' শিবলি খানিকটা আশ্বস্ত হয়ে বললো, 'জি্ব।

' কম্পাউন্ডার ফেটে পড়েন এবার, 'সর্দির জন্যে ডাক্তার দেখানো? ইয়ার্কি পেয়েছো? পয়সা বেশি হয়েছে তোমার? পকেটে আর টাকা রাখা যায় না, তাই না, ছিটকে ছিটকে পড়ে যায় রাস্তায়? পয়সার গরম দেখাতে এসেছো আমার কাছে? যাও, এই জঘন্য হাতের লেখাওয়ালা প্রেসক্রিপশন নিয়ে দূর হও! বেরোও আমার দোকান থেকে!' সোজা হাঁকিয়ে দিলেন তিনি শিবলিকে। 'সর্দির জন্যে ওষুধ, আহ্লাদের আর সীমা নাই!' গজগজ করতে থাকেন তিনি। বাধ্য হয়ে খানিকটা এগিয়ে আরেকটা ওষুধের দোকানে যেতে হলো শিবলিকে। সেখানে এক ইয়াংম্যান অলস ভঙ্গিতে চেয়ারে এলিয়ে বসে, হাতে একটি বিপজ্জনক চেহারার ম্যাগাজিন, তার সামনের মলাটে এক স্খলিতবসনা দলিতআসনা গলিতদশনা সুন্দরী সোজা শিবলির দিকে আধো আধো চোখে চেয়ে, আর পেছনের মলাটে তারই সাথে সংশ্লিষ্ট একটি পণ্যের বিজ্ঞাপন, যে পণ্যটি দোকানে যথেষ্ঠ পরিমাণে বর্তমান। সেই মনোযোগী পাঠকের হাতে একরকম জোর করেই তথাকথিত প্রেসক্রিপশনটা গছিয়ে দিলো শিবলি।

ব্যাজার মুখে ম্যাগাজিন বুঁজিয়ে রেখে এক পলক কাগজটা দেখেই ইয়াংম্যান কম্পাউন্ডার বললো, 'এই রাস্তা বরাবর সোজা যান, দুইটা গলি ছেড়ে দিয়ে হাতের বাঁয়ে তিন নাম্বার গলিতে ঢুকবেন। শেষমাথায় দোতলা লাল ইঁটের বাড়িটাই ছিদ্দিকুর রহমানের বাড়ি। ' শিবলি তো হতভম্ব। ব্যাটা বলে কী? কিসের লাল ইঁট, আর ছিদ্দিকুর রহমানটাই বা কে? এ কাগজে কি তা-ই লেখা? ছিদ্দিকুর রহমানের কাছে তাকে রেফার করা হয়েছে? ছিদ্দিকুর রহমানের নাম ঠিকানাই তবে চাররঙা কালিতে লিখে দিলেন জামান ভাই? যদি তা-ই হয়, তাহলে অ্যাতো সোজা জিনিসটা আগের দোকানের বুড়ো নীতিবাগীশ জটিলতাপ্রেমী ভামটা পড়তে পারলো না কেন? নাকি এই দোকানের কম্পাউন্ডার জামান ভাইয়ের হাতের লেখা সম্পর্কে একজন এক্সপার্ট? ঘটনা কী? শিবলির মনে হাজারো প্রশ্ন ফেনায়িত হতে থাকে, কিন্তু তাকে আর কোন কথা বলার সুযোগ দিলো না এই ইয়াংম্যান কম্পাউন্ডার, কী একটা কাজে ম্যাগাজিনটা বগলদাবা করে হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলো সে, এক পিচ্চির ওপর দোকান সামলানোর দায়িত্ব দিয়ে। অগত্যা তৃতীয় এক দোকানে পদার্পণ করতে হলো শিবলিকে।

এই দোকানের কম্পাউন্ডার মাঝবয়েসী, বেশ সুফী চেহারা, লম্বা দাড়ি, কুর্তা পায়জামা পরনে। সহাস্যে শিবলিকে আপ্যায়ন করলেন তিনি, কিন্তু প্রেসক্রিপশনটা আগাগোড়া দেখে নিয়ে কাঁচুমাচু হয়ে বললেন, 'বাবা, সেই ছোটবেলায় মক্তবে পড়াশোনা করার সময় শেষ ফারসি কেতাব পড়েছিলাম, এখন বয়স হয়েছে, সব মনে নাই। তবে আমাদের পাড়ার ছিদ্দিকুর রহমান সাহেব খুব ভালো ফারসি জানেন, তাঁর কাছে যাও, উনি এর তর্জমা করে দিতে পারবেন। বাসা চেনো না? খুব সোজা, দুশো ছিয়াশি নাম্বার বাসা ---। ' শিবলি অবিলম্বে তাঁকে হাত তুলে থামিয়ে দিলো, 'কী যে বলেন, এ পাড়ার ছেলে হয়ে ছিদ্দিকুর রহমান সাহেবের বাসা চিনবো না মানে? আলবাত চিনি।

সামনে দুইটা গলি ছেড়ে হাতের বাঁয়ে তিন নাম্বার গলির শেষ মাথায় লাল ইঁটের দোতলা বাড়িটায় থাকেন না উনি? --- অনেক মেহেরবানি। ' গটগটিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে এসে শিবলি প্রথমবারের মতো ভালো করে কাগজটা চোখের সামনে তুলে দেখলো, সত্যিই, সেই কাগজের লেখা, অথবা আঁকার মর্ম উদ্ধার করা আসলেই দুরূহ কর্ম। একমাত্র ছিদ্দিকুর রহমানরাই বোধহয় একে সৎকার করতে পারবেন। তবু শিবলি শেষ চেষ্টা করে দেখে, শেষ দোকানটায় হানা দেয় সে। এ দোকানে অনেক লোকের ভিড়, এক জঙ্গী চেহারার কম্পাউন্ডার বিক্রিবাটায় মহাব্যস্ত।

পিলপিল করে লোক ঢুকছে, প্রেসক্রিপশন বাগিয়ে ধরে হৈহল্লা করছে, আর কম্পাউন্ডার চরকির মতো ঘুরপাক খেয়ে একের পর এক আলমারি খুলে নানা রঙের ট্যাবলেট, ক্যাপসুল আর বোতল বের করে দিচ্ছেম সেই চিরাচরিত সিম্পলায়িত নিয়মে। শিবলি মিনিট দশেক লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করলো, তারপর শেষ পর্যন্ত তিতিবিরক্ত হয়ে বেরিয়ে এলো। নাহ, এই লোকের দোকানের কাটতি যেমন, ফারসি প্রেসক্রিপশন দেখলে সময় নষ্টের দায়ে তাকে মেরেধরে বসতে পারে। তারচেয়ে ছিদ্দিকুর রহমানের কাছে গিয়ে এটাকে অনুবাদ করিয়ে আনা যাক। শিবলি পরামর্শ মতো দুশো ছিয়াশি নাম্বার বাসা খুঁজে বের করে।

লাল ইঁটের দোতলা রঙের বাড়িতে গিয়ে দরজায় কিল মারে সে। 'ছিদ্দিকুর রহমান সাহেব কি আছেন?' দোতলার বারান্দায় এক চুলদাড়িওয়ালা প্রৌঢ় ভদ্রলোকের আবির্ভাব ঘটে। 'কে হে ছোকরা, নাম ধরে ডাকছো যে বড়?' শিবলি কিঞ্চিৎ ভাবিত হয়ে বলে, 'ইয়ে, আমার একটা দরকার ছিলো। ' ভদ্রলোক এবার খটখটিয়ে নিচে নেমে আসেন। এরপর শিবলি প্রায় ছয় সাতটা ছিটিকিনি খোলার শব্দ পায়।

আধডজন ছিটকিনিকে বন্ধনমুক্ত করে বাড়ির বাইরে বেড়িয়ে আসেন ছিদ্দিকুর রহমান, চোখে ভাবুক দৃষ্টি, যা কেবল ফারসি ভাষায় সুপন্ডিত কাউকেই মানায়। 'কী দরকার তোমার? লজ্জা কেন, মুখ ফুটে বলো? শাহনামার গল্প শুনতে চাও? খৈয়ামের রুবাই নিয়ে আলোচনা করতে চাও? নাকি জালালুদ্দিন রুমির কিছু লাজওয়াব শের শুনতে চাও? কোনটাতে তোমার দিলচসপী, বলো?' শিবলি কাগজটা বাড়িয়ে ধরে। ছিদ্দিকুর রহমান চোখে একটা চশমা এঁটে কাগজটা খুঁটিয়ে দেখেন। তারপর বিড়বিড় করে বলেন, 'আশ্চর্য! --- এসো এসো, ভেতরে এসো। ' শিবলি তাঁর পিছু পিছু দোতলায় একটা ঘরে ঢোকে।

ঘরভর্তি আলমারি, তাতে ধূলোপড়া হাজারো বইপত্র, আর তাড়া বাঁধা কাগজ। টেবিলে খোলা কয়েকটা বই, আর সেগুলো নিঃসন্দেহে ফারসিতে লেখা, আঁকাবাঁকা হিলহিলে হরফে হিজিবিজি সব দাগ। ছিদ্দিকুর রহমান একটা আতশ কাঁচ বের করেন পকেট থেকে, তারপর কাগজটা আরো মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষা করেন। তারপরও সন্তুষ্ট না হয়ে আলমারি খুলে একটা প্যাথলজিস্টের মাইক্রোস্কোপ বের করেন, সেটার তলায় কাগজটা ফেলে কিছুক্ষণ স্ক্রু নেড়েচেড়ে দেখেন। তারপর খেঁকিয়ে উঠে বলেন, 'তুমি এই কাগজ কোথায় পেয়েছো, অ্যাঁ?' শিবলি আমতা আমতা করে বলে, 'এই তো, ইয়ে ---।

' ছিদ্দিকুর রহমান সাহেব তেড়ে আসেন, 'এটা কোন শের হলো? চার লাইনের শের, সেটা বোঝা যাচ্ছে, কিন্তু পড়ার জো নেই, এতো বিচ্ছিরি লেখা! তিরিশ বছর তেহরানের প্যাথলজি ল্যাবে কাজ করেছি, নোঙরা ময়লা কতো ঘেঁটেছি, কিন্তু এমন বাজে জিনিস কখনো চোখে পড়ে নি! --- কে লিখেছে এই রুবাই?' শিবলি আরো ঘাবড়ে যায়। 'ইয়ে ---। ' 'জানো না, তাই তো? রাস্তাঘাট থেকে পদ্য টুকে নিয়ে এসেছো আমার কাছে?' ছিদ্দিকুর রহমান তড়পাতে থাকেন। 'পেয়েছোটা কী তোমরা আমাকে? শান্তিমতো আমাকে শাহনামার ওপর গবেষণাও করতে দেবে না? ওমর খৈয়ামের অপ্রকাশিত গজলগুলো নিয়ে কাজ করতে বসেছি, আর অমনি যত রাজ্যের লোকজন এসে উৎপাত শুরু করেছে! রুমির শায়েরিতে মঙ্গোল দসু্যদের প্রভাব নিয়ে একটা প্রবন্ধ সেদিন আদ্ধেকটা লিখে শেষ করেছি, কোত্থেকে এক তালেবান ছোকরা এসে হাজির, বলে কি না, আফগানিস্তানে জেহাদ করতে যাবে, ওর মেট্রিকইন্টারমিডিয়েটের সার্টিফিকেটগুলো পশতুতে অনুবাদ করে দিতে হবে! যতই বলি, পশতু আমি জানি না, সে আরো বেশি করে চেপে ধরে, বলে সহযোগিতা না করলে নাকি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলে আমাকে রিমান্ডে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করবে, বদতমিজ অসভ্য নওজোয়ান একটা --- শেষমেষ ফারসিতেই তর্জমা করে দিতে হয়েছে ছোকরাকে! আর আজ তুমি এসেছো, একটা রুবাই দেখাতে, কার লেখা, সেটাও বলতে পারছো না, আর এমন জঘন্য লেখা --- আমি তো বলি, এটা আদপে ফারসিই নয়, বরং পুরানো আমলের খারোষ্ঠী হরফের সাথে মিল আছে খানিকটা ---। ' শিবলি একটা হাঁচি দেয়।

অমনি ছিদ্দিকুর রহমান কথা থামিয়ে এক তুর্কি লাফে পিছিয়ে যান, তারপর আঙুল তুলে দরজার দিকে দেখান। 'নিকালো! আভি নিকালো!' উদর্ুতে গর্জে ওঠেন তিনি। 'অসুখ বাঁধিয়ে এসেছো আমার বাসায় জীবাণু ছড়াতে! বেরোও তোমার বিচ্ছিরি চেহারার পদ্য নিয়ে!' শিবলি কোনমতে হাঁচি চাপতে চাপতে বেরিয়ে আসে। সন্ধ্যে হয়ে এলো প্রায়। তবে এখন আর অন্য কোন ফার্মেসিতে যাওয়ার উপায় নেই।

শিবলি চটেমটে সব গন্ডগোলের গোড়ায় হামলা চালানোর সংকল্প নিয়ে জোর পায়ে হাঁটতে থাকে। 3. 'আমি জানতে চাই, এই কাগজের টুকরোটাতে আসলে কী লেখা আছে!' শিবলি কাগজটা জামান ভাইয়ের নাকের নিচে বাগিয়ে ধরে। ঝিমুনি ঝেড়ে কাগজটা চোখের কাছে ধরে ভালোমতো দেখেন জামান ভাই। তারপর ড্রয়ার থেকে একটা চশমা বের করে সেটা দেখেন। তারপর ভারি বিরক্ত হয়ে শিবলির দিকে তাকান।

'কিসের কাগজ এটা?' গম্ভীর গলায় জানতে চান তিনি। 'বলছি। তার আগে আপনি বলুন, এতে কী লেখা আছে। ' শিবলি ততোধিক গম্ভীর গলায় বলে। 'লেখা? কিসের লেখা? এটা একটা লেখা হলো? জঘন্য হাতের লেখা --- এই কাগজের লেখা পড়ার সাধ্য আমার নেই।

' কাগজটা দলা পাকিয়ে ছুঁড়ে ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে ফেলে দেন জামান ভাই। 'আর আমি একজন ডাক্তার, লেখাবিশারদ তো নই। সবচেয়ে বড় কথা, আমি আরবীফারসিউদর্ু পড়তে পারি না। এখন, যদি আর কিছু বলার না থাকে, তুই ভাগ। আমি ঘুমোবো।

' শিবলি এবার ফেটে পড়ে। 'আহ্লাদ? আরবীফারসিউর্দু পড়তে পারেন না? পড়তে যখন পারেন না, তখন লিখতে গেলেন কেন?' 'আমি? আমি লিখেছি এই ছাইপাঁশ?' জামান ভাই চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে ওঠেন। 'আলবাত!' গর্জে ওঠে শিবলি। 'আপনার নিজের হাতে লেখা প্রেসক্রিপশন এটা! আজ বিকেলে আপনি এই প্রেসক্রিপশন লিখে দিয়েছেন আমাকে! আপনার এই জঘন্য হাতের লেখার কারণে আমাকে আজকে দুই কিলোমিটার হেঁটে হেঁটে ফার্মেসীর পর ফার্মেসী চষে বেড়াতে হয়েছে! না, কোন কম্পাউন্ডার এই লেখা পড়তে পারেনি, কারণ তারাও কেউ আরবীফারসিউর্দু পড়তে জানে না! এমনকি ছিদ্দিকুর রহমান, যিনি দুইটা গলি ছেড়ে হাতের বাঁয়ে তিন নাম্বার গলির শেষ মাথায় লাল ইঁটের দোতলা বাড়িতে থাকেন, যিনি ফারসি ভাষার একজন মহাপন্ডিত, যিনি ফেরদৌসির শাহনামার ওপর গবেষণা করছেন, খৈয়াম-রূমি ছাড়া যিনি কথা বলেন না, তিনি পর্যন্ত আপনার এই জঘন্য হাতের লেখা ফারসি প্রেসক্রিপশন পড়তে পারেননি। শুধু তাই না, তিনি বলেছেন, এটা আদপে ফারসিই নয়! আরও শুনবেন? কম্পাউন্ডাররা বলেছে, বহু বড় বড় ডাক্তার চরিয়ে তারা খেয়েছে, কিন্তু এমন বাজে হাতের লেখা তারা জীবনে কখনো দেখেনি! নার্সারির বাচ্চারাও আপনার চেয়ে সুন্দর করে ফারসি লিখতে পারবে!' জামান ভাইও ফেটে পড়েন।

'ফারসি? ফারসি দিয়ে আমি কী করবো? ফারসি আমি লিখতে যাবো কেন? আমি কি খোমেনি না খামেনি? আমার কি ঠ্যাকা পড়েছে ফারসি লেখার জন্যে?' শিবলিও চ্যাঁচাতে থাকে, 'তাহলে কী এটা?' কাগজটা কুড়িয়ে এনে ডলে ডলে সমান করে আবার জামান ভাইকে দেখায় সে। 'এটা আপনার হাতের লেখা না বলতে চান? এই যে, আপনার ডাক্তারি প্যাডের কাগজ এটা, নাড়িভুঁড়ির জলছাপ মারা!' জামান ভাই কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে যান, তারপর কাগজটা ভালো করে দেখে বলেন, 'আরে, তাই তো!' শিবলি চেঁচিয়ে ওঠে, 'আবার বলছেন আপনি ফারসি লিখতে পারেন না!' জামান ভাই খানিকক্ষণ কাগজটা ভালো করে দেখে নিয়ে বলেন, 'তুই বলতে চাস, এটা আমার লেখা?' শিবলি গদাম করে একটা কিল বসিয়ে দেয় ডেস্কের ওপর, 'হ্যাঁ, এটা আপনার নিজের হাতে লেখা ফারসি প্রেসক্রিপশন!' জামান ভাই গর্জে ওঠেন, 'খবরদার, ফারসি নিয়ে কোন কথাই বলবি না! ফারসি আবার আসে কোত্থেকে? ফারসি কি আমি ধুয়ে খাবো?' শিবলিও চ্যাঁচায়, 'ফারসি হোক, পশতু হোক, খারোষ্ঠী হোক, এটা আপনার লেখা প্রেসক্রিপশন!' জামান ভাই এবার হঠাৎ ভারি অবাক হয়ে বললেন, 'প্রেসক্রিপশন? কিসের প্রেসক্রিপশন? আমার তো সব প্র্যাকটিস মাগনা, সবাইকে মুখে মুখে ওষুধ দিয়ে আসি! আমি গত দুই বছরে আদৌ কোন প্রেসক্রিপশনই লিখিনি!' এবার শিবলি ঘাবড়ে গিয়ে বললো, 'বা রে, এই যে বিকেলে এসেছিলাম আপনার কাছে, আপনি আমাকে দেখেটেখে একটা প্রেসক্রিপশন দিলেন না?' জামান ভাই ভুরু কুঁচকে খানিকক্ষণ ভেবে বললেন, 'বলিস কি? তুই এসেছিলি আমার কাছে? কেন, কী সমস্যা তোর?' শিবলি এবার গর্জে ওঠে, 'ধিক! শতধিক! কেমন ডাক্তার আপনি? রোগী দেখেছেন কি না সেটাই ভুলে যান? আর আপনার কাছে তো মাসে একজন রোগী আসে, আপনার উচিত তাদের ছবি তুলে এনলার্জ করে স্টীলের ফ্রেমে বাঁধিয়ে চেম্বারের দেয়ালে টাঙিয়ে রাখা!' জামান ভাই দাঁতে দাঁত পিষে বললেন, 'মেলা কপচাচ্ছিস! সমস্যাটা কী ছিলো তোর?' শিবলি নাকে সর্দি টেনে বললো, 'সর্দি। ' এবার জামান ভাইয়ের মুখে রক্ত জমলো। তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে মেঘস্বরে বললেন, 'তুই সর্দির চিকিৎসা করাতে আমার কাছে এসেছিলি? কখন?' শিবলি অবাক হয়ে বললো, 'আজকে, বিকেলে, যখন মেডিকেল রিপ্রেজেন্টিটিভ লোকটার চিকিৎসা করছিলেন, আপনাকে প্যাড আর কলম দিয়ে গেলো লোকটা, তখনই তো ---। ' জামান ভাই অন্যমনস্ক হয়ে যান, আনমনে খানিকক্ষণ ভাবেন, তারপর হঠাৎ তুড়ি দিয়ে চেঁচিয়ে ওঠেন।

'ইউরেকা! --- আরে রামছাগল, আমি তো প্যাডের ওপর আঁকিবুঁকি দিয়ে দেখছিলাম, কলমগুলো থেকে ঠিকমতো কালি বেরোয় কি না --- ঐ শালা সবসময় রদ্দি মালগুলো আমাকে গছিয়ে দিয়ে যায়! সেজন্যেই তো সবসময় পেনিসিলিন ইঞ্জেকশনটা তৈরি করে রাখি, নষ্ট কলম দিয়ে গেলেই দেবো পেছনে ফুঁড়ে! --- আর তুই সেই বাতিল কাগজটা নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় দোকানে দোকানে ঘুরে বেরিয়েছিস, আর বলে বেড়িয়েছিস যে ডাক্তার জামান তোর সর্দির চিকিৎসা করে এই প্রেসক্রিপশন দিয়েছে?' শিবলি মাথা নাড়ে। 'তাই তো। ' জামান ভাই এবার বাঘের মতো গর্জে ওঠেন, 'হারামজাদা কোথাকার! সর্দির জন্যে ডাক্তার দেখাতে চাস, ইয়ার্কি পেয়েছিস? তোর সর্দির চিকিৎসা করবো আমি, ডাক্তার জামান? সর্দি চিকিৎসার লায়েক কোন রোগ? জানিস না, সর্দি চিকিৎসা করলে এক হপ্তায় সারে, আর চিকিৎসা না করলে সাত দিনে? মুজতবা আলির লেখায় পড়িসনি, মূর্খ কোথাকার? আবার সারা মহল্লায় রটিয়ে দিয়েছিস, আমার হাতের লেখা খারাপ, আমি ফারসি লিখতে পারি না, আমি শুধু সর্দির চিকিৎসা করি? য়্যাঁ? এক বাঙ্ সিভিট দিলাম তোকে, তার এই প্রতিদান? কৃতঘ্ন পামর!' শিবলি এবার ঘাবড়ে গিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বললো, 'কী করবো, আমার সর্দি সারে না তো!' জামান ভাই চিল চিৎকার দিয়ে বললেন, 'সর্দি হয়েছে তো হিস্টাসিন আর প্যারাসিটামল খেয়ে শুয়ে থাক না! বেশি নবাবি শিখেছিস, তাই না? পয়সা বেশি হয়ে গেছে তোর? সর্দি লেগেছে দেখে ডাক্তারের কাছে এসেছিস? যা, বেরো চোখের সামনে থেকে, ফাজিল কোথাকার! আর কোনদিন তোকে আমার চেম্বারের ধারেকাছে দেখলে এমন ফারসি ধোলাই লাগাবো যে ফরসা হয়ে যাবি! যা ভাগ!' শিবলি নাকের জল চোখের জল একাকার করে জামান ভাইয়ের চেম্বার থেকে বেরিয়ে আসে। 4. তবে ভাইসব, গল্প এখানেই শেষ নয়। শিবলির কল্যাণে এ পাড়ার সব কম্পাউন্ডারদের সর্দি লেগেছে।

ভয়ানক সর্দি। তারা গলায় মাফলার জড়িয়ে হ্যাঁচ্চো হ্যাঁচ্চো করছে। কারো কারো বুকে কফ জমে গেছে, খকখক করে খোনা সুরে কাশছে তারা। পাড়ায় ডাক্তার বলতে ঐ এক জামান ভাই, কিন্তু তার কাছে তারা যেতে নারাজ, কারণ প্রথমত, তার প্রেসক্রিপশন দেখে কিছু বোঝা যায় না। আর ফারসি প্রেসক্রিপশন তর্জমা করাতে হলে ছিদ্দিকুর রহমান সাহেবের কাছে যেতে হবে, ফেরদৌসি-খৈয়াম-রূমি শোনার সময় কিংবা দিলচসপী তাদের কারো নেই।

ছিদ্দিকুর রহমান সাহেব দরজায় আরেকটা ছিটকিনি লাগিয়ে নিয়েছেন। এমনিতেই তালেবানরা সার্টিফিকেট তর্জমা করানোর জন্যে তাঁকে উৎপাত করে মারে, শান্তিমতো ফেরদৌসি-খৈয়াম-রুমি নিয়ে গবেষণা করতে পারেন না, তার ওপর তিনি লোকমুখে শুনতে পেয়েছেন, পাড়ায় একটা সর্দির মহামারী লেগে গেছে, কোন রকম ঝুঁকি নিতে তিনি নারাজ। সেদিন এক হোঁৎকা সর্দিবাজ ছোকরা এসেছিলো, তাকে দেখেই সাবধান হয়ে গেছেন তিনি। আর জামান ভাইয়ের অবস্থা আরো খারাপ। না, সর্দি তার লাগে নি, তবে নাড়িভুঁড়ির জলছাপ আঁকা ডাক্তারি প্যাডের ওপর দিনরাত হাতের লেখা সুন্দর করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি।

একটা ফাজিল বখাটের জন্যে তার নামে অযথা দুর্নাম রটুক, এটা তিনি মোটেও চান না। আর সৈয়দ মুজতবা আলি? তিনি তো বলেই গেছেন, 'বেঁচে থাকো সর্দি কাশি, চিরজীবী হয়ে তুমি!'

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.