খুব গোলমেলে, নিজেও ভাল জানি না। তবে আছে,এই ঢের।
বাপ্পাদিত্য বন্দোপাধ্যায়ের সিনেমা 'কাঁটাতার'। সিনেমাটি দেখে এসে অব্দি মাথায় ঘুরছে, হাওয়া অফিস। সুধা।
রেহানা । পিরানী । একদিনে তিনটি জীবনের কাহিনী। কাঁটাতার। বেড়া।
আর বেড়া ডিঙানোর গল্পো তো নতুন নয়। নদী, শাখা বিস্তারের ডালপালা তাদের কাছে এই অতিক্রম কত অনায়েস আর প্রাচীন। এক ভূখন্ডকে ভাগ করে কে দুই দেশ বানায়? মাথার উপরে একই আকাশ । পায়ের তলার মাটিও এক । মাঝখানে কাঁটাতার ।
দুপাশে দুই দেশ। কাঁটাতার পেরিয়ে ওপারের মানুষ এপারে আসে, এপারের মানুষ ওপারে যায়। জীবিকার সন্ধানে । নামের সন্ধানে । পরিচয়ের সন্ধানে ।
আশ্রয়ের সন্ধানে ।
গ্রামের একপাশে নদী। সেখানে এক হাওয়া অফিস । অপরূপ নৈসর্গিক সৌন্দর্য । তার উপর যেন অপারেশনের দাগের মত পড়ে আছে কয়েক ছড়া কাঁটা তার ।
কত কষ্টে এই জীবনযাপন সীমান্তবর্তী পটাশপুরের। গাছেরা সব দাঁড়িয়ে বুকজলে । চলাচলের রাস্তাটি যেন সরু সিঁথিটির মত পড়ে থাকে প্লাবনের জলে । হাওয়ার দিক নির্ণয়ের কাজ করে বিনোদ । আছে এক সহকারী ।
যে বেলুনে গ্যাস ভরে আর উড়িয়ে দেয় আকাশে । বিনোদ কাগজে লিখে দেয় সেদিনকার বাতাসের গতিবেগ, ঝড়-বৃষ্টির পূর্বাভাস । সহকারীটি সেই কাগজ নিয়ে পোষ্ট অফিসে গিয়ে টেলিগ্রাম করে আসে শহরে । আসা যাওয়ার পথে সে দেখে জীবন । কোর্ট ।
সেখানে ঠিকানা বিহীন ছিন্নমূল নারী অনুনয় করে উকিলবাবুকে । উকিলবাবু উচ্চমূল্যে তাকে পরামর্শ দান করেন, সে যেন আগে নাম ঠিকানা যোগাড় করে আনে। ধর্ম ও । রোকসানা খাতুনের বদলে কোন হিন্দু নাম । যাতে করে রীশন কার্ড বানানো সহজ হবে ।
ভোটের ছবি তোলা যাবে। ওগুলো ছাড়া করে প্রমাণ হবে সে কে ? ঝড় ওঠে । তামাম পৃথিবীর দস্তাবেজ উড়ে বেড়ায় কোর্ট চত্ত্বরে । মুহুর্তের ঝড়ে সব একাকার ।
গ্রামের রাস্তায় মিলিটারি ট্রাকের কনভয় চলাচল করতে থাকে ।
ট্রাক চলাচলের উপযোগী রাস্তা চাই । পাথর ফাটিয়ে, বোল্ডার ভেঙে কর্কশ শব্দে তৈরী হতে থাকে রাস্তা । এক প্রবীন গ্রামবাসী তার অতি পূরাতন বন্দুকটির লাইসেন্স নবীকরণের জন্যে একের পর এক চিঠি লিখিয়ে যান পোষ্ট অফিসের সামনের টাইপিষ্টকে দিয়ে । টাইপিষ্ট বিরক্ত । কত চিঠি সে টাইপ করবে? কিন্তু বন্দুকের মালিকটি বিরক্ত নন।
তিনি কি পারিশ্রমিক দেন না? সব পুষিয়ে দেবেন তিনি । তার কাছে বরং কিছু প্রশ্নের উত্তর জানা অনেক জরুরী হয়ে পড়েছে । তিনি একের পর এক চিঠি টাইপ করিয়ে যান বিভিন্ন দপ্তরে দপ্তরে । অক্লান্ত ।
হাওয়া অফিসের শান্ত নিস্তরঙ্গ জীবনে একদিন এসে হাজির হয় সুধা ।
রান্না করে দেয় বিনোদ ও তার সহকারীর জন্যে । সহকারীটি ভয় পায়, রান্নার লোক রাখলে তো মাইনে দিতে হবে । তারা মাইনে কোথা থেকে দেবে? সুধা মাইনে চায়না । সুধা সুন্দরী । যৌবনবতী।
বিনোদ ক্রমশ জড়িয়ে যেতে থাকে সুধার সাথে শরীরী সম্পর্কে। সুধা নিশ্চিন্ত হয় । সে গল্প করে, তার তিনটি জীবন । সকালে একটি,দুপুরে একটি আর রাতে আরেকটি । ধর্মও তাই ।
নদীর পারে বিনোদ হাওয়ার গতি দেখে যন্ত্র ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে। সহকারী বেলুন ওড়ায় । বিনোদ কাগজে লিখে দেয় হাওয়ার গতিবেগ । সহকারী সাইকেলে চেপে গ্রামে যায় । পোষ্ট অফিস, কোর্টচত্তর ঘুরে আসে।
সেখানে মিথ্যা সাক্ষী দিয়ে মাঝে মাঝে কিছু উপরি মেলে তার । বোরখাপরা এক মহিলাকে কোমরে দড়ি বেঁধে টেনে নিয়ে আসে পুলিশ। তার কোলে শিশু। সে নাকি দেশের গোপন খবর পাচার করে কাঁটাতারের ওপারে । প্রশ্ন জাগে মনে, ঐ শিশুটির কি হবে? সে কি করে জেলে থাকবে ?
ট্রাকে চেপে গণিকারা আসে গ্রামে।
গ্রামে যে মিলিটারি এসেছে। তাদের শরীরের ক্ষিদে মেটাতে হলে যে মেয়ে চাই । এত মেয়ে আসবে কোথা থেকে? হাস্যে লাস্যে শরীর প্রদর্শন করতে করতে গ্রামে ঢোকে গণিকারা । হৈ চৈ এলাকা জুড়ে, সরগরম কোর্টরুম চত্ত্বর । বোল্ডার - মেশিন এখন আরও দ্রুত চলে ।
প্রবীন সেই গ্রামবাসী এবার টাইপিষ্টকে নিয়ে আসেন নদীতীরে । যেখানে বসে নিশ্চিন্তে চিঠি লেখানো যাবে কখনো প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে তো কখনো অর্থমন্ত্রীকে। টাইপিষ্ট যেহেতু টাকা পায় তাই অনিচ্ছা সত্বেও বসে বসে সকাল হতে সন্ধ্যে অব্দি চিঠি টাইপ করে। বিনোদ আর সুধার শরীরী প্রেম দেখে চঞ্চল হয় সহকারীটি । রাতে সে যায় গণিকালয়ে।
টাকার বিনিময়ে সে নারীসঙ্গ কিনতে যায়। কিন্তু মিলিটারি এসে পড়ায় তাকে ফিরে আসতে হয় । রাতের অন্ধকারে মিলিটারি হানা দেয় গ্রামে ঘরে । মেয়েরা দৌড়োয় সম্ভ্রম বাঁচাতে। পালিয়ে বাঁচতে চায় মিলিটারির হাত থেকে।
বুটের শব্দে রাতের নিস্থব্ধতাকে ভেঙে খানখান করে মিলিটারি তাড়া করে গ্রামের মেয়ে-বৌদেরকে। প্রবীন গ্রামবাসিটি তার অকেজো বন্দুক তাক করেন তার ঘুমন্ত বৌর মাথায় । হানাদারের কবলে পড়ার আগে তিনি নিজেই মেরে ফেলতে চান বৌকে। কিন্তু বন্দুক যে অকেজো । জং ধরানো ।
আওয়াজ করে কিন্তু গুলি বেরোয়না ।
উকিলবাবু হাওয়া অফিসে আসেন বিনোদের সহকারীকে ডাকার জন্যে, তাকে দিয়ে কোর্টে মিথ্যে সাক্ষী দেওয়াবেন তিনি । সুধাকে দেখে তিনি চিনতে পারেন । জিজ্ঞাসা করেন বিনোদ কোথায়? বিনোদকে না পেয়ে তিনি তার সহকারীকে বলে যান, ও সুধা নয়, ও রেহানা । ও পিরানী ।
ওর যতগুলো নাম ততগুলো ধর্ম । ভীত, সন্ত্রস্ত সুধা বিনোদকে শোনায় তার তিনটি জীবনের গল্প । এর পরের অংশ ফ্ল্যাশব্যাক । কিন্তু বাপ্পাদিত্য কি দেখাবেন, সহস্র যুগের প্রেম ভালোভাসার দর্পণ? কাঁটাতার তো তার জন্যে নয় । ছিল সে পিরানী ।
ক্ষিদে, অভাব তাকে নিয়ে যায় কোলিয়ারীতে । ছেলেবেলা থেকেই বিভিন্ন পুরুষের লালসার আঁচ পাওয়া পিরানী কোলিয়ারীতে কাজ করতে এসেই নজরে পড়ে ঠিকাদারের। ঠিকাদার স্বপ্ন দেখায়। ঘর বাঁধার। নিজের ঘরনী ও তিন সন্তানকে ফেলে ঠিকাদার পিরানীকে নিয়ে পালায় ।
এক পরিত্যাক্ত প্রাসাদের এক অংশে পিরানী তার গেরস্থালী সাজায় । ডগমগ পিরানী মহানন্দে বৃষ্টিতে ভেজে ছাদবিহীন সেই ঘরে । একদিন সেখানে আসে মজিদ। মতিবিবির খোঁজে। পিরানী জানায় মতিবিবিরা এখানে নেই, চলে গেছে অন্য কোথাও।
মজিদ টাকার বিনিময়ে একটি কাগজে মোড়ানো প্যাকেট রাখতে দেয় পিরানীকে। অভাবের সংসার চালাতে গিয়ে ইতিমধ্যেই ঠিকাদারের সাথে মনোমালিন্যে ব্যাতিব্যস্ত পিরানী টাকার লোভে মজিদের চোরাচালানের সঙ্গী হয়ে পড়ে। ঠিকাদার যখন বাড়িতে থাকেনা তখন আসে মজিদ। নিজের কথা বলে। প্যাকেট রাখে, নিয়ে যায়।
পিরানী টাকা পায় । এভাবে বেশিদিন চললনা। পিরানী ধরা পড়ে যায় ঠিকাদারের হাতে। পিরানী পালায় তার পুঁটুলিটি হাতে করে। মজিদ তাকে সাথে করে নিয়ে যায়।
সেও পিরানীর যৌবনে আকৃষ্ট ছিল । পিরানী নতুন নাম পায় । রেহানা । সে এখন রেহানা। এক বোরখা পরা মুসলিম নারী ।
মজিদ আর রেহানা দুজনে একসাথে কাজ করে। কাঁটাতারের ওপার থেকে প্যাকেট নিয়ে আসে । নিয়ে আসে বিদেশী টাকা । চড়াদামে বিক্রি কিরে এপারে । একদিন ধরা পড়ে যায় মজিদ।
বন্দি হয় জেলে । রেহানা বহু চেষ্টা করেও মজিদকে ছাড়াতে পারেনা জেল থেকে, যদিও মজিদ রেহানাকে আগেই বলেছিল, কোন জেলেই নাকি তাকে দু/তিন দিনের বেশি থাকতে হয়না । জামিন পেয়ে যায় । কিন্তু এবারে আর জামিন পেলনা । কারন মজিদের কেস কোর্টেই তুললনা থানার দারোগা ।
সে টাকা খেল, রেহানার যৌবন খেল, কিন্তু মজিদকে ছাড়লনা । একদিন মজিদকে কোথাও চালান করে দেওয়া হল কিন্তু থানার খাতায় মজিদের নাম এন্টি হ্লনা । রেহানা আবার পথে । আবার সে নিরাশ্রয় । পথ চলতে গিয়ে সে বহু পুরুষের লালসার শিকার হল।
কারও সাথে সে গেল, কারও সাথে গেলনা । হাঁটতে হাঁটতে সে পৌছুলো নদীর ধারের ঐ হাওয়া অফিসে।
এবার সে সুধা । লাল শাড়ি কুঁচিয়ে পরা । দু হাতে কাঁচের চুড়ি ।
বিহ্বল বিনোদ সুধাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। সুধা রাজী হয়না । সেখানে যে রেহানা এসে পড়বে । সুধার অতীত । বিনোদ সুধাকে অনুরোধ করে সে যেন না যায় ।
পরদিন সকালে মিলিটারি জিপ এসে দাঁড়ায় হাওয়া অফিসের পাশে । উর্দিপরা একটি লোক এসে জিজ্ঞাসা করে ছড়ি উঁচিয়ে, এই মেয়েটি কে? বিনোদ জবাব দেয়, ও সুধা । তাবুর ভেতর তল্লাশী চালিয়ে পাওয়া যায় একতাড়া বিদেশী টাকা। মিলিটারিরা নিশ্চিন্ত হয়, তাদের পাওয়া খবর সঠিক ছিল । সুধাকে জিপে বসিয়ে নিয়ে যায় তারা ।
যথারীতি বেলুন ওড়ে আকাশে, বিনোদের ইচ্ছের বাইরে ঘটে আবহাওয়ার সুক্ষ পরিবর্তন ।
বোরখা পরা একটি মেয়ে হেঁটে আসে কাঁটাতারের ওপার হতে । কাঁটাতার পেরিয়ে সে এপারে আসবে নাম,ঠিকানা ও কাজের সন্ধানে । এখানে কি শেষ হয় সিনেমাটা? খুব ভাল লেগেছে আবহ সঙ্গীত । যতবার সুধা,রেহানা, পিরানী এসেছে, গেছে কোথাও, মৃদু লয়ে বেজেছে, কোন বা দ্যাশে শে যাও গো কন্যা, কোন বাতাসে যাও ।
যতবার পিরানী, রেহানা, সুধা কোন পুরুষের কাছে আশ্রয়ের জন্যে গেছে ততবার বেজেছে, চাঁদবরনী কন্যারে তোমরা গোসল করাও রে ...। 'গোসল' একটা মানুষকে তিনবার দেওয়ানো হয় । একবার জন্মের পর । একবার বিয়ের সময় । আর একবার মৃত্যুর পর ।
অভিজিত বসুর কথা ও সুর মনকে ভারী করে তোলে । গোটা সিনেমায় আশ্চর্য সুন্দর সব প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখা যায় । খুব ভাল লেগেছে প্রবীন সেই গ্রামবাসীর চরিত্রে প্রদীপবাবুর অভিনয় । অসাধারণ অভিনয় করেছেন রুদ্রনীল । সহকারীর ভূমিকায় ।
শ্রীলেখা পারফেক্ট । পিরানীর রূপ-যৌবন যথার্থ ফুটে উঠেছে শ্রীলেখার মাঝে । উকিলবাবুর চরিত্রে নিমাই ঘোষ এককথায় অসাধারণ । 'কাঁটাতার' শুধু হলে বসে সোয়া দু ঘন্টায় দেখেই শেষ হয়ে যায়না । আর এখানেই বাপ্পাদিত্যবাবুর কৃতিত্ব ।
তার সিনেমা ভাবতে বাধ্য করে । ভাবায়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।