আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিদ্রোহী কাঁটাতার

সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ অ-কবি...

ওয়ার্নিং বেজে উঠতেই ছাত্র-ছাত্রীরা হুড়মুড় করে কাসে ঢুকছিল। সানজিদা কাসে ঢুকে তার প্রিয় বান্দবী ফোরা বন্দোপাধ্যায়কে দেখতে পেয়ে মুখে পরিধি বাড়ানো হাসি এনে বললো,আমি আগামী পরশু চলে যাচ্ছি!
চমকে মুখ তুলে বললো, কোথায় যাবি? কখন আসবি? একটানে প্রশ্নকরে বেঞ্চে বসতে বসতেই জানতে চাইলো ফোরা ! বান্দবীর দেখা পাওয়ার কারনে তার মুখটা যতটা না উজ্জল হয়েছিল তা আচানকই অন্ধকারে ছেয়ে গেল। ওর চাহনি যেন নেপথ্যে ঢেকে বলছিল, এ্যাই সানজিদা! তুমি বলো, কথাটা তুমি সত্যি সত্যি বলনি এমনিতে দুষ্টুমি করে বলেছ।
আমি বাংলাদেশে চলে যাচ্ছি! ঠিক সেই সময়েই স্যার হাজিরা খাতা সহ কাসে প্রবেশ করলেন। বাংলা পড়ান তিনি।

এই সত্য সাধন স্যার পড়া পারলে কাউকে কিছু বলেন না। তবে কেউ যদি হাজিরা ডাকার সময় কথা বলে তবে রা নেই। স্যারটা যেমন ভালো তেমনি রেগে গেলে প্রলয় ঘটিয়ে ছাড়েন। সেজন্য ছাত্র-ছাত্রীরা তার পিরিয়টে খুবই সুবোধ বনে যায়। এজন্য ফোরা সানজিদাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পায়নি।

‘আমি বাংলাদেশে চলে যাচ্ছি’ বারবার এ কথাটি ফোরার কানে গুঞ্জরিত হচ্ছে। ও শত চেষ্টা করেও কাসে মন দিতে পারছিল না। ফোরা বরবারের মতই কাসে ফাষ্ট হয়ে আসছে আর সানজিদা কখনো সেকেন্ড হয়,আর কখনো বা দীপাবলী মুখার্জী। ফোরা কাসে উপস্থিত অথচ মন অন্য জগতে বিচরণ করছে বিষয়টি সত্যসাধন স্যারের দৃষ্টি এড়াল না, ফোরাকে বাজিয়ে দেখতে স্যার তাকে ল্য করে বললেন, ফোরা তুমি বলোতো সমাস কত প্রকার? ফোরা প্রথমেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তারপর চট করে দাঁড়িয়ে বললো, ছয় প্রকার স্যার!
কি কি ?
১. দ্বন্দ সমাস, ২. কর্মধারয় সমাস ৩. তৎপুরুষ সমাস ৪. বহুব্রীহি সমাস ৫. দ্বিগু সমাস এবং ৬. অব্যয়ীভাব সমাস।
স্যার বসতে বললে ফোরা হাফ ছেড়ে বাঁচলো যেনো ! কারণ প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারলে তার লজ্জা পেতে হতো।

আর অমনযোগিতার জন্য তাঁর হেস্ত নেস্ত হতো।
৭ম শ্রেণীর ছাত্রী ফোরা বন্দোপাধ্যায় আর সানজিদা যেন একে অপরের জীবনের অংশ। একজন অপরজনকে একদিন না দেখলে যেন থাকতেই পারে না। একদিন একজন কাসে কোন কারনে অনুপস্থিত থাকলে ছুটির পরে অপরজন যেন একদম উড়ে গিয়ে তার খবর নেয়। যেই ছোটকাল থেকে তারা এই হাইস্কুলে পড়ে আসছে।

প্রথম শ্রেণী থেকে এই তারা একত্রে সাতসাতটি বৎসর একসাথে পড়া, খেলাধূলা। ফোরা সানজিদাকে তাদের পূজাপার্বনে দাওয়াত দেয় আর সানজিদা ও দুই ঈদ সহ শবে বরাতের সময় ওই এলাকার মুসলমান অধ্যুষিত এলাকায় যে মেলা জমে উঠে সেখানেও ফোরাকে দাওয়াত দেবার কথা কখনও ভুলে না। আজ হঠাৎ করে সানজিদার কথাটি কোনভাবে মন থেকে মুছতে পারছিল না। ফোরা মাস খানেক আগে সানজিদার মুখে শুনেছিল তার বাবা মা তার বিয়ে ঠিক করেছে আপন খালাতো ভায়ের সাথে। বিয়ে দেবে বাংলাদেশে নিয়ে।


বিষয়টি শোনার পর সানজিদার মার কাছে ফোরা ছুটে গিয়েছিল এবং নি:শ্বাস ছাড়তে ছাড়তে বলেছিল মাসিমা ! সত্যি নাকি আপনারা দেশে চলে যাচ্ছেন? সানজিদার বিয়ে দিবেন আপনাদের দেশে? সানজিদার আম্মু শাহানা বিজাতীয় মেয়েটির এ ব্যাকুল জিজ্ঞাসা দেখে অবাক হয়ে তার আকুল মাখা মুখের দিকে চেয়ে রইলেন। ভাবতে লাগলেন তার মেয়ের প্রতি এই মেয়েটির সীমাহীন ভালবাসা দেখে। এ্যাই মাসিমা ! কিছু বলছেন না যে, শাহানা সম্বিত গিরে পেয়ে বললেন, হ-মা ! তবে এখন শুধু সানজিদাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বিয়ে দেবার জন্য । আমরাওতো চলে যাবো। নিজেদের দেশ ছেড়ে চিরকালতো এখানে পড়ে থাকতে পারি না ! শত হলেও নিজের জন্মভূমি !
ওই দিনের শুনা কথা যে, এত সাততাড়াতাড়ি সত্য হয়ে তার কাছে ধরা দেবে যে, কোন ভাবেই ভাবতেই পারে নিনা সে ।

আর ভাবতে পারছে না। একদিন সানজিদা তাকে সুন্দর হাতের কাজ করা একটি রুমাল দেখাল। সে বলেছিল কিরে এটি আবার কার জন্য করেছিস ! ফোরা মুখে রাজ্যের লজ্জায় জড়তা এনে বলেছিল ওর জন্য, মানে! আরে আমার ওই খালাতো ভাইয়ের জন্য, যার সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে। মা বললেন আমি এসব পাড়ি তাই ওর জন্য করতে বললেন। বললে না তো কেমন হয়েছে? ফোরা খুব কষ্টে ঠোটে হাসি এনে বললো যাহ বাব্বা অনেক সুন্দর হয়েছে ! দেখতে হবে না কে করেছে ! তোর বর এটা পেলে একদম বর্তে যাবে।

যদিও সে তার বলাটা আনন্দিত গলায় বলতে পেরেছে, কিন্তু তার বুকটা একদম ফেটে যাচ্ছিল, সানজিদাদের চলে যাওয়ার কথাটা উঠলে তার মনটা কেমন করে উঠে। সানজিদা তার কথা শুনে মুখ লজ্জায় লাল করে বলেছিল, যাহ ! তুই খুব দুষ্ট হয়ে গেছিস ! খুব ধৈর্য্যের বাতি হয়ে শেষ পিরিয়ড শেষ করে কাস থেকে বেরিয়ে এলো ওরা। পেছন থেকে মুখে শুকনো হাসি টেনে ফোরার কাঁধে হাত রাখতেই সানজিদা বললো, এ্যাই ফোরা ! মা তোকে আমাদের বাড়িতে যেতে বলেছে। ফোরার মাথা কাত করে সায় দিল। মুখের অবস্থা দেখে ফোরার মনের অবস্থা আচ করতে পেরেছিল সানজিদা।

সে চিন্তা করতে লাগলো। কি আর করা যাবে, যেতে যখন হবে তখন দুই একদিন আগ পাছ এমনিতেই জানাতে হতো। এখন রাখ ঢাক করে কি লাভ; তার কি কম কষ্ট হচ্ছে। দীর্ঘ জীবনের তার এই পরিচিত স্থানটা ছেড়ে যেতে হচ্ছে, জন্মের পর থেকে এই এতটুকু বড় হওয়ার পর থেকে এই স্কুলের শ্রদ্ধেয় স্যারদের এবং বন্ধু-বান্ধবদের থেকে তাকে আলাদা হয়ে যেতে হবে। ভাবতে ভাবতে তার বুক ফেটে কান্না বেরিয়ে আসতে চাইছিলো।

ফোরার কথা চিন্তা করে নিজেকে খুব কষ্টে নিবৃত্ত করলো। এমনিতে ওর মনের অবস্থা যা। সানজিদা ফোরা হাত টেনে ধরে তাদের বাড়ির পিচঢালা পথের দিকে এগিয়ে গেল।
সানজিদা পাঁচ ভাই বোনের মধ্যে সবার বড়। বাবার নাম শরাফত আলী।

সানজিদা তার বাবা এবং শাহানা অনেক অনেক আদরের সন্তান। তার কারণ সানজিদার আগে তাদের দুটি সন্তান জন্ম হয়ে মারা যায়। সানজিদার প্রতি ভালবাসাটা অন্য সন্তানদের থেকে একটু বেশি। আর ওই স্নেহের কারনে মেয়ের সুখ দু:খ ভালোলাগা চাহিদার দিকে খবর রাখেন মাবাবা। সানজিদার বাবা শরাফত আলীর আদি নিবাস বাংলাদেশে।

জনাব শরাফত আলীর বাবা হাফেজ আলীর মৃত্যুর পর প্রায় দশ বৎসর বয়সে অভাবের তাড়নায় কাজের আশায় ভারতের জলাপাইগুড়ি গিয়েছিলেন। ওই সময় সীমান্তে কাটাতারের বেড়া ছিল না। ফলে ভারতীয়রা বাংলাদেশে এবং বাংলাদেশীরা ভারতে যেত অবাধে। কাজ করতে গিয়ে ভারতের আলীপুরে সানজিদার মা শাহানার সঙ্গে পরিচয় হয় শরাফত আলীর। গ্রামের পাশের দণি রামখানা।

বানারবিটার বাসিন্দা হওয়ায় শাহানার সঙ্গে বিয়ে হয় শরাফত আলীর। দুই মেয়ে সন্তান জন্ম নিলেও কিছুদিন পর মারা যায়। দুই সন্তানের মৃত্যুর পর স্বামী-স্ত্রী দুজনে আলীপুর ছেড়ে আসার পর এই গল্পের গোয়ালপাড়া জেলার নিউ বংগাইগাঁও জলপাইগুড়িতে চলে আসার পর সানজিদার জন্ম হয়। পরে আরো চায় সন্তানের জন্ম হয়। এক মুদির দোকান দিয়ে সানজিদার নানী সহ তাদের পরিবারের ৮সদস্যের সুখের সংসার।

জনাব শরাফত আলী অর্থনৈতিকভাবে কিছুটা স্বচ্ছল হলে তিনি দেশে ফিরে যাবেন এই আশায় তারা আসামের নাগরিকত্বের সুযোগ ফেলেও তা গ্রহণ করেননি। তিনি দেশে ফিরে আসবেন বলে বাংলাদেশের ভোটার হন। জাতীয় পরিচয় পত্রও নেন। সানজিদা বড় হওয়ায় তাকে বাংলাদেশে বিয়ে দেবেন এই পরিকল্পনা ছিল তাদের। সানজিদার নানী হাজেরা বিবির আপন বড় বোন লালমনিরহাট জেলার কুলাঘাট ইউনিয়নের চরকুলাঘাট গ্রামের ইদ্রিস আলীর ও আনজিদা বেগমের বড় ছেলে আমজাদ হোসেনের সঙ্গে বিয়ে ঠিক করতে হয় সানজিদার।

ফাল্গুন মাসে শরাফত আলী বাংলাদেশের লালমনিরহাট গিয়ে আমজাদ হোসেনের মায়ের সঙ্গে ২০১০ এর ৯ জানুয়ারী বিয়ের দিন ধার্য হয়। বাবা শরাফত আলী মেয়েকে বাংলাদেশে বিয়ে দেওয়ার কথা ভাবলেও এত সাততাড়াতাড়ি দেবার পরিকল্পনা তার কোন কালেই ছিলনা। ইচ্ছে ছিল মেয়েকে কম করেও হলেও বারো কাস পড়িয়ে তবেই বিয়ে দেবেন। কারণ লেখা পড়ার শেষ করার আগেই মেয়ের বিয়ে দিলে নিম্ন বা মধ্যবিত্ত পরিবারের তখন বেশির ভাগ মেয়েদের লেখা পড়ার ইতি ঘটে স্বামীর বাড়ি সামাল দেওয়ার কারনে। কিন্তু সানজিদার নানী এবং ছেলে প থেকে তাকে বাংলাদেশে নিয়ে গিয়ে বিয়ের পর বারো কাস পড়ানোর প্রতিশ্র“তি দিলে তবেই তিনি এ বিয়েতে রাজী হন।

পরিবারে পরামর্শ হয় যে, যেহেতু ৯তারিখ বিয়ে তাই ছয় তারিখ সকালেই শরাফত আলী মেয়েকে নিয়ে রওয়ানা হয়ে যাবেন। পরিবারের অন্য সদস্যরা বর্ডার পার হবার জটিলতার কারনে অন্য সময় তাদের অনুপস্থিতি পুষিয়ে দেবেন। সানজিদার ছোট ভাই বোনেরাও বোনের বিয়েতে যাবারা বায়না ধরলে অবস্থাভেদে তাদের আবদার রা করতে পারেননি বলে শরাফত আলী নিজেরও কষ্ট হচ্ছিল। পরিবারের বড় মেয়ের বিয়ে হচ্ছে অথচ সকলে সেখানে যেতে পারছে না। তিনি সন্তানদের প্রবোধ দিলেন এই বলে পরে তাদের সকলকে নিয়ে যাবেন।

তিনি সানজিদাকে সকলের কাছ থেকে বিদায় এবং মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিতে বললেন। সানজিদা সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে শেষবারের মতো বিদায় চাইতে ফোরাদের বাড়িতে গিয়ে বলতেই ফোরার বাবা মাও সানজিদাকে বিদায় দিতে গিয়ে চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি। কারণ তাদের মেয়েটি সানজিদার কারনেই আনন্দিত এবং চটপটে দেখা যায়। সানজিদাকে না দেখলে কেমন যেন মিইয়ে যায়। এই মেয়ে চলে গেলে তার মেয়ের কি হবে? কঠিন বাস্তবতাকে আর অস্বীকার করা যায় ! বাড়ির সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যখন ফোরার কাছে যায় তখন তাকে জড়িয়ে ধরে সে ফুপিয়ে কাঁদা আর কিছু বলতে পারে নাই।

বাড়ি থেকে বের হয়ে যখন সানজিদা রাস্তায় উঠে এল। তখন সূর্য তার অগ্নিবর্ষনকারী ডাইনী রূপটাকে ঝোলাতে পুরে রক্ত জবার মতো লালিমা ছাড়িয়ে পৃথিবী বাসী থেকে খুবই বিষন্ন মনে বিদায় নিচ্ছে। খানিক পড় সাদা ধোয়াটের মত কুয়াশা সমগ্র এলাকায় তার আস্তরণ ফেলবে। দূরের ভুঠান পাহাড়ের চূড়া হতে হিমশীতল শীতরা ডানা মেলে এই এলাকার আশে পাশে নেমে আসবে। সানজিদার দূরত্ব ফোরাদের বাড়িতে থেকে যত বাড়ছিল ততই তার বুকের ভিতর কষ্ট মোচড় দিয়ে উঠলো, হঠাৎ দূরে দুইটি ছেলেকে আসতে দেখে অতি কষ্টে সে কান্না লোকাল।


৬ জানুয়ারী সকাল। সূর্যি মামা ফোকলা দাঁতে হাসতে হাসতে পূর্ব আকাশে তার রুপের ঢালি মেলে ধরা ঠাহর করতে পেরে কুয়াশার আচানকই মিলিয়ে যেতে শুরু করলো। শীতেরাও বাক্স-পেটারা নিয়ে এলাকা ছাড়ছিল। সানজিদা খালি পায়ে সকালের শিশির ভেজা ঘাস মাড়াতে মাড়াতে ভাবছিল ইস ! সেকি আর সকাল বেলা এখানে এসে আর এভাবে খালিপায়ে হাটতে পারবে না। গতবছরে লাগানো তার পেয়ারা গাছটার কোন খোঁজ-খবর নিতে পারবে না, পানি দিতে পারবে না সেই লিচু গাছটায়।

গত বৎসর যে গাছটায় লিচু এসেছিল এবারতো আরো বেশি করে আসবে। লাউগাছের মতো লকলকে উঠা ডগায় ছেয়ে গেছে আঙ্গুরের মাচাটা। ভাবতে ভাবতে তার চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসছিল। গতকালের কষ্টটা ভিতরে যেন আবারো পাক দিয়ে উঠলো। সানজিদা, এ্যাই সানজিদা ! মা এদিকে আয়, তোর বাবা তাড়াতাড়ি রেডি বললো।

মার কন্ঠস্বরে সে তাড়াতাড়ি চোখ মুছে ঘরের দিকে পা বাড়াল। ঘড়ির কাটা তখন সকাল এগারটার ঘর ছুঁই ছুঁই। সানজিদা এবং তার বাবা শরাফত আলী সফরের সামানা নিয়ে প্রস্তুত, এ্যাই তো বের হলো বলে; আশে পাশের মেয়ে ছেলেরা ও তাদের বিদায় জানাতে জড়ো হল। সানজিদা সকলের কাছ থেকে অশ্র“সজল নয়নে শেষ বারের মতো বিদায় নিলো। হঠাৎ করে একপাশে ফোরাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো বোবাকান্নায় জড়িয়ে ধরালো বান্দবীকে।

ফোঁপানো কান্না ছাড়া আর কোন কথা বলতে পারলো না সে। মা শাহানারা যাবার জন্য তাকিদ দিতেই বান্ধবী থেকে পৃথক হয়ে চোখ মুছতে মুছতে বাবার সঙ্গে এগোল। সানজিদাকে আজ সাাৎ রাজকুমারীর মাতা মনে হচ্ছে, তার মা শাহানা তাকে নিজ হাতে সাজিয়ে দিলেন। পরিয়ে দেন হাতে গলায়, কানে, নাকে ও পায়ে স্বর্ণও রূপার অলংকার। মায়ের নির্দেশে হবু স্বামীর জন্য সানজিদা তার হাতের করা রুমাল, কিছু উহার সামগ্রী নিতে ভুললো না।

শাহানাও তাদের জন্য দুটি আংটি, একটি চেইনসহ মেয়ের হাত খরচের বাবদ ১৯ হাজার রূপি দেন সঙ্গে। আসাম থেকে দীর্ঘ ৮ঘন্টার পথ পাড়ি দিয়ে বাবা মেয়ে রাত আটটার দিকে আসাম থেকে চৌধুরী হাট বাসস্ট্যান্ডে পৌছলে ভারতীয় চৌধুরীহাট খেতাবের কুটি সীমান্তবর্তী গ্রামের হোসনের ছেলে দালাল মোশাররফ হোসেন ও দালাল বুর্জত আলী সহ ৩/৪জন তাদের পিছু নেয়। দালালরা তাদের কাঁটাতারের বেড়া পার করে দেবার জন্য ৩হাজার টাকায় চুক্তি করে। মেয়ের কোন তি হবে না শর্তে তিনি তাদের চুক্তি মতো টাকা পরিশোধ করেন।
রাত ৯টায়।

চারপাশ ঘুটঘুটে নিকষ কালো আঁধারে ঠাসা। সমস্ত এলাকা যেন কয়লার চেয়ে আরো বেশি কালো চাদর শরীরে চাপিয়ে নিয়েছে। দালালদের সঙ্গে চলতে সানজিদা কিছু দেখতে পাচ্ছিলেন। সারাদিন একটু বাবা মেয়ে একটু বিশ্রাম সুযোগ পায়নি। সানজিদার কোমল দেহ কান্তিতে নেতিয়ে আসছিল।

ঘুমেরা একজোট হয়ে তার চোখে হামলে পড়ছিল। শরাফত আলী তার মেয়েকে কান্তিতে পা ফেলতে দেখে বললেন এ্যাইতো মা ! কিছুণ পর আমরা বর্ডার পার হবো, তখন তুমি ইচ্ছে মতো ঘুমুতে পারবে। সানজিদা মুখে হাসি এনে বললো না বাবা আমার কোন সমস্যা হচ্ছে না। দালাল মোশারফ তাদেরকে নিজবাড়িতে নিয়ে এসে সীমান্তে পার করে দেবার অজুহাতে রাত ৩/৪টা পর্যন্ত এ বাড়ি ওবাড়ি ঘোরালো। এতো টানাহিঁচড়ার ফলে সানজিদার অবস্থা যাচ্ছে তাই হয়ে এলো।

কিন্তু এইতো একটু পর পার হয়ে খুব ভালো করে বিশ্রাম নিতে পারবে এই আশায় সে নিজেকে শক্ত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছিলো। নির্ঘুম রাত কাটানো সানজিদা এবং তার বাবাকে ৭জানুয়ারী ভোর রাতে ফজরের আযানের সময় ফুলবাড়ী অন্তপুর হাজিটারী সীমান্তের আন্তর্জাতিক পিলার ৯৪৭/৩ এস- এর পাশে ভারতের অভ্যন্তরে চৌধুরী হাট খেতাবের খুটি এলাকায় নিয়ে আসে দালালরা। ওই এলাকার কাটাতারের তিন স্তরের বেড়া পাড় হতে বাঁশের তৈরী ৩টি মই লাগানো হয়। প্রথমে শরাফত আলী পার হলেন, তারপর মেয়ে পার হওয়ার সময় ২/৩ জন বিএসএফকে তাদের দিকে আসতে দেখে মেয়েকে তাড়াতাড়ি পার হতে জোড় তাগাদা দিতে লাগলেন। ততণে সানজিদা বেড়ার মাঝ খানটায় এসে গেল।

শরাফত আলী ডেকে যাচ্ছেন তাড়াতাড়ি পার হতে। অত্যাধিক দূর্বল হওয়ার কারনে সে নিজের ভারসাম্য ঠিক রাখার প্রাণপন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ পা ফসকে সানজিদা আর্তনাদ তুলে ভারতীয় ভূ-খন্ডে পড়ে গেল। শরাফত আলী সানজিদাকে তাড়াতাড়ি আবারো মইয়ে উঠার জন্য বলতে লাগলো। কিন্তু সানজিদা নিজেকে সামলে উঠার আগেই বিএসএফরা তাকে ধরে ফেলে আর তার বাবাকে ভয় দেখানোর জন্য কয়েকবার ফাঁকা ফায়ার করে।


হিন্দুত্ববাদী জানোয়ারগুলো সানজিদাকে পাঁজাকোলা করে পার্শ্ববর্তী সরিষা খেতে নিয়ে গেল। দস্যুগুলো প্রথমেই তার শরীরের অলংকারগুলো লুঠে নেয়। সানজিদার চিৎকার তাদের পাষন্ডতায় কোন ক্রিয়া করছিলনা। তার প্রাণভিায় মহাপাপী ইবলিসের প্রাণ গলে যাবে, কিন্তু গলেনি ভারতীয় সীমান্তবর্তী ডাকাত কুত্তাদের, সানজিদা বলছিল আমার সব নিয়েছ এবার আমাকে ছেড়ে দাও! তোমাদের ভগবানের দোহাই আমাকে ছেড়ে দাও। বিএসএফ শয়তানগুলো অশ্লীল খিস্তিখেউড় করে কোমল দেহলতার অসভ্য কুকুরের মতো হামলে পড়লো।

সানজিদার জিগর পাটা আর্তনাদ রাতের নিস্তব্দতাকে ভেঙ্গে খান খান করে গোটা সীমান্ত এলাকা কাঁপিয়ে দিল। এ চিৎকারে সানজিদা জ্ঞান হারালো। তার অচেতন দেহে রাতভর পাশবিক নির্যাতন করার পর মানুষরূপী ভারতীয় কুত্তাগুলো সানজিদার উপর ফায়ার করলে,বারকয়েক ধাপাধাপপি করে চিরদিনের জন্য স্তব্দ হয়ে গেল সেই চপলা-চঞ্চলা মেয়েটি।
৮ জানুয়ারী সকাল ১০টা। চৌধুরী হাট খেতাবের খুটি সীমান্তের কাঁটাতারের কাছে আজ যেন লোকদের ঢল নেমেছে।

এলাকার সকল লোক এই জায়গায় সমবেত হয়েছে। ভোর ৫টা থেকে এখনো ঝুলছে সানজিদার লাশ। হায়েনারা নিজেদের পাপ ঢাকতেই সানজিদার লাশ কাঁটাতারে ঝুলিয়ে রেখেছে। ভারতীয় সীমান্ত রীদের জুলুম নির্যাতনে, নিষ্পেশনে লোকজনের চোখমুখ যেন বোবা হয়ে গিয়েছিল। কেউ বা প্রতিশোধ স্পৃহায় ক্রোধে ফাটছিল।

গোটা প্রকৃতি যেন নীরব হয়ে বিএসএফের নৃশংসতা দেখতে দেখতে ভিতরে জমে থাকা ােভ পুরো হয়ে আজ যেন তা ডিনামাইট রূপ লাভ করে বিস্ফোরণ ঘটাতে চাচ্ছে। ঝলমলে রোদের সূর্য যেন আপন কর্তব্য ভুলে মানুষ রূপী ভারতীয় হায়েনাদের নিমর্মতার নিস্ক্রিয় হয়ে আছে। কাঁটাতারের যেন আজ সহ্য সীমা ছাড়িয়ে গেছে; বিদ্রোহী মুখ করে নেপথ্যে আহবান করে যাচ্ছে সকলকে এই বর্বরতার কড়া গন্ডায় প্রতিশোধ নিতে।
মেয়েকে ধরে নেওয়ার পর বেহুশ শরাফত আলী চেতনা ফিরে পেয়ে মাতম করতে করতে তিনি সীমান্তের কাঁটাতারের কাছে পৌছলে কাঁটাতারের কাছে দাঁড়ানো লোকজন চমকে সেদিকে তাকাল। শরাফত আলী আবারও বুকফাটা আর্তনাদ করে চেতনা হারালেন।


[৭ জানুয়ারী বর্ডারে নিহত ফেলানী খাতুনের জীবনের ছায়া অবলম্বনে রচিত]

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।