'... আমাদের আশার কোনো পরকাল নাই'
গত একবছর ধরে প্রতিদিনই মা জুয়েলের আর্তচিৎকার শুনেছেন। নির্ঘুম রাতগুলো কেটেছে সন্তানের কাতর আর্তনাদের ধ্বনিগুলো কানে বাজতে বাজতে। কখনো বুকের ভেতরটা দুমড়ে-মুচড়ে একাকার হয়ে গেছে। কখনো ডুকরে কেঁদে উঠেছেন। বুকফাটা আর্তনাদে বাতাস ভারি করেছেন।
জুয়েল ফেরেনি। জানেন, আর কখনো ফিরবে না আদরের এই সন্তান। আজকের এই দিনে, গত বছর এই 29 নভেম্বরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সোহরাওয়াদর্ী হলে চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানানোর কারণে ছাত্রশিবিরের ক্যাডাররা জুয়েলকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হাত-পা ভেঙে দিয়েছিলো। দীর্ঘ 7 মাস ধরে অসুস্থ থাকার পর শেষপর্যন্ত এ বছরের 4 জুলাই জুয়েল মারা যায়। যতদিন বাঁচবেন জুয়েলের মা'র বুকে তাই আজকের এই দিনটি শেল হয়েই বিধবে প্রতিবছর।
তার পুরো নাম শাইন ইসলাম জুয়েল। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব বিজ্ঞান ও তথ্য ব্যবস্থা বিভাগের চতুর্থ বর্ষ অষ্টম সেমিস্টারের ছাত্র ছিলো সে। বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার দেওয়ান জায়গীর গ্রামে। শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলের 314 নং কক্ষে থাকতো। হলের শিবির কর্মীরা প্রায়ই তার কাছ থেকে 'এয়ানতের' নামে চাঁদা নিতো।
2005 সালের নভেম্বরে জুয়েল একটি কম্পিউটার কেনে। সে সময় সোহরাওয়ার্দী হল শাখা শিবিরের সেক্রেটারি হেলাল শিবিরের কেন্দ্রীয় সদস্য সম্মেলনের নামে জুয়েলের কাছ থেকে এক হাজার টাকা চাঁদা দাবি করে। জুয়েল এ টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে হেলালের নেতৃত্বে একদল শিবির ক্যাডার ওই বছরের 29 নভেম্বর রাত সাড়ে 10 টার দিকে তাকে হলের 324 নম্বর রুমে (এই রুমটি শিবির ক্যাডার আলতাফের) ধরে নিয়ে যায়। সেখানে শিবির ক্যাডাররা লোহার রড, হাতুড়ি, ছেনি দিয়ে জুয়েলকে বেধড়ক পেটায়। শিবির ক্যাডারদের অমানসিক এই নিযর্াতনে জুয়েলের সারা শরীরে তের সৃষ্টি হয়।
ঘটনার পর আতঙ্কিত জুয়েল পুরো ঘটনা চেপে রেখেছিলেন। সংবাদপত্রে ছোট করে খবর প্রকাশিত হলেও পরিবারের সদস্যদের কাছে এ ঘটনা আড়ালেই থেকে যায়।
জুয়েলের মা শামীমা আক্তার জানান, পরিবারকে না জানিয়ে জুয়েল নিজেই চিকিৎসা নেয়। কিন্তু পায়ের ক্ষত আর সারে না। কয়েক মাস পরে পায়ের ক্ষত আরো মারাত্মক আকার ধারণ করে শরীরের অন্যান্য স্থানে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলে সে বিষয়টি বাড়িতে জানায়।
এক পর্যায়ে জুয়েলের পরিবার ঘটনা জানার পর উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকায় নিয়ে যায়। সেখানে চিকিৎসকরা জানায়, পায়ের ক্ষত থেকে জুয়েল ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছে। জুয়েলের বাবা নজরুল ইসলাম সেন্টু জানান, তারা অনেক কষ্টে অর্থ জুগিয়ে তাকে উন্নততর চিকিৎসার জন্য ভারতের কলকাতার ঠাকুরপুকুরে নিয়ে যান। কিন্তু সেখানে চিকিৎসকরা জানিয়ে দেন, আর বেশি আশা নেই। চিকিৎসকরা আরো জানান, প্রচণ্ড নির্যাতনে সৃষ্ট ক্ষতগুলোর যথাসময়ে যথাযথ চিকিৎসা না হবার কারণেই তাকে ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে হয়েছে।
পরে তাকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। শেষ ভরসা হিসেবে সর্বস্ব দিয়ে তারা জুয়েলকে ঢাকায় নিয়ে কেমোথেরাপিও দেন। কিন্তু শেষ রক্ষা আর হয়নি। 4 জুলাই জুয়েল পৃথিবীর মায়া ছাড়ে।
জুয়েলের মা স্কুল শিক্ষিকা শামীমা আক্তার এ বছরের 11 আগস্ট চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ প্রেসকাবে এক সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেন, 29 নভেম্বর জুয়েলকে পেটানোর সঙ্গে জড়িত ছিলো শিবির সোহরাওয়াদর্ী হল শাখার সভাপতি (তখন সাধারণ সম্পাদক) হেলাল, আলতাফ, মুসলিম, আরিফ, জুয়েল ও মাসুম।
কিন্তু জুয়েলের পরিবারের প থেকে তার মৃতু্যর ঘটনায় কোনো মামলা দায়ের করা হয়নি। জুয়েলের মা জানান, তার এক মেয়ে থাকেন রাজশাহীতে। বারবার হুমকি এসেছে, তারা এ ব্যাপারে আইনি পদপে নিলে তারও সমস্যা হতে পারে। এই আতঙ্কেই পুত্র হারানোর শোক বুকে চেপে জুয়েলের বাবা-মা মামলায় যাননি। তার মা জানান, তিনি জুয়েলের বন্ধুদের কাছ থেকে শুনেছেন, যখন তাকে শিবির ক্যাডাররা পিটিয়ে ফেলে রেখে চলে যায়, তখন জুয়েল 'মা, মা' বলে ডাকছিলো।
তার সেই ডাক এখনো চোখ বন্ধ করলে শুনতে পান শামীমা আক্তার। আজ যখন আবার সেই দিন ফিরে এসেছে বছর ঘুরে তখন জুয়েলের মায়ের একটিই প্রশ্ন, ক্ষমতার দাপটে শিবির যেভাবে তার সন্তানকে মেরেছে- এই কি তাদের ইসলামের নীতি? এর কোনো বিচার কি কখনো হবে না?
আজকের সমকালে সম্পাদনা করে নিউজটি ছাপা হয়েছে
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।