আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বেঁচে রইবো, দহনের নেশায়...

মানুষ তার আশার সমান বড়...

গত কিছুদিন ধরে বিকেলে দাদী এসে ঘুম ভাঙ্গাচ্ছে; কিযে উৎপাত...? কলেজ ছুটির পর রাজ্যের ঘুম দুচোখে বাসা বাঁধে। ব্যাগটা শূন্যে আর গায়ের শার্ট আলনায় ছুঁড়ে যেই বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দেই অমনি ঘুম আর ঘুম। পৃথিবীর আর কোনো কিছুর অস্তিত্বের কথা মনে থাকেনা তখন। পাঁচ মিনিট যেতে না যেতে একটাই বাক্য ইদানিং শুনতে হচ্ছে- "অবেলায় ঘুমাস কেন? ওঠ ভাত খাবি"। খুব কষ্ট করে শুনা লাগে।

কাঁচা ঘুম থেকে জেগে প্রথম যে প্রশ্নটা মাথায় আসে সেটা হলো- "এই বিষন্ন বিকেলে যন্ত্রণাটা ছাদে এলো কেমনে? তাও ভাত খেতে ডাকছে! কি আশ্চায্য..." আমি ঢুলুঢুলু রক্তিম চোখটা মেলে কোনমতে বলি, "যান আসছি দশ মিনিট পর"। "না এখনি ওঠ" বলে তিনি তড়িগড়ি করে ফ্যান আর পিসি'র সুইচ বন্ধ করে দেন। কাজটি করে তিনি যে মহা খুশি সেটা গম্ভির চেহারা দিয়ে ঢেকে ফেলার চেষ্টাও করেন। কিন্তু চোখ সত্যি কথা বলে। আমাকে উঠতেই হয়।

তারপর নিজে নিজে সবকিছু বেড়ে দেন। পাতে তরকারি দেন, গ্লাসে পানি ঢেলে দেন। বুড়ি ইদানিং খুব যত্ন নিচ্ছে আমার! মরার সময় এসেছে বোধহয়! শুনেছি মরার সময় আসলে মানুষ নাকি ভালো হয়ে যায়! চাকরী ছেড়ে দিয়েছি, সেটা বলেছি। তিনি চেহারার এখানে-সেখানে আঁকা-বাঁকা দাগ ফেলে, চোখ দুটো ছোট ছোট করে বলেন- "রুম ভাড়া আর টেলিফোন বিল দিবি কেমনে?" আমার হঠাৎ তার সাথে মজা করতে খুব খুব খুব ইচ্ছে করে। বহুদিন তার সাথে খোলামেলা আলাপ করিনি।

সব সময় তাকে এড়িয়ে থেকেছি। আজ বোধহয় তাকে কিছুটা আপন মনে হলো; খাওয়া থামিয়ে বলি- "দিতে পারবো বলেতো মনে হচ্ছেনা... বলেন কিভাবে আপনাকে দেই, চাকরীতো নাই? কলেজের সেমিষ্টার ফি'টাও বাকী...। তবে আপনি সব মিলিয়ে যদি 1200 টাকা নেন তবে দিতে পারি। " তিনি হেঁটে উল্টো দিকে গেলেন। বললেন, "দেখ আমাকে ঠকাস না... আমাকেওতো চলতে হয়...।

" অকারনে আমার মাথায় হঠাৎ রাগ চড়ে যায়। ইদানিং আমার এ সমস্যাটা হচ্ছে, বাসে, রাস্তা-ঘাটে, এখানে-সেখানে আমার অকারনে মানুষকে ঝার দিতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে কাউকে বেদম পিটিয়ে নিজেও বেদম পিটুনি খাই। তবেই হয়তো আমার কিছুটা ভালো লাগবে। কোনোমতে নিজেকে সামলে বলি, "আমার টাকায় আপনি চলেন নাকি? আরো অনেকেইতো এই বাড়ীতে থাকে তাদের কাছ থেকে নেন না কেন?" তিনি শুনে কপালে ভাঁজ ফেলেন।

কিছুক্ষন চুপ থেকে অবশেষে মুখ খোলেন, যেন সাংঘাতিক গুরুগম্ভির কোন কথা বলবেন এমন ভাব নিয়ে বলেন- "দেখ আমাকে ঠকাস না; আমি বুড়ো মানুষ... আমাকেওতো চলতে হবে...। " পড়ন্ত বিকেলের শেষে আবিদকে কাছে পেলাম। এটাকেও এতদিন মিস করেছি। অনেক বদলে গেলেও আমাকে দেখে তার চোখ পিটপিট করা অদ্ভুতুড়ে সেই রোমাঞ্চকর দৃষ্টি নিক্ষেপ সে ভোলেনি। এক দৌড়ে এসে কোলে উঠে আমাকে জড়িয়ে ধরেছে।

অনেক পেকে গেছে। অথচ এইতো সেইদিনইতো ছিল এটুকুন পিচকি! আজ কত সুন্দর করে হাঁটছে, দৌড়োচ্ছে, পাকনা পাকনা কথা বলছে। অবাক লাগে। 'ভাইয়্যা আমি অনেক বড় হব, তোমার মত' 'তাই নাকিরে?' 'হুম' তারপর সেই অদ্ভুত দৃষ্টি মেলে চোখ পিটপিট করে চেয়ে থাকা। 'ওরে পাকনু তোকে বড় হতে কে বলেছে?' 'কেউ বলেনি; আমি বলো হব, তোমার মত' 'বড় হওয়া ভালো না।

' 'কেনো ভালোনা?' 'বড়তে অনেক কষ্ট' 'কষ্ট কি ভাইয়্যা?' 'কষ্ট হচ্ছে- দুঃখ। তুই পড়ে গেলে দুঃখ পাসনা, অমন দুঃখ, তবে সেটা দেখা যায়না' 'কেন দেখা যায়না' 'দেখানো নিষেধ তাই' 'নিষেধ কেন?' 'বেশি প্রশ্ন করতে নেই' ও চুপ হয়ে যায়। ঘাড়ে মাথা রেখে আমাকে জড়িয়ে রয়েছে চুপটি করে। আমি হেঁটে চলি ছাদের এপাশ থেকে ওপাশ। আমার জীবনের এক পাশে আঁধার, অন্যপাশেও ঠিক তাই।

মাঝখানের অথই নিকোশ নোনা পথ ধরে ধীর পাঁয়ে হেঁটে চলেছি। গন্তব্যগুলোয় অনেক...অ-নে-ক ব্যারিকেড। আমাকে থামতে হয়, প্রমাণ দিতে হয় কে আমি? তারপর আবার কিছুটা অনুপথ, পাহাড়সম বাঁধা। আমার পথচলাটা বড় একঘেয়ে, কখনো কখনো অন্যের প্রতি নির্ভরশীল, পরজীবির মত। কখনো কখনো ছন্নছাড়া।

আত্মহননের কথা কতবার ভেবেছি... কতবার...! কাপুরুষ হয়তো। বেঁচে আছি। বেঁচে আছি অনেকের ভালোবাসা ফেরত দেবার আশায়। বেঁচে আছি কিছু কল্পনাতীত প্রাপ্তির আশায়। বেঁচে আছি।

কাপুরুষ... তাই বেঁচে আছি। বেঁচে রইবো। বেঁচে রইবো, নিজেকে দহনের নেশায়।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.