অতীত খুড়ি, খুঁজে ফিরি স্বজাতির গুলিবিদ্ধ করোটি
তথ্যটা এ কারণেও যে প্রাসঙ্গিক, যুদ্ধ পরবর্তী এই যে অবস্থা সেজন্যও তাদের দায় অনেকখানি । এই যে ব্যাপক আকারে গর্ভপাত কর্মসূচী, তার পেছনের কারণ হিসেবে এসব দালালদের ভূমিকাটাই ছিল আসল। সানডে টাইমস (২০ জুন ’৭১) লিখেছে রাজাকাররা তাদের কর্মকাণ্ড এখন হত্যা ও চাঁদাবাজিতেই আটকে রাখেনি, এখন তারা বেশ্যালয়ও খুলেছে। চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে তারা একটি শিবির খুলেছে যেখানে অল্পবয়সী সুন্দরী মেয়েদের আটকে রাখা হয়েছে, রাতে পাকবাহিনীর অফিসারদের সরবরাহ করা হয় তাদের। এছাড়াও প্রতিদিনই অনেক মেয়ে অপহরণ করছে তারা নিজেদের জন্যও, এদের অনেকেই আর ফিরে আসেনি...’।
২১ জুন ’৭১ টাইম পত্রিকায় পেত্রাপোলের উদ্বাস্তুু শিবিরের এক ষোড়শীর জবানীতে লেখা হয়েছে, ‘ওরা আমার বাবা-মাকে মেরে ফেলেছে, দুজনকেই বন্দুকের বাট দিয়ে পেটাতে পেটাতে মেরেছে। এরপর মেঝেতে আমাকে চিৎ করে শুইয়ে তিনজন মিলে ধর্ষণ করেছে। ’ একই প্রতিবেদনের ভাষ্য, ‘ভিটেমাটি ছেড়ে প্রাণভয়ে পালাতে থাকা পরিবারগুলোর মেয়েদেরও হামলা চালিয়ে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে এবং এরপর বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে পাকবাহিনীর কাছে। অবশ্য পরিবারগুলো মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে ছুটিয়ে নিয়েছে অনেককে। যারা পারেনি, তাদের ঠাই হয়েছে রাজাকারদের খোলা বেশ্যালয়ে।
’
২ আগস্ট ১৯৭১ নিউজউইকের প্রতিবেদন, ‘আগুনে পোড়া গ্রামকে পেছনে ফেলে দুই কিশোরী মেয়ে নিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে পালাচ্ছিলেন চন্দ্র মন্ডল। কাদামাটির ভেতর দিয়ে। একটু পর সৈন্যদের হাতে ধরা পড়লেন। অসহায় চোখে তাকে দেখতে হলো তার মেয়েদের ধর্ষনের দৃশ্য। বারবার, বারবার, বারবার।
’
১১ অক্টোবর ’৭১ নিউইয়র্ক টাইমস লিখেছে, ‘১১ এপ্রিল সৈন্যরা আমাদের গ্রামে এল। একদল এসে আমাকে বাড়ির বাইরে নিয়ে গেল কী যেন দেখাতে। ফিরে এসে দেখি আমার বোন নেই। আমার প্রতিবেশীর মেয়ে এবং এক হিন্দুর মেয়েও একইরকম নিখোজ। মে মাসের মাঝামাঝি আমার বোন আর প্রতিবেশিকে ওরা ছেড়ে দিল।
কিন্তু হিন্দু মেয়েটার খোঁজ পাওয়া গেল না। ফিরে আসা দুজনই গর্ভবতী, বাচ্চা হবে। ওদের দিয়ে কাপড় ধোঁয়ানো হতো এরপর প্রতিদিন দু-তিনবার করে সৈন্যদের সঙ্গে শুতে হতো। ’
১৫ নভেম্বর ’৭১ নিউজউইক লিখেছে, ‘স¤প্রতি পাকবাহিনী ডেমোরা গ্রাম চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে (এখানে মুক্তিবাহিনী কখনোই আসেনি), ১২ থেকে ৩৫ বছর বয়সী সব নারীকে ধর্ষন করে এবং ১২ বছরের ওপর সব পুরুষকেই গুলি করে মারে। ’
’৭২ সালের জানুয়ারির শেষ নাগাদ হঠাৎ করেই বাংলাদেশ উপলব্ধি করল বড় এক দুর্যোগ অপেক্ষায়।
যুদ্ধ শেষ হলেও বিশাল এক বোঝা তাদের ঘাড়ে চাপল বলে- অনাকাঙিখত মাতৃত্বের বোঝা। প্রচুর ধর্ষিতা রমনীই তখন মা হতে চলেছেন, কারো বা শেষ সময় আসন্ন। ধারণা করা হয় পুরো ব্যাপারটাই ছিল পাকবাহিনীর এক পরিকল্পিত নীলনক্সা। এমন কোনো প্রমাণ নেই যে ইসলামাবাদের রাজনৈতিক বা সামরিক হাইকমান্ড সুনির্দিষ্ট নির্দেশ দিয়েছে, কিন্তু বেশ কজন পাঞ্জাবী অফিসারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে ব্যাপারটা আনঅফিশিয়ালি হলেও পরিকল্পিত (উদাহরণ, জুন মাসে ঢাকা এয়ারপোর্টে ফন শুলজকে দেওয়া এক পাক মেজরের সাক্ষাৎকার)।
সমস্যাটার চরম মাত্রার ব্যাপ্তি সম্পর্কে প্রথম ধারণা পাওয়া গেল কলকাতা থেকে আসা খবরে।
প্রচুর মেয়ে সেখানে গিয়েছেন গর্ভপাত ঘটাতে। সেখানকার এক ডাক্তার ঢাকা এলেন এবং এর ফলে স্থানীয়ভাবে তদন্ত করে জানা গেলো আসলেই সংখ্যাটা বিশাল। তাড়াহুড়োয় তখন একটি সংগঠন দাঁড় করানো হলো- দ্য ন্যাশনাল বোর্ড অব বাংলাদেশ উইম্যানস রিহ্যাবিলেশন প্রোগ্রাম। প্রচুর অর্থ সংস্থান করা হলো এবং তাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হলো যে কোনো মূল্যে সমস্যাটা মেটাতে। সমস্যা শুধু অবাঞ্ছিত গর্ভবতীরাই নন।
আরো ছিলেন বিধবা নারী যাদের অনেক সন্তান, সৈন্যদের হাতে আহত নারী (এমন নয় তারা ধর্ষিতা বা গর্ভবতী), ধর্ষিতা কিন্তু গর্ভবতী নন এবং পরিবার তাড়িয়ে দিয়েছে এমন মেয়েরা। (চলবে)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।