অতীত খুড়ি, খুঁজে ফিরি স্বজাতির গুলিবিদ্ধ করোটি
[ প্রাককথন : এটি ডাঃ জিওফ্রে ডেভিসের নিজের লেখা। 1972 সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে ধর্ষিতা নারীদের গর্ভপাতে সাহায্য করতেই এ দেশে এসেছিলেন এই অস্ট্্েরলিয়ান চিকিৎসক। মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর নাগাদ মাস ছয়েকের অভিজ্ঞতাই তুলে ধরেছেন। এতে আনুষঙ্গিক উপাত্ত হিসেবে এসেছে আন্তর্জাতিক মিডিয়ার কিছু কাভারেজের অংশ বিশেষও। এবং তার অনেকখানিই আমাদের প্রতিষ্ঠিত বা এখন পর্যন্ত জানা জ্ঞানের সঙ্গে যায় না।
আমি মূলত জোর দিয়েছি ডেভিসের সে সময়কার অভিজ্ঞতার ওপর, প্রসঙ্গক্রমেই এসেছে টিওপি (টার্মিনেশন অব প্রেগনেন্সি) করতে গিয়ে কী ধরণের অদ্ভুতুরে সরঞ্জামের ওপর নির্ভর করতে হয়েছে তাকে ও তার দলকে। মোকাবেলা করতে হয়েছে অদ্ভুত সব পরিস্থিতি। এবং ক্ষমা চেয়ে জানাচ্ছি এটিও ধারাবাহিক। চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিশেষ করে গাইনীর ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য অবশ্যপাঠ্য মনে হয়েছে ডেভিসের অভিজ্ঞতা]
দমনপীড়নে বাংলাদেশের অধিকারবোধ টিকিয়ে রাখতে বিশাল এক পরিকল্পনা ছিল পাকিস্তানের। ইসলামাবাদের তরফে পাকিস্তানী সেনাদের ওপর ছিল তাই এক বিশেষ নির্দেশনা।
বিবাহিত কিংবা কুমারী, যতবেশি সম্ভব বাঙ্গালী মেয়েকে গর্ভবতী করা! বিশেষ এই নির্দেশের একটা বিশেষত্ব ছিল যে বাঙ্গালীদের চীরকালীন গর্বের জাতীয়তাবোধে একটা আঘাত হানা। শংকর এক জাত সৃষ্টির মাধ্যমে সেটাকে টলিয়ে দেওয়া। আবার একটি ধর্মীয় নির্দেশনাও, কোনো মুসলমান আর যার সঙ্গেই লড়ুক, তার বাবার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরবে না।
বিজয়ের পর স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার অসহায়ভাবে আবিষ্কার করল এত দুর্যোগের ভিড়ে নতুন আপদ। বিশাল সংখ্যক কুমারী গর্ভবতী, যাদের বেশিরভাগই কুড়ি পেরোয়নি।
আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সাহায্য চাওয়া হলো। একই সঙ্গে তাড়াহুড়ো করে দেশব্যাপী একটি গর্ভপাত কর্মসূচী নেওয়া হলো। তখনই আবিষকৃত হলো দেশটির আইনীব্যবস্থা মান্ধাতা আমলের। জনসংখ্যা নিয়ে হিমশিম খাওয়া দেশগুলোর একটি এই বাংলাদেশের পেনালকোডে এখনো 312 ও 313 ধারা বলবৎ। 1861 সালে ব্রিটিশ আইনের 58 ও 59 ধারাই এগুলো।
তারপরও হালকা প্লেনে করে দেশব্যাপী প্রচারপত্র ফেলা হলো গর্ভপাতের নিয়মকানুন জানিয়ে। এটা বেশ কার্যকর প্রচারণা হয়েছিল, যার ফলে সামাজিক সমস্যাগুলো কাটিয়ে ওঠা গিয়েছিল অনেকখানি। অবশ্য এছাড়াও প্রথাগত সব মাধ্যমও ব্যবহার করা হয়েছে।
'70 সালের নির্বাচনে শেখ মুজিব ও আওয়ামী লিগ 98% ভোট নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে নিরঙ্কুশ বিজয়ী হয়। সেটা মেনে নিতে পারেনি পশ্চিমা সেনা বাহিনী এবং জুলফিকার আলী ভুট্টোর মতো কিছু নেতা।
ক্ষমতার এই টানাপোড়েনে ক্রমশই বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠছিল বাংলাদেশ। '71 সালের মার্চে ইয়াহিয়া খানকে তার রাজনৈতিক ও সামরিক গোয়েন্দারা বোঝালো যে ছোটমাপের একটা সামরিক হামলা দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতাকামীদের নিস্তব্ধ ও নিমর্ূল করে দেওয়া সম্ভব। 25 মার্চ রাতে ঠিক তাই করল পাকিস্তানী সেনারা, এবং হতভম্ব হয়ে আবিষ্কার করল তুমুল প্রতিরোধের শিকার তারা! সশস্ত্র এই প্রতিরোধ অচিরেই ছড়িয়ে গেল সারা দেশে। তাড়াহুড়ো করে গড়ে তোলা মুুক্তিফৌজ (পরে মুক্তিবাহিনী) ঢাকার দক্ষিণে কুমিল্লায় পাকবাহিনীকে আক্রমণ করে বসল। 13 এপ্রিল চুয়াডাঙ্গায় স্বাধীন পুর্ব পাকিস্তান (বাংলাদেশ) অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠিত হলো।
সেখান থেকেই ব্যাপ্তি নিল পুরো মাত্রার গৃহযুদ্ধ। বাংলাদেশ বারবার বিদেশী সাহায্য চাইল। একমাত্র রাশিয়া সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল।
মে মাসে রাজনৈতিক মিত্রতা এক অদ্ভুত রূপ নিল। মুক্তিফৌজ ভারতীয় ও বার্মিজ মাওবাদী গেরিলাদের সঙ্গে কাধে কাধ মিলিয়ে লড়তে শুরু করল।
এরাই যুদ্ধশেষে নকশাল ও মেসো সন্ত্রাসবাদী গ্রুপ গড়ে তুলল আর তখন মুক্তিবাহিনীই তাদের দমনে নামল। রাশিয়া বাংলাদেশকে সমর্থন দিচ্ছিল। আমেরিকা ছিল দ্বিধাগ্রস্থ। আগের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তারা পশ্চিম পাাকিস্তানকে সাহায্য করছিল এবং নিশ্চিত ছিল তারাই জিতবে। কিসিঞ্জার ইসলামাবাদকে ব্যবহার করছিলেন পিকিংয়ের সঙ্গে সমঝোতার একটা ক্ষেত্র হিসেবে।
পিকিং যখন পাকিস্তানের পক্ষ নিল, ভারত সর্বাত্মক সহযোগিতা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল বাংলাদেশের পক্ষে। ঘটনাটা ঘটল মে মাসে, তবে রুশদের বাদ দিলে পুরো ব্যাপারটাই রইল আনঅফিশিয়াল- প্রকাশ্য নয়। 1971 ও '72 সালে ভারত ও বাংলাদেশের হোটেলগুলোর রেজিস্টার পরীক্ষা করে বিপুল সংখ্যক রাশিয়ান উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া গেছে।
এপ্রিলে এটা পরিষ্কার হয়ে গেল যে 'স্রেফ সামরিক অভিযানই পশ্চিম পাকিস্তানের একমাত্র এজেন্ডা নয়। শহরের পর শহর পাকিস্তানী সেনারা পরিকল্পিতভাবে ধংস করতে শুরু করল পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক খাতগুলো যাতে স্বাধীনতা আন্দোলনকে বিনাশ করা যায়।
ইসলামাবাদ হাইকমান্ডের (আসলে রাওয়ালপিন্ডি) নির্দেশে সৈন্যরা নিয়মমেনে গুলি করে মারতে লাগল ছাত্র, প্রকৌশলী, চিকিৎসক, বুদ্ধিজীবি এবং সম্ভাব্য নেতৃত্বের গুণধারী যে কাউকে। সেটা তারা স্বাধীনতায় বিশ্বাসী হোক বা না হোক (নিউজউইক, 26 এপ্রিল '71)। 'তারা নিশ্চিত হতে চাইছিল যাতে তাদের বিরুদ্ধে আর কেউ মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে' (একজন মুক্তিযোদ্ধার উক্তি যিনি সিলেট ও কুমিল্লায় যুদ্ধ করেছেন)।
এরপর নাটকীয় মোড় নিল পরিস্থিতি। 24 মে '71 টাইমসে লেখা হলো : 'পরিকল্পিতভাবেই সব হচ্ছে।
ক্রায়ার (লুই ক্রায়ার তখনকার বিখ্যাত সাংবাদিকদের একজন) জানাচ্ছেন হত্যাকান্ড একটা নির্দিষ্ট রূপরেখা মেনে এগোচ্ছে। সরকারী বাহিনী বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত কোনো শহর দখলের জন্য কৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে উস্কানী দিয়ে। বাঙ্গালীরা প্রতিশোধ পরায়ন হয়ে স্বাধীনতাবিরোধীদের হত্যা করছে আর তারপর তারা সব সঙ্গীন নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। '
উদ্ধৃতিটা এ কারণেই চমকপ্রদ, যে এখানেই প্রথম আমরা বাঙ্গালীদের হাতে বাঙ্গালীদের নিহত হওয়ার খবর পাই। পরে ব্যাপারটা বিস্তারিত ব্যাখ্যা পেয়েছি ব্যারিস্টার শামসুল হকের কাছ থেকে।
উনি ত্রিশ বছরের ওপর মুসলিম লিগ করেছেন এবং রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় ছিলেন তারও বেশিকাল ধরে। তার মতে পাকবাহিনী যে কোনো শহর দখল করতে গিয়ে হিন্দুদের ওপরই আক্রমন করত। অন্যদিকে মুক্তিবাহিনী মারত শহরের অভিজাতদের কারণ তাদের ভাষায় তারা ছিল 'দালাল'। এই দালালের সংজ্ঞাটা ছিল এরকম, 'যারাই পাকিস্তান সরকারের পক্ষে কাজ করছে তারা দালাল, সেটা যুদ্ধের আগে বা যুদ্ধকালীনই হোক। এদের দেখলেই গুলি করে মেরে ফেলতে হবে।
'
যুদ্ধের পরপরই এই দালালরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। যারা বিদেশে পালাতে পারেনি এবং ধরা পড়েছে, তাদের পোরা হয়েছে কারাগারে। আমি তাদের অনেককে কারাগারে পেয়েছি। নোয়াখালি জেলের কথাই বলি। সেখানের ধারণক্ষমতা 250 জনের।
'72 সালের 1 মে কয়েদীদের সংখ্যা ছিল 1,250 (আমি ছিলাম ওখানে, তাদের গুনেছি, কথা বলেছি)। কেউ কেউ ঘুষ দিয়ে বেরিয়ে গেছে, কিন্তু 1250 ছিল একটা ধ্রুব সংখ্যা। তাদের অবস্থা বেশ শোচনীয়। (চলবে)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।