অনাথ আশ্রমের ছোট ছোট কামরা সংলগ্ন বারান্দাটিতে জ্বলে উঠেছে সান্ধ্যকালীন টিমটিমে বাতিগুলি। জাফরি কাটা দেওয়ালের পাশে সৃষ্টি হয়েছে
এক অপার্থীব ভুতুড়ে আলো আঁধারীর খেলা। পুরাতন ভবনটার সেই আগের জৌলুস বলতে গেলে কিছুই নেই আর। শান বাঁধানো উঠোনটার এখানে ওখানে ভাঙ্গচুরের চিত্রাবলী, আঁকিবুকি ফাটল। টিমটিম আলো জ্বলা
বারান্দাটার এক কোনে চুপচাপ বসে আছে মেয়েটি।
আজও তার চারদিক ঘিরে রয়েছে ছোট ছোট একগাদা ছেলেমেয়ে। তাদের মাঝেই দেখছে সে আজ থেকে আটত্রিশ বছর আগের শিশুদের ভিড়ে বসে থাকা ছোট্ট আর একটি মেয়েকে।
ডা. জ্যাক: নরওয়ে নামের এক দেশে যাবে তুমি কোহিনূর ?
কোহিনূরঃ না। যাবোনা।
ডা. জ্যাকঃ সেখানে তুমি অনেক অনেক ভালো থাকবে।
বাবা পাবে, মা পাবে। ভাই পাবে।
প্রবলবেগে মাথা নেড়ে অনিচ্ছা জানায় সাড়ে তিন বছরের কোহিনূর , না,না, যাব না আমি! কেন যাবো?
ডা. জ্যাকঃ তোমার সেখানে যাওয়া উচিৎ বেবি। তুমি এর চাইতে অনেক অনেক ভালো থাকবে সেখানে। ট্রাস্ট মি।
কোহিনূরঃ না না । আমি যাবোনা। আমি মুক্তা, শিল্পী, নার্গিস এদের ছেড়ে কোথাও যাবোনা। লরা আন্টি, ওয়াজেদ চাচ্চু এদেরকে ছেড়ে কোথাও যাবোনা আমি। আমি এখানেই থাকতে চাই।
ডা. জ্যাকঃ আমি বলছি আমার সাথে নরওয়ে চলো, সেটা তোমার জন্য ভালো হবে। তুমি পড়ালেখা শিখে অনেক বড় হবে। দেখো এই আমি তোমার ভালো চাই।
কোহিনূরঃ না আমি তোমাদেরকে ছেড়ে কোথাও যাবোনা। আমাকে কোথাও পাঠিয়ে দিওনা প্লিজ! প্লিজ আঙ্কেল অনেক ভালোবাসি তোমাদেরকে আমি।
অসহায়্ত্ব ফুটে ওঠে ছোট্ট একরত্তি সাড়ে তিন বছরের মেয়ে কোহিনূরের চোখে মুখে।
দিনটি ছিল ১৯৭৬ সালের ১৪ই জুলাই। কোহিনূর নামের সেই ছোট্ট মেয়েটি সত্যি সত্যিই তারপর মাদার তেরেসা অনাথ আশ্রমের সকল মায়া ছেড়ে নরওয়ে নামের একটা দেশে পাড়ি জমাতে হলো। শুধু বুকের মধ্যিখানের আতশকাঁচে বাঁধা পড়ে রইলো মাদার তেরেসা অনাথ আশ্রমের ছোট্ট ছোট্ট মায়াগুলি।
নতুন দেশ, নতুন জীবন, নতুন পরিবেশ।
নতুন মা অডি নোর্ডবার্গ, বাবা নিল্স নোর্ডবার্গ আর ভাই নিল্স জুনিয়র। নতুন একটা নামও হলো তার মারি। মারি কোহিনূর নোর্ডবার্গ। অবাক হয়ে দেখলো কোহিনূর এত আদর,এত ভালোবাসা জন্মের পর থেকে আসলেই কখনও দেখা হয়নি তার। ১২ বছর বয়সে পালক মা ভর্তি করে দিলেন ব্যালে নাচের ক্লাসে।
১৯৯৬ সালে পড়াশোনা শেষ করলেন অসলোর স্টেট একাডেমি অব ব্যালে থেকে। নৃত্যেই শুরু করলেন ক্যারিয়ার। তবে নাচতে নাচতে এবং নাচ শেখাতে শেখাতে একসময় গানের ভুবনেও ভেসে গেলো কোহিনূর। বানিয়ে ফেললো সাত সদস্যের একটা ব্যান্ড দল। কালের স্রোতে ধীরে ধীরে অস্বচ্ছ আর ঘোলাটে হয়ে এলো সেসব স্মৃতি।
ধীরে ধীরে ভুলেই গেলো বুঝি মেয়েটি তার সুদূর শৈশবের সোনালী মায়াস্মৃতি ও অনাকাঙ্খিত জীবনের সেই দিনগুলির কথা। তবুও কোনো কোনো ভর দুপুরে বা বিষন্ন সন্ধ্যায় হু হু করে ওঠে মন।
একসময় গান হয় তার নেশা ও পেশা। গান লিখতে ভালো লাগে ও সুরও দিয়ে ফেলে নিজেই। গানে গানে তুলে আনে, নারী, শিশু ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের কথা, বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে জেগে ওঠার কথা।
গানে গানেই জাগে তার কান্না হাসির খেলা। কোহিনূর গায় ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি বাবা, আমি তোমাকে ভালোবাসি মা...’ এই গান ভিন দেশে পাড়ি জমানো মানুষদের জন্য তবুও সাত সাগর পাড়ি দিয়ে সে গানের সুর কি ধাক্কা দেয় এসে বাংলাদেশের কোথাও কোনো প্রত্যন্ত প্রান্তরে বসে থাকা কোনো এক দুঃখিনী বাঙ্গালী মায়ের মনের দরজায়? যশ, নাম , খ্যতি এত কিছু প্রাপ্তির পরেও কিসের অপ্রাপ্তি কোহিনূরের হৃদয়কোনে?
বাংলাদেশের যুদ্ধশিশু কোহিনূর। বেড়ে উঠেছেন নরওয়েতে। সংগীতশিল্পী হিসেবে পেয়েছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতি। বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধেও সোচ্চার তাঁর কণ্ঠ।
পেয়েছেন ‘নরওয়েজিয়ান অব দ্য ইয়ার’-এর মতো সম্মাননা। গত বছর বিজয়ের মাসে তিনি এসেছিলেন বাংলাদেশে। মুক্তিযুদ্ধের পর পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে তার মতো আরো অনেক শিশুকে দত্তক হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেতে হয়েছে।
ছোটবেলার কথা তেমন কিছুই মনে করতে পারেন না একাত্তরের যুদ্ধশিশু নরওয়ের বিখ্যাত শিল্পী কোহিনূর। মা-বাবার নামও জানেন না তিনি।
কী করতেন তাঁর মা, কোথায় থাকতেন কিছুই মনে নেই তাঁর। ঢাকার অলিগলি, ফুটপাত ও বস্তিতে তন্ন-তন্ন করে খুঁজে চলেছেন তিনি! এখনো পাননি মায়ের সন্ধান। তবুও আশা ছাড়েননি। একবার হলেও তিনি দেখতে চান মায়ের মুখটি।
নরওয়েতে সবই আছে কোহিনূরের।
অর্থ-বিত্ত, খ্যাতি, সম্মান সব! এর পরও একমাত্র নাড়ির টানে, মায়ের খোঁজে এ পর্যন্ত চারবার বাংলাদেশে এসেছেন তিনি। প্রতিবার খোঁজ করেছেন মাকে। কিন্তু কোনোবারই পাননি। বেঁচে আছেন, নাকি মরে গেছেন তাও জানেন না; তবুও তিনি বাংলাদেশের পথে-প্রান্তরে খুঁজে চলেছেন তাঁর মাকে। কোহিনুরের খুব ইচ্ছা শুধু একটিবার যদি দেখতে পেতো তার জন্মদাত্রী মাকে।
হয়তো আমৃত্যু এ বাসনা নিয়েই থাকতে হবে তাকে। জানা হবেনা কোনোদিন কেমন ছিলেন তার দুঃখিনী মা। কোনোদিনই হয়তো পাবেনা সে তার শেকড়ের সন্ধান । তবুও মনে প্রবল আশা আর দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে তিনি বলেন, 'অবশ্যই খুঁজে পাবেন মাকে একদিন না একদিন।
এ বছরের ফেব্রুয়ারীর ৭ তারিখে ঢাকা ছেড়ে নরওয়ের ফিরে গেছেন কোহিনুর।
তবে নাড়ির টানে তিনি আবারও আসতে চান, বারবার আসতে চান বাংলাদেশে। দেশবাসীর কাছে তাঁর মায়ের খোঁজ চান, দোয়াও চান তিনি। কোহিনুর অনুরোধ করেছেন, তার মা-বাবা অথবা আত্মীয় স্বজনকে যদি কেউ চেনেন তাহলে যেন তাকে জানান। ঢাকায় ০১৮২৫৭৭৮৯৫৮ এই ফোন নাম্বারে তথ্য জানালে তিনি জানতে পারবেন।
স্বাধীনতার ৪২ বছর পর এসেছে আর একটি বিজয়ের মাস।
এ স্বাধীনতায় অংশ আছে কত আত্মত্যাগের, কত স্বার্থত্যাগের। কত কোহিনুর হারিয়েছে তার মাকে। মা হারিয়েছে সন্তান। কখনও জানা হয়নি পরস্পরকে, পাওয়া হয়নি সন্তানটির মায়ের মমতা। মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে করা হয়নি কোনো আবদার।
ডাকা হয়নি একটাবার মা বলে তাকে। বুকের মধ্যে চাপা দিয়ে রাখা একটি প্রশ্ন গুমরে কেঁদে মরে সারাক্ষন, মাগো কেমন আছো তুমি? প্রশ্নের ওপার হতে জবাবে ভেসে আসে অপার শূন্যতা। প্রার্থনা ইচ্ছা ও প্রবল আকাংখার কাছে পরাজিত হোক সকল অসম্ভাবতা, সকল শূন্যতা। যুদ্ধশিশু কোহিনুর খুঁজে পাক তার মমতাময়ী মায়ের কোল।
কোহিনুর সংক্রান্ত আরও কিছু তথ্যাবলী।
Click This Link
Click This Link
Click This Link
Click This Link
Click This Link
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।