আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গোয়েন্দা ঝাকানাকা (আগের 7 খন্ড + শেষ খন্ড = অখন্ড)

সুন্দরী বালিকাদের যত্ন করে কামড়াই

তারিখ দেখাচ্ছে সেপ্টেম্বর 17, 2003। যা-ই হোক, আগের খন্ডগুলো মুছে দেবো। অনেকেই এক সাথে পড়তে ভালোবাসেন, আমি জানি। টুকরো টুকরো করে তুলে দুয়েকজনের বিরক্তির কারণ হয়েছি, এখন একসাথে তুলে কতজনের রোষানলে পড়বো কে জানে। যারা পড়বেন তাঁদের মন্তব্য প্রত্যাশা করবো।

ধন্যবাদ। -------------------------------------------------- 1. 'মুহাহাহাহাহা!' চারপাশ কেঁপে ওঠে। কাঁপবেই তো। নবীন পাঠক হয়তো এ শব্দটার কোন কিনারা করতে পারবেন না, আর করবেনই বা কিভাবে, যা বিদঘুটে আওয়াজ, বাব্বাহ্ --- কিন্তু অভিজ্ঞ পাঠক বুঝে ফেলেছেন, এটা একটা হাসির শব্দ। তবে অভিজ্ঞ পাঠকদের মধ্যেও জাতভেদ আছে, স্বীকার করতেই হবে।

এনাদের মধ্যে যাঁরা একটু নিচু জাতের, তাঁরা হয়তো এটাকে কোন ভিলেন কি টপটেররের অট্টহাসি ভাবছেন। বড়জোর কোন মন্ত্রী-সাংসদ। কিন্তু না, নিচু জাতের অভিজ্ঞ পাঠক ভাইসব, এ হাসি সেই কুখ্যাত খুনে দসু্য বদরু খাঁ, যে শুধু রাত বারোটায় খুনখারাপি করে, তার বিকট কন্ঠনিঃসৃত নয়, কিংবা চতুর চোরাচালানবাজ আদমাহানি ইস্পানজি, যে কেবল ভোর তিনটেয় ট্রাকের পর ট্রাক সীমান্তের এপারওপার করে, সেও অমন হাসির জন্যে দায়ী নয়, এ হাসি হাসছেন আমাদের গল্পের নায়ক, উপমহাদেশের স্বনামখ্যাত গোয়েন্দা, গোয়েন্দা ঝাকানাকা, যাঁকে সনাক্ত করতে পেরেছেন কেবল আমাদের উঁচু জাতের অভিজ্ঞ পাঠক সমাজ! ঝাকানাকার হাসির শব্দে চারপাশ যেমন কেঁপে ওঠে, তেমনই কেঁপে ওঠেন বৈঠকখানায় বসে থাকা তিন ভদ্রলোক। সোফার পাশে চার পা মুড়ে বসে থাকা ছাগলটাও দাড়ি কাঁপিয়ে ম্যাঅ্যাঅ্যা করে ডেকে ওঠে। 'আপনাদেরকে যদিও তিন ভদ্রলোক হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়া হচ্ছে,' আলাপের সুরে বললেন ঝাকানাকা, আর বলবেন না-ই বা কেন, তিনি তো আলাপই করছেন, আলাপের মাঝে তো আর বিলাপের সুর তোলা ভালো কাজ নয়, 'কিন্তু আদতে আপনাদের মধ্যে কেবল দুজন ভদ্রলোক।

বাকিজন হচ্ছে লুচ্চা, গুন্ডা, বদমাশ, খুনে, ইতর এক বোঁচকামারা বাটপার!' আবারও চারপাশ কেঁপে ওঠে ঝাকানাকার আলাপের সুরে, দুই ভদ্রলোক আর লুচ্চা, গুন্ডা, বদমাশ, খুনে, ইতর এক বোঁচকামারা বাটপার আরো বেশি করে কেঁপে ওঠেন। ছাগলটা আবারও ম্যা বোল তোলে। ঝাকানাকা তৃপ্তির হাসি হেসে চায়ে চুমুক দেন আর গোঁফে একবার তা দেন। 'আসুন, পরিস্থিতিটা একবার বিশ্লেষণ করে দেখা যাক। ' গোয়েন্দাশ্রেষ্ঠ উঠে পড়েন সোফা থেকে, তারপর পায়চারি করতে থাকেন ঘরের এ কোণ থেকে ও কোণ।

আর এরই ফাঁকে পকেট থেকে একটা জাবদা চেহারার নোটবই বের করে তিনশো একান্ন নাম্বার পৃষ্ঠা বার করেন। 'গত পরশু দিন, রাত বারোটার সময় এখানে একটা নৃশংস খুন হয়। ' গোয়েন্দা ঝাকানাকা ডায়রি দেখে হেঁকে বলেন। এবার আরেকটা সোফায় বসা দারোগা কিংকর্তব্যবিমূঢ় চৌধারি, যাঁকে অভিজ্ঞ পাঠক সমাজ (উঁচু ও নিচু দুজাতেরই) কিংকু চৌধারি নামেই চেনেন, মোলায়েম একটা কাশি দেন। ঝাকানাকা থেমে পড়ে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকান।

'গতকাল রাত বারোটায়। ' বিনীত গলায় বললেন কিংকু চৌধারি, আর বলবেন না-ই বা কেন, চৌধারি বংশের সন্তান, চৌদিকেই ধারালো তিনি, বিনয়-আদব তাঁর রক্তে মিশে আছে। তাছাড়া গোয়েন্দা ঝাকানাকার সাথে বিনয় না দেখিয়ে তাঁর উপায়ও নেই, বেয়াদবি করলেই তাঁকে ঘাগড়াছড়িতে বদলি করা হতে পারে, যেমন করা হয়েছিলো এই থানার ভূতপূর্ব দারোগা ঘুষেন্দ্র মালদারকে। গোয়েন্দা ঝাকানাকা ভুরু কুঁচকে বলেন, 'কিন্তু কিংকু সাহেব, আপনিই তো আমাকে গতকাল ভোর একটায় ফোন করলেন?' কিংকু চৌধারি একটু ঘাবড়ে গিয়ে বললেন, 'ভোর একটা? হ্যাঁ, তা বলতে পারেন। ' ঝাকানাকা বুক ঠুকে বললেন, 'অবশ্যই বলতে পারি, রাত বারোটার পরই তো ভোর।

--- যাকগে এসব বাজে আলাপ, যা বলছিলাম, গত পরশু, রাত বারোটায় একটা খুন হয় এ বাড়িতে। কাকে খুন করা হয়েছিলো যেন?' ডায়রির পাতা উল্টে যান তিনি, 'ও হ্যাঁ --- এ বাড়ির মালিক, সরফরাজ জবরদস্ত-কে। ' তিন ভদ্রলোক, থুক্কু, দুই ভদ্রলোক আর লুচ্চা, গুন্ডা, বদমাশ, খুনে, ইতর এক বোঁচকামারা বাটপার এবার ভারি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন ঝাকানাকার দিকে। ছাগলটাও যেন ঘাবড়ে গিয়ে একবার এদিক, আরেকবার ওদিকে তাকায়। কিংকু চৌধারি ভারি বিনীত গলায় শুধরে দেন, 'জি্ব না, তাঁর নাম আওরঙ্গ আলম।

' গোয়েন্দা ঝাকানাকা এবার ডায়রিটা চোখের কাছে ধরেন, তারপর পকেট থেকে একটা চশমা বের করে ডায়রিটা আলোর দিকে ফিরিয়ে ধরেন, তারপর সোজা হয়ে বলেন, 'ঠিক, আওরঙ্গ আলমই বটে। ' তারপর গলা খাঁকরে কিংকু চৌধারির দিকে ফিরে কড়া গলায় বলেন, 'এমন জড়ানোপাকানো বিচ্ছিরি হাতের লেখা, কী লেখা হয়েছে, কিচ্ছু বোঝার উপায় নেই --- কে লিখেছে এসব?' কিংকু চৌধারি বিনয়ে মাথা নত করে লাজুক গলায় কী যেন বললেন। কিন্তু ঝাকানাকা উত্তর শুনে মহা চটে গেলেন। 'আপনার সুন্দরী সেক্রেটারি মিস মিলি? কেন এসব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য লেখার দায়িত্ব আপনি আপনার সুন্দরী সেক্রেটারি মিস মিলিকে দেন? আর দেবেন না বলে দিচ্ছি। শুধু গ্ল্যামার থাকলেই কাজ চলে না, গ্রামারও কিছু জানতে হয়! মেয়েটার হাতের লেখা যে কী বিচ্ছিরি, বলে বোঝানোর উপায় নেই।

ভবিষ্যতে ওকে আর এসব গুরুত্বপূর্ণ কাজ দেবেন না, বরং হালকা কোন কাজ, যেমন ধরুন, আমার সাথে যোগাযোগ করার দায়িত্ব, এ ধরনের কোন কাজ দেবেন আপনার সুন্দরী সেক্রেটারি মিস মিলিকে। ' কিংকু চৌধারি অবাক হয়ে বিনয়ে মাথা সোজা করে বললেন, 'কিন্তু স্যার, আমি তো সরকারি চাকরি করি, দারোগার আবার সুন্দরী সেক্রেটারি আসবে কোত্থেকে? তাছাড়া, মিস মিলি তো আপনার সেক্রেটারি!' ঝাকানাকা চটে গিয়ে বললেন, 'তাহলে আপনি কেন বললেন, এসব [গাঢ়] আপনার সুন্দরী সেক্রেটারি মিস মিলির লেখা [/গাঢ়]?' কিংকু চৌধারি ঘাবড়ে গিয়ে বললেন, 'সেটাই তো বললাম স্যার, ওই নোটবুকে যা কিছু সব [গাঢ়] আপনার সুন্দরী সেক্রেটারি মিস মিলির লেখা [/গাঢ়]। ' গোয়েন্দা ঝাকানাকা গভীর ভাবনায় মগ্ন হয়ে পড়েন, তারপর কটমট করে কিংকু চৌধারির দিকে তাকিয়ে বলেন, 'ওহ!' ওদিকে দুই ভদ্রলোক আর লুচ্চা, গুন্ডা, বদমাশ, খুনে, ইতর এক বোঁচকামারা বাটপার একে অপরের মুখের দিকে তাকায়। তবে ছাগলটার মুখের দিকে কেউ তাকায় না, তাকাবেই বা কেন বলুন, ছাগলের মুখ তো আর তাকিয়ে থাকার মতো কিছু নয়, তাই ছাগলটা সবাইকে একবার করে দেখে নিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে দেয়ালে ঝোলানো আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেকে খুঁটিয়ে দেখে। যাই হোক, ঝাকানাকা নিজেকে সামলে নিয়ে আবার পায়চারি শুরু করেন।

'যা বলছিলাম, গত পরশু রাত বারোটায় এ বাড়িতে নৃশংসভাবে খুন হন এ বাড়ির মালিক, আওরঙ্গ আলম। মৃতু্যকালে তাঁর বয়স হয়েছিলো --- দাঁড়ান দেখি কত,' আবারো ডায়রিটা খুলে ধরেন তিনি, কিছুক্ষণ চোখ কুঁচকে তাকিয়ে থেকে সেটা বন্ধ করে পকেটে গুঁজে রাখেন, তারপর গলা খাঁকরে বলেন, 'ইয়ে --- অনেক বয়স হয়েছিলো বেচারার। কয়েকদিন বাদেই হয়তো অসুখবিসুখে পড়ে মারা যেতেন, কিন্তু না!' নাটকীয়ভাবে শরীর মোচড় দিয়ে ঘোরেন তিনি সোফার দিকে, যেখানে সেই তিন --- ব্যক্তি বসে আছে। 'কয়েকদিন সময় তাঁকে দিতে চায়নি সেই লুচ্চা খুনেটা। তাঁকে রাতে ঘুমের মধ্যে মুখের ওপর বালিশ চেপে ধরে নির্মমভাবে খুন করে সে।

ধস্তাধস্তির শব্দ শুনে বাড়ির লোকজন ছুটে আসে। এসে দেখে যে শোবার ঘরে মরে পড়ে রয়েছেন অসহায় আওরঙ্গ আলম, মুখের ওপর তখনও বালিশটা পড়ে রয়েছে,' পকেট থেকে ডায়রিটা আবার বের করে পড়েন ঝাকানাকা, 'ঘাতক বালিশের ছিলো নীল রঙের ওয়াড়, ওজন প্রায় এক কেজি, নীলক্ষেতের তুলোর দোকান থেকে বানানো হয়েছিলো --- ইয়ে, বছর পাঁচেক আগে, হুমম। যাকগে, আওরঙ্গ আলম মৃতু্যর আগে পর্যন্ত চরম ধস্তাধস্তি করেছিলেন, এ থেকে বোঝা যায়, তিনি ঘুম থেকে জেগে উঠেছিলেন, অথবা আদপে ঘুমোননি --- তবে বালিশটাকে আঁচড়ে কামড়ে একেবারে ফালাফালা করে ফেলা হয়েছে। অবশ্য পাঁচ বছরের পুরনো বালিশ, ধস্তাধস্তি সহ্য করার ক্ষমতা তার আদৌ ছিলো বলে মনে হয় না। যাই হোক, আমরা ধরে নিতে পারি, খুন হবার আগে তিনি সচেতন ছিলেন, কে জানে, হয়তো হত্যাকারীকে চিনেও ফেলেছিলেন।

ধস্তাধস্তির শব্দ শুনে দোতলার ঘরে ছুটে আসেন তাঁর কন্যা, বনানী পারভিন, যিনি এখন মানসিক আঘাত পেয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন, আর আপনি,' বসে থাকা তিন ব্যক্তির মধ্যে একজনের দিকে আঙুল তুলে বাজখাঁই গলায় বলেন ঝাকানাকা, সেই ব্যক্তি কেঁপে ওঠেন, '--- জিন্দাদিল জব্বলপুরী, তাঁর জামাতা। এসে দেখেন, ঘরের দরজা খোলা, ভেতরে খাটের ওপর পড়ে আছেন আওরঙ্গ আলম, তাঁর মুখের ওপর বালিশ। তাই তো?' জিন্দাদিল জব্বলপুরী ইতিবাচক ভঙ্গিতে মাথা নাড়েন। 'হুম। আপনারা দুজন তখন জোর চিৎকার করে ওঠেন।

এই চিৎকার শুনে কোত্থেকে যেন ছুটে আসেন, আপনি,' দ্বিতীয় ব্যক্তির দিকে তাকিয়ে চোখ গরম করেন দুর্ধর্ষ গোযেন্দা, 'নিহত আওরঙ্গ আলমের ভাগ্নে, বজরঙ্গ বাহরাম। ঠিক?' বজরঙ্গ বাহরাম শুষ্ক মুখে মাথা নাড়েন। 'তারপর আপনিও দৃশ্যটা দেখে চিল চিৎকার করে ওঠেন। আপনাদের চিৎকার শুনে, বাইরে থেকে ছুটতে ছুটতে ঘরে ঢোকেন আপনি,' কটমটিয়ে অবশিষ্ট ব্যক্তিটির দিকে তাকান ঝাকানাকা, 'আওরঙ্গ আলমের শালা, বিল্লাল বসুনিয়া, নাকি ভুল বললাম?' নেতিবাচকভাবে মাথা দোলান বসুনিয়া। 'তারপর আপনারা সবাই মিলে পাড়া মাথায় তুলে চ্যাঁচাতে চ্যাঁচাতে ঘরে ঢুকে নিহত আওরঙ্গ আলমের মুখের ওপর থেকে বালিশটা সরান।

সরিয়ে দেখেন, তিনি মুখ ভেটকে পড়ে আছেন, তাই না?' এবার সবাই মাথা নাড়েন, এমনকি ছাগলটাও। 'আপনারা তাই দেখে ভয়ে আরো জোরে চেঁচিয়ে ওঠেন। এবার ঘটে এক আছায্য ঘটনা, আওরঙ্গ আলম চোখ খোলেন। তারপর হাত পা নাড়ান। তারপর একটা হাত তুলে বলেন, "ব --- ব --- ব --- ব ---", তারপর তিনি আবার মৃতু্যর কোলে ঢলে পড়েন।

নাকি?' এবার কিংকু চৌধারি মৃদু কাশেন। 'আবার নয়, তখনই তিনি মৃতু্যর কোলে প্রথম ও শেষবারের মতো ঢলে পড়েন। ' 'ঐ হলো। যেই লাউ সেই কদু। ' ঝাকানাকা হাতে হাত ঘষেন।

'উনি কবার মরলেন, সেটা বড় ব্যাপার নয়। বড় ব্যাপার হচ্ছে, মরার আগে তিনি চারবার "ব" বলেছেন। কেন?' এবার জিন্দাদিল জব্বলপুরী লাফিয়ে ওঠেন, 'আমি জানি কেন! তিনি খুনীকে চিনিয়ে দিয়ে গেছেন! এই বজরঙ্গ আর এই বসুনিয়া, দুই ব-ওয়ালা বখাটে বকলম বদমাশ মিলে বালিশ দিয়ে চটকে আব্বাসাহেবকে খুন করেছে! দেখেছেন ওদের স্বাস্থ্য? এই বজরঙ্গ হারামজাদাটা দিন রাত বারবেল ভাঁজে, সারাটাক্ষণ গুন্ডামির তোড়জোড় করে ব্যাটা, আব্বার পয়সায় ছোলামটর খেয়ে খেয়ে দেখুন কেমন কেঁদো শরীর বানিয়েছে বদমাশটা, দেখুন, বাইসেপ ট্রাইসেপ সব কেমন বাগিয়ে বসে আছে! আর --- আর ঐ বসুনিয়াটাও কম যায় না, সারারাত ধরে গাঁজা খেলে কী হবে, সকালে উঠেই দুসের দুধ খেয়ে ক্ষেতিটা একেবারে সুদে আসলে পুষিয়ে নেয় ব্যাটা বাটপার!' 'বটে?' সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে বাকি দুজনের দিকে তাকান ঝাকানাকা। 'সত্যি নাকি?' জিন্দাদিলের দিকে এক পশলা জিঘাংসু দৃষ্টি হেনে বজরঙ্গ বলেন, 'হ্যাঁ স্যার। ' ঝাকানাকা গর্জে ওঠেন, 'হ্যাঁ স্যার মানে? কী --- কী বলতে চাও তুমি? তোমরা দুজন মিলে আওরঙ্গ আলমকে একটা পাঁচ বছরের পুরনো ময়লা বিটকেলে গন্ধওয়ালা বালিশ চেপে খুন করেছো? আবার এতবড় সাহস, সরাসরি কবুল করো আমার সামনে, আমাকে মাথা ঘামানোর বিন্দুমাত্র সুযোগ না দিয়ে? কিংকু সাহেব, দিন তো ফিচলে দুটোর হাতে হাতকড়া এঁটে!' বজরঙ্গের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে যায়, সে তাড়াতাড়ি বলে, 'না স্যার, আমি সে কথা বলছি না।

' ঝাকানাকা এবার খানিকটা প্রসন্ন মুখে বললেন, 'তবে কী বলতে চাও?' 'আপনি যে বললেন, সত্যি কি না, আমি ভাবলাম, ব্যায়ামের কথা বলছেন বুঝি, তাই হ্যাঁ বলেছি স্যার। আমার স্যার, একটু স্বাস্থ্যবাতিক আছে আর কি, তাই খুব ভোরে উঠে ব্যায়াম করতে বসি। ডন বৈঠক দেই, আর ছোলাটোলা খাই, আপনাদের দোয়ায় স্বাস্থ্য আমার খারাপ না। ' সত্যি সত্যি শার্টের হাতা গুটিয়ে দোয়াদত্ত এক গুচ্ছ চারতলা পেশি দেখিয়ে দেয় সে। 'কিন্তু এই ব্যাটা বল্টু যা বলছে, তা মোটেও সত্যি নয় স্যার।

আমি কেন মামাকে খুন করতে যাবো?' 'বল্টু কী?' ঝাকানাকা প্রশ্ন করেন। 'কী নয়, বলুন কে! এই যে, এই অকর্মার ধাড়িটার নামই তো বল্টু!' জব্বলপুরীকে দেখিয়ে বলে বজরঙ্গ। 'ব্যাটার নাম তো খুব জাঁকের, জিন্দাদিল জব্বলপুরী, কিন্তু সবাই ওকে বল্টু নামেই চেনে। ' 'আচ্ছা!' মোচে তা দিলেন ঝাকানাকা। 'আর ও মোটেও সত্যি বলেনি স্যার!' বসুনিয়া এই ফাঁকে ডুকরে ওঠেন।

'আমি স্যার, গাঁজাফাঁজা খাই না স্যার। সারারাত জেগে থাকতে হয়, সকালে একটু দুধ না খেলে শরীরে বল আসে না স্যার। তাতেও এই বল্টু শালার আপত্তি। আর নিজে দুলাভাইয়ের পয়সায় ঘিচপচপ পরোটা আর মুগর্া মোসল্লম ওড়ায়! ওর স্বাস্থ্যটাই বা খারাপ কিসে, বলুন? বছরে পর বছর মাগনা খেয়ে খেয়ে ওর ভুঁড়িটা কেমন হয়েছে, একবার পাঞ্জাবী উল্টে পরখ করে দেখুন না স্যার। ওরকম একটা ভুঁড়ি থাকলে বালিশ লাগে? ঐ ভুঁড়ি দিয়েই তো ও দুলাভাইকে খুন করেছে!' 'হুমম।

' জব্বলপুরী ওরফে বল্টুর পাঞ্জাবীআবৃত ভুঁড়ির দিকে একটি কটাক্ষ হানেন ঝাকানাকা। 'হ্যাঁ, ভুঁড়িটা তো নেহায়েত ফেলনা নয় --- যদিও ভুঁড়িটুড়ি ফেলে দেয়াই ভালো। ' বল্টু এবার দাঁতে দাঁত পিষে বলেন, 'আমি আমার শ্বশুরের পয়সায় খাই, তাতে তোদের এতো জ্বলে কেন রে, পরগাছার দল? দাঁড়া, এবার তোদের পেঁদিয়ে এই বাড়িছাড়া যদি না করেছি তো আমার নাম বল্টু, মানে জিন্দাদিল জব্বলপুরীই নয়!' ছাগলটা ম্যা করে ওঠে। ঝাকানাকা গর্জে ওঠেন, 'খামোশ!' সবাই থেমে যায়, ছাগলটাও। ঝাকানাকা খানিকটা পায়চারি করে বলেন, 'খুবই সন্দেহজনক।

এ বাড়িতে নিহত আওরঙ্গ আলম বাদে আর মাত্র চারজন বাস করেন, বনানী, বল্টু, বজরঙ্গ আর বসুনিয়া। চারজনের নামই তো ব দিয়ে শুরু। আবার আওরঙ্গ সাহেব দ্বিতীয় মৃতু্যর আগে যে প্রথম গানটা জুড়ে দিয়েছিলেন, তাতেও ব আছে চারবার! মনে তো হচ্ছে, চারজন মিলেই কাজটা করেছে!' এবার সবার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে যায়। ঝাকানাকা আড়চোখে তিনজনকে দেখেন। তারপর গলা খাঁকরে বলেন, 'মিসেস বল্টু, মানে বনানী পারভিন তো হাসপাতালে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন।

তাঁকে এখনো জিজ্ঞাসাবাদ করা যায়নি। তবে তিনিও আমাদের সন্দেহের তালিকায় বিদ্যমান। যাই হোক, আপনাদের প্রাথমিকভাবে যখন পুলিশ জেরা করেছে, আপনারা একেকজন একেকরকম কাহিনী পয়দা করেছেন। আপনাদের তিনজনের মধ্যে একজনের কাহিনীতে গলদ থাকবে, স্বাভাবিকভাবেই, কারণ খুনটা সেই ব্যাটাই করেছে! আসুন দেখি, আরেক দফা শোনা যাক গল্পগুলো। প্রথমে আপনি, বল্টু, বলুন, কী হয়েছিলো সে রাতে?' বল্টু ঘাবড়ে গিয়ে বলেন, 'আমি? আমি কেন শুরুতে বলবো? এই বজরঙ্গ আর ঐ বসুনিয়া, ওরাই বলুক না আগে।

ওদের গল্পেই বিস্তর গলদ পাবেন আপনি। মিথু্যকগুলো রোজ বাজারের পয়সা মারতো, আর হিসেব দিতে গিয়েই আব্বাসাহেবের কাছে ধরা খেতো!' বজরঙ্গ বাইসেপ ফুলিয়ে বল্টুর দিকে ফেরেন। 'আর তুই? ব্যাটা ঘাগু চোর! তোকে তো মামা একদিনও পাকড়াতে পারেনি, অথচ তুই রোজ বাজারের পয়সা ঝেড়ে দিয়ে সিনেমা দেখিস, বিড়ি খাস, ফকিরকে পয়সা বিলিয়ে বেড়াস, ব্যাটা ফাজিলের ঝাড়!' বসুনিয়াও ফুঁসে ওঠেন, 'বাজারের পয়সা মেরে মেরে তুই গাঁজা খাস রাতের বেলা, তুই!' 'চোপ!' গর্জে ওঠেন ঝাকানাকা। 'কী হলো, বল্টু?' বল্টু গলা খাঁকরে বলেন, 'আচ্ছা, আচ্ছা, বলছি শুনুন। ' আড়চোখে বাকি দুজনের দিকে চেয়ে দেখলেন একবার, তারপর বলতে লাগলেন।

'আমাদের ঘরটা দোতলায়, ডানদিকে। তো, রাতে শুয়ে আছি, এমন সময়, নিচে ক্যাঁঅ্যাঁচ ক্যাঁঅ্যাঁচ করে একটা শব্দ হলো। আমি বনুকে বললাম, "এটা কিসের শব্দ?" বনু বিরক্ত হয়ে বললো, "তোমার মাথা!" আমি বললাম, "চোর না তো?" বনু বললো, "তোমার কি মাথা খারাপ? চোর এসে কী ঘোড়ার ডিম চুরি করবে, এ বাড়িতে চুরি করার মতো আছে কিছু? তাছাড়া এ বাড়িতেই তো জলজ্যান্ত দুটো চোর বাস করে, বাইরে থেকে আবার চোর আসতে হবে কেন?" তো, আমি ভেবে দেখলাম, কথা সত্য ---। ' বজরঙ্গ আর বসুনিয়া, দুজনই শার্টের হাতা গোটাতে গোটাতে উঠে দাঁড়ালেন। বল্টু জব্বলপুরী তাড়াতাড়ি বললেন, 'আমি ভেবে দেখলাম, কথা সত্য, এ হচ্ছে আব্বাসাহেবের মতো হাড়কেপ্পনের বাড়ি, এখানে চোর আসবে কেন? তো, আমি আবার ঘুমোনোর চেষ্টা করছি, এমন সময় সিঁড়িতে খুটখুট আওয়াজ হলো।

আমি আবার বললাম, "বনু, সিঁড়িতে কিসের শব্দ?" বনু ঘুমিয়ে পড়েছিলো, সে মহা ক্ষেপে গিয়ে বললো, "আমার মাথা!" তো, আমি ভাবলাম, নিশ্চয় বসুনিয়া কোথাও থেকে গাঁজাটাজা খেয়ে বাড়ি ফিরেছে, তো, আবার শুয়ে পড়লাম। ' বসুনিয়া পাঞ্জাবীর হাতা আবার কব্জি পর্যন্ত সমান করে এনেছিলেন, তিনি এ কথা শুনে আবারও তা গোটাতে শুরু করলেন, কিন্তু ঝাকানাকা একটি রক্তজলকরা কটাক্ষ ঝেড়ে তাঁকে নিবৃত্ত করলেন। জব্বলপুরী বলতে লাগলেন, 'একটু পরেই কেমন একটা হাত-পা ছোঁড়াছুঁড়ির শব্দ হতে লাগলো, আমি বনুকে বললাম, "বনু, একটা মারামারির শব্দ হচ্ছে, শুনতে পাচ্ছো?" বনু এবার চোখ খুলে বললো, "হ্যাঁ, তাই তো!" এরপর আবার সিঁড়িতে একটা খটখট শব্দ হলো, তারপর আবার ক্যাঁঅ্যাঁচ ক্যাঁঅ্যাঁচ করে শব্দটা হলো। আমি উঠে বসে বললাম, "চলো, দেখে আসি। " বনু বললো, "হ্যাঁ, চলো।

" তারপর আমরা দুজন ঘর থেকে বেরিয়ে দেখি, আব্বাসাহেবের ঘরের দরজা খোলা, ভেতরে আলো জ্বলছে! তখনই বুঝলাম, ডাল মে কুছ কালা হ্যায়, কারণ আব্বাসাহেব কখনো রাতে নিজের ঘরে আলো জ্বলতেন না, পয়সা বাঁচানোর জন্যে। বনু তো ভেতরে গিয়ে উঁকি দিয়েই চেঁচাতে লাগলো। তারপর আমিও উঁকি দিয়ে দেখি, আব্বাসাহেব খাটের ওপর তিনভাঁজ হয়ে পড়ে, মুখের ওপর বালিশ। এই দুই বদমায়েশকে ডাকাডাকি শুরু করলাম। একটু পর নিজের ঘর থেকে এই বজরঙ্গ শালা বের হয়ে এলো, চোখ ডলতে ডলতে, এমন একটা ভাব যেন সে ঘুমোচ্ছিলো, কিন্তু মুখ দিয়ে ভকভকিয়ে তাড়ির গন্ধ বেরোচ্ছে, মাতাল কোথাকার! --- তারপর ঘরে ভেতরে একবার উঁকি দিয়েই সে চেঁচাতে লাগলো।

তখন বাইরে থেকে গদাম করে দরজা খুলে বসুনিয়াটা লুঙ্গি মালকোঁচা মেরে ছুটতে ছুটতে এলো --- তারপর হাঁপাতে হাঁপাতে সিঁড়ি বেয়ে উঠলো, তারপর ঘরে ঢুকে বিকট একটা চিৎকার দিলো। তো, আমি সবাইকে কোনমতে শান্ত করে বললাম, চলো, বালিশটা উল্টে দেখি! তখন এই বজরঙ্গ বলে কি, "আমি ঐ বালিশে হাত লাগাতে পারবো না, ওটা কয় মাস ধোয়া হয় না কে জানে, চিমসে একটা গন্ধ বেরোচ্ছে, দেখছো না?" আমি বললাম, "তবে রে অকৃতজ্ঞ, যার পয়সায় খেয়েপরে বেঁচে আছিস, তার জন্যে এটুকুও করতে পারবি না, পাষন্ড কাঁহিকা?" তখন বজরঙ্গ আমায় তেড়ে মারতে এলো। তখন বনু সবাইকে ধমকে এগিয়ে গেলো। সে বালিশটা তুলতেই দেখি, আব্বাসাহেবের মুখ নীল হয়ে আছে, চোখ উল্টে জিভ বের করে পড়ে আছেন! সেই চেহারা দেখে আমরা আবার চিৎকার করে উঠলাম, আর এই বসুনিয়াটা, জানেন, খিকখিক করে হেসে ফেললো! তখন আব্বাসাহেব পট করে একটা চোখ খুললেন। তারপর কাঁপতে কাঁপতে একটা হাত তুলে একবার বজরঙ্গকে, আর একবার বসুনিয়াকে দেখিয়ে বললেন, "ব --- ব --- ব --- ব ---", তারপর তাঁর হাতটা বিছানাতে পড়ে গেলো।

আমি তখন কাছে গিয়ে ওনার বুকে কান পেতে দেখি, কোন শব্দ হচ্ছে না। তারপর বনু কাঁদতে কাঁদতে ফিট হয়ে গেলো। তারপর এই বজরঙ্গ ডাক্তার আর পুলিশকে ফোন করলো। তারপরই তো আপনারা এলেন। ' ঝাকানাকা মনোযোগ দিয়ে সব শুনলেন, তারপর বজরঙ্গ আর বসুনিয়ার দিকে ফিরলেন।

দুজনেই মহা চটে বল্টু জব্বলপুরীর দিকে রোষকষায়িত চোখে তাকিয়ে আছে, দুজনেরই পাঞ্জাবীর হাতা গোটানো, বাইসেপ বিপজ্জনকভাবে উদ্যত। 'ইনি যা বললেন, তা সত্যি?" 'মোটেও না!' গরম গলায় বলে বজরঙ্গ। 'মিথু্যকটা আগাগোড়া মিথ্যে কথা বলছে! আমাদেরকে কায়দা করে ফাঁসিয়ে দিতে চায় ব্যাটা ফেরেব্বাজ! আর আমি মোটেও তাড়িফাড়ি খাই না, বরং এই ব্যাটা বল্টুই মাঝে মাঝে রাতে ছাদে গিয়ে ব্যাটারিভেজানো ধেনো খায়!' 'হ্যাঁ!' জোর গলায় সমর্থন জানালেন বসুনিয়া। 'ও ব্যাটা নিজে খুন করে আমাদের ওপর দোষ চাপাতে চায়! ও আগেও এমন করেছে। বাজারের পয়সা মেরে আমার ঘাড়ে দোষ চাপিয়েছে!' 'চোপ!' গর্জে ওঠেন ঝাকানাকা।

'এবার বজরঙ্গ, আপনি বলুন। কী ঘটেছিলো সে রাতে?' বজরঙ্গ গলা খাঁকরে শুরু করেন। 'আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। অনেক ভোরে উঠতে হয় ঘুম থেকে, ব্যায়াম করতে হয়, নাশতা করতে হয়, তো, সকাল সকাল না ঘুমোলে আমার পোষায় না। আমার ঘরটা দোতলার এক কোণে, এই বল্টুর ঘরের উল্টোদিকে, সিঁড়ির এপাশে।

চেঁচামেচির শব্দে আমার ঘুম ভেঙে যায়, আমি উঠে বসি। তারপর শুনতে পাই, বনা বলছে, "হায় হায়, এখন কী হবে?" তার জবাবে শুনলাম বল্টু বলছে, "চিৎকার করো না বুদ্ধু মেয়েছেলে, পাড়াপড়শী সবাই এসে জড়ো হবে তাহলে। " এই শুনে আমি আমার ঘর থেকে বের হই, দেখি মামার ঘরের দরজায় বনা দাঁড়িয়ে, আর এই বল্টু মামার ঘর থেকে বেরিয়ে আসছে। আমার খটকা লাগলো, আমি দৌড়ে গিয়ে ঘরে ঢুকে দেখি, ঘরে আলো জ্বলছে, মামা হাত পা কেৎরে বিছানার ওপর শুয়ে, মুখের ওপর সেই ময়লা বালিশটা গোঁজা। আমি বুঝলাম, একটা ঝামেলা করেছে বল্টু।

আমি চিৎকার করে বসুনিয়াকে ডাকতে লাগলাম। তো, আমার চিৎকার শুনে বসুনিয়া দৌড়ে এলো বাইরে থেকে। সে এই ঘটনা দেখে হাউমাউ করে চেঁচিয়ে উঠলো। তখন বল্টু বললো, "রাখ রাখ, আর মরাকান্না কাঁদিসনি, খুন করে রেখে গেছিস, আবার চোখের জল ঝলসাচ্ছিস যে বড়! এই বজরঙ্গ, বালিশটা তুলে দেখ, কঞ্জুষ বুডঢার কী অবস্থা। " আমি বললাম, "তুই দেখ না, আমি ঐ ময়লা বালিশে হাত দিতে পারবো না।

" আমার আবার, স্যার, একটু শুচিবাই আছে। তো, এই কথা শুনে বল্টু খুব লাফাতে লাগলো, বললো, "খুন করার সময় তো ঠিকই ধরেছিলি, আর এখন ধরতে মানা? ভন্ডামির আর জায়গা পাস না? পীর সাজতে চাস? আউলিয়া বনতে চাস? পেঁদিয়ে তোর পীরগিরি যদি না ছোটাই তো আমার নাম বল্টুই নয়!" তো, আমিও স্যার, লুঙ্গিটা মালকোঁচা মেরে তৈরি হয়েছি, শালাকে মাথার ওপর এক পাক ঘুরিয়ে একটা আছাড় মারবো, তখন বনা বললো, 'বল্টু, ভাইয়া, তোমরা যদি বেশি গ্যাঞ্জাম করো, দুজনকেই ঝাড়ু মেরে খেদিয়ে দেবো কিন্তু!" তো, আমরা এই কথা শুনে চুপ করে গেলাম। তখন বনা এগিয়ে গিয়ে মামার মুখ থেকে বালিশটা সরালো। দেখলাম, মামার মুখ পুরো নীল হয়ে আছে, মুখে ফেনা, চোখ বন্ধ। বসুনিয়া তখন "দুলাভাই গো" বলে কেঁদে উঠলো, আর এই বল্টু শালা বললো, "হে হে হে, এক্কেবারে সিনেমার মতো, ঠিক সিনেমার মতো!" তখন মামার হাত নড়ে উঠলো।

তারপর মামা চোখ খুলে একটা হাত উঁচু করে কোনমতে বললেন, "ব --- ব --- ব --- ব ---। " তারপর তিনি ঢলে পড়ে গেলেন। এই সিন দেখে বনা গেলো ফিট হয়ে। --- এই তো, তারপর আমরা আপনাদের খবর দিলাম। ' 'ইন্টারেস্টিং!' বলে উঠলেন ঝাকানাকা।

'খুবই। ' মাথা দোলালেন কিংকু চৌধারি। বল্টু লাফিয়ে উঠলেন। 'একগাদা মিথ্যে বলেছে এই বজরঙ্গ হারামীটা!' গলার রগ ফুলিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি। 'মোটেও আমি আব্বার ঘরে আগে ঢুকিনি! আমরা সবাই একসাথে আব্বাসাহেবের ঘরে ঢুকেছি! আর --- আর কখনো আমি আব্বাসাহেব সম্পর্কে এমন বাজে --- এমন বাজে উক্তি করিনি!' 'এহেহেহেহে!' ভেঙচে উঠলেন বসুনিয়া।

'উক্তি করিনি! উক্তি করিনি! --- উক্তি করিসনি মানে? দিনরাত দুলাভাইকে গাল দিয়ে বেড়াতিস, আবার এখানে সাধু সাজতে চাস!' ঝাকানাকা একটা সম্ভাব্য মারামারিকে গলা টিপে মেরে ফেলেন। 'চোপ! বল্টু, বসে পড়ুন, নয়তো সোজা গারদে পুরে দেবো। আর বসুনিয়া, এবার আপনার পালা। বলুন, কী হয়েছিলো সে রাতে?' বসুনিয়া অস্বস্তিতে শরীর মুচড়ে শুরু করেন, 'ইয়ে --- মানে, আমি থাকি বাইরের ঘরটাতে। এ বাসায় কোন দারোয়ান নেই, তাই আমাকেই অনেকটা চারদিকে ইয়ে --- মানে, মাঝে মাঝে রাতে চোখকান একটু খোলা রাখতে হয় আর কি।

কিন্তু, সেদিন সন্ধ্যাবেলা আবার আমাকে আটা কিনতে বাজারে যেতে হয়েছিলো। আমরা আবার কয়েকমাসের আটা একবারে কিনে রাখি, তাতে দরে সস্তায় পড়ে তো! তাছাড়া এই বজরঙ্গ ছেলেটা, সত্যি বলতে কি, খায় একটু বেশি। ' বজরঙ্গ একটু নড়েচড়ে বসে, কিন্তু কিছু বলে না। 'তো, সেই কয়েকমণ আটা বয়ে এনে বেজায় কাহিল লাগছিলো আমার। তার ওপর, রাতে বনা রান্না করেছিলো খিচুড়ি আর মাছ ভাজা।

তো, আমার এমন ঘুম পাচ্ছিলো, বুঝলেন, একটু জলদি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম ---। " বল্টু লাফিয়ে ওঠেন, 'এই ব্যাটার কাজ হচ্ছে দারোয়ানগিরি করা, আর এই শালা রাতে জেগে থেকে হয় গাঁজা খায়, নয়তো আদপে জেগেই থাকে না, পড়ে পড়ে ঘুমোয়। ওর গাফিলতির জন্যেই এই বজরঙ্গ বদমাশটা মামাকে খুন করতে পেরেছে!' বজরঙ্গ এবার তেড়ে যান বল্টুর দিকে। 'বটে? আর তুই খুব সাধু নাকি? তোরও তো হপ্তায় তিন দিন দরোয়ানের ডিউটি করতে হয়, তুই তখন কী করিস রে, য়া্যাঁ, শুনি? তুই তো তখন এই বসুনিয়ার কল্কেতে করেই গাঁজা টানিস, ব্যাটা নেশারু!' বসুনিয়া চেঁচিয়ে ওঠেন, 'ডাঁহা মিথ্যে কথা, আমার কোন কল্কে নেই!' ছাগলটা এবার সটান দাঁড়িয়ে গিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে, ম্যাঅ্যাঅ্যা! ঝাকানাকা গর্জে ওঠেন, 'চোপ!' কল্কে না পেয়ে সবাই বসে পড়ে। ছাগলটাও।

'বসুনিয়া, বলে যান। এরপর যে কথার মাঝখানে কথা বলবে তাকে শরীরের নরম অংশে দু'ঘা বেত লাগানো হবে। ' ফাঁকতালে বজ্রকন্ঠে বলে ওঠেন কিংকু চৌধারি। ঝাকানাকা আড়চোখে তাকান তাঁর দিকে। বসুনিয়া বলতে থাকেন, 'আমি সেদিন ভরপেট খেয়ে একটু তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

হঠাৎ একটা গোলমালে আমার ঘুম ভেঙে গেলো। আমি শুনলাম, ওপরে বজরঙ্গ আমাকে ডাকছে, "বসুনিয়া, জলদি আয়, খুন, খুন হয়েছে!" আমি তাড়াহুড়ো করে চাবি দিয়ে দরজা খুললাম, তারপর ভেতরে ঢুকে আবার চাবি দিয়ে দরজা বন্ধ করলাম। তারপর দৌড়ে ওপরে উঠে দেখি, দুলাভাইয়ের ঘরের ভেতরে সবাই ভিড় করে দাঁড়িয়ে, মামার ঘরে আলো জ্বলছে। আমি বুঝলাম, ডাল মে কুছ কালা হ্যায়। ভেতরে ঢুকে দেখি, দুলাভাই বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে পড়ে আছে, মুখের ওপর একটা বালিশ চাপা দেয়া, আর বনা খুব কান্নাকাটি করছে।

তখন, আমিও চিৎকার করে উঠলাম। তখন এই বল্টু শালা আমাকে ভ্যাঙাতে লাগলো, বললো, আমিই নাকি খুন করে রেখে গেছি, এখন বাঙলা সিনেমায় শাবাহানার মতো ন্যাকা সেজে নকল কান্নাকাটি করছি। তারপর বল্টু বজরঙ্গকে বললো বালিশটা তুলে দেখতে। বজরঙ্গ বললো, সে এসব ময়লা জিনিসে হাত লাগাতে পারবে না, তার নাকি তাহলে পরে চুলকানি হতে পারে। বল্টু তখন মুখ ভেঙচে বললো, "বটে? তাহলে খুন করার সময় কি দস্তানা লাগিয়ে ধরেছিলি নাকি? এক চড়ে মামাবাড়ি পাঠিয়ে দেবো, ব্যাটা বেলি্লক, মুখের ওপর কথা বলিস!" বজরঙ্গ তখন ধমক দিয়ে বললো, এটাই তার মামাবাড়ি।

বল্টু তখন বললো, এই মামাবাড়ি নয়, সে বজরঙ্গকে জেলখানার মামাবাড়িতে পাঠিয়ে দেবে। বজরঙ্গ তখন হো হো করে হেসে উঠে বললো, "অশিক্ষিত কোথাকার, লোকে জেলখানাকে মামাবাড়ি বলে না, বলে শ্বশুরবাড়ি। " তখন বল্টু একটা ঘুষি পাকিয়ে খুব লম্ফঝম্ফ করতে লাগলো। তখন বনা দুজনকে ধমকে দিয়ে নিজেই গিয়ে বালিশটা তুললো। তুলতে দেখি, দুলাভাইয়ের মুখ নীল হয়ে আছে, মুখে ফেনা গড়াচ্ছে, চোখ উল্টে আছে।

আমরা এটা দেখে আবারো হায় হায় করে উঠলাম, বল্টু খ্যাকখ্যাক করে হাসতে লাগলো, আর বজরঙ্গ বললো, "এহহে, কী অস্বাস্থ্যকর!" তখন দুলাভাই চোখ খুললেন, একটা হাত তুললেন, তারপর বল্টুকে দেখিয়ে চোখ পাকিয়ে বললেন, "ব --- ব --- ব --- ব ---!" তারপর তিনি মারা গেলেন। বল্টু তখন বললো, "মরে গেলো? গেলো তো? নাকি আবারও উঠবে?" বজরঙ্গ আর আমি দাঁড়িয়ে রইলাম, বল্টু এগিয়ে গিয়ে দুলাভাইয়ের পালস দেখলো, গালে চাপড় মারলো, শেষে বুকে কান পেতে শুনলো। তারপর বললো, "খতম!" বনা তখন চিৎকার দিয়ে মাটিতে পড়ে কাঁদতে লাগলো, তারপর মুখে গ্যাঁজলা তুলে ফিট হয়ে গেলো। ব্যস, তারপর আমরা ডাক্তার আর পুলিশে ফোন করলাম। ' বল্টু চোখ লাল করে কিছু একটা বলতে যাবেন, এমন সময় কিংকু চৌধারি বেতটা বের করে সবাইকে দেখালেন, সবাই চুপ করে গেলেন।

গোয়েন্দা ঝাকানাকা এবার এগিয়ে এসে বসলেন। তাঁর চোখ সরু, হাবভাব সুবিধের নয়। তিনি একটা বাঁকা হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে বললেন, 'বটে? দেখা যাক। সব কিছু চুলচেরা বিশ্লেষণ করে দেখা যাক। ' এই বলে তিনি নিজেই একটা নোটবই খুলে পেন্সিল বাগিয়ে ধরেন।

আর সেইসাথে তাঁর খেইল শুরু হয়। 'মৃত আওরঙ্গ আলম, তিনি ছিলেন বিপত্নীক, এবং অপুত্রক। নবীন পাঠকদের সুবিধার জন্যে সোজা বাংলায় বলছি, তাঁর স্ত্রী মারা গিয়েছিলেন, এবং কোন ছেলে জন্মায়নি। তিনি প্রচুর টাকা পয়সা এবং সম্পত্তি রেখে গেছেন, যাঁর অংশীদার, যথাক্রমে তাঁর কন্যা, জামাতা, ভাগ্নে আর শালা। এঁরা ছাড়া তাঁর নিকটাত্মীয় কেউ ছিলো না।

এবং, এঁরা অনেকদিন ধরেই তাঁর সাথে বাস করছেন। ' ঝাকানাকা পকেট থেকে একটা চকলেট বের করে মুখে পুরে দেন। অন্যান্য গল্পের গোয়েন্দাদের মতো পানতামাক খাবার বদভ্যেস তাঁর নেই। চকলেট খেতে খেতে আবারো বলতে থাকেন তিনি। 'কিন্তু, আওরঙ্গ আলম ছিলেন, যাকে বলে হাড়কেপ্পন, মাইজার টু দ্য কোর।

এত টাকা থাকা সত্ত্বেও তিনি রিকশায় চড়তেন, গাড়ি কেনেননি। একটা বালিশ দিয়েই তিনি বছরের পর বছর কাটিয়ে দিয়েছেন। তিনি খবরের কাগজ পড়তেন বছরে তিনবার, নাপিতের দোকানে গিয়ে। তাঁর বাড়িতে কোন কাজের লোক নেই, বরং ঘরের লোককেই সেখানে কাজ করে খেতে হয়। তাঁর রাঁধুনীর দায়িত্ব পালন করতেন বনানী পারভিন, তাঁর বাজারু-কাম-দরোয়ানের দায়িত্ব পালন করতেন জিন্দাদিল জব্বলপুরী, তাঁর পিয়ন-কাম-বাটলারের দায়িত্ব পালন করতেন বজরঙ্গ বাহরাম, আর তাঁর দরোয়ান-কাম-বাজারু ছিলেন বিল্লাল বসুনিয়া।

শুধু তাই না! এঁদের প্রত্যেককেই পালা করে গোটা বাড়ি ঝাঁট দিতে হতো, নিজেদের জামাকাপড় নিজেদের কাচতে হতো, নিজেদের বাসনকোসন নিজেদের মাজতে হতো। আর জামাকাপড়ের অবস্থাও তথৈবচ, কারণ গতকাল গোটা বাড়ি আমি তন্নতন্ন করে তল্লাশী করেছি, এই দেয়াল আলমারিটা বাদে, কারণ ওটা চাবি লাগানো। কিন্তু একেকজনের কপালে পুরনো কয়েকটা মোটে জামা ছাড়া আর কিছুই জুটতে দেখিনি। এ বাড়িতে সবাই তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে বিদু্যতের খরচ বাঁচানোর জন্যে। এ বাড়ির টেলিভিশনটা আদ্যিকালের মডেলের, তাতে সরকারি টেলিভিশন ছাড়া আর মাত্র দুতিনটে চ্যানেল ধরে, নাচগানওয়ালা কোন চ্যানেল তাতে দেখা সম্ভব নয়।

আর ধরলেও লাভ হতো না, কারণ, আওরঙ্গ আলম স্যাটেলাইটের কানেকশন নেননি। এমনকি লোকে বাঁশের আগায় হাঁড়িপাতিল ফিট করেও তো দুয়েকটা চ্যানেল পাকড়াতে পারে, কিন্তু তিনি সে চেষ্টাও করেননি। ' সবাই অধোবদনে বসে থাকে। 'এর মানে কী? এর মানে হচ্ছে, এ বাড়ির সদস্যরা, যারা হয়তো আধুনিক জীবন সম্পূর্ণভাবে উপভোগ করতে চান, তাঁরা বাধ্য ছিলেন কৃপণের মতো জীবন যাপন করতে। কিন্তু কে না চায়, বুয়ার হাতে রান্না খেতে, কাজের লোকের হাতে বাজার করাতে, দারোয়ানের হাতে গ্যাসপানিবিদু্যতের বিল পাঠাতে? কে না চায় হাল ফ্যাশানের জামাকাপড় পরে শপিং করতে, লেটেস্ট মডেলে গাড়িতে চড়ে দামী রেস্তোরাঁয় খেতে যেতে, সন্ধ্যেবেলা টিভি ছেড়ে ইদানীংকার নাচে গানে ভরপুর সিনেমাগুলো দেখতে? কাজেই, এই হাড়ভাঙ্গা হাড়কঞ্জুষ জীবন থেকে নিষকৃতি পেয়ে বিলাসব্যসনে জীবন কাটানোর একটি মাত্রই পথ খোলা ছিলো তাঁদের সামনে, সেটি হচ্ছে, আওরঙ্গ আলমকে তার জীবন থেকে নিষকৃতি দেয়া।

অর্থাৎ, আমি বলতে চাইছি, এ ব্যাপারে তাঁদের প্রত্যেকেরই একটি জোরালো মোটিভ ছিলো। কাজেই, এঁদের মধ্যে যে কোন এক, বা একাধিক লোক এই খুন করে থাকতে পারেন। আপনাদের জোরালো কোন অ্যালিবাই নেই, কাজেই আমার চোখে এখানে সবাই খুনী। তবে, আমার ধারণা, খুনের ফলে সবাই উপকৃত হলেও, খুনটা করেছে একজন, বা দু'জন। ' তবুও সবাই অধোবদনে বসে থাকে।

'এবার আসুন, আমরা আরো দূর অতীতকে যাচাই করে দেখি। প্রথমেই যিনি অনুপস্থিত, সেই বনানী পারভিনের ঘটনা। এ ঘটনা আমরা জানতে পেরেছি প্রতিবেশী মিসেস হাক্কানীর কাছ থেকে, যিনি মাঝে মাঝে এ বাড়িতে বেড়াতে আসতেন। গত পরশু দিন, সন্ধ্যে ঊনিশশো ঘন্টায়, আওরঙ্গ আলমের সাথে বনানীর তুমুল বচসা হয়। বনানী বলেন, সারাটা জীবন তিনি আওরঙ্গ আলম আর তাঁর একপাল জ্ঞাতিগোষ্ঠীর খেদমত করে আসছেন, রান্নাঘরেই তিনি গোটা জীবনটা কাটিয়ে দিয়ে গেলেন, নিজের জামা কেচে, নিজের বাসন মেজে, আর নিজের ঘর ঝাঁট দিতে দিতে তাঁর হাতে কড়া পড়ে গেছে।

বদলে তিনি কী পাচ্ছেন? শান্তিমতো একটু বসে চা খেতে খেতে ইদানীংকার হিন্দি কুচুটে সিরিয়ালগুলোতে শাশুড়ি-বউয়ের ঝগড়ার আধুনিক কানুন সম্পর্কে যে একটু ওয়াকেবহাল হবেন, তারও তো উপায় নেই। সরকারি টিভ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.