আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

স্বদেশের কুকুর? না বিদেশের ঠাকুর??

মাঝে মাঝে বৃষ্টি দেখে হাত বাড়ানোর ইচ্ছে জাগে... ভেতর ভেতর যাই পুড়ে যাই, কেউ জানেনা আমার আগে... ছেলেবেলায় 'স্বদেশপ্রেম' নামে একখানা রচনা হরহামেশা মুখস্ত করতে হতো। সেই রচনা পড়তে গিয়ে একটা বাক্য আমাকে খুব দ্বিধাগ্রস্ত করে ফেলেছিল। বাক্যটা হচ্ছে 'যুগে যুগে মানুষ বিদেশের ঠাকুর রেখে স্বদেশের কুকুরের পূজা করেছে'। বলাই বাহুল্য, এখানে ঠাকুর শব্দটি রূপক অর্থে শ্রেষ্ঠ বা মহান হিসেবে এবং কুকুর শব্দটি নগণ্য অর্থে ব্যাবহার করা হয়েছে। বাক্যটা আমাকে রীতিমত দ্বিধাগ্রস্ত করে ফেলেছিল।

বলে কি? বিদেশের ঠাকুরের চেয়ে দেশের কুকুরও শ্রেষ্ঠ!! দিনে দিনে যত বড় হয়েছিলাম কথাটার মর্মও তত উপলদ্ধি করছিলাম। তখনো বাংলাদেশ ক্রিকেট টিমের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার সুযোগ হয়না, হয়তো কয়েক বছরে একবার সুযোগ মেলে, সবেধন নীলমণি- এশিয়া কাপ। তো টিভিতে যখন ইন্ডিয়া, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ার খেলা দেখতাম, তখন একটা ছোট্ট বিষয় ভেবে খুব উত্তেজিত হতাম, সেটা হচ্ছে, টেলিভিশন মনিটরের উপরের বা দিকে ছোট্ট করে যে স্কোরকার্ড দেখা যেত সেখানে ব্যাটিং দলের স্কোর দেখাতে তাদের রান ও উইকেট সংখ্যার সামনে তাদের দেশের নামের প্রথম তিনটি অক্ষর লেখা থাকতো (এখনো থাকে, তবে নিচের দিকে)। যেমন, INDIA কে সংক্ষেপে লেখা হতো IND, PAKISTAN কে PAK, NEW ZEALAND কে NZL, AUSTRALIA কে AUS ইত্যাদি। আবার SRI LANKA'র টা লেখা হতো SL আর WEST INDIES এর WI. আমরা বাচ্চারা তখন এইভেবে উত্তেজিত হতাম যে, ইশ! বাংলাদেশ যদি খেলে, তাহলে BANGLADESH এর ক্ষেত্রে কি লেখা হবে!! কি যে উত্তেজনা আমাদের মধ্যে।

আকরাম খান, আমিনুল ইসলাম বুলবুল, নান্নুরা তখন দেশের ঘরোয়া ক্রিকেট কাপিয়ে বেরাচ্ছেন, আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে বসে রেডিওতে তার ধারাবিবরণী শুনি। কিন্তু এদের খেলা যে টিভিতে দেখবো, সেই সুযোগ কই? তো সেবার এশিয়া কাপে বাংলাদেশের খেলা টিভিতে দেখার সুযোগ হোল। প্রথম টিভি স্ক্রীনের স্কোরকার্ডে BANGLADESH কে সংক্ষেপে BAN লিখতে দেখে সে কি উচ্ছ্বাস! ওই BAN লেখা দেখেই মনে হয়েছিলো, ক্রিকেট বিশ্বে বাংলাদেশ অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ভারত, পাকিস্তানের সমান কিছু একটা হয়ে গেছে! তো এশিয়া কাপে পাকিস্তান, ভারত, শ্রীলংকা দলের হোমরা চোমরা সব ব্যাটসম্যানরা পত্রপাঠ বল পিটিয়ে সীমানা ছাড়া করছেন, সেঞ্চুরি হাফ সেঞ্চুরীর বন্যা ছুটছে, তাদের বোলাররা মুড়ি-মুড়কির মতো উইকেট পাচ্ছেন। কিন্তু সেটা নিয়ে কার কি মাথা ব্যথা! আমাদের দেশের আকরাম ২৫ বলের মাথায় লং অনে বল ঠেলে দিয়ে যখন দুই রান নিল, আমাদের চিৎকারে তখন আকাশ বাতাসে কান পাতা দায়! বুলবুল যখন তার বিখ্যাত রিভার সুইপে চার মেরেছিল, আমাদের মনে হচ্ছিল, একটা কালোমতো বলের গড়িয়ে গড়িয়ে কষ্টে সৃষ্টে সীমানা দড়ির ওপর দিয়ে পার হবার যে দৃশ্য তার মতো সুন্দরতম দৃশ্য বোধ হয় এই পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই। ১০ ওভারে সত্তুর রান দিয়ে যখন আমাদের এনামুল হক মনি একটা উইকেট পেল, আমাদের তখন আর কিছু মনে নেই, কিচ্ছু না, অনুভূতি আর উচ্ছ্বাসের সবটুকু জুড়ে তখন কেবল বাংলাদেশ! আমার বাংলাদেশ!! সেই প্রথম আমি উপলদ্ধি করলাম, কেন মানুষ যুগে যুগে বিদেশের ঠাকুর রেখে স্বদেশের কুকুরের পূজা করেছে! দেশ হোল মা, আর মায়ের চেয়ে বড় কিছু নেই, শ্রেষ্ঠ কিছু নেই।

সেই মা অন্ধ, বোবা, কালা কিংবা অথর্ব হলেও তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ কিছু নেই! আজ ভারতের প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার ঋতুপর্ণ ঘোষ মারা গেছেন। নিঃসন্দেহে তিনি অসামান্য প্রতিভাধর একজন মানুষ। মানুষের সম্মান ও শ্রদ্ধা তার প্রাপ্য। কিন্তু তার মৃত্যু পরবর্তী গুণকীর্তন নিয়ে আমাদের আশেপাশে, বাংলাদেশে, বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলে, মিডিয়ায় যা হচ্ছে তা দেখে কোথায় যেন খুব বড়সড় একটা হোঁচট খেলাম। মনে হোল, যে তীব্র ভালোবাসা এবং অনুভূতি দেশের জন্য লালন করতাম, তা কি অন্য কোথাও নীরবে-নিভৃতে কিংবা সরবে-প্রকাশ্যে বেদখল হয়ে গেছে? আমার দেশকে, আমার মা-কে, আমার মানুষকে, আমার অনুভুতিকে যারা উপেক্ষা, তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে, শ্রদ্ধা করতে জানে না, দুঃখিত, আমি পারবোনা সে যত বড় ঠাকুরই হোক, তাকে পূজা করতে আমি পারবোনা!! হুমায়ূন আহমেদ নামে বাংলা সাহিত্যে জন্ম নিয়েছিলেন বিশ্ব সাহিত্যের অন্যতম সেরা কথা সাহিত্যিক।

এপার বাংলা-ওপার বাংলার অসংখ্য পাঠক এই জাদুকরের লেখায় মুগ্ধ হয়ে থাকতেন, কেঁদে বুক ভাসাতেন, হো হো করে হাসতেন। অথচ, এই কিংবদন্তী লেখকের মৃত্যুতে যখন কোটি কোটি চোখে অশ্রুর মহাসাগর, বাংলা সাহিত্য যখন হারাল স্মরণকালের অন্যতম প্রভাবশালী এক মহানায়ককে, তখনও কিনা এই পাশের দেশের সংবাদ মাধ্যমে ১০ সেকেন্ডের একচিলতে সংবাদ পর্যন্ত নেই! সংবাদপত্রের এমন ভাব যেন হুমায়ূন আহমেদ নামে কারো কথা তারা কখনো শোনেনইনি! কোন এক অখ্যাত পত্রিকার ভেতরের দিকের টুকরো খবর অংশে চার লাইনে হয়তো লেখা হয়, ‘মারা গেছেন প্রাবন্ধিক (!) হুমায়ূন আহমেদ’ নামক সংবাদ!! অথচ, ভারতের সবচেয়ে বিখ্যাত বাংলা ম্যাগাজিন ‘দেশ’ পত্রিকা তাদের শারদীয় সংখ্যা বের করবার আগে আমাদের হুমায়ূন আহমেদের জন্য ছয় মাস আগে থেকে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে দাদা দাদা বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেলত! আমরা দেশকে ভালোবাসি বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেলি, আমাদের টিভি চ্যানেল পর্যন্ত দাদাদের দেশে নিষিদ্ধ, অথচ, হিন্দি সিরিয়াল ছাড়া আমরা ঘুমাতে পারি না, হিন্দি গান, হিন্দি সিনেমা না দেখলে আবার জাত থাকে নাকিগো দাদা!! অ্যা?? জি বাংলা ছাড়া আবার ভাত হজম হয় নাকি দাদা। মিরাক্কেল আমাদের ক্রিকেট নিয়ে জঘন্য নোংরা রসিকতা করে, আর আমরা মিরাক্কেল না দেখলে বেয়াক্কেল হয়ে যাবার ভয়ে, প্রাণ পাঠিয়ে তাদের স্পন্সর করি, সব কাজ বাদ দিয়ে টিভির সামনে হা করে বসে থাকি! আমরা শাহরুখ, সাল্মান, রনবির, ক্যাটরিনা, প্রিয়াংকা বলতে বাক বাকুম বাকুম বাকুম। জিত, দেভ, কোয়েল মল্লিক যেন রসের ছানা, আর শাকিব খান হোলো আমাদের চোখে হিজড়া, আমরা শ্রীকান্তের কিম্ভুত নর্তন কুর্দন দেখে তাকে লিজেন্ড বলি, আর আমাদের অনন্ত জলিলকে বলি, জইল্যা! আমরা ডাক্তার ইউনুসের চৌদ্দ গুষ্ঠি উদ্ধার করি আর অমর্ত্য সেনকে চুমা চাটটায় ভরিয়ে রাখি, আমাদের স্কুল পাঠ্যপুস্তকে ভারতের এগারোজন কবির কবিতা ছাপা হবে ভেবে গর্বে আমাদের বুক ফুলে ওঠে। আহা, দাদাদের কাব্য বলে কথা! এইদেশে যারা লেখে, তারা কি না কি ছাইপাশ লেখে! ওসব কি আর গেলা যায়গো দাদা! এহ! দুগগন্ধ!! দুগগন্ধ!! আফসোস কি জানেন দাদা! আফসোস হচ্ছে, আমরাই পৃথিবীর একমাত্র জাতী, যারা স্বদেশের ঠাকুর রেখে বিদেশের কুকুরের পূজা করি! ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.