জুলাই সংখ্যা'06
হোসনে আরা আকন্দ
একদিন কিছু বাচ্চা খেলা করছিল। খেলতে খেলতে হঠাৎ তারা একটি অদ্ভুত জিনিস দেখতে পেল। এটি দেখতে অনেকটা শস্যকণার মত, কিন্তু এটি এত বড় ছিল যে, প্রায় একটি মুরগীর ডিমের মত। একজন পথচারী রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় এটি দেখতে পেলেন এবং বাচ্চাদের কাছ থেকে কিনে নিলেন। তিনি রাজধানীতে নিয়ে গিয়ে উচ্চমূল্যে রাজার কাছে বিক্রি করে দিলেন।
রাজা জিনিসটি কি তা বের করার জন্য তার জ্ঞানী সভাসদদের এক মিটিং ডাকলেন। জ্ঞানী ব্যক্তিরা বার বার জিনিসটি দেখতে লাগলেন কিন্তু বের করতে পারলেন না কিছুই। অবশেষে একটি মুরগি তাদেরকে সেই চিন্তা হতে অব্যাহতি দিল। একটি মুরগী এতে ঠোকর মেরে গর্ত করে ফেললো। আর এতে করে জ্ঞানী ব্যক্তিরা বুঝে গেল যে, এটি একটি খাদ্যশস্য।
জ্ঞানী ব্যক্তিরা রাজার কাছে গিয়ে বললো যে, এটি আসলে বড় সাইজের খাদ্যশস্য। এতে রাজা বিস্মিত হয়ে গেলেন। তিনি জ্ঞানী ব্যক্তিদের এরকম বিশাল আকৃতির শস্য কখন এবং কোথায় জন্মাতো তা বের করার জন্য বললেন। জ্ঞানী ব্যক্তিরা দিনের পর দিন চিন্তা করে নানা বই ঘেটে কিছুই বের করতে না পেরে অবশেষে রাজার কাছে এসে বললেন- "মহামান্য রাজা, আমরা তো এ সম্পর্কে আমাদের বইতে কিছুই খুঁজে পেলাম না। তাই আমরা এ সম্পর্কে কোন তথ্য আপনাকে জানাতে পারছি না।
আপনি বরং কোন বৃদ্ধ কৃষককে ডেকে জিজ্ঞেস করুন। তিনি হয়তো আপনার কৌতূহল মেটাতে পারবেন। "
তৎণাৎ রাজা লোক পাঠালেন বৃদ্ধ কৃষকের খোঁজে। রাজার লোকেরা খুবই বৃদ্ধ এক কৃষককে খুঁজে বের করলো এবং রাজার সামনে হাজির করলো। লোকটি ছিল অতিকায় বৃদ্ধ, বয়সের ভারে নু্যব্জ এবং একেবারেই দন্তহীন।
তিনি দু'টো ক্র্যাচে ভর করে রাজার সামনে এসে দাঁড়ালেন। রাজা বৃদ্ধের সামনে খাদ্যশস্য দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন- আচ্ছা আপনি কি এ ধরনের খাদ্যশস্য দেখেছেন কখনও? বলতে পারবেন কখন এবং কোথায় এটি জন্মেছে?
বৃদ্ধকে প্রায় বধিরই বলা যায়। তিনি খুব কষ্টে বুঝতে পারলেন রাজা কি বলছেন। চোখের খুব কাছে নিয়েও তিনি বুঝতে পারলেন না, জিনিসটা আসলে কি? তাই হাতে নিয়ে ধরে অনুভব করার চেষ্টা করলেন, পরে বললেন- না মহামান্য রাজা, আমি আমার জীবনে এ ধরনের কিছু দেখিনি। আপনি বরং আমার পিতাকে জিজ্ঞেস করতে পারেন।
তিনি হয়তো বলতে পারবেন।
বৃদ্ধের পিতার খোঁজে লোক পাঠানো হলো এবং তাকে দরবারে হাজির করা হলো। তিনি রাজার সামনে একটি ক্র্যাচে ভর দিয়েই হাঁটছিলেন। রাজা তাকে খাদ্যশস্যটি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলেন তিনি বলতে পারবেন কিনা কখন এবং কোথায় এটি জন্মেছে।
বৃদ্ধ কৃষকের পিতা তার চেয়ে আরো ভালো দেখতে পান এবং ভালো শুনতেও পান।
তিনি খুবই সতর্কতার সাথে খাদ্যশস্যটি দেখলেন এবং বললেন- "আমাদের সময়ে খাদ্যশস্য বর্তমানের চেয়ে বড় হতো। কিন্তু আমি ঠিক এত বড় দেখিনি। আমার পিতার মুখে শুনেছি তাদের সময়ে খাদ্যশস্য আরো বেশি বড় হতো। আপনি বরং তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করতে পারেন। আমি নিশ্চিত যে, তিনি আপনাকে সঠিক উত্তর দিতে পারবেন।
"
রাজা আবারো লোক পাঠালেন ঐ বৃদ্ধকে আনার জন্য। লোকেরা গিয়ে তাকে বাগানে কর্মরত অবস্থায় দেখতে পেল। তার দৃষ্টিশক্তি ভালো, কানে ভালো শুনেন এবং কণ্ঠও বেশ স্পষ্ট। তিনি তার ছেলের চেয়ে এবং নাতির চেয়ে অনেক বেশি সমর্থবান। সংবাদটি পেয়ে তিনি কোনরকম সাহায্য ছাড়াই সোজা হেঁটে রাজদরবারে চলে এলেন।
রাজা বৃদ্ধের দাদাকে দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন। রাজা বৃদ্ধকে খাদ্যশস্যটি দেখিয়ে পূর্বের মতই প্রশ্ন করলেন।
বৃদ্ধ এটি নিয়ে দেখলেন তারপর ুদ্র টুকরা করে মুখে দিয়ে স্বাদ নেয়ার চেষ্টা করলেন। তারপর হেসে বললেন- "হঁ্যা অনেক আগের কথা যখন আমি এমন চমৎকার শস্য দেখেছি। এরকম শস্য আমাদের সময়ে সবজায়গায়ই হতো।
যখন আমরা ছোট ছিলাম এবং যুবক বয়সেও আমরা এ শস্য খেয়েছি এবং অন্যদের খাইয়েছি। "
"আসলেই আপনারা এরকম শস্য উৎপাদন করতেন এবং বিক্রি করতেন"- রাজা জিজ্ঞেস করলেন।
"আমাদের সময়ে খাদ্যশস্য কেনা-বেচার মত এমন জঘন্য কাজ করার কথা কেউ ভাবতেও পারতো না। এত চাই চাই পাই পাই ছিলো না। প্রত্যেকেরই তার স্বচ্ছন্দে চলার মত পর্যাপ্ত খাদ্য ছিল।
"কি পরিমাণ জমি ছিল আপনাদের এবং আপনারা চাষই বা করতেন কি পরিমাণ?" রাজা জানতে চাইলেন।
"সব জমিই আলস্নাহর জমি বলে মনে করতাম আমরা এবং তা ছিল মুক্ত। " উত্তর দিল দাদু। একজন যতটুকু পারতো ততটুকুই চাষ করতো কিন্তু কেউ নিজের বলে দাবি করতো না। একমাত্র শ্রমই ছিল তার নিজের।
"
"দয়া করে আমাকে আরো দু'টি প্রশ্নের উত্তর দিন। " রাজা বললেন। প্রথম প্রশ্ন হলো- তখন কেন মাটিতে ঐরকম শস্য জন্মাতো আর কেনই বা বর্তমানে তা হচ্ছে না? দ্বিতীয় প্রশ্ন কেন আপনার নাতি দুইটি ক্রাচে ভর করে এবং আপনার ছেলে একটি ক্রাচে ভর করে হাঁটে, যেখানে আপনার কিছুই লাগে না? আপনার চোখগুলো উজ্জ্বল, দাঁত মজবুত, শ্রবণশক্তি ভালো এবং কথাবার্তা স্পষ্ট এবং শ্রুতিমধুর; আপনার সবকিছু আপনার ছেলের চেয়ে এবং নাতির চেয়ে অনেক অনেক বেশি ভালো অবস্থায় আছে। এ জিনিসগুলো কিভাবে এরকম থাকলো?"
সব জিনিসই পরিবির্তত হয়েছে কারণ, মানুষ পরিবর্তিত হয়েছে- দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে উঠলেন বৃদ্ধ। পূর্বে মানুষ আলস্নাহর আইন অনুসারে জীবন চালাতো তাং নিজের শ্রমের ওপর নির্ভর করতো।
অর্থাৎ নিজে পরিশ্রম করে নিজের চাহিদা মেটাতো। তারা নিজেরা যা উৎপাদন করতো তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতো এবং অন্যের জিনিসের প্রতি বা তাদের উৎপাদিত দ্রব্যের প্রতি লোভ করতো না। সেইসব সোনালি দিনগুলোতে তারা তাদের জীবন পরিচালনা করতো আলস্নাহর আইন অনুসারে আর নির্ভর করতো নিজের মতার উপরে। বর্তমানে জিনিসপত্র ও রকম হয়ে গেছে কারণ মানুষ এখন আর আলস্নাহর আইন মানতে চায় না। নিজের মতার ওপর নির্ভর করে বাঁচতে চায় না।
নিজের যা আছে তা নিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারে না, তাদের লোভ হচ্ছে অন্যের যা আছে তার উপরে। বৃদ্ধ আেেপর সরে বলে উঠলো- হায়রে সময়, হায়রে মানুষ!
[টলস্টয় থেকে]
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।