শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। পরীক্ষা পদ্ধতির মান হওয়া চাই শিক্ষিত মানুষ তৈরির সহায়ক। ইদানীং সরকারের পক্ষ থেকে বিনামূল্যে বই বিতরণ, এমপিওভুক্তি, নতুন শিক্ষক নিয়োগ, সৃজনশীল বিষয় প্রবর্তন, মাধ্যমিক পরীক্ষায় শতভাগ পাসের ফল নিয়ে হৈ-হৈ রৈ-রৈ রব তুলে মঙ্গলগ্রহ জয়ের আওয়াজ তোলা হচ্ছে। মেরুদণ্ডহীন শিক্ষাব্যবস্থা আছর করেছে বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। পরিতাপের বিষয় বর্তমান পরীক্ষা পদ্ধতি ছাত্রদের বিদ্যাহীন উচ্চ নম্বর বিতরণ করছে।
অন্যদিকে দুর্নীতি, অনিয়ম, গোঁজামিল আর বাণিজ্য সম্প্রসারণের হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছে কিছু শিক্ষক নামধারী বণিকের। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনেক অর্জন চাপা পড়ে যাচ্ছে বিতর্কিত নম্বর বিলানোর উৎসবে। লোভের বশবর্তী হয়ে এ বাণিজ্যে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে কিছু অবসরপ্রাপ্ত প্রিন্সিপাল। যারা ক্যাডেট কলেজের বা নাম করা অন্য স্কুলের বা রাজউক কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন। তাদের অতীত ইমেজ ব্যবহার করে শিক্ষা ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছেন।
শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের অতীত জীবন ছিল আদর্শ শিক্ষা বিস্তারের, বর্তমানে দুই হাতে টাকা কামাই করার ফিকিরে মশগুল। অর্থই জীবনের সব নয়। অনেক ভালো ছাত্র পয়দা করছেন এই অতীত গুণী শিক্ষকরা, যারা আপনাদের হয়ে পৃথিবীতে সৌরভ ছড়াচ্ছে। ব্যবসাই যদি করতে হয় অনেক ব্যবসা আছে, শিক্ষা নিয়ে ব্যবসা করা অনুচিত।
খ্যাতনামা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা অবসরে এসে বাড়তি রোজগারের আশায় স্কুল নামের শিক্ষা ব্যবসার দোকান খোলেন নিজের মালিকানায়।
তারা চাতুর্যের সঙ্গে আগের পদ-পদবি নামের পরে বসিয়ে চীনের প্রাচীরের মতো লম্বা এক লাইন অতীত অভিজ্ঞতার বিশেষণ সংযুক্ত করেন অনভিজ্ঞ ছাত্র-অভিভাবককে আকর্ষণ করার অভিলাষে। বর্তমান শিক্ষা পদ্ধতি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে বিদ্যা বিতরণের বদলে সনদ বিক্রয়কেন্দ্রে পরিণত করেছে। ছাত্ররাই বলাবলি করে, ৪০ মার্কের অবজেক্টিভ প্রশ্নের উত্তর তাদের পড়া লাগে না, শিক্ষকরা পরীক্ষার হলে উত্তর বলে দেন। বাকি ৬০ মার্কের জন্য পরীক্ষার হলে বই তাবিজ সুতা যে যা পারে তাই নিয়ে হলে ঢোকে দেদার দেখাদেখি, মতবিনিময়, বিদ্যা-বিনিময় করে উত্তর দিচ্ছে। তার প্রমাণ পাওয়া যায় উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল তলানিতে দেখে।
শিক্ষামন্ত্রী ঢাকঢোল পিটিয়ে জানুয়ারি মাসে সময়মতো বই বিতরণের কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীও বেজায় খুশি হন তার শিক্ষামন্ত্রীর ত্বরিত কর্মযজ্ঞ দেখে। বাস্তবতা হলো, সৎ-কঠোর পরিশ্রমী-নিষ্ঠাবান শিক্ষামন্ত্রীর শত আর্তনাদ আর কায়িক পরিশ্রমের পরও জানুয়ারিতে বই বিতরণ শুধু হাতের কাছের কিছু স্কুলে ঘটেছে। বাস্তবে বেশির ভাগ সরকারি-বেসরকারি স্কুলে বই পেয়েছে অনেক দেরিতে। বিলম্বে বই পাওয়া সরকারি ও নানাবিধ ছুটি কাটিয়ে নভেম্বরে পরীক্ষা শুরু হয়।
নভেম্বর, ডিসেম্বর, জানুয়ারি প্রায় তিন মাস ক্লাস নেই। তিন মাস পর বই প্রাপ্তি দুই মাস ছুটি আর তিন মাস ক্লাস হয় না মোট আট মাসের মতো ছাত্ররা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। এত অল্প সময়ে (চার মাসে) কি করে এসব শিক্ষার্থীকে ১০ মাসের সিলেবাস সম্পূর্ণ করানো সম্ভব। অন্যদিকে এক ক্লাসে শিক্ষার্থী থাকার কথা ৩০ জন সেখানে ১০০ জন গাদাগাদি করে বসে। কোনো স্কুল অনুমোদনের সময় সরকার কি ছাত্র সংখ্যা, স্কুলের পরিবেশ, শিক্ষকের মান বেঁধে দেবে না? না কি গড়ের মাঠের মতো ছাত্র এলে জায়গা পাওয়া যায় নীতিতে চলবে।
গত বছর আবার সরকার মহোদয় আরও মেধা বিকাশের বিষয় আমদানি করেছে দেশে মেধার নিবিড় চর্চা করতে, তাও আবার সৃজনশীল বিষয়। কোথাও গোলপাতার ছাউনির কোথাও বাঁশ আর টিনের ঘর কোথাও বারান্দায় কোথাও ভাড়াটে বসবাস উপযোগী বাড়িতে স্কুল দেশে বিদ্যমান। এসব জরাজীর্ণ ক্ষুদ্র জায়গায় গায়েরজোরে ক্লাস রুম বলে চালিয়ে দেওয়া, রুমে কি সৃজনশীল পরিবেশ আনা সম্ভব? যেখানে ভাড়া বাড়িতে স্কুল চালানো হয় জায়গার সংকটে এনালগ শিক্ষার পরিবেশ পর্যন্ত অদৃশ্য সেখানে কি করে সৃজনশীল চিন্তা ছাত্ররা করবে?
স্কুলে ভালো শিক্ষক থাকে না কম বেতনের বেদনায়। তারা ভালো অফার পেলে অন্য জায়গায় চলে যান। তখন তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষক যান অষ্টম শ্রেণীর ক্লাস নিতে।
শিক্ষক নিজেই ভালো করে জানেন না অষ্টম শ্রেণীর পাঠ তিনি কি করে মানসম্মত পাঠদান করবেন। স্কুলে স্বল্প বেতন ধার্য হওয়ায় শিক্ষকরা কোচিং করান নিতান্ত সংসার চালনার তাগিদে। ক্যাম্পাসে কোচিং করান বিনিময়ে স্কুলকে কোচিং রোজগারের একটা অংশ শিক্ষক প্রদান করেন। অর্থ ভাগ-বাটোয়ারার কি মধুর সহাবস্থান। ভালো ফল দেখিয়ে মফস্বলের ছাত্রদের টানা হয় স্কুলে ভর্তির জন্য, তাদের জন্য খোলা হয়েছে হোস্টেল শাখা, এখানেও ব্যবসা করার সুযোগ।
মাধ্যমিক পরীক্ষায় ২২ লাখ ছাত্র পরীক্ষা দেয় তাদের খাতা দেখা হয় ১৫ থেকে ২০ দিনের মধ্যে। জিন-ভূতেও এত রকেট গতিতে পরীক্ষার খাতা দেখে দিতে পারবে না। অভিযোগ রয়েছে, শিক্ষকরা অন্যদের দিয়ে খাতা দেখান, নিজে সময় অপচয় করতে চান না। উপরের নির্দেশে অতি মার্ক দেওয়া হয় খাতায় তাই শিক্ষকরা মেধা যাচাইয়ের আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। অতি নম্বর দেওয়ায় লাভ কি? উপরের মহলের কাছে আমার প্রশ্ন, কাকে ধোঁকা দিচ্ছি? এ তো নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারছি।
কিছু দিন আগে খোদ সরকারি এক অফিসে তীক্ষ্ন জ্ঞানের অধিকারী অসাধারণ মেধাবী এক প্রধান প্রকৌশলীর সঙ্গে আলোচনার এক পর্বে বর্তমান পরীক্ষা পদ্ধতি গ্রেডিং নিয়ে একজন অভিভাবক ও বিদ্যোৎসাহী হিসেবে তার উদ্বেগ ও পর্যবেক্ষণ তুলে ধরলেন। আমি নিজে তার পর্যবেক্ষণের সঙ্গে শতভাগ সহমত পোষণ করি। গ্রামের স্কুল, গ্রামের শিক্ষক তাদের নৈতিকতা-আদর্শ আর রাজধানীর সুখ্যাত স্কুলের শিক্ষকের মান-নৈতিকতা-আদর্শ, ছাত্রছাত্রীর মেধা কখনো এক হতে পারে না। অথচ মফস্বলের ছাত্ররা বিদ্যাহীন গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছে নকল আর শিক্ষকের করুণায়। আবার নামকরা স্কুলে রাত-দিন পরিশ্রম করে একই গ্রেডিং পাচ্ছে তারচেয়ে খারাপ ফলও পাচ্ছে বেশি মেধাবীরা।
কিছু কিছু উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভর্তি পরীক্ষা গ্রেডিংয়ের ভিত্তিতে হওয়ায় মেধাবীরা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে এই স্বজনপ্রীতি আর ন্যায়বিচার-বহির্ভূত পদ্ধতির নম্বর বিলানোর কায়দা দেখে। ছাত্ররা লেখাপড়ায় নিরুৎসাহিত হচ্ছে; সঙ্গে মেধাবী ছাত্রদের অভিভাবকরা উদ্বেগের সঙ্গে হতাশাগ্রস্ত হচ্ছে। গ্রেডিংয়ের ভিত্তিতে ভর্তি নিয়ম চালু হলে অর্থনীতির ভাষায় বলতে হয় Bad money drive out good money from market. ঠিক একইভাবে অজ্ঞরাই প্রতিভাবান মেধাবীদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে উচ্চশিক্ষার সুযোগ থেকে। এ অবস্থার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় বেশি দায়ী। পাইকারি হারে প্রতিভার গণতারকা আবিষ্কার করলে আসল তারকা হারিয়ে যাবে, থাকবে আলোকহীন তারকা- যা জাতিকে আলো ছড়াতে পারবে না।
খাটা-খাটনি করে আলোক বিচ্ছুরিত তারকাদের নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করতে দিন। প্রতিভাবানদের মেলে ধরতে দিন তাদের মেধা। শিক্ষকদের কাজ ছাত্র আউটানো যেমন একজন গিনি্ন দুধ থেকে সর উপরে আনে।
যে ছাত্র নবম শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী, প্রি-টেস্ট, টেস্টে টেনে টুনে শতকরা ৩০ থেকে ৩৫ নম্বর পায়, সে কী আলাদিনের চেরাগ পরীক্ষার হলে পায়, যা তাকে ৭০ থেকে ৮০ নম্বর পেতে সহায়তা করে। বোর্ডে প্রতি ফেলের জন্য স্কুলের মাইনাস স্কোর তারপর এমপিও ভুক্তির ঝামেলা তো আছে।
এত পাস না দেখালে শিক্ষকদের আবার রাজকোষ থেকে বরাদ্দ পাওয়া যাবে না। শিক্ষকরা আজ অনৈতিক অনিয়মের কাছে জলাঞ্জলি দিচ্ছে তাদের আদর্শ নীতি-নৈতিকতা। মেধাবী ছাত্ররা হচ্ছে বঞ্চিত তাদের অধিকার থেকে। মেধার অস্বীকৃতি থেকে তাদের মধ্যে বাড়ছে হতাশা আর ক্ষোভ। পরীক্ষার হলে মেধাবীরা অটো ছাত্রদের উত্ত্যক্ততায় মনোনিবেশ দিয়ে লিখতেও পারে না।
কিছু স্কুল পরীক্ষা কেন্দ্র চড়া দামে খরিদ করছে বোর্ড থেকে। এমনকি পরীক্ষা কেন্দ্রে আগত ইনভিজিলেটরদের দামি উপঢৌকন, কখনো অর্থের বিনিময়ে বশ করে হলে ভালো ফলাফল করার মনোরম পরিবেশে পরীক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে। কখনো পরীক্ষকের দ্বারস্থ হচ্ছে ডাব্বা মারা ছাত্রদের ললাটে প্রশংসনীয় ফলের তিলক পরাতে। পাশাপাশি নতুন কৌশল একের ভেতর দুই স্কুল। নামি স্কুলের পাশাপাশি একই মালিক অন্য নামে স্কুলের নতুন দোকান খুলেছেন সেখানে ফেল মার্কা ছাত্রদের ভর্তি করা হয়।
এই দুর্বল ছাত্ররা নিবন্ধিত হয় অজ্ঞাত-অখ্যাত নতুন স্কুলে, ক্লাস করে নামি স্কুলে একই ইউনিফরম পরে। কি অভিনব কায়দায় সরল ছাত্র-অভিভাবককে প্রতারিত করা হচ্ছে। এসব কাজ বোর্ডের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে চলছে তা না হলে একক স্কুল কর্তৃপক্ষের পক্ষে এমন অনিয়ম করে স্কুলের নামে টাকা কামাই করা সম্ভব নয়। ক্যাডেট কলেজ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল রাজউক আরও কিছু ভালো স্কুলের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রদের জ্ঞানের কাছে জিপিএ-৫ পাওয়া এই বাণিজ্যিক স্কুলের ছাত্ররা দাঁড়াতেই পারবে না। তাহলে এই সুলভ সনদের মূল্য কি জাতিকে একদিন সুদে আসলে দিতে হবে না? এরা না পারবে হাল চাষ করতে, না পারবে অফিস চালাতে দুমড়ো নারকেল হয়ে থাকবে।
আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, ১৯৭২ সালের মাধ্যমিক পরীক্ষায় এমন উজ্জ্বল ফল জাতি পেয়েছিল। সেই দেশ কাঁপানো ভালো ফলাফলের কৃতী ছাত্র প্রথম বিভাগ পেয়েও মামা-খালু ধরে দারোয়ানের চাকরিও পাচ্ছিল না।
এই অটো পাস ছাত্ররা ফাঁকিবাজি লেখাপড়া আর বোনাস নম্বর প্রাপ্তির খেসারত দিচ্ছে ভালো প্রতিষ্ঠানে ভর্তি পরীক্ষায় গ্যাঁড়া মেরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বুয়েট মেডিকেল যেখানে ভর্তি পরীক্ষা আছে সেখানে এরা কেউ ভালো করছে না। না পড়ে পাস করা ছাত্ররা ভালো ফলাফলের সনদ নিয়ে কঠোর নিয়মানুবর্তিতায় অধ্যবসায় নিমগ্ন ভালো স্কুল-কলেজের ছাত্রদের কেরানি পিয়ন হওয়া ছাড়া আর কিছুই করতে পারবে না।
যে শিক্ষা পরীক্ষা পদ্ধতি ভবিষ্যৎ সুনাগরিক তৈরি না করে জাতির কাঁধে বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছে, তা কি চলতে দেওয়া উচিত। জাতি কতদিন এই বোঝা টানতে পারবে। সস্তা জনপ্রিয়তা আর ভোটের রাজনীতির গন্ধ খুঁজলে জাতিকে পরিণামে চরম মাসুল দিতে হবে।
লেখক : রাজনীতি পর্যবেক্ষক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।
ই-মেইল : Zillu65@hotmail.com
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।