পুষ্প, বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরাণ
ঘটনাটি আমার এক বন্ধুর মুখ থেকে শোনা।
তাদের গ্রামের নাম নোয়াগাঁও। মাঘ মাসের এক কুয়াশাঘেরা রাতে সেই গ্রামের মেঠো পথ ধরে হাঁটছিল সে। কুমিল্লা থেকে যাবার আগে সে আমাকে নিমন্ত্রণ করে যায় তাদের গ্রামে যাবার জন্যে। অফিসে যথেষ্ট ছুটি পাওনা ছিল আমার।
তাকে জানিয়ে দিয়েছিলাম, ঠিক এক সপ্তাহ পর তাদের বাড়িতে বেড়াতে যাব আমি।
সে রাজি হয়েছিল।
বাজারে গিয়েছিল সে। আজই এসে পৌঁছেছে কুমিল্লা থেকে। পরিচিত অনেকের সাথেই দেখা হয়েেেছ ।
কল্যাণের চায়ের দোকানের আড্ডায়ও যোগ দিয়েছিল। কয়েকজন ওর জন্য আফসোস করেছে- আর কিছুদিন আগে এলেও নাকি "রসের বাইদানী' পালাটি দেখতে পেত। এরপর চলেছে তাসের আসর। মোটামুটি ভালই কেটেছে সময়। অনেক নতুন পুরাতন খবর শুনেছে ।
আসবার সময় কল্যান আবার দু'টি সিগারেটও গছিয়ে দিয়েছে হাতে।
বাড়ি থেকে বাজার তিন মাইলের পথ। ঠিকমত হাঁটতে পারলে এক ঘন্টাও লাগে না। কিন্তু শীতের রাতে অনেকক্ষন লেগে যায়।
হাঁটছে সে।
গাঁয়ের এ পথটা একটু নির্জন। অসময়ের বৃষ্টি হয়েছে এক পশলা। এখানে সেখানে পানি জমে আছে। এঁটেল মাটির রাস্তা, কাদা হয়ে আছে নানা জায়গায়। সেরকমই একটা কাদায় ওর স্যান্ডেল দেবে গেল।
টেনে উঠাল সে। তারপর পাশের ভেজা ঘাসে স্যান্ডেল ঘষে নেবার জন্যে উবু হতেই ঘটে ব্যাপারটা। কে যেন ঠিক ঘাড়ের ওপর নি:শ্বাস ফেলল। শীতল দীর্ঘশ্বাস। যেন কারও বুক থেকে বিশাল পাথর নেমে গেছে!
পাব কি পাব না,এরকম একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে হঠাৎ পেয়ে যাওয়ার ফলে সুখের একটা নি:শ্বাস!
তবে তার জন্য ব্যাপারটা কিন্তু মোটেই সুখকর ছিল না।
বরং গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। ঝট করে মাথা তুলল বিষঞু - আমার বন্ধু।
এদিক ওদিক তাকায়-নাহ ,কিছু নেই তো,কিছুই নেই। স্যান্ডেল পায়ে দিয়ে বাড়ির পথে পা বাড়ায় আবার। শিস দিতে দিতে,আকাশের তারা গুনতে গুনতে যাচ্ছে সে, হঠাৎ মনে হলো নিচের দিকে তাকানো দরকার।
বলা বাহুল্য,বিষঞু তাকাল। দেখল ছোট্ট একটা সাদা বেড়াল ওর পায়ের ঠিক একহাত সামনেই শুয়ে আছে। ওর মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি খেলে যায়! ছোট বেলার বদ অভ্যাসটা তখনও যায়নি তার। হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে বিষঞু। আলতো করে সাদা কালোয় ডোরা কাটা লেজের আগাটা ধরল,পুরোটা নয়- কয়েকটা লোম মাত্র।
তারপরই মারল হ্যাঁচকা টান! "ম্যাও' করে দাঁড়িয়ে গেল বিড়ালটা। একবার বিষ দৃষ্টি নিপে করল বিষঞুর দিকে। তারপর সোজা রাস্তা ধরে ছুটতে শুরু করল।
আকাশের দিকে তাকিয়ে একবার হেসে ওঠে বিষঞু। তারপর আবার সামনে তাকায়।
নেই বেড়ালটা! আশ্চর্য,এত তাড়াতাড়ি চলে গেল! একটু অবাক হয়ে আবার হাঁটা দেয়।
সামনের বাঁকা রাস্তা পেরোলেই পড়বে পুরানো ভাঙা কালী মন্দিরটা। তার পাশেই কালীপুকুর,জানে ও। হঠাৎ খেয়াল হতেই মনে মনে মা কালীকে স্মরণ করতে লাগল। ধর্মে কোথাও না থাকলেও ওর বাবা বিশ্বাস করতেন,মা কালী নাকি পুরানো মন্দিরের পাশ দিয়ে যাওয়া একলা পুরুষ পথিককে দেখা দেন।
নিজ হাতে স্বামী-হত্যার অপরাধবোধের কারণেই খুব সম্ভব,পুরুষ পথিকদের অমূল্য বর দেন তিনি।
তার বাবা এ আশায় সারা জীবনই মন্দিরের আশেপাশে কাটিয়েছিলেন। তবে বোধহয় বর পাননি। পেলে মৃত্যুর সময় তিনি প্রাপ্ত বয়স্ক তিন সন্তানের জন্যে নিশ্চয়ই শুধুমাত্র একটি কুঁড়ে ঘর এবং মাটির ব্যাংকে জমানো আড়াইশো টাকা রেখে যেতেন না!
কালী মন্দিরটা চোখে পড়তেই বিষঞু প্রণাম করল। এদিক ওদিক তাকাল মা কালীর খোঁজে।
তখনই দেখল,পুকুর ঘাটে কে যেন বসে আেেছ !
আরেকটু এগোল সে।
আরে,বিমলদা না? বিমলদা-ই তো! সেই শাল, সেই বাবরি চুল,স্বল্প আলোয় ঘাড়ের দাদের সাদা দাগগুলোও স্পষ্ট!
বিমলদার দিকে এগিয়ে যায় বিষঞু।
পাঠক,আমার বিশ্বাস - আমার অতীব বুদ্ধিমান বন্ধু বিষঞু যদি কল্যানের দোকানে বসে গল্পের ছলে বলা কালীপুকুরে ডুবে বিমলের মৃত্যুর খবরটায় একটু মনোযোগ দিত, তবে ও এভাবে এগিয়ে যেত না।
কিন্তু নিয়তি ঠেকাবে কে? নিয়তি তাকে টেনে নিয়ে গেল বিমলের কাছে। সেই নিয়তিই আবার তার মুখ দিয়ে বলাল,"কেমন আছ,বিমলদা?'
বিমল ঘাড় ফেরাল।
বিষঞু লক্ষ্য- করল সেই আগের মতই আছে বিমলদা। সেই চেহারা, সেই নাক, মেয়েদের মত সেই পাতলা ঠোঁট। কিন্তু চোখ দু'টি কেমন যেন নিষপ্রাণ বলে মনে হয়।
ছমছমে গলায় বিমল বলে ওঠে," আয়,বস? কখন এসেছিস? '
" এই তো আজই,' বলে বসে পঙল বিষঞু বিমলের পাশে।
দু'জনে গল্প করতে লাগল।
ছোটবেলার গল্প; কত মজারই না ছিল সেসব দিন! চেয়ারের পায়ায় লেগে বিপিন স্যারের ধুতি খুলে যাবার কথা মনে করে পেট চেপে হাসতে লাগল দু'জন। শেষ মুহুর্তে হাত দিয়ে গোলপোস্টে বল ঢুকিয়ে দিয়ে নিজেদের দলকে জিতিয়ে দেয়ার আনন্দ স্মৃতিও রোমন্থন করল।
এক সময় হঠৎ বিমল বলে উঠল," চল, বিষঞু,চান করি! '
বিমলের প্রস্তাবে অবাক হয়ে গেল বিষঞু!- "তুমি কি পাগল হয়ে গেলে বিমলদা! এখন স্নান করবে? এই শীতে?!! '
"আরে ধ্যুৎ,আয় তো!' বলে বিষঞুর হাত ধরে টান দিল বিমল।
বিষঞু অনুভব করল একটি বরফ শীতল হাতের স্পর্শ।
পাঠক,এর ঠিক এক সপ্তাহ পর এই রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে বিষঞু আমাকে বলেছিল এই ঘটনা।
বলেছিল তার পরদিনই নাকি লোকে কালীপুকুরে ওর লাশ খুঁজে পায়। ফুসফুসে পানি ঢুকে মারা গিয়েছিল বিষঞু।
ওর গল্প এখানেই শেষ।
কিন্তু আমার নয়।
আমি এখন বহুরাত ধরে অপেক্ষা করছি,আমার গল্পটা কাউকে শোনাব।
কেউ শুনতে আসবে, এমনই কোন কুয়াশা ঘেরা শীতের রাতে, একা।
কালীপুকুরের ঘাটে বসে তাকে শোনাব আমি আমার গল্প।
আসবেন নাকি আপনি?
আসুন না একবার! মাত্র একটি বার ?!
আমার নিমন্ত্রণ রইল।
---------------------------
[ইটালিক] ছবি: শিল্পি শাহাবুদ্দিনের - থার্স্টি ( তৃষঞার্ত) [/ইটালিক]
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।